Published : 24 Jul 2021, 06:31 PM
প্লেটো তার কল্পরাষ্ট্র থেকে কবিদের নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। তার পক্ষে যুক্তিও ছিল। কবি সকল মানুষকে সমান আসনে দেখতে চান। সকল ভেদাভেদের উর্দ্ধে মানবতাকে স্থান দিতে চান। এর বিপরীতে রাষ্ট্র চালাতে হলে দরকার হয়ে পড়ে শ্রেণি বিভাজন। রাষ্ট্রে জনগোষ্ঠীর একটা অংশ ক্ষেতে খামারে কাজ করবে, আরেক দল ব্যবসা বাণিজ্য করবে, আরেকদল প্যান্ট-শার্ট-টাই-স্যুট পরে অফিস আদালতে করণিক, কর্মচারী-কর্মকর্তা বা আমলা হিসেবে কাজ করবে। তাই কবিদের ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতে তাদের কল্পরাষ্ট্র থেকে নির্বাসন পাঠানোর যুক্তি একটা খাড়া করেছিলেন মহান প্লেটো।প্লেটো প্রসঙ্গে এখানেই থামি।
কল্পরাষ্ট্র থেকে বাস্তব রাষ্ট্রে ফিরে আসি। বাস্তব রাষ্ট্র প্লেটোর কল্পরাষ্ট্রের চেয়েও ঘোরতর কবিভীরু। অন্য দেশের উদাহরণ দেব না, নিজের দেশের কথাই ধরি। যে দেশে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি, সে দেশে কবিতা লিখে কবির ভাত নাই। আদতে দুই একটা ব্যতিক্রম ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কবিদের অবস্থা ঘোরতর নাকাল। আমাদের দেশে কবি অভিধা কবিখ্যাতি বা কবিপর্যাদা বা কবিপরিচিতির ক্ষীণতম যে জায়গাটি ছিল সেটিও এখন নানা পদধারী-পদলোভী-ক্ষমতাধারী-ক্ষমতালোভী আমলা, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, উকিল-মোক্তার-মোল্লা-পুরোহিত আর ব্যাংকারদের দখলে চলে গেছে।
কবি আর হাইব্রিড কবি আমাদের দেশে হাল আমলের নতুন এক বাস্তবতা। শুধু কবি মানে তিনি প্রকৃত কবি, কবিতাই তার ধ্যান আর জ্ঞান। দিন রাত বারো মাস বছরের শব্দকল্প সুর ছন্দের পেছনে উজাড় করে দেন, কবিতার পেছনে দিয়ে যান জীবনের সমান রক্ত আর আয়ু। তারা বেঁচে থাকার জন্য, রুটি-রুজির জন্য কিছু একটা করেন বটে। কিন্তু সেটা কবিতার অগ্রাধিকারকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। অন্যদিকে অনেক কবি আবার ভাতেও মারা যান, নিগ্রহের শিকার হন, নাজেহাল হন, বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। এরকম উদাহরণ সব দেশেই আছে কম আর বেশি।
হাইব্রিড কবি হচ্ছে তারুণ্যে প্রেমে পড়ার মতো বয়সে কবিতা লিখতেন, পড়তেন, কবিতা ভালোবাসতেন, লেখার হাত ছিল কিংবা ছিল না। কিন্তু কবিতায় স্থিত হননি। জীবনের প্রায় পুরোটা সময় দিয়েছেন অন্য কোনো পেশায় বা কাজে। ধরুন অধ্যাপনায়, সাংবাদিকতায়, আমলাগিরিতে, কিংবা ব্যবসায়। ওসব জায়গায় ফন্দিফিকির করে অবস্থা রমরমা করেছেন। বয়স ও যৌবন খুইয়েছেন, অবসর যাবার পরও চেয়ার বা পদ কোথাও না কোথাও ধরে রেখেছেন- এই ধরুন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, কিংবা কোনো উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক বা উপদেষ্টা কিংবা নিজেই ব্যবসা খুলে বসেছেন। সেই সঙ্গে কবিতাও লিখেন, প্রকাশ করেন, পুরস্কার পান, সংবর্ধনা নেন, সভা সেমিনারে ভালো চেয়ারটা কব্জায় রাখেন। আমি এরকম কবিদেরকে হাইব্রিড কবি বলতে চাই। একই সঙ্গে এইটাও খোলাসা করতে চাই ওইসব পেশায় থেকেও জাত কবি থাকা যায়। এরকম উদাহরণ আছে অনেক, যেমন মোটাদাগে শামসুর রাহমানের কথা বলা যায়। তিনি ছিলেন জীবনের অনেকটা সময় দেশের জাতীয় পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। একইভাবে উল্লেখ করা যায় পাবলো নেরুদা, জসিম উদদীন, টমাস ট্রান্সন্ট্রয়মার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রফিক আজাদ প্রমুখ।
হাইব্রিড কবি অন্য দেশেও আছে। বাইরের হাইব্রিড কবিদের লজ্জা সংকোচ বলে একটা ব্যাপার কাজ করে। তারা জাত বা পেশাদার কবিদের মেলে একটু নাজুক মনোভাব প্রদর্শন করেন। তাদের লজ্জা শরম বলে একটা বিষয় কাজ করে। তারা পুরস্কার ও পদ-পদবীর পেছনে দৌড়ান না। পেশাদার কবিদের ভাড়া ভাতে ছাই দেন না। কিন্তু আমাদের হাইব্রিড কবিদের সেই লজ্জাটুকু নাই।
এরকম বাস্তবতায় প্রকৃত কবিদের উচ্ছেদ হবার মতো অবস্থা। আমাদের দেশে নদী দখল, বনভূমি দখল, জমি দখল, বাড়ি দখলের মতো খান খ্যাতি পদ পদবী আর পুরস্কার দখলের মতো ঘটনাও ঘটে বটে। এই ক্ষেত্রে কবিরা এরকম নির্মম পরিণতির মুখে। এই বিষয়ে আরো কথা বলা যায় বিশদ করে! তার আগে কেন এই মুহূর্তে কবি প্রসঙ্গ নিয়ে এই লেখা সেটাও একটা খোলাসা করা দরকার।
এবারেও একজন কবিকে বাংলা একাডেমির প্রধান নির্বাহী পদে বা মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি হচ্ছেন আমাদের সকলের আপন হুদা ভাই, কবি,মুহম্মদ নূরুল হুদা। তিনি একই সঙ্গে কথাশিল্পী, প্রবন্ধকার, অনুবাদক, সম্পাদক এবং শিক্ষক। তিনি আমাদের দেশের একজন মেধাস্বত্ব বিশেষজ্ঞও বটে। এই পদে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার নিয়োগ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ইতিপূর্বে বাংলা একাডেমিতে কাজ করেছেন সারাজীবন এবং পরিচালক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। তার অভিজ্ঞতা, মেধা আর প্রতিভার সমন্বয় থেকে বাংলা একাডেমির উপকৃত হবার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
এমন এক সময়ে তার নিয়োগ দেওয়া হলো যখন সংসদের ভেতরে ও বাইরে আমলাতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। নতুন নিয়োগ পাওয়া বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের সামনে সুযোগ ও কঠিন বাস্তবতা দুটোই রয়েছে। প্রথমেই সমস্যা-সংকুল বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে চাই।
যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে বাংলা একাডেমির মত প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছিল, গত প্রায় একদশকে আমলাতন্ত্রের মারপ্যাঁচে সেটা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। একাডেমিটি কার্যত একটা ভারবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি আইন অনুযায়ী নতুন প্রবিধানমালা প্রণীত হয়নি। যে কারণে একাডেমি জনবল সংকট, আর্থিক সংকট যেমন মোকাবেলা করছে- তেমনি স্বায়ত্বশাসিত হবার কথা থাকলেও নতুন আইনের কারণে এটি মূলত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি গৎবাঁধা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
মহাপরিচালক এক অর্থে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত মধ্য মর্যাদার একজন সরকারি কর্মকর্তা। অথচ এরকম হবার কথা ছিল না। একাডেমির প্রধান নির্বাহীর মর্যাদা কোনোভাবেই একজন জ্যেষ্ঠ সচিবের নিচে হওয়াটা সঙ্গত নয়। পৃথিবীর অন্যদেশের এরকম একটি একাডেমি প্রধানের মর্যাদা, ভূমিকা আর গুরুত্ব খোঁজ নিয়ে দেখুন। বিগত প্রায় একদশকে একাডেমিতে জনবল নিয়োগ হয়নি, পদোন্নতিও আটকে আছে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের। দক্ষ জনবল সেই অর্থে গড়ে উঠেছি কি না সে প্রশ্নও তোলা যায়। এক দশক আগে পৃথিবী যে জায়গায় ছিল,এখন আর সে জায়গায় নাই। নতুন বাস্তবতার নিরিখে একাডেমির লক্ষ্যও স্থির করার সময় এসেছে।
এক দশকের অধিককাল ধরে একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদে সাধারণ সদস্য এবং একাডেমির ফেলোদের মাঝ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি রাখা হয়নি। কোনো নির্বাচনই আয়োজন করা হয়নি এই দীর্ঘ সময়ে। প্রতিবছর সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হলেও একাডেমির কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা আর বিদ্যমান সংকট নিয়ে কোনো কার্যকর বিতর্ক হয়নি। সবকিছু হাইব্রিডদের কব্জায় থাকলে যা হবার কথা, তাই হয়েছে। এই ধূসর বাস্তবতায় একাডেমির তিন হাজারের মতো সদস্যের মাঝ থেকে এমন কাউকে পাওয়া গেছে কি যিনি এসব বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেছেন? অবস্থা দেখে মনে হয় সবাই তাকিয়ে থাকেন ক্ষমতার কেন্দ্রের দিকে ক্ষমতাধর আমলাদের দিকে কিছু একটা যদি পাওয়া যায় যেমন পুরস্কার, পদ, পদবী, জমি বা বিদেশ ভ্রমণের কোনো সুযোগ কিংবা নিদেন পক্ষে হজ করার একটা টিকেট। লেখকরা যদি এভাবে হাইব্রিড লেখকদের দাপটে চুপসে গিয়ে থাকেন তাহলে উপায় কী?
বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে একটা অরাজকতা চলছে। এর জন্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু গণমাধ্যম, প্রশাসন যন্ত্র, সংসদ ও বিচারালয় কোনো জায়গায় বাংলা ভাষার ভুল ব্যবহারের দূষণ থেকে মুক্ত নয়। যথেষ্ট হয়েছে এই অবস্থা আর চলতে দেওয়া যায় না। সময় এসেছে বাংলা একাডেমির অধীনে অথবা একাডেমির উদ্যোগে ও সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট বিভাগের যোগসাজশে একটা জাতীয় ভাষা উন্নয়ন পরিষদ গঠনের।
আমি অধ্যাপক পণ্ডিতদের, সম্পদকদের এবং প্রশাসনের কর্তাদের প্রথমত কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই। বাংলা বাক্যের ভেতরে আগে বা পেছনে ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে না দিলে কি বাঙালির জাত উঠে যায়? কেউ গোস্যা কইরেন না। যে কথাগুলো সারাদিন বলি, তার থেকে কয়টা কথা ইংরিজির মিশ্রণ থেকে মুক্ত? তারপর কয়জনে শুদ্ধ এক পৃষ্ঠা বাংলা লিখি? অনেক চিঠিপত্র, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বা লেখাজোখা নজরে এসেছে অনেক করতে পণ্ডিতদের হয়ে, তাহাতে ক খ গ ঘ মাথা হেডের মতো অবস্থা।
বাংলা বানানের বিভ্রান্তি দূর করতেই হইবে। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা একাডেমির সঙ্গে একযোগে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে বাংলাভাষাভাষী আমাদের প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোর সঙ্গেও- বিশেষ করে আসাম এবং ত্রিপুরার সঙ্গে। বাংলা একাডেমিকে ক্ষমতাহীন দায়িত্ব দিলে লাভ হবে না, একাডেমিকে আইনগত কর্তৃত্বও দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিতে চাই। বছর কয়েক আগে একটা বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে সুইডিশ কবি কারিন বোইয়ের একটা কবিতা থেকে উদ্ধৃতি ভুলভাবে একটি বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করার পর তা প্রচার হচ্ছিল। সুইডিশ একাডেমির নজরে এলে তারা সে বিজ্ঞাপনটি ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। আমাদের একাডেমীর সেই ক্ষমতা আছে কি?
বাংলা একাডেমির মূল লক্ষ্য বাংলা ভাষা সাহিত্যের উৎকর্ষতা সাধনে কাজ করা। প্রায় বিশ কোটি লোকের দেশে এই কাজটি সহজ নয়। কিন্তু তারপরও যদি একাডেমি বইমেলার মতো একটি অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে, তাহলে কীভাবে কী! এই বইমেলার সঙ্গে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে যুক্ত করে প্রকাশক সমিতিকে সঙ্গে নিয়ে স্বতন্ত্র একটি কোম্পানি বা ইউনিট করে দেওয়া যায়। আর স্বাধীনতার অর্ধশতকে এসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে উপজীব্য করে আয়োজন করা বইমেলাকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক করতে হবে। প্রকাশকদের এব্যাপারে তাদের কুপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ভয় পাবার কিছু নাই, প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকুন।
পৃথিবীর সব সভ্য দেশেই একাডেমিগুলো নিজ নিজ ভাষাগুলোর নিয়মিতভাবে ভুক্তি প্রকাশ করে, নতুন শব্দ যুক্তের কাজে নিয়োজিত থাকে এবং এ ব্যাপারে বিবৃতি বা তালিকা প্রকাশ করে। বাংলা একাডেমি কি গত দশ বছরে মাসভিত্তিক কোনো বিবৃতি প্রকাশ করতে পেরেছে না সে প্রস্তুতি একাডেমির আছে? যেকোন বিদেশি শব্দের অনুবাদের ক্ষেত্রে নিজস্ব শব্দের তালাশ না করে আমরা হুবহু বিদেশি শব্দ চালিয়ে দিচ্ছি। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে এরকম একাডেমির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। প্রসঙ্গক্রমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাই। এই একাডেমির আসলে কাজটা কী? এটি প্রতিষ্ঠা করে আমরা কী ফায়দা নিতে পেরেছি? এটি কি একটা দালান সর্বস্ব মামুলি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে? এই প্রতিষ্ঠানটিকেও বাংলা একাডেমির কিছু কাজের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। এ প্রতিষ্ঠানটিকে কোনোভাবেই শিক্ষামন্ত্রণালয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যুক্তিযুক্ত হয়নি। এটিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে হস্তান্তর করতে বাঁধাটা কোথায়?
মহামারীর কঠিন বাস্তবতায় বাংলা একাডেমিকেও মহামারী পরবর্তী বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে হবে। কাগজের প্রকাশনা আর চলমান যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে ডিজিটাল অগ্রগতির যোগসাজশ বা সমন্বয় রক্ষা করে চলতে হবে। ওয়েবসাইটে সংশ্লিষ্ট অ্যাপ যেমন উন্নয়ন করতে হবে তেমনি যোগাযোগটাও ডিজিটাল করতে হবে।
এবার যে প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম সে বিষয়ে দুই-একটি কথা বলে লেখাটি শেষ করতে চাই। কবিকে মনে করা হয় ভাষার অভিভাবক। নানা কারণে একজন কবিকে বাংলা একাডেমির মতো এরকম প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়াকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কবি নূরুল হুদা একাধিক ভাষায় ঈর্ষণীয় দখলের অধিকারী একজন পরিশ্রমী লেখক, অনুবাদক। সৃজনশীল লেখালেখি নিয়ে তিনি অসংখ্য কর্মশালা আর কর্মসূচির সঙ্গে দেশে বিদেশে সংশ্লিষ্ট থেকেছেন। সর্বোপরি তিনি ধারণ করেন তারুণ্য। আশা করা যায়, তিনি তার ভেতরে থাকা সবটুকু আলোর দ্যুতি বাংলা একাডেমির কার্যক্রমে ছড়াতে পারবেন।
ভাষার অভিবাবক কবিদের দেশ সমাজ ও প্রশাসন থেকে নির্বাসনের সময়ে বাংলা একাডেমির নির্বাহী পদে একজন কবির নিয়োগকে সাধুবাদ জানাই। কাড়াকাড়ির দেশে যাদের দৃশ্য-অদৃশ্য বাড়াবাড়ির সুযোগ আছে, তারা দখলে নেন রাষ্ট্র সমাজের যাবতীয় চেয়ারগুলো। ষোল কোটি মানুষের দেশে একজন কবিকে কেবল হিসেবে বাংলা একাডেমির মতো দুই একটি ছিটেফোঁটা জায়গা ছাড়া আর কোথায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে? আমাদের পরিকল্পনা কমিশন রয়েছে। সেখানে কখনো কোনো কবিকে নেওয়া হয়েছে? অথচ দেশের জন্মলগ্নে প্রাজ্ঞ পণ্ডিত লেখকদের জাতীয় পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে অধ্যাপক আনিসুজ্জানান, কবির চৌধুরী, খান সারোয়ার মুর্শিদের নাম উল্লেখ করা যায়।
এরকম প্রশ্ন তোলা যায় কূটনৈতিক নিয়োগেও। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখুন সামরিক-বেসামরিক আমলাদের মাঝ থেকে অবসরের আগে ও পরে কত কত জনকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
একটি জাতির গণতান্ত্রিক বিকাশ বিবেচনায় এই লক্ষণটাকে বাহবা দেবার সুযোগ নাই। অবসরের পরে একজন আমলাকে যদি চুক্তিতে নিয়োগ দিয়ে ধরেই রাখতে হয়, তাহলে প্রশাসনে বাকি আমলাদের দক্ষতা উন্নয়নে হলোটা কী? তাহলে অবসরের সময় সীমা রাখার দরকারটাই বা কি?
এরকম বিতর্ক শুরু করার এখনই সময় এবং সেটা বাংলা একাডেমির নতুন নিয়োগকে সাধুবাদ জানিয়েই শুরু হতে পারে। নবনিযুক্ত মহাপরিচালকের সাফল্য কামনা করে এই লেখার ইতি টানতে চাই। মহাপরিচালক হবার পূর্বে অনানুষ্ঠানিক নানা আলাপে যে উচ্ছাস আর আক্ষেপের সুর আপনার কণ্ঠে ধ্বনিত হতো, এখন সুযোগ এসেছে সেই সবের কুলকিনারা করার।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে আপনার ভেতরের তারুণ্যের উচ্ছাসের সঙ্গে নব নব তরুণরাও সুর খুঁজে নেবার জায়গা পাবেন সেই আশাও রাখি। তরুণ লেখক প্রকল্পের মত নতুন নতুন কর্মসূচিও চালু হতে পারে আপনার হাত দিয়ে। আবার অনুবাদ তো আপনার নিজের এলাকাও। তার সঙ্গে যোগ করবেন দুনিয়ার অন্যান্য একাডেমির সঙ্গে বোঝাপড়া আর অংশীদারিত্বের সম্পর্ক। আন্তর্জাতিক সাহিত্যসম্মেলনটিও নতুন করে শুরু হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধু লেখক ট্রাস্ট পুনরুজ্জীবনের আলোচনাও আপনার মাধ্যমে শুরু হতে পারে।