Published : 17 Feb 2022, 09:09 PM
'সময়ের ভুল ট্রেন নিয়ে যায় প্রিয় মুখ আমরা পড়ে থাকি পেছনে'।
আমরা পেছনে পড়ে থাকলাম। সংগীত জগতের তিন নক্ষত্র বিদায় নিলেন পাঁচদিনের ভেতর। উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকর বলে গিয়েছিলেন- 'চিতার আগুনে সবকিছু পোড়ানো যায়, সংগীত পোড়ানো সম্ভব না'।
কিন্তু লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কিংবা বাপ্পি লাহিড়ীরা চলে গেলে সংগীত নিজেই বিষণ্ণ হয়। হয়তো ঈশ্বরও বিষণ্ণ হন। কারণ ঈশ্বরর বন্দনার এক চিরায়ত মাধ্যম সুর ও সংগীত। বাপ্পি লাহিড়ীর গানে যেমন আছে, 'আমি বিশ্বাস করি সঙ্গীতে তাই বিশ্বাস করি ভগবান'।
হয়তো সংগীতই নিয়ে গেছে লতাজী বা সন্ধ্যাকে। নিয়ে গেছে বাপ্পি লাহিড়ীকে। হয়তো তারা গানের আকাশে ধ্রুবতারা কিংবা সন্ধ্যাতারা হয়ে জ্বলবেন। বাপ্পি হয়তো বেদনা বাতাসের কোরাসে বিয়োগান্তক সেতারে গানের সুর বাঁধবেন, যেভাবে বাঁধতেন- 'মেলা শেষ হলে পরে/পরে থাকে সাজ ঘরে/জরীর পোশাক,মেকি,পরচুলো/ জীবনটা কিছু নয় শুধু একমুঠো ধূলো/ চৈতি বাতাসে ওড়া শিমুলেরও তুলো!/ জীবনটা'…
আহারে জীবন। দীর্ঘ বাহাত্তর বছরের গানের জীবনে লতা মঙ্গেশকর হয়ে উঠেছিলেন ভারতের জনপ্রিয়তম গানের আইকন। খুব কম মেয়েকে পাওয়া যাবে যারা গান শিখতে যাওয়ার প্রথম দিনে লতা মঙ্গেশকর হতে চায় নি। অনুপ্রেরণা হতে পারা সবচেয়ে গর্বের। ভারতের গনের 'গর্ব' ছিলেন লতা। হয়তো তিনি সুরের সাম্পানে চড়ে গানের ঈশ্বরের কাছেই গিয়েছেন। খুব কম মানুষই জানেন যে লতা মঙ্গেশকর সংগীত পরিচালক হিসেবেও পুরস্কার পেয়েছিলেন! পরিবারের ছায়া হয়েছিলেন, ভাইবোনের জন্য নিজে কখনো বিয়ে করেন নি। হয়তো সংগীতকেই পরিবার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ৩৬টি ভাষায় গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর, কোন ধরনের সংগীত প্রতিযোগিতার 'বিচারক' হিসেবে যেতে চাননি কোথাও। চিতা যেমন সংগীতকে পোড়াতে পারে না, প্রতিযোগিতা হয়তো গায়ক তৈরি করে, শিল্পী গড়তে পারে না। ব্যতিক্রম নিয়ম না। হয়তো একারণেই লতা ভালোবাসতেন সন্ধ্যাকে।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জীবনের উত্থান প্রতিযোগিতা থেকেই। সেকারণে তার নামের আগে গীতশ্রী সংযুক্ত করেন অনেকেই। ১৯৪৩ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের আসরে রবীন্দ্র সংগীত বাদে রাগ প্রধান গানসহ সব ধরনের গানের প্রতিযোগিতায় প্রতিটিতে প্রথম হয়েছিলেন সন্ধ্যা। ১৯৪৬ সালে 'গীতশ্রী' পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন সন্ধ্যা। যখন তার বয়স চৌদ্দ তখনই তার প্রথম রেকর্ড বেরিয়েছিল। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত কয়েকটি ছবিতে প্লেব্যাক করেন, বের হয় তার আধুনিক গানের রেকর্ড। লতা মঙ্গেশকর এর সাথে সন্ধ্যার পরিচয় 'তারানা' ছবিতে প্লেব্যাক করতে যেয়ে। দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছিলেন- 'বোল পাপিহে বোলরে, তু বোল পাপিহে বোল' গানটি। নায়িকা মধুবালা ঠোঁট মিলিয়েছিলেন লতার গানে আর শ্যামা মিলিয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানে। সুরকার ছিলেন অনিল বিশ্বাস যার 'ফরেব' ছবিতেও গান গেয়েছিলেন সন্ধ্যা।
পরিচয়ের পর থেকে লতা হয়ে উঠেছিলেন তার বন্ধুসম। এক সাথে থেকেছেন, জীবনের গল্প বিনিময় করেছেন। যদিও সন্ধ্যা পরবর্তীকালে হিন্দি ছবিতে খুব একটা কাজ করেন নি, ফিরেছিলেন কলকাতাতেই। উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন জুটির খ্যাতি যখন মধ্যগগনে তখন সুচিত্রার মুখ মেলানো অনেক জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন সন্ধ্যা। 'এ শুধু গানের দিন, এ লগনও গান শোনাবার' ছিল সবচে বেশি জনপ্রিয়। এছাড়া 'চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কী হবে', 'মধুমালতী ডাকে আয়', 'হয়তো কিছুই নাহি পাব', 'আমি তার ছলনায় ভুলবো না', 'সজনী দিন রজনী কাটেনা', 'মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা' সহ আরও অনেক গান রয়েছে জনপ্রিয়তার তালিকায়। সন্ধ্যার জীবন লতার মতো একাএকা কাটে নি। বিয়ে করেছিলেন শ্যামল গুপ্তকে যিনি গীতিকার ও সুরকার ছিলেন, সন্ধ্যার জন্য কিছু গানও লিখেছিলেন।
নিজের জীবন সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, "যে সব মেয়ের গায়ের রং কালো তাদের হয়তো সহসা বিয়ে হতো না। বিয়ের জন্য হয়তো তাদের গান শেখানো হতো। আমিও হয়তো সেই দলে ছিলাম।" মুখার্জি বাড়ির মেয়ে, গুপ্ত বাড়ির ছেলেকে বিয়ে করবে এটা কেউ মেনে নিতে পারেনি। অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাদের। "আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি" কিংবা "জনমে হয় গো যেন তোমায় ফিরে পাওয়া"র মতো গানগুলো তৈরি হয়েছিল শ্যামল আর সন্ধ্যার ভালোবাসা বা বিয়ের কারণে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের অনন্য স্মৃতি হয়ে আছেন সন্ধ্যা। অপারেশন জ্যাকপট যেটা বাংলাদেশসহ অনেক দেশে যুদ্ধের 'পাঠ' হয়ে আছে সেই অপারেশান জ্যাকপট শুরু হয়েছিল সন্ধ্যার গান দিয়ে। কথা ছিল যখন রেডিওতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান- "আমার পুতুল আজকে যাবে তোমার শ্বশুর বাড়ি" শুরু হবে তখনই অপারেশান জ্যাকপট শুরু হবে এবং হয়েছিল তাই। লতাজীর মতো মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশি শরনার্থীদের জন্য ফান্ড গঠনের উদ্দেশ্যে গান গেয়েছেন সন্ধ্যা, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র এবং আকাশবাণীতে সন্ধ্যার গান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের 'সুরেলা' প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সন্ধ্যা গেয়েছিলেন, 'মুজিব তুমি ফিরে এলে'। শ্যামলগুপ্ত লিখেছিলেন এই গান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হওয়া এক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন সন্ধ্যা। জন্মেছিলেন হেমন্তের এক সন্ধ্যায়, তাই তার নাম রাখা হয়েছিল সন্ধ্যা। চলে গেলেন এক বসন্তের রাতে,কুয়াশা ঘেরা এক জ্যোস্নায় কান্নাময় রাতে।
ঠিক সেই রাতেই, সন্ধ্যাজী চলে যাবার কিছু মুহূর্ত পর, কুয়াশার বিষণ্ণতায় জ্যোস্নার কান্নার রঙে মিশে ঘুমের ভেতর ঈশ্বরের কাছে চলে গেলেন বাংলা গানের আরেক দিকপাল বাপ্পি লাহিড়ী। সংগীতের যে ঈশ্বর তাকে বাপ্পি লাহিড়ী হিসেবে তৈরি করেছিলেন যেন তার কাছে যেয়ে বললেন, 'তবু যারা বিশ্বাস করে না তুমি আছ তাদেরই মার্জনা কর প্রভূ..মঙ্গল দ্বীপ জ্বেলে…'।
বাংলা ও হিন্দি গানে মঙ্গল দ্বীপ জ্বালাতেই যেন এসেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। ধ্রুপদী গানের সাথে চটুল গানের মিশ্রণ, পাহাড়ি গানের সাথে আঞ্চলিক গানের সংমিশ্রণ আর পাশ্চাত্যের 'ডিসকো' গানের ফরমেট নিয়ে এসেছিলেন বাংলা ও হিন্দি গানে। হিন্দি ও বাংলা গানে অবিশ্বাস্য রকম কিছু জনপ্রিয় গান দিয়েছিলেন তিনি। রাহুল দেব বর্মনের পরে কিশোর কুমারের গাওয়া বেশিরভাগ জনপ্রিয় গানের সুরকার ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী।
প্রথম যখন তার বাংলা গান বের হয় সেটিও তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। আজও মানুষের হৃদয়ের সংগীত হয়ে আছে তার সেইসব গান- 'সোনার আখরে লেখা ভুলে যাওয়া নাম', 'আমি বিশ্বাস করি সংগীতে', 'আর ফেরানো যায় না কেন মনকে আপন বাসাতে', 'শেষ ট্রামে দুজনাতে ফাগুনের এক রাতে', 'মাকা যাই মাকা যাই রাম পামপো', 'জীবনের এতগুলো দিন', 'বালিতে তোমার নাম লিখে দেব' কিংবা 'তুমি আমার নয়ন গো' সহ আরও অনেক গান।
হিন্দি 'চলতে চলতে' বা শরাবী' ছবিতে বাপ্পি লাহিড়ীর গাওয়া গানও জনপ্রিয় হয়েছিল তুমুল। গানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং সবশেষ ২০২০ সালেও একটি ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিৎ বলেছেন, যতদিন বাংলা গান থাকবে ততদিন 'চিরদিনই তুমি যে আমার' হয়ে থাকবেন বাপ্পি লাহিড়ী।
গানের পরীক্ষা নিরীক্ষার মতো পোশাক ও গয়না নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতেন। গলা ও হাত ভর্তি সোনার গয়না ছাড়া বাপ্পি লাহিড়ীকে কল্পনা করা যেত না। গান শুরু করার সময়ে তার প্রিয় ছিল বিখ্যাত ইংলিশ গায়ক এলভিস প্রিসলি। প্রিসলি সোনার গয়না পরতেন। বাপ্পি লাহিড়ী মনে মনে ভাবতেন তিনি কখনো বিখ্যাত হলে শরীর ভর্তি সোনার গয়না পরবেন। বিখ্যাত হবার পর তেমনই করেছিলেন। বাপ্পি লাহিড়ীর খুব কম ছবি পাওয়া যাবে যেখানে তিনি সোনার গয়না পরেননি।
রাজনীতি নিয়েও হয়তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে নেমেছিলেন বাপ্পি। কেন তিনি ভূপেন হাজারিকার মতো বিশেষ একটা দলকে ভালোবাসতে গিয়েছিলেন অন্তিমযাত্রায় সেটা আর না বলি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ছবির জন্য হাসান রাজার কয়েকটি গানে সুর করেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। হাসন রাজার গানে যে সুর ব্যবহৃত হয় বাপ্পি লাহিড়ী নাকি সেই পথে হাঁটেননি। ছবিটা মুক্তি পায় নি বলে গানগুলো হয়তো আর আলোর মুখ দেখবে না। লেখক ও আর্কিটেক্ট বন্ধু শাকুর মজিদের কাছ থেকে এই তথ্য জানা গেছে। হেমন্ত যাবে, বসন্ত আসবে। দাগ মুছে যাবে ধীরে ধীরে ধীরে দিন যত চলে যাবে। বাপ্পি লাহিড়ীর গানের কথা মতো বেদনার পাখি এসে বাসা বাধবে মনেরই ছায়ায়। গোধুলি ধুসর হয়ে আসবে। বেদনা কিংবা চলে যাওয়ার বেদনা তিনি গাইবেন এভাবে, 'দিয়েছে আগুন জ্বেলে আমারও বুকে/বুকে../ সোনার আখরে লেখা ভুলে যাওয়া নাম। মনের আধারে আমি লুকিয়ে নিলাম..'
গানের এই কথাটা কখনো ঠিক থাকবে না। লতা,সন্ধ্যা বা বাপ্পি লাহিড়ীর নাম সোনার আখরে লেখা থাকবে বাংলার সংগীত পিপাসু মানুষের হৃদয়ে।