পাহাড় ভালো না থাকলে সমতলও ভালো থাকবে না। তাই তো কঠোর হাতে দমন করতে হবে ঘৃণা ও নৈরাজ্য ছড়ানো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে।
Published : 22 Sep 2024, 12:24 PM
বেশ কিছুদিন ধরে পরিকল্পনা করছিলাম, আসছে শীতে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাব। সমুদ্রের চেয়ে পাহাড় আমার বেশি ভালো লাগে। যদিও এই ভালোলাগার পেছনে সুনির্দিষ্ট অনেকগুলো কারণ রয়েছে, তার মধ্যে পাহাড়ের জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সম্প্রতি পাহাড়ের অস্থিরতার ঘটনায় মনটা বেশ আনচান হয়ে উঠেছে। মনে জন্ম নিয়েছে হাজারও প্রশ্নের। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে পাহাড়ে শিক্ষাভ্রমণের আলাপ আসলে কি জবাব দেব এবার শিক্ষার্থীদের? সৎ সাহস নিয়ে কি দাঁড়াতে পারব পাহাড়ের গল্প শোনাতে?
পাহাড় জ্বলছে। দাউ দাউ করে। ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট কিছুই রেহাই পায়নি। মানুষের জীবনও যেন তুচ্ছ! পুড়ে ছারখার, নেভাবে কে? বহ্নিশিখার মতো জলন্ত পিণ্ডির তেজ আছড়ে পড়ছে। পাহাড়ের অশান্তির রহস্যকে কি আমরা কখনও উদঘাটন করতে পেরেছি? নাকি কোনো ঘটনা ঘটলে তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার মানসিকতায় রয়ে গেছি? পাহাড়ের অনাদি সমস্যার মূল কী? কেন বারবার বলা হচ্ছে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত? তাহলে সর্ষের মধ্যে ভূত কোথায়?
সম্প্রতি খাগড়াছড়ির সংঘর্ষ ও মৃত্যুর ঘটনার জেরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে রাঙামাটিতেও। বান্দরবানেও ছড়িয়ে পড়বে না তো? উত্তর আমরা সবাই জানি। পাহাড়ের আগুন, আক্ষরিক অর্থে আগুন হয়ে না এলেও দ্রুত সমতলে ছড়িয়ে পড়ে। অশান্ত করে সমতলের জনজীবন। বিষফোঁড়ার মতো পচন ধরায় সমাজ ব্যবস্থায়। পাহাড় জ্বললে কি শুধু পাহাড়ই জ্বলে? বাংলাদেশ কি জ্বলে না? উত্তর হয়তো অজানা না কারও। চির অশান্তির বীজ কেনই বা রোপিত হলো পাহাড়ে? প্রকৃত প্রতিকারই বা কী?
পাহাড়ের সমস্যা আজকের না, বরং বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে চলছে। শুরু হয়েছে বাংলাদেশের জন্মের আগে, কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে। অতীতে আমরা দেখেছি পাহাড়ে যারা রক্ষকের ভূমিকায় ছিল তারাই ছিল মূলত ভক্ষক। চরম বিভাজন ও অসহিষ্ণুতার রাজনৈতিক মিশ্রণ দিয়ে পাহাড়ে জিইয়ে রাখা হয়েছিল সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প। প্রচার করা হয়েছে পাহাড়ে বাঙালিরা অনেক বেশি নিষ্পেষিত? এটা ঠিক পাহাড়ে যেহেতু জুম্ম নৃগোষ্ঠীর আদিবাস তারা তো একটু বেশি সুবিধা পাবেই। তাই বলে বাঙালিরা যে একেবারেই পাচ্ছে না এমনটি কিন্তু নয়। তবে বাজারে এটি নিয়ে বেশ শক্তিশালী প্ররোচনা ও প্রচারণা আছে বটে। কেন আমরা সমস্যার গোঁড়ায় যেতে চাই না? কাদের রাজনৈতিক স্বার্থে সমতল থেকে বাঙালিদের পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে পুনর্বাসন করা হলো? এর জবাব কি খুঁজেছি আমরা?
পাহাড়িদের আলাদা করে রাখা, ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতি ছড়ানো, বৈষম্যমূলক আচরণ কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদীর তকমা দিয়ে বরাবরই রাজনৈতিক ট্রাম্পকার্ড খেলা হয়েছে। তাই তো এসব নিয়ে রয়েছে পাহাড়ে তীব্র অসন্তোষ। দৃষ্টিভঙ্গিতে এসেছে বাঙালি-পাহাড়ি উসকানিমূলক ন্যারেটিভ। তার ওপরে রয়েছে পার্বত্য চুক্তির দুই দশকের বঞ্চনার খতিয়ান। বিশ বছর ধরে এ চুক্তিকে ‘মুলা ঝুলা’ দিয়ে রাখা হয়েছে সুকৌশলে। বিগত আওয়ামী আমলে দেখেছি মাঝে মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলে গা-ঝাড়া দেওয়া হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি কখনও। বিগত দিনে দেখেছি পাহাড়িদের দাবি নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে আসলে বলা হতো শান্তি বাহিনীর এজেন্ট। ফলে পাহাড় যখন আগুন লাগে, তখন ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে যে সব বিক্ষোভ মিছিল হয়, সেখানে বাঙালিদের অংশগ্রহণ থাকে হাতেগোনা, যেন নির্যাতনের প্রতিবাদ করার দায়ও আদিবাসীদের একার। আবার এর সঙ্গে ছিল তাদের ওপর হামলার কোনো সুষ্ঠু বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি। বিভাগীয় তদন্ত তো দূরের কথা। বিগত দিনে এসব আক্রমণের ঘটনা কি এক ফোঁটাও প্রকাশ করা হয়েছে মূলধারার গণমাধ্যমে? শাসকরা সদা ব্যস্ত ছিল এসব হামলা ও হাঙ্গামার খবর আড়াল করতে, বড় বড় রাস্তা আর সেতু নির্মাণের উন্নয়ন খবর প্রচারে, উন্নয়ন যে মানুষের, জনজাতির জীবনের স্বস্তির মধ্যেও নিহিত তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার কারণেই তো দুর্বৃত্তরা প্রশ্রয় পেয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বরাবরই প্ররোচিত হয়েছে।
এবার বর্তমান ঘটনার ওপর মনোযোগ দেওয়া যাক। গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরের পানখাইয়া পাড়ার নিউজিল্যান্ড এলাকায় মামুন নামের এক যুবককে চুরির কারণে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ আনা হয় পাহাড়িদের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে স্থানীয় বাঙালি জনগণ পাহাড়িদের বসতবাড়ি, ভিটা ও দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। আমি কথা বলে জেনেছি, আগুন লাগাবার আগেই তাদের থামানো যেতে বলে মনে করেন পাহাড়িরা। এই আগুনের ফলে দুই পার্বত্য জেলায় সংঘর্ষে সরকারি হিসেবে প্রাণ হারায় মোট চারজন। যা মূলত করা হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব রটিয়ে। মিথ্যা ও উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে তরুণ ও যুবকদেরকে ঘর থেকে বের করে এনে ঘটানো হয়েছে চরম নৈরাজ্য। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে করা হয়েছে লুটপাট। এদের এখন খুঁজে বের করে জনগণের সামনে আনা দরকার।
পাহাড়ে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার ও সংগঠন আছে যারা যে কোনও সংকটময় মুহূর্তে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করতে চায়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা না হয় বাদই দিলাম। এসব নিয়ে ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না এখন। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে কারও এজেন্ডার ভাগীদার হওয়া যাবে না। আর কারা এসব নিয়ে ফায়দা লুটতে চায় তাদেরও শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জন্ম হয়েছে নতুন বাংলাদেশের। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে সংগ্রাম করা এসব ছাত্র-জনতার প্রতিদানকে কখনও সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসার মতো ঘটনায় বৃথা হতে দেওয়া যাবে না। একজন পাহাড়ি ফুটবলার বা খেলোয়াড়ের কৃতিত্বে কেন আমরা আনন্দিত হই? কেন একজন পাহাড়ি বাংলাদেশের হয়ে জাতীয় দলে খেলে কিছু অর্জন করলে আনন্দে বুক ফাটা চিৎকার করি? তখন তো ভাবি না, তুমি কে, আমি কে?
পরিশেষে বলব, দীঘিনালার অশান্তি দীঘিনালাতেই শেষ করতে হবে। পাহাড়ে রক্তারক্তি দেখলে প্রতিবাদ করতে হবে, আমার, আপনার, আমাদের সবার। তারাও তো আমাদের মতো এদেশেরই জনগণ। বৈষম্য থাকবে কেন তাহলে? আমাদের আরও সহানুভূতিশীল হতে হবে। তাদের দুর্দিনে সরব হতে হবে। কিছু করতে না পারলে, তাদের নিয়ে মন খুলে লেখার চেষ্টা করতে হবে। মৃত্যু যাতে আর না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সাম্প্রদায়িক উসকানি বন্ধ করতে হবে। ঘর যাতে না পোড়ে সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। জীবন থাকুক জীবন্ত ও সবুজ থাকুক প্রাণ।
এটি মনে রাখা দরকার, পাহাড় ভালো না থাকলে সমতলও ভালো থাকবে না। তাই তো কঠোর হাতে দমন করতে হবে ঘৃণা ও নৈরাজ্য ছড়ানো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে। প্রয়োজনে পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের জনগণের মন ও মগজের দূরত্ব কমাতে হবে, ওই পাহাড়টা আমার, পাহাড়িদের বিতাড়িত করে আমি এর দখল নিতে পারি, এমন ঔপনিবেশিক ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে দৃশ্যমান ঐক্য বাড়াতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থে। দ্রুত পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নতুন সরকারকে তাগিদ দিতে হবে। সরকারকে বুঝতে হবে আওয়ামী লীগ চুক্তি করে চুক্তি বাস্তবায়নে টালবাহানার মধ্য দিয়ে এই পরিস্থিতির বীজ লুকিয়ে রেখেছিল। দাঙ্গার হোতাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং এটি রোধে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ করে পাহাড়ের প্রকৃত সমাধানের পথে হাঁটতে হবে।