Published : 29 Oct 2021, 04:45 PM
বড় অন্ধকার সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে প্রিয় স্বদেশ। গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের দ্বিতীয় দিন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় এবং বাড়িঘরে ধারাবাহিকভাবে সংঘবদ্ধ হামলা চালানো হচ্ছে। কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননা করার অভিযোগ তুলে হামলা চালানোর পর থেকে একে একে তাণ্ডব চালানো হয়েছে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায়। কোথাও কোথাও সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের সুযোগ নিয়ে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কথাও শোনা যাচ্ছে। এসব হামলায় সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে। এসব ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে অনেককে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলেও এসব তাণ্ডবের পেছনের মূল হোতারা এখনও চিহ্নিত হয়নি, রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোন উদ্দেশ্যে, কারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়েছে তা-ও স্পষ্ট নয়। অথচ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তেই অনেক জায়গায় সহিংসতার সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গিয়েছে। যদিও, অতীতের যেকোনো সময়ের মতো এবারও কুমিল্লার ঘটনার পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছেন। আওয়ামী লীগ বলছে, এসব কাজের পেছনে বিএনপি-জামায়াত জড়িত, আর বিএনপির বক্তব্য, জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই সরকারি সংস্থাগুলো এসব হামলা চালাচ্ছে। এ ধরনের আগাম অযৌক্তিক দোষারোপ নিঃসন্দেহে এ ঘৃণ্য অপরাধের মূল রহস্য উদঘাটনের অন্তরায়।
১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেন এবং সাহিত্যিক-সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক রণেশ দাশগুপ্তসহ আরো অনেক প্রগতিশীল মহান ব্যক্তিদের যৌথ প্রচেষ্টায় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী নামের যে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করেছিল তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত, বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে জন্ম নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে উদীচী। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তেও বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি উদীচীর কর্মীরা। স্বাধীনতার পর নামের সাথে 'বাংলাদেশ' শব্দটি যুক্ত করে উদীচী হয়ে ওঠে 'বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী'। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, দেশবিরোধী চক্রান্ত, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের অপচেষ্টাসহ মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সর্বদা সোচ্চার থেকেছে সংগঠনটি। যার ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এবারও সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে এরই মধ্যে দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে উদীচী। ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধ থেকেই এসব সংগ্রামে সবার আগে লিপ্ত হয় উদীচী, নিশ্চয়ই ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
দেশে আজ শুধু যে সাম্প্রদায়িক দানবের নগ্ন নৃত্য চলছে তাই নয়, অনেকটা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদকে জিইয়ে রাখার একটা অপচেষ্টাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা এবং ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের চার মূলনীতি ছিল– জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এসব মহান নীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জীবন দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। অথচ ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে গিয়ে প্রথমে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানের শুরুতে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' যুক্ত করেন। এরপর সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনী এবং ২০১১ সালে সপ্তম সংশোধনী বাতিল করেন। ২০১৭ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সব বাধা দূর হলেও এখন পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ৭২-এর সংবিধানে ফিরে না যাওয়ার ফলে মৌলবাদী শক্তি আসকারা পাচ্ছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। সাম্প্রতিক ঘটনায় রাষ্ট্র যে শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালনের অধিকার সুরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের অবমাননাও ঠেকাতে সফল হয়নি। অর্থাৎ, দেশের সর্বস্তরের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে কুচক্রী, ধান্দাবাজরা অবাধে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করলেও রাষ্ট্র তা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া, ২০১৭ সালে পাঠ্যপুস্তকে প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন লেখা জুড়ে দেয়ার ফলে ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ বপনের কাজটি আরো কঠিন করে তুলেছে রাষ্ট্র।
মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত সমাজ গঠন করা। যা উদীচীর লক্ষ্য-আদর্শের সাথে শতভাগ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ লক্ষ্য অর্জনে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকসংস্কৃতি। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বাউল, মুর্শিদী, মারফতিসহ মাটির সুরের লোক গান ছাড়াও যাত্রাপালা এবং অন্যান্য মাধ্যমে বাংলার পথে প্রান্তরে হাজার বছর ধরে অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছেন লালন, হাছন, শাহ আব্দুল করিমের মতো লোক সাধকরা। কিন্তু বাংলাদেশে সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার পথ আজ অবরুদ্ধ। নতুন প্রজন্মকে আবহমান বাংলার সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া তো দূরের কথা, উল্টো তাদেরকে সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার পরিবর্তে নির্দিষ্ট গণ্ডিবদ্ধ শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়ার ফলে শৈশব থেকেই সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষের বীজ বপন করা হচ্ছে। অবিলম্বে এ ধারা পাল্টাতে না পারলে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত ও কয়েক লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত মহান স্বাধীনতার মূল চেতনা ভূলুণ্ঠিত হবে। বিফলে যাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং চার জাতীয় নেতাসহ অগণিত মুক্তিসংগ্রামীর দীর্ঘদিনের সংগ্রাম।
সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, সাম্রাজ্যবাদসহ সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উদীচী সর্বদা অগ্রগামী। একইসাথে আবহমান বাংলার সংস্কৃতির সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসারেও সদা উদ্যোগী উদীচী। পূর্বসূরিদের কাছ থেকে যে আদর্শের পতাকা বয়ে এসেছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে, সেটি উড্ডীন রাখতে এই সময়ের উদীচী শিল্পী-কর্মীরা শতভাগ বদ্ধপরিকর। উদীচী সঠিক ধারায় থাকলে সঠিক ধারায় থাকবে এদেশের শিল্প-সংস্কৃতি, উদীচীর সোচ্চার ভূমিকা থাকলে সঠিক ধারায় বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। একইসাথে ব্যর্থ হবে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তির সকল অপচেষ্টা। তাই আসুন, ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি। প্রিয় স্বদেশকে সঠিকভাবে পরিচালনায় অবদান রাখি। অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত, বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজেদের সর্বোচ্চ মেধা ও সৃজনশীল সত্ত্বাকে নিয়োজিত করি। জয় উদীচী। জয় হোক মেহনতী মানুষের।