Published : 23 Nov 2021, 06:13 PM
আমরা যারা রাস্তার খাবার বা পথ-খাবার খাই, তারা মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে যাই। আমাদের অসুস্থতা (টাইফয়েড, আমাশয়, ডায়রিয়া ইত্যাদি থেকে শুরু করে খাদ্য ও পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ) কখনো সাময়িক কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। সাময়িক অসুস্থতায় শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে অনেকের ক্ষেত্রেই ঔষধ বা কোনো ধরনের চিকিৎসা ছাড়াই সেরে যায়। আবার, কারো কারো ক্ষেত্রে ঔষধের প্রয়োজন হয়, চিকিৎসাও নিতে হয়। এমন ঘটনা অনেকের ক্ষেত্রেই কিছুদিন অন্তর অন্তর ঘটতে থাকে। অন্যদিকে, একজন সাধারণ মানুষ যখন বিপদে পড়ে, সেই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য অবস্থা অনুসারে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে বিগত এক বছরে কতবার অসুস্থ হয়েছেন, অসুখ কতদিন স্থায়ী হয়েছে, সেই সময় ঔষধ খেতে হয়েছে কিনা, ঔষধ খেয়ে থাকলে কি ধরনের ঔষধ খেয়েছেন ইত্যাদি তথ্য মনে রাখাটা অর্থাৎ অন্যভাবে বলতে গেলে ট্রেন্ড অ্যানালাইসিস বা প্রবণতা বিশ্লেষণ করাটা সম্ভব হয় না। ডকুমেন্টেশন বা তথ্যায়ন করে রাখা তো আরও দূরের কথা।
আমাদের অনেক সচেতন ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষও এ সকল বিষয়ে বেখেয়াল, অবহেলা করে থাকি কিংবা মনে থাকে না আমাদের। ফলে শরীর অসুস্থ হওয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণগুলো আমরা বুঝতে পারি না। কিংবা বুঝেও গুরুত্ব দেই না। অথচ একবার, দুইবার, তিনবার এভাবে বারবার অল্প অল্প অসুস্থতা দীর্ঘমেয়াদে অনেক জটিল ও বড় রোগের জন্ম দেয়।
স্বাস্থ্যব্যয় বিবেচনায়ও পথ-খাবারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবার অসুস্থতায় অল্প অল্প খরচ আমরা অনেকেই আমলে নেই না কিংবা টেরও পাই না। কিন্তু সারা বছরের সেই খরচগুলো যদি যোগ করা হয়, তাহলে অঙ্কটা অনেকের ক্ষেত্রেই আঁৎকে ওঠার মতোও হতে পারে– এ বিষয়ে আমার অন্তত কোনো সন্দেহ নেই। আর বড় ধরনের অসুস্থতার খরচ, সে তো উল্লেখ করার প্রয়োজনই হয় না।
আমাদের দেশে যদি বড় ধরনের অসুস্থতার কারণ অনুসন্ধানের কোনো ব্যবস্থা থাকত অথবা এ নিয়ে নিয়মিতভাবে গবেষণা হতো, তাহলে আরও যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিষয়টা উপস্থাপন করা সহজ হতো। এ ধরনের গবেষণা এখন নিয়মিতভাবে হওয়াটা খুবই জরুরি। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য এবং মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর অনুসারে জানা যায় যে, মানুষের স্বাস্থ্যব্যয় ক্রমশই বাড়ছে। যারা চিকিৎসা গ্রহণ করতে যান, তারাও বিষয়টা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করেন। কিন্তু এর পেছনের মূল কারণগুলোর অনুসন্ধান সেভাবে করা হচ্ছে না কিংবা বিভিন্ন কারণে অনুন্মোচিতই থেকে যাচ্ছে।
আমাদের মতো দেশগুলোতে পথ-খাবার স্বাস্থ্যব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ বলেই আমার কাছে মনে হয়। উন্নত বিশ্বে পথ-খাবার স্ট্রিট ফুড নামে পরিচিত ও সমাদৃত– খুব জনপ্রিয় বললেও অত্যুক্তি হবে না। পথ-খাবার কি তাহলে খারাপ? আসলে মূল প্রশ্নটা সেখানেই– খাবার সেটা খারাপ হতে যাবে কেন?
খাবার, পাতায় পরিবেশন করা হোক আর প্লেটে– যদি সুষ্ঠুভাবে খাবারের মান নিয়ন্ত্রণ করার আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা থাকে, যিনি খাবার তৈরি করছেন তিনি যদি খাবারের গুণ ও মান সম্পর্কে সচেতন থাকেন, তিনি যদি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাবার পরিবেশন করেন এবং নিয়মিতভাবে সেটার চর্চা করেন, তাহলে পথ-খাবার হলেও, সেটাই হবে নিরাপদ। অথচ আমরাই অতি লোভে, অজ্ঞতা ও অসচেতনায় পথ-খাবারকে স্বাস্থ্যহানি ও স্বাস্থ্যব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ করে তুলেছি।
আমি এটা অনুমান থেকে বলছি না। বলছি নির্ভরযোগ্য গবেষণার সূত্র ধরে। সম্প্রতি ঢাকার অভিজাত-অনভিজাত দুই ধরনের এলাকারই অন্তত ১৫টি জায়গার ১৪৯টি পথ-খাদ্যের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) সে সকল তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নমুনাগুলোতে মারাত্মক মাত্রায় ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া পেয়েছেন। প্রতি গ্রামে সহনীয় মাত্রা যেখানে ৩০, সেখানে এসব খাবারে এক হাজার ১০০টির বেশি টোটাল কলিফর্ম ও ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। খাদ্যমান পরীক্ষার আন্তর্জাতিক সংস্থা এসজিএসের ল্যাবরেটরিতে খাবারের নমুনাসমূহ পরীক্ষা করা হয়েছে। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলেও ল্যাবরেটরির ফলাফলকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যে সকল ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গিয়েছে সেগুলো মূলত প্রাণীদের মলমূত্রে থাকে। বলাবাহুল্য, ডায়রিয়া-কলেরা থেকে শুরু করে নানা ধরনের রোগের মূলসূত্রই হলো এসব ব্যাকটেরিয়া। অথচ গবেষণায় প্রকাশিত তথ্যে এটাও জানানো হয়েছে যে, ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ পথ-খাবার খেয়ে থাকেন।
এ ধরনের কোনো গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হলে সাধারণভাবে আমরা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হতে দেখি। সম্প্রতি এর একটি প্রতিফলন আমরা সিটি করপোরেশনের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার মন্তব্যে লক্ষ্যও করেছি। যাইহোক, সমস্যা থাকলে সমাধান নানা উপায়ে করা যায়। কিন্তু এক সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে আরও বড় সমস্যা কিংবা অন্য কোনো গুরুতর সমস্যা তৈরি হচ্ছে কিনা, সেটা সবার আগে ভেবে দেখাটা জরুরি হবে।
শুধু ঢাকা নয়, ছোট-বড় সকল নগর এলাকায় বসবাসকারীর একটা বড় অংশই এসব খাবারের ওপর এখন নির্ভরশীল। বিশেষ করে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট অভিভাবক, রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, শ্রমিকসহ নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ শখ করে হলেও মাঝেমধ্যেই কম-বেশি পথ-খাবার খেয়ে থাকেন।
সহজে পাওয়া যায়, দামে সস্তা, চোখের সামনে দেখে খাবারের স্বাদ উপভোগ করার ইচ্ছে, বিকল্প না থাকা ইত্যাদি নানা কারণ এর পেছনে থাকতে পারে। এর সাথে স্বাভাবিকভাবেই অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কিত যেমন, দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের প্রশ্ন, মানুষের অভ্যাস-আচার-আচরণের সম্পর্ক, আইনি অবস্থান– বৈধতা ও অবৈধতার অভিযোগ, আছে সচেতনতা এবং গুণ ও মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়। শুধু তাই নয়, এর সাথে দেশের সংস্কৃতির বিষয়টিও যুক্ত। ফলে, শুধু উচ্ছেদ করার মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। সেটা সম্ভব নয়, ঠিকও হবে না। বরং তা নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করবে।
কাজেই বিষয়টাকে সার্বিকভাবে দেখে এর সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করাটা জরুরি। যেখানে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। যান ও পথচারীর চলাচল, গাড়ির চালক এবং পথচারী-উভয়ের নিরাপত্তার বিষয়টি অগ্রাধিকারে রেখে ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দায়িত্ব রয়েছে সিটি করপোরেশনগুলোর। খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দায়িত্ব রয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের; উৎপাদন থেকে বাজারজাত ব্যবস্থাপনা, ভোক্তার স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দায়িত্ব রয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ নিউট্রিশনের (আইপিএইচএন)। এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও সম্পর্কিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাই, এজন্য সবার আগে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাথে নিয়ে একটি রোডম্যাপ জরুরি ছিল।
তবে আশার কথা যে, সরকার ইতোমধ্যে 'বাংলাদেশ গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস নীতিমালা, ২০২০' অনুমোদন করেছেন। উৎপাদন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত খাদ্যপণ্যের গুণগত মান এবং ভোক্তার স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে বিভিন্ন বিষয় সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ পথ-খাবারকে নিরাপদ করতে আরেকটি নীতিমালা তৈরির কাজ অব্যাহত রেখেছে।
এছাড়া একটি রোডম্যাপের আলোকে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনে পথ-খাবারের জন্য আলাদা স্থান বরাদ্দ করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। কাজ চলছে বিক্রেতাদের রোগজীবাণু ও পুষ্টি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল তৈরি এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি প্রদানের বিষয়েও। এগুলো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আশা করি, উপযুক্ত রোডম্যাপের আলোকে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে এগুলো দ্রুতই আলোর মুখ দেখবে।
থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশে পথ-খাবার বিক্রির জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা আছে। আছে জীবাণুমুক্ত পানির ব্যবস্থা এবং মান নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিতভাবে তদারকির ব্যবস্থাপনা। তাই উচ্ছেদ না করে দেখা উচিত কেন খাবারগুলোতে জীবাণু থাকছে। প্রকৃত কারণগুলো অনুসন্ধান করা এবং সে লক্ষ্যে প্রতিকারের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এজন্য পথ-খাবার প্রদানকারীদের সবাইকে একটি নিবন্ধনের আওতায় আনাটাও জরুরি হবে। আর অবশ্যই তাদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দ করে দেওয়া হলে কর্তৃপক্ষের জন্য মান নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি করাটাও সহজ হবে।
নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে জানাটা এখন সবার জন্য জরুরি। নিজেকে জানতে হবে, অন্যকেও জানাতে হবে। কারণ এর মধ্য দিয়ে আপনি বাঁচবেন, আপনার আপনজন ও অন্যদেরও জীবনের আয়ু বৃদ্ধি ও জীবন রক্ষা পাবে। স্বাস্থ্যব্যয়ের বোঝা সরিয়ে ফেলে আমরা সবাই নিশ্চয়ই সুস্থ ও সুন্দরভাবে জীবনধারণ করতে চাই। আমরা সবাই নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর, ভেজাল-রঙ-মাছি-ধূলা ও রাসায়নিকমুক্ত খাদ্য চাই। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা ও অধিকারের দিকটিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ওপরের উদ্যোগগুলো প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়িত হলে আমরা ধীরে ধীরে এর সুফল পাওয়া শুরু করব। আসুন, আগে নিজেরা সচেতন হয়ে উঠি, পাশাপাশি অন্যদেরকেও সচেতন করে তুলি। আর প্রত্যাশা রইল, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জনস্বার্থ বিবেচনায় সার্বিক সমাধানের পথ খুঁজবেন ও পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের দিকে এখনই বিশেষভাবে নজর দেবেন।