Published : 12 Apr 2022, 10:42 PM
আমি আসলে আমার বাবা হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায় নিয়ে খুব একটা ভাবিত বা উদ্রগ্রীব নই। জামায়াতে ইসলামী নেতা রাজাকার দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী এবং হরকাতুল জিহাদের মুফতি আব্দুল হান্নানের নাম মামলায় থাকলেও যেদিন চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়, সেদিন থেকেই এই মামলার অগ্রগতি নিয়ে আমি, আমার মা কোহিনূর এবং বোন স্মিতার আগ্রহের মৃত্যু ঘটে।
২০০৩ সালের ঈদ সংখ্যায় 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' উপন্যাস দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছিল। 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' ছাপা হওয়ার পর ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এর প্রচণ্ড সমালোচনা করে। পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী আমির এবং তৎকালীন সংসদ সদস্য, যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জাতীয় সংসদে বইটি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিয়ে ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। এরপর তিনি ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন এবং আমার বাবাকে 'মুরতাদ' ঘোষণা করে হত্যার ইঙ্গিত দিয়ে ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে উসকে দেন।
২০০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেন সাঈদী জাতীয় সংসদে হুমায়ুন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' উপন্যাসটিকে ইসলাম বিরোধী আখ্যায়িত করে বক্তব্য দেন। তিনি বিভিন্ন সমাবেশেও টার্গেট করে বইটি নিয়ে বিষোদগার করেন। জনগণকে বিভ্রান্ত করেন। তাছাড়া এ যুদ্ধাপরাধী সাঈদী লেখকদের লেখা বন্ধ করতে ব্ল্যাসফেমি আইন (ধর্ম অবমাননা বিরোধী আইন) প্রণয়নের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
হুমায়ুন আজাদকে আক্রমণের পরেও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একাধিকবার ওয়াজ মাহফিল ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে হুমায়ুন আজাদকে কীভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এমন বক্তব্যও রাখেন। এতকিছুর পরেও তার নামটি মামলা থেকে মুছে দেওয়া কাম্য নয়। শায়খ আব্দুর রাহমান থেকে শুরু করে আরও যাদের গ্রেপ্তার করা হয়, তারাও স্বীকার করেছিলেন যে, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বক্তব্য শুনে তাদের হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করার পরিকল্পনা রচিত হয়।
হুমায়ুন আজাদ নিজেই সাঈদীকে হামলার জন্য দায়ী করেছিলেন। ভিকটিম তো বলেই গেছেন সাঈদী এ ঘটনার সাথে জড়িত। কিন্তু তাকে তো আসামি করা হয়নি। সেই সময়ের ওয়াজ মাহফিল ও রাজনৈতিক সভার ভিডিও ফুটেজ দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, হুমায়ুন আজাদকে হত্যার জন্য ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে সাঈদী উস্কানি দিয়েছিলেন, কাউকে হত্যার উস্কানি দিলে তো তার বিরুদ্ধে বাঙলাদেশের আইনে মামলা করা যায়। কিন্তু এখানে হত্যার উসকানি দেওয়ার জন্যও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। তার বিরুদ্ধে হত্যা প্ররোচনার মামলা দাখিল করা হয়নি। অর্থাৎ ভিক্টিমের বক্তব্যকে অগ্রাহ্য করা হয়।
যেখানে উস্কানিমূলক লেখা প্রকাশ না করা সত্ত্বেও মিথ্যা মামলা দিয়ে অসংখ্য অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেখানে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর প্রত্যক্ষ মদদে হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণ করা হলেও তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া সহজ দৃষ্টিতে দেখার কোন সুযোগ নেই। এখানে রাজনৈতিক কোন ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে বা আপস করা হয়েছে- এমন বললে সম্ভবত ভুল হবে না। এ কথা বলার কারণ হচ্ছে, রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যুদ্ধপরাধ প্রমাণ হওয়া সত্ত্বেও তাকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয় নি।
কয়েক বছর আগে হাফিজ মাহমুদ ও সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিনকে পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। কিন্তু এই জঙ্গিরা কোন দলের সাথে সম্পৃক্ত তা এখন আর কেউ বলে না। যারা প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল, তারা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিল।
আসামিরা হলেন- নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাআতুল মুজাহিদিন বাঙলাদেশের (জেএমবি) ৪ সদস্য সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন, আনোয়ারুল আলম ওরফে আনোয়ার, মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ও নুর মোহাম্মদ। এর মধ্যে সালেহীন ও নূর পলাতক এবং বাকি ২ জন কারাগারে আছেন। বাঙলাদেশ পুলিশ কতটা ব্যর্থ হলে ১৮ বছরেও আসামী ধরতে সক্ষম হয় না! আসলেই কি সক্ষম হয় না নাকি সক্ষম হতে দেওয়া হয় না- এটা প্রশ্ন করা যেতে পারে!
হুমায়ুন আজাদ হত্যাচেষ্টা মামলার একজন সাক্ষী ও পরিবারের সদস্য হিসেবে বলতে পারি যে, এই মামলা এখনও অসম্পূর্ণ। আর সম্পূর্ণ করতে চাইলে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে হত্যা প্ররোচনার মামলায় গ্রেপ্তার করতে হবে। হুমায়ুন আজাদকে ধারণ করার মতো বাঙলাদেশ আমরা যেমন গড়তে পারিনি, তেমনই হুমায়ুন আজাদ হত্যাচেষ্টা মামলার রায় ধারণ করাও সম্ভব নয়।