Published : 06 Mar 2022, 06:25 PM
নানা সমীকরণের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে ইউক্রেইন সংকট বিষয়টি । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের মিত্র দেশের পক্ষ থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকি, অপরদিকে ইউক্রেইনের বিষয়ে পুতিনের বিশ্বের কোন হুমকির কাছে মাথা নত না করে যুদ্ধের ময়দানে কঠিন দর্পে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। পুতিনের নানা বক্তব্যের বিষয়টি স্পষ্টত, কোনওভাবেই রাশিয়ার নিরাপত্তা ইস্যুতে ছাড় দিবে না মস্কো। যদি কেউ তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, সে যেই হোক তাকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধে প্রস্তুত পুতিন। প্রয়োজনে নিউক্লিয় ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার করতেও দ্বিধা করবে না দেশটি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেইনের রাজধানী কিয়েভে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে সামরিক আক্রমণ চালিয়েছে। এই হামলার পিছনে পুতিন- জেলেনস্কির দ্বন্দ্ব, ইউক্রেইনকে ঘিরে রাশিয়ার অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বলয় রক্ষাসহ অনেক ইস্যু বিশ্ব রাজনীতির আলোচনায় উঠে এসেছে। সবচেয়ে আলোচনায় আছে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউক্রেইনের যোগ দেওয়ার বিষয়টি। কেন ন্যাটোর বিষয়টি রাশিয়া এত গুরুত্ব পাচ্ছে? মূল কারণ হিসেবে রাশিয়া বলছে, রাশিয়ার সীমান্তে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ১৯৯০ সালের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের। এই চুক্তির ব্যাখ্যায় রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ন্যাটোর পরিধি পূর্ব ইউরোপে বাড়াবে না বলে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটা বারবার ভঙ্গ করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা। ১২টি দেশ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ন্যাটোর পাঁচ দফায় সদস্য বাড়িয়ে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০। উত্তর মেসিডোনিয়া সর্বশেষ সদস্য হিসেবে ন্যাটোতে যোগ দেয় ২০২০ সালের ২৭ মার্চ। রাশিয়ার ভূখণ্ডের পার্শ্ববর্তী এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ডে ন্যাটোর চারটি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন রয়েছে। এই সমীকরণটা অনেকটা সবার অজানা নয় যে, যদি ইউক্রেইনে ন্যাটো তাদের বাহিনী মোতায়েন করতে পারে তবে রাশিয়াকে নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক বিষয়ে চাপে ফেলার একটা সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হবে।
বর্তমান ইউক্রেইন সংকট পাঁচটি বিষয়ে নতুন মাত্রা পেয়েছে বলা যেতে পারে। প্রথমত, জেলেনস্কিকে বরাবরই সমর্থন দিয়ে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর সদস্যদের মস্কো ইউক্রেইনকে দখলের পর্যায়ে থাকলেও তাকে প্রতিরোধের জন্য কোন সামরিক সহায়তা না দেওয়া বা পদক্ষেপ না নেওয়া। এই কিছুটা হলেও অবাক করার মতো বিষয়। গত দুই দশকে আফগানিস্তান, ইরাক, মধ্যপ্রাচ্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার মহরত দেখেছে বিশ্ববাসী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার বিষয়কে সামনে এনে ন্যাটোকে নিয়ে সরাসরি যুদ্ধ পরিচালিত করেছে। তবে, ইউক্রেইন ইস্যুতে দেখা গেল ভিন্নচিত্র। হুমকি-ধামকি বিশেষ করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মাঝেই শান্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটোর কারণে ভেস্তে যাওয়ার প্রস্তাবের বিষয়েও তেমন জোরালো বক্তব্য পাওয়া যায়নি যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদেশের। পাকিস্তান, সৌদি আরবের মতো দেশের অবস্থানে বইছে নতুন হাওয়া। অনেকটা নিরব থেকে রাজনৈতিক সমাধানের পথের বুলি আওড়িয়ে চলেছে দেশগুলো। তৃতীয় কোনও দেশের 'নিজেদের তৈরি সমরাস্ত্র না পাঠানোর' নীতিতে অনেকটা অবিচল থাকতে দেখা যাচ্ছে জার্মানিকে। এই বিষয়গুলো থেকে একটি বিষয় ভাবনায় আসতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর সামরিক সক্ষমতা হ্রাস পেলো, নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো জোটের মিত্ররা হাঁটছে উদারনৈতিকতার পথে !
দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক আদালতে ইউক্রেইনের রাশিয়ার বিপক্ষে অভিযোগ দায়ের। বিষয়টি কিছুটা হলেও জটিল। জেলেনস্কি ২০১৪ সালের ইউক্রেনের ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাশিয়া দাবি করে আসছিল, বিদ্রোহ দমনের নামে পশ্চিম অঞ্চলে দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক এলাকায় জেনোসাইড চালাচ্ছে জেলেনস্কি। এই জেনোসাইড বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপের নামে বিদ্রোহীদের শুরু থেকেই সমর্থন দেয় রাশিয়া, এমনকি অঞ্চল দুটিকে স্বাধীনতাও ঘোষণা করে মস্কো। শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়া হিসেবে রাশিয়ান বাহিনীকে ওই অঞ্চলে অবস্থানের নির্দেশ দেন পুতিন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে ইউক্রেইন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) একটি আবেদন দাখিল করে যাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জেনোসাইড অপরাধ প্রতিরোধ ও শাস্তি সংক্রান্ত কনভেনশনের অধীনে কার্যক্রম শুরু করার নামে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে ইউক্রেইন। এ সময় দেশটি উল্লেখ করে, ইউক্রেইনের লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ক ও ব্লাস্টে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে- এমন মিথ্যা দাবির ভিত্তিতে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য রাশিয়ার কোন বৈধ ভিত্তি নেই। এক্ষেত্রে, আইসিজেকে ইউক্রেনের অধিকার সংরক্ষণের জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থাগুলো নির্দেশ করা এবং ইউক্রেইনের জনগণের পাশাপাশি দেশটির সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় আইসিজেকে তার ক্ষমতা প্রয়োগের অনুরোধ জানায়। গত পয়লা মার্চ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বিষয়টিকে আমলে নিয়ে আগামী ৭ মার্চ এবং ৮ মার্চ উক্ত বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
সরাসরি এবং ভার্চুয়াল দুই মাধ্যমের শুনানিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ৭ মার্চ ইউক্রেইন এবং ৮ মার্চ রাশিয়ার জন্য সময় নির্ধারণ করেন। তবে কি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ফেঁসে যেতে পারেন পুতিন! এমন জল্পনা কল্পনার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে বিশ্ব রাজনীতিতে।
তৃতীয় দিক, রাশিয়ার হামলার প্রতিবাদের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের নিরপেক্ষতা বা নিরবতা। সম্প্রতি জাতিসংঘের এক জরুরী সাধারণ অধিবেশনে ইউক্রেইনে অবিলম্বে হামলা বন্ধ করে আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে রুশ সেনাদের সরিয়ে নিতে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে ১৪১টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। তবে, ভোটদানে বিরত ছিল ভারত, চীনসহ ৩৫টি দেশ। রাশিয়াসহ বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, ইরিত্রিয়া ও সিরিয়া প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। এসময়েও রাশিয়ার পিছনে যে একটা বিরাট অংশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে, সেটা এই ভোটের প্রক্রিয়া থেকে হলেও কিছুটা আঁচ করা যায়। এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির মেরুকরণে একটি নতুন মাত্রার উন্মেষ ঘটিয়েছে।
চতুর্থত, আলোচনার টেবিলে যুদ্ধ প্রক্রিয়া এবং সমাধান। ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রিপিয়াত নদীর কাছে ইউক্রেইন-বেলারুশ সীমান্তের গোমেল অঞ্চলে রাশিয়া এবং ইউক্রেইনের দুই দেশের প্রতিনিধি চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বসে। ৩ মার্চ দুই দেশের মধ্যকার বৈঠক পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় সিদ্ধান্ত আসে, ইউক্রেইন থেকে বেসামরিক নাগরিকদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দুই পক্ষই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে । যুদ্ধের ফলে যেন বেসামরিক জনগণের জীবননাশ না হয় সেটাকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এই ধরনের বার্তা থেকে ধারণা করা যেতেই পারে, যাতে বড় ধরনের যুদ্ধে জড়াতে না হয় সেটাও লক্ষ্য রাখছে রাশিয়া। রাশিয়া মূলত ইউক্রেইন বা জেলেনস্কিকে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়া থেকে থামাতে চাচ্ছে, অন্য কোন উদ্দেশ্য নয়।
পঞ্চমত, ইউরোপে নতুন শরণার্থীর ঢল। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিশনার থেকে জানানো হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাত মিলিয়ন অর্থাৎ ৭০ লাখ ইউক্রেনিয় বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এই ভবিষ্যৎ বাণীর সত্যতা মিলছে ক্রমান্বয়ে। ৩ মার্চ জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইউক্রেইনে রুশ আগ্রাসনের কারণে দেশটি থেকে ১০ লাখ মানুষ পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও , জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে , এই সংঘাত প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিরাট জনগোষ্ঠির জীবনে নেমে এসেছে অনিশ্চিত গন্তব্য, একটি নয়া মানবাধিকার সংকটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বিশ্ব ।
এই যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে হয়তো নাও যেতে পারে, সে ধরনের ভবিষদ্বাণী করছেন অনেক বিশ্লেষক। তবে বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপরে যুদ্ধের রেশ হতে পারে দীর্ঘ। যুদ্ধের আবহ, নতুন নতুন সমীকরণ ও সমস্যা উদ্ভবের কারণে সংকটের শেষ কোথায়, ব্যাপ্তিকাল কতোটা, সমাধান নাকি সংঘাত- কোনদিকে পরিস্থিতি মোড় নিবে, সেই গোলকধাঁধাঁয় রয়েছে সারাবিশ্ব।