Published : 27 Aug 2021, 01:12 PM
১৯৪২ সালের ৯ জুলাই কলকাতা বেতার কেন্দ্রে প্রোগ্রাম চলাকালীন হঠাৎই নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার জিভ আড়ষ্ট হয়ে জড়িয়ে গিয়েছিল। থরথর করে কাঁপছিল তার ঠোঁট। মুখ দিয়ে কোনো স্বর বের হচ্ছিল না। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না কাজী নজরুল কী রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যে রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ সময় নির্বাক ও জীবন্মৃত অবস্থায় কাটিয়েছেন, সেই রোগের নাম 'পিক'স ডিজিস'। কাজী নজরুল ইসলাম নির্বাক অবস্থায় ৩৪ বছর ১ মাস ২০ দিন বেঁচেছিলেন। ঢাকায় কবিকে নিয়ে যাওয়ার পর কোথায় তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়? বাংলাদেশের ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পর কবিকে পুরনো ২৮নং রোডের ৩৩০/বি ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার বাড়িটি দান করা হয়। সে-সময়ে বাড়িটির নামকরণ করা হয় 'কবি ভবন'। এই বাড়িতে কবি কাটিয়েছেন তিন বছর এক মাস ২৯ দিন। কবি ভবন থেকে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় পিজি হাসপাতাল (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)-এর ১১৭নং কেবিনে। পিজি হাসপাতালে কবি মৃত্যু পর্যন্ত অর্থাৎ ছয় মাস ১১ দিন কাটিয়েছেন। পিজি হাসপাতালে কবির সংকটময় অবস্থায় যে বয়স্কা মহিলা প্রতিদিন নজরুলের শিয়রের পাশে বসে থাকতেন, তিনিই কবির এক সময়ের প্রেমিকা ফজিলাতুন নেছা। ১৯৭৬ সালের ২৯ অগাস্ট (১২ ভাদ্র) রবিবার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ১১৭নং কেবিনে কাজী নজরুল ইসলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
(২)
গ্রামোফোন কোম্পানির সাথে সংযুক্ত থাকায় তার পরিশ্রমের অন্ত ছিল না এবং একান্তভাবে তাকে মস্তিষ্কের পরিশ্রমই করতে হয়েছিল অত্যন্ত বেশি। নজরুলের এত বড় রোগ তা নোটিস না দিয়ে আসেনি। সেই নোটিসের ভাষা শুরুতে শুধু নজরুলই বুঝেছিলেন। আমি আগেই বলেছি যে তখন তিনি বিজ্ঞানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে তার রোগ যখন সবার চোখে প্রকাশ পেল তখন চিকিৎসা হয়েছিল বটে; কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসা অত্যন্ত অপরিমিত ও অসম্পূর্ণ হয়েছে। অবশ্য সে-সময় কোনো কোনো ডাক্তার বলেছিলেন যে বড় দেরি হয়ে গেছে। তখন যদি কবিকে ইউরোপে পাঠানো যেত তাহলে তার মস্তিষ্কে অপারেশন অন্তত হতে পারত। তবে, টাকা থাকলেও সেই সময় কবিকে ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হতো না। কেননা বিশ্বযুদ্ধ চলছিল; কিন্তু 'নজরুল নিরাময় সমিতি' গঠিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের জুন মাসে। চার মাস রাঁচিতে চেষ্টা করার পরে সস্ত্রীক কবিকে ইউরোপে (লন্ডন) পাঠানো হয়েছিল ১৯৫৩ সালের মে মাসে। ১০ মে তারা হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা হয়েছিলেন। লন্ডনে বড় বড় ডাক্তার কবির রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। ডাক্তার রাসেল ব্রেন, ডাক্তার উইলিয়াম স্যারগ্যান্ট ও ডাক্তার ম্যাক্কিস্ক্-এর মতো প্রসিদ্ধ ডাক্তারগণ কবিকে নিয়ে তিনবার বসেছিলেন। শুনেছি প্রত্যেক বৈঠকে তারা ২৫০ পাউন্ড হিসেবে ফিস নিয়েছেন। প্রবীণ চিকিৎসক রাসেল ব্রেনের মতে, কবির মস্তিষ্ক বিকৃতি দুরারোগ্য। রোগীর রোগ সম্বন্ধেও লন্ডনে দু-দল বিশেষজ্ঞের মধ্যে প্রবল মতভেদ হয়েছে। একদল বিশেষজ্ঞ বলেছেন, রোগী 'ইন্ভলুশনাল সাইকোসিস' রোগে ভুগছেন, অন্যদল কলকাতার বিশেষজ্ঞদের ডায়াগনেসিসকেই সমর্থন করেছেন। তবে উভয় দলীয় বিশেষজ্ঞদের মতেই প্রাথমিক চিকিৎসা অত্যন্ত অপরিমিত ও অসম্পূর্ণ হয়েছে। লন্ডনের 'লন্ডন ক্লিনিক' নামক হাসপাতালে কবির মস্তিষ্কে বাতাস পুরে 'এয়ার এনসেফ্যালোগ্রাফি' নামক এক্স-রে পরীক্ষা করা হয়। ঐ পরীক্ষায় প্রতিপন্ন হয় যে কবির মস্তিষ্কের পুরোভাগ অর্থাৎ 'ফ্রন্টাল লোব'দ্বয় সংকুচিত হয়ে গেছে। ডাক্তার ম্যাক্কিস্ক্ প্রমুখ ডাক্তারগণ বলেন, 'ম্যাক্কিস্ক্ অপারেশন' নামক অস্ত্রোপচার বিধির দ্বারা যদি কবির মস্তিষ্কের পুরোভাগে অবস্থিত ফ্রন্টোথ্যালমিক ট্রাক্ট নামক স্নুায়ুপথ মস্তিষ্কের অপরাংশ হতে বিচ্ছিন্ন করা যায়, তবে হয়তো রোগীর বর্তমান অপরিচ্ছন্নতা প্রভৃতি বদভ্যাসগুলো উপশম হবে; কিন্তু ডাক্তার রাসেল ব্রেন এই মতের বিরোধিতা করেন। অতঃপর কবির রোগ বিবরণী ও পরীক্ষার রিপোর্টসমূহ ভিয়েনা ও ইউরোপের অন্যান্য বহু জায়গার চিকিৎসকদের দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়। জার্মানির বন ইউভার্সিটির মস্তিষ্ক শল্যবিদ্যার অধ্যাপক, প্রফেসর রোয়েটগেন বলেন, ম্যাক্কিস্ক্ অপারেশন কবি নজরুলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ভিয়েনার মস্তিষ্ক শল্যবিদ ডাক্তার ম্যাক্কিস্ক্-এর মতের বিরোধিতা করেন। উপরিউক্ত তিনজনই কবির মস্তষ্কে সেরিব্রাল অ্যানজিওগ্রাফি নামক পরীক্ষা (এক্স-রে) করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কবির সুহৃদগণের ইচ্ছায় কবিকে (ভিয়েনায়) নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রফেসর হবাগনার ইয়াউরেগ-এর সুযোগ্য ছাত্র ডাক্তার হান্স হফ-এর অধীনে ভর্তি করা হয়। ৯ ডিসেম্বর ১৯৫৩, বুধবার, কবির ওপর সেরিব্রাল অ্যানজিওগ্রাফি পরীক্ষা করা হয়। ডাক্তার হফ্ এই পরীক্ষার ফলদৃষ্টে দৃঢ় মত প্রকাশ করেন যে কবি পিক্'স ডিজিজ নামক মস্তিষ্কের রোগে ভুগছেন। উক্ত রোগে মস্তিষ্কের সম্মুখ ও পার্শ্ববর্তী অংশগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। ডাক্তার হফের মতে, রোগীর বর্তমান লক্ষণগুলো এই রোগের সাথে মিলে যায়। ডাক্তার হফ বলেন, কবির ব্যাধি এতদূর অগ্রসর হয়েছে যে, নিরাময়ের বিশেষ কোনো আশাই নেই। বন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রোয়েটগেন ব্যক্তিগতভাবেও কবিকে পরীক্ষা করেছেন। ইংল্যান্ডের ডাক্তাররা কবিকে পরীক্ষা করার জন্য মোটা ফিস নিয়েছিলেন; কিন্তু ইউরোপের অন্যান্য স্থানের ডাক্তাররা বাংলার জাতীয় কবিকে পরীক্ষা করার জন্য কোনো ফিস নেননি। নজরুলরা ইউরোপ ত্যাগ করার পরক্ষণেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায় ভিয়েনা গিয়েছিলেন। নজরুলের ব্যাপারে তিনি ডাক্তার হান্সে হফ-এর সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। নজরুলরা ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বরের শেষ রাতে রোম থেকে হাওয়াই জাহাজে কলকাতা ফিরেছিলেন।
(৩)
১৯৪২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর সময়কে কাজী নজরুল ইসলামের জীবনকে অন্ধকারময় যুগ বলা হয়। কারণ ঐ সময়ে কবির রচিত গান প্রায় কেউ গাইত না। বরং বলা ভালো গাইতে বলতে দেওয়া হতো না; রেডিওতেও প্রচার হতো না। তখন কবির রচিত ও সুরারোপিত গান মাঝে মধ্যে অন্যের নামেও প্রচারিত ও প্রকাশিত হতো।
ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পর কবিকে পুরনো ২৮নং রোডের ৩৩০/বি ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার বাড়িটি দান করা হয়। সে-সময়ে বাড়িটির নামকরণ করা হয় 'কবি ভবন'। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কাজী নজরুল ইসলাম। এ দুই মহাপ্রাণের জন্ম না হলে বাঙালি পেত না তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। দুজনের বয়সের সংখ্যাগত পার্থক্য ২১ বছর। দুজনের জীবনের বাস্তবতা হলো, নজরুল যখন সৃষ্টিকর্মে উদীয়মান, বঙ্গবন্ধুর তখন জন্ম। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু যখন আন্দোলনের তুঙ্গে তখন নজরুল নিভে যাওয়া এক আগ্নেয়গিরি। 'বিদ্রোহী' কবিতার ৯০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন, 'বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল এবং বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানসিকতার দিক থেকে সমান্তরাল অবস্থানে রয়েছেন।' (বাংলা নিউজ, ২৫ মে ২০১২)।
দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, গণভবন থেকে কাজ সেরে আড়াইটায় বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির বাড়িতে আসেন। বাড়ি গিয়ে তিনি বুকশেলফ থেকে বের করেন নজরুলের বাক্যগ্রন্থ সঞ্চিতা। আবৃত্তি করেন বিদ্রোহী কবিতা। তারপর মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেইদিন হবো শান্ত, আবৃত্তি করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসেন। তার বাড়ি থেকে ২৮ নম্বর কবির বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত আওড়ালেন কবিতার চরণ। কবিকে যেখানে রাখা হয়েছে সেই কক্ষে গিয়ে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে পরিয়ে দেন পুষ্পমাল্য। বেগম মুজিব নিজের হাতে তুলে দেন অতি সযত্নে বানানো ফুলের তোড়া। কবির মাথায় ও শরীরে হাত বুলিয়ে দেন। কবি নির্বাকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় কবির জন্মদিন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিলেন। বাণীতে বঙ্গবন্ধু কবির সৃষ্টি পুনর্মূল্যায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশের বিদগ্ধ সমাজকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'নজরুল একাডেমী কাজে অগ্রণী হয়েছে জেনে আশ্বস্ত হওয়া গেছে। নজরুল জন্মদিবসের উৎসবে মিলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কাজে বিদগ্ধ সমাজ আত্মনিয়োগ করবে বলে আশা রাখি।' কবি নজরুল ইসলামের ঢাকায় আগমন উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ২৫ মে'র দৈনিক বাংলা পত্রিকাটি বঙ্গবন্ধুর উক্তি দিয়ে সংবাদ শিরোনাম করেছিল। উক্তিটি ছিল বাংলাদেশের বিদগ্ধ সমাজকে কবির সৃষ্টির পূর্ণ মূল্যায়নের দায়িত্ব নিতে হবে। ঢাকায় কবি নজরুলের আগমনের দিনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এবং তদানীন্তন তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীকে নিয়ে কবিকে দেখতে যান। এ-সময় কবির পাশে ছিলেন তার পুত্রবধূ। বঙ্গবন্ধু কবিকে দেখতে গেলে সেখানে এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়। 'কবি ও বঙ্গবন্ধু: এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য' শীর্ষক শিরোনামে দৈনিক বাংলা পত্রিকা মন্তব্য করেছিল: "বঙ্গবন্ধু গভীর শ্রদ্ধাভরে পুষ্পমাল্য পরিয়ে দিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। পরম স্নেহে বারবার হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন কবির মাথায়, পিঠে, সর্বাঙ্গে। নির্বাক কবি অপলক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। হাত বাড়িয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বললেন বঙ্গবন্ধুকে। বাকশক্তিহীন সে মুখের ভাষা বোঝা গেল না।" বঙ্গবন্ধু কবি নজরুল ইসলামকে ঢাকায় এনেই ক্ষান্ত ছিলেন না। কবির সুযোগ-সুবিধার বিষয়টিও চিন্তা-ভাবনার ভেতর রেখেছিলেন। কবিকে ঢাকার ধানমন্ডিতে রাখার ব্যবস্থা এবং আর্থিক বরাদ্দের বিষয়েও বিবেচনা করেন। 'বাংলাদেশ কবিকে মাসে ১ হাজার টাকা ভাতা দেবে' শিরোনামে দৈনিক বাংলা লিখেছিল: "গতকাল বুধবার (মে ১৯৭২) বাংলাদেশ সরকার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে মাসে ১ হাজার টাকা ভাতা মঞ্জুর করেছেন। এখন থেকে তা কার্যকরী হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল বিকালে কবি নজরুলকে তার ধানমন্ডি বাসভবনে দেখে আসার পর এই সরকারি সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন।" (দৈনিক বাংলা, ২৫ মে ১৯৭২)। এই পরিসরে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে রাখতে চাই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে মাসিক ৩৫০ রুপি ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের এক মুখপাত্র ভারতের বাংলা 'দৈনিক আনন্দবাজার' পত্রিকায় জানিয়েছিল, "বিদ্রোহী কবির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসার নির্দেশ হিসেবেই ভাতা প্রদানের এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।" মুখপাত্র আরও জানিয়েছিলেন, "গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কবিকে যে ভাতা দেয়া হতো তা ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার অনুমোদন করেছিল। কিন্তু ২৫ মার্চের অভিযান শুরুর পর ইয়াহিয়া খান তা বন্ধ করে দেয়।"
(৪)
কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কবিতা 'মৌনী ফকির' কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কবিতা। মাত্র ১২ বছর বয়সে কবি সেটি রচনা করেন। কবি তখন আসানসোলে রুটির দোকানের কর্মচারী। কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম 'অগ্নিবীণা'। ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে ঐ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। 'বিদ্রোহী' কবিতাটি জার্মান ও ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার। পরবর্তীকালে রুশ, চীনা ও অন্যান্য ভাষায়ও বিদ্রোহী কবিতা অনূদিত হয়। সিরাজগঞ্জের তথা বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী নজরুলের লেখা পড়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন এবং নজরুলকে ১০ টাকা মানিঅর্ডার করে পাঠিয়েছিলেন। তিনি মানিঅর্ডার কূপনে লিখেছিলেন, "তোমার লেখা পড়িয়া খুশি হইয়া ১০টি টাকা পাঠাইলাম। ফিরাইয়া দিওনা, ব্যথা পাইব। আমার থাকিলে দশ হাজার টাকা পাঠাইতাম।" নজরুলের প্রথম মুদ্রিত কবিতা কোনটি? নজরুল ইসলামের প্রথম মুদ্রিত কবিতাটির নাম 'মুক্তি'। যে কবিতাটি নজরুল করাচি থেকে পাঠিয়েছিলেন 'ক্ষমা' নাম দিয়ে। পত্রিকার তরফ থেকে নামটি বদলে দেওয়া হয়। ১৯১৯ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বঙ্গীয় মুললমান সাহিত্য পত্রিকায় কবিতাটি ছাপানো হয়। কাজী নজরুল রচিত কবিতার সংখ্যা কত? কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কবিতার সংখ্যা ৯০০। নজরুলের প্রথম যে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, তার নাম 'যুগবাণী'। ১৯২২ সালে বাংলা সরকার ফৌজদারি বিধির ৯৯-এ ধারায় বইটি বাজেয়াপ্ত করে। বাংলা সরকারের গেজেট বিজ্ঞপ্তির তারিখ ও নম্বর যথাক্রমে ২৩ নভেম্বর ১৯২২ এবং নম্বর-১৬৬৬১পি। সেন্ট্রাল প্রভিনস্ ও বর্মা সরকার যুগপৎ গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে 'যুগবাণী' নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় নজরুলের দুটি কবিতার বই 'বিষের বাঁশী' ও 'ভাঙার গান'। 'বিষের বাঁশী' ও 'ভাঙার গান' বই দুটি বাজেয়াপ্ত করা হয় ১৯২৪ সালে, ফৌজদারি বিধির ৯৯-এ ধারা অনুসারে ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবর গেজেট ঘোষণায় (নং-১০৭২পি) 'বিষের বাঁশী' নিষিদ্ধ হয়। তবে পরাধীন ভারতেই 'বিষের বাঁশী' থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। ভাঙার গান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে অনেকগুলো নিষিদ্ধ বইয়ের মধ্যে নজরুল ইসলামের ৪টি বই রয়েছে। বইগুলো হলো- ভাঙার গান, বিষের বাঁশী, যুগবাণী, চন্দ্রবিন্দু। 'প্রলয় শিখা' কবে এবং কোন ধারায় বাজেয়াপ্ত করা হয়? কোন সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়? 'প্রলয় শিখা' বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে। সরকারি বিজ্ঞপ্তি বের হয় ১৯৩০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর (নং-১৩০৮৭পি) ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২৪-এ ১৫৩-এ ধারানুসারে বইটি নিষিদ্ধ। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় ১৯৪৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারির গেজেট বিজ্ঞপ্তির (নং-৮৫ পিআর) মাধ্যমে। 'প্রলয় শিখা' প্রকাশের জন্য রাজদ্রোহিতার অভিযোগে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কবির ছয় মাসের জেল ঘোষণা করেন। কবিকে গ্রেফতার করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করা হয়। ইতোমধ্যে 'গান্ধী-আরাউইন প্যাক্ট' সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির শর্তানুযায়ী অন্যদের সাথে নজরুলও মুক্তি পেয়ে যান। কিন্তু 'প্রলয় শিখা' বাজেয়াপ্ত থেকে যায়। কবে, কোন ধারায় 'চন্দ্রবিন্দু' নিষিদ্ধ হয়? এ নিষেধাজ্ঞা কবে প্রত্যাহার করা হয়? ১৯৩১ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৯৯-এ ধারানুসারে 'চন্দ্রবিন্দু' নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।