Published : 03 Jul 2021, 06:39 PM
ডারউইনের 'যোগ্যতমের টিকে থাকা' তত্ত্ব এবং ম্যালথাসের 'প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সংখ্যা তত্ত্ব' মেনে নিলে বাংলাদেশের সমতলের আদিবাসীরা টিকে থাকার লড়াইয়ে সবচেয়ে বিপদজনক অবস্থানে রয়েছেন। ডারউইনের আর ম্যালথাসের তত্ত্বকে শতভাগ মেনে না নিলেও বলা যায়, সমতলের আদিবাসীরা টিকে থাকার সংগ্রামে মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌত এবং প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পিরামিডের তলানিতেই রয়েছেন।
একথা বহুলভাবে প্রচারিত হচ্ছে, এক বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন অবস্থানের উন্নতি হয়েছে তিন ধাপ। ১৮৯টি দেশকে অতি উন্নত, উন্নত, মধ্যম এবং নিম্ন মানব উন্নয়নের চারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। ইউএনডিপির 'মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন- ২০১৮' থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ রয়েছে মানব উন্নয়নের মধ্যম দেশের স্তরে। প্রতিবেদনে ১৮৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১৩৬তম স্থানে, যার বর্তমানে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৮৫৫ ডলার। তাছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সর্ব্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার প্রসার উন্নয়নের একটি বিশেষ চিত্র তুলে ধরলেও প্রকৃত চিত্র বলছে এখনও অনেক মানুষ উন্নয়নের তলানিতেই পড়ে আছে। দেশের ২৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে, যার মধ্যে ১২ শতাংশই হতদরিদ্র। এ হতদরিদ্রদের মধ্যে যাদের অবস্থান সবচেয়ে বেশি নিচে তারা হলেন- সমতল ও পাহাড়বাসী সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক মুসলিম-অমুসলিম 'অচ্ছুৎ' দলিত সম্প্রদায়। ১২ শতাংশ মানুষের মধ্যে এরাই ৭৫ লাখ অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ।
আবার এ ৭৫ লাখ হতদরিদ্রের মধ্যে সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসী মানুষের সংখ্যা ২৫ লাখ। ৫০ লাখ জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুৎ মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ''ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য গৃহিত উন্নয়ন কর্মসূচি'-তে সমতলের আদিবাসী মানুষের সংখ্যা ২০১১ সালের জাতীয় জরিপ বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে- ১৫ লাখ ৮৬ হাজার এর কিছু বেশি।
ফিলিপ গাইন সম্পাদিত 'Survival on the fringe: Adibashis of Bangladesh' বইতে জাতীয় জরিপ ১৯৯১ ও ২০০১-কে ভিত্তি ধরে বলা হয়েছে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের মোট জনসংখ্যার দেড় শতাংশ হলেন আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যারা মোট আদিবাসী সংখ্যার ২৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। সে হিসেবে ১৫ লাখ সমতলের আদিবাসী রয়েছেন এবং এ বিচারে সমতলের আদিবাসীরা পাহাড়ের আদিবাসী অপেক্ষা সংখ্যাগুরু।
কেবল মাথাপিছু গড় আয়ের উলম্ফন দিয়ে এ মানুষগুলোর বেঁচে থাকার বহুমাত্রিক প্রান্তিকতা বিচার সম্ভব নয়। দীর্ঘ সাত বছর বাংলাদেশের সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে ওতপ্রোতভাবে কাজ করে অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে এ লেখায় পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হয়েছে শতাব্দীর অতীতকাল থেকে সমতলের আদিবাসী গণগোষ্ঠী এ ভূখন্ডে বসবাসরত থাকলেও কেন তারা আজও তাদের মৌলিক অধিকার এবং চাহিদা থেকে বহুমুখী বঞ্চনার শিকার।
এদেশের উন্নয়ন কাণ্ডারীদের অধিকাংশই মনে করেন, আদিবাসী গণগোষ্ঠীর পিছিয়ে থাকার জন্য দায়ী আদিবাসীরা নিজেরাই। বিশেষ করে সরকারী উন্নয়ন কর্মকর্তা এবং আমলারা মনে করেন, সমতলের আদিবাসীদের বঞ্চনার কারণ হচ্ছে এদের প্রথাগত অভ্যাস, আচার-আচরণ, সামাজিক আচার, ধর্ম, ভূমিকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা এবং অশিক্ষা। আরাম কেদারায় বসে এসব উন্নয়ন বিশারদরা বলেন- আদিবাসীরা অন্য সম্প্রদায়ের সাথে মিশতে জানেনা। তারা দূরবর্তী এবং দুর্গম এলাকাতে থাকতে পছন্দ করে। শহরমুখী হতে চায় না। তাই আধুনিক জীবনের সুবিধা থেকে তারা স্বাভাবিকভাবেই বঞ্চিত। আদিবাসী সম্প্রদায় নানা পালা-পার্বণে, উৎসবে চোয়ানি, হাড়িয়া, মদ পান করে তাই অন্যান্য সম্প্রদায় বিশেষ করে মুসলিমরা তাদের সাথে মিশতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। আদিবাসীরা মদ পান করে বলে তারা ভদ্র সমাজে এসে সুশীল আচরণ করতে পারেনা।
উন্নয়ন দ্রষ্টাদের এসব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করছি না। কিন্তু বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতার কারণে পিছিয়ে থাকার মৌল কারণগুলো ছাপিয়ে গৌণ কারণগুলো সম্মুখে চলে আসে। বাংলাদেশের সমতলের আদিবাসী সম্প্রদায় কোন কোন মৌলিক কারণে সমাজের তলানিতে পড়ে আছে প্রবন্ধটিতে সে বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে। আর আদিবাসী জনগণের সাথে সরাসরি সরেজমিন কথোপকথনের ভিত্তিতেই এটি লেখা। তবে আলোচ্য লেখায় নওগাঁর পত্নীতলা এবং দিনাজপুরের বিরল ও পার্বতীপুর উপজেলার তিনটি আদিবাসী গ্রামের মানুষের নিজস্ব বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তাদের উপর চাপিয়ে রাখা অসমতার চিত্রটি দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।
সুলতানপুর গ্রামের ভূইয়া/মুশহর সম্প্রদায়
ভারতবর্ষে সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হুল (১৮৫৫) সম্পর্কে বাঙালি ও সমতলের আদিবাসীদের কার না জানা রয়েছে। তবে এ বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমনের পর অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় বাঙলা অঞ্চলে বিশেষ করে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অভিবাসন নিতে বাধ্য হয়। নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের ভূইয়া/মুশহর সম্প্রদায় হুল বিদ্রোহ দমনের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলার দুমকা থেকে অধুনা বাংলাদেশে চলে আসে। এ সম্প্রদায় অতীতকালে বনচারী এবং শিকারী জাতি ছিল। এরা সাপ, গুইসাপ, কুইচ্চা শিকার, কন্দ-মূল-ফল সংগ্রহ করতো। দারাশ আর গুই সাপ শিকার করে চামড়া ছিলে অনেক দামে বিক্রি করতো। এখন আর সাপ-গুইসাপ-কাছিম নাই, নাই কুইচ্চা- তাই সনাতনী জীবিকা হারিয়ে গেছে অনেক কাল আগে। উনিশ শতকের শেষভাগে কাবুলিওয়ালাদের দেখেছে মুশহর সম্প্রদায় এ দেশে। সুদীর্ঘ অতীত কাল থেকে সুলতানপুর গ্রামের ভূইয়া বা মুশহর সম্প্রদায় বসবাস করলেও তাদের আদিবাসী বলে স্বীকার করে না এ অঞ্চলের বাঙালি সম্প্রদায়। গোড়াপত্তনের সময় থেকে দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে কাবুলিওয়ালারা সুদের ব্যবসা করতে শুরু করে মুশহর সম্প্রদায়ের মধ্যে। সুলতানপুর ভূইয়া বা মুশহর সম্প্রদায়ের মানুষ আইয়ুব খানের আমলে নওগাঁ জেলার ধামুইর হাট অঞ্চলের ধুরইল এলাকায় বসবাস আরম্ভ করেন। কিন্তু পানির অভাবে ধুরইল এলাকায় চাষাবাদের অপর্যাপ্ততার কারণে কঠিন দারিদ্রের শিকার হয়ে জীবিকা খুঁজতে ধুরইল হতে পত্নীতলার সুলতানপুর গ্রামে চলে আসতে বাধ্য হয়। তৎকালীন করিম চেয়ারম্যানের জমিতে তিন পুরুষ আগে থেকে কৃষি শ্রমিক হিসেবে জীবিকা শুরু করে এবং স্থায়ীভাবে বসবাস গড়ে তোলে। মুশহর সম্প্রদায় এ অঞ্চলে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ভূমিদাস হিসেবে বসবাস করলেও নিজেদের নামে জমির মালিকানা নেই। ক্ষুধার জ্বালা থেকে বাঁচতে পচা ভাতের সাথে রানু লতার বড়ি মিশিয়ে পচানি বানিয়ে নিজেরা পান করে আর বাচ্চাদের পান করিয়ে পরিবারের সবাই মিলে অচেতন হয়ে ঘুমিয়ে দিন পার করে।
পাঁচ দশক ধরে সুলতানপুর গ্রামে ১১০ পরিবার বসবাস করলেও আজও জমিতে তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমনকি তাদের মৃতদেহ সৎকার করাও খুব কঠিন। বন্যা হলে লাশের গলায় কলসি বেঁধে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। শুকনা মওসুমে দেড় কিলোমিটার দূরে খাস জমিতে লাশ পুঁতে রাখা হয়। কিন্তু সেই খাস জমি যেসব বাঙালিদের দখলে, তারা চাষাবাদের জন্য কবর খুঁড়ে লাশগুলো তুলে ফেলে, তখন সেগুলো শিয়াল-কুকুরের খাবারে পরিণত হয়। মরা পোড়াতে গেলে অনেক খরচ লাগে তাই লাশ পোড়াতে পারেন না এ আদিবাসীরা। কাঠ, সরিষা, ঘি কেনার পয়সা কোথা থেকে জুটবে? তাই নামমাত্র মুখাগ্নি করে অধিকাংশ মরা রাস্তার ধারে ধারে মাটি চাপা দিতে হয়। সুলতানপুরের আদিবাসী মানুষদের ভূমিহীন করে রাখা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এ সম্প্রদায়ের নৃতাত্বিক পরিচয় কী তা পরিষ্কার নয়। কোন নৃতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালিত হয়নি অদ্যাবধি। বয়স্ক যারা বেঁচে আছেন তারা বলছে নানা পরিচয়ের কথা। কেউ বলছেন আমরা ঋষি, কেউ বলছেন মুশহর আবার কেউ বলছেন আমরা জাত-বেহারা। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, সনাতনী নৃতাত্ত্বিক পরিচয় হারিয়ে আজ তারা নিজেদের ভূইয়া বলে পরিচয় দিচ্ছেন। কারণ ভূইয়া পরিচয়ে তাদের তথাকথিত সামাজিক মর্যাদা বাড়ে। আদিতে এ সম্প্রদায় প্রকৃতি পূজারী ছিল। সূর্য পূজা এ সম্প্রদায়ের প্রধানতম উপাসনা। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে সনাতন হিন্দু ধর্ম প্রভাব বিস্তার করে। এরা এখন বিষহরি/মনসা পূজা, কালী, দুর্গা, লক্ষ্মী পূজা, কারাম বন্দনা করেন। খ্রিস্টধর্মের যাজকদের প্রভাবে অনেকে খ্রিস্টান হয়ে গেছেন। তবে সনাতন ধর্মের সব পার্বণ পালন করে থাকেন। নানা ধর্মিয় পার্বণে নানা রকম খাবার এর সাথে হাঁড়িয়া বানান এবং পান করেন সনাতনী ধর্মীয় উপাচার হিসেবে। হাঁড়িয়া এই সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির অংশ। মাদল প্রধান বাদ্যযন্ত্র, নানা পালা-পার্বণে দলবেঁধে নাচ ও গান করেন। অতীতে ভাদ্রমাসের পূর্ণিমা তিথির পরদিন এ রকমই উৎসব হতো। এখন সে উৎসব নেই। তবে এই সময়টায় এরা ধুমধামের সঙ্গে মনসাকে স্মরণ করে। মুশহরদের কাছে মনসা হলো বিষহরী, জিন্দা দেবতা। বিষহরী পূজার পরদিন বিকেলে এখানে আয়োজন চলে 'তুমরি' খেলার। এটি আদিবাসীদের প্রাচীন তন্ত্রমন্ত্র খেলা। আশপাশের উপজেলা থেকে নামকরা সব ওঝা অংশ নেন এ খেলায়। ওই দিন রাতে মুশহর গ্রামে চলে নাচ-গান আর ধাঁধাঁর আসর। একই সঙ্গে প্রিয় পানীয় হাড়িয়া আর চুয়ানি বাড়িয়ে দেয় আদিবাসীদের আনন্দকে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে আচার, প্রথা, অনুষ্ঠান এবং ধর্মের কারণে এ সম্প্রদায়ের মানুষ নানাবিধ বৈষম্যের শিকার। এ বৈষম্য চলে গেছে ইস্কুল, কলেজ, বাজারে এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে। তাই বৈষম্যের হাত থেকে বাঁচতে এ সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরা নিজের নামের প্রথম অংশ দিয়ে পরিচয় দেয়, নামের শেষে সম্প্রদায়ের টাইটেল তার ব্যবহার করে না। যেমন- রাজু ভূইয়া না বলে শুধু রাজু নামে পরিচয় দেওয়া হয়। স্কুলের নিবন্ধন থেকে শুরু করে জাতীয় পরিচয়পত্রেও তাদের সম্প্রদায়ের টাইটেল খুঁজে পাওয়া যায়না। মেয়েরা সনাতনী পোশাক পরা ছেড়ে বেছে নিয়েছে সালোয়ার-কামিজ। মাথায় নেকাব ব্যবহার শুরু করেছেন কেউ কেউ। সালোয়ার-কামিজ আর নেকাব পরায় অনেকে তাদেরকে এখন মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বলে মনে করেন। সুলতানপুরের আদিবাসীরা এখন পরিচয়ে এবং পোশাকে মুসলিম হয়ে বসেছে।
এ সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা আছে। এরা মুশহর ভাষায় কথা বলেন। তবে তাদের অনেকেই মাতৃভাষার নাম পর্যন্ত বলতে পারেনি। এদের এ ভাষা অস্ট্রো-এশীয় ভাষার নানা শাখার মধ্যে রাঢ়ী উপভাষার অন্তর্গত (ভাষাতাত্ত্বিক শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অনুসারে)। কোন এককালে মুশহর ভাষার বর্ণলিপি ছিল। মিশরীয় বর্ণমালার মত প্রতিটি হরফ ছিল প্রতীকী। একেকটি বর্ণ ছিল একেকটি ছবি। হাল আমলে বাঙলা ব্যবহার অনেক বেড়েছে, কেননা মুশহর ভাষার বর্ণমালা আর বেঁচে নেই। মুশহর সম্প্রদায় মণ্ডল শাসিত। সনাতনী পদ্ধতিতে পারিবারিক ক্রম অনুসারে মণ্ডল নির্ধারিত হয়। নিজস্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে মুশহরদের বিয়ে হয়ে থাকে। অন্য আদিবাসীদের সাথে বিয়ে হতে পারে, তবে মুসলিম ও বাঙালি ছাড়া। সামাজিক চাপের মুখে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে নিজের পরিচয় হারিয়ে আজ তারা ভূইয়া নামে পরিচিত হতে বাধ্য হচ্ছে।
হালজায়-ঝিনাইকুরি গ্রামের কড়া সম্প্রদায়
বাংলাদেশের সমতলের কম-বেশি ৩০টি আদিবাসীর মধ্যে কড়া একটি আদিবাসী গোষ্ঠী। নিজস্ব ধারার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লালন করে এ গোষ্ঠী গড়ে তুলেছে বৈচিত্র্যময় জীবন প্রণালী। অতীতে প্রায় ৪০০ কড়া পরিবার এ অঞ্চলে বসবাস করলেও বর্তমানে জাতিটি এ দেশ থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এদেশে কড়া আদিবাসীদের একমাত্র গ্রামটি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হালজায় মৌজায়। এখানে বর্তমানে বাস করে ২৪টি পরিবার। এছাড়াও দিনাজপুরের বৈরাগীপাড়ায় একটি এবং সদর উপজেলার ঘুঘুডাঙার খাড়িপাড়ায় রয়েছে আরও দুইটি কড়া পরিবার। কড়া শব্দের অর্থ 'খোঁড়া'। অর্থাৎ যারা মাটি খনন করে পুকুর, খাল বা রাস্তা নির্মাণ করত তাদেরকে কোড়া বা কড়া নামে সম্বোধন করা হত। যতদূর জানা যায়, কড়া সম্প্রদায়ের আদিনিবাস আন্দামান দ্বীপে। পরে তারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং এক অংশ রয়ে যায় উড়িষ্যা অঞ্চলে, অন্য অংশ চলে আসে রাঢ় অঞ্চলে। আরও পরে একটি অংশ নবাবী আমলের শেষে বা ব্রিটিশ আমলের শুরুতে বর্তমান বাংলাদেশের বরেন্দ্র এলাকায় বসবাস শুরু করে। এদের প্রধান কাজ ছিল জঙ্গল হাসিল করে কৃষিকাজের উপযুক্ত জমি তৈরি করা, পুকুর বা খাল কাটা। অনন্যা আদিবাসীদের মত কড়ারাও বন্য পশু যেমন বেজি, খরগোশ, ইঁদুর, বনবিড়াল, কাঠবিড়ালি, খেরাম, খাটাশ, গঞ্জর শিকার করতেন। নদীনালা, খালবিল চষে কুচিয়া, ঝিনুক, ঘংঘি, শামুক, কাঁকড়া সংগ্রহ করতেন।
কড়ারা বেশ কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত যেমন- মুদি, মুন্ডা, ওরাও, ধাঙ্গর, কুমরি। এ থেকে অনুমান করা যায়, হয়তো কড়াদের থেকেই মুন্ডা, ওরাও, ধাঙ্গর, কুমরি ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। বর্তমানে অনেকেই সনাতন ধর্মের পূজা-পার্বণ করলেও তাদের প্রধান দেবতা 'বুঙ্গা বুরু'। তারা বিশ্বাস করেন সকল রোগব্যাধি বা বালা আসে 'বুঙ্গা'র কারণে। পৌষ মাসে পালন করেন 'পৌষ পার্বণ'। এ পার্বণের দেবতা 'আকেন বুঙ্গা'। এছাড়াও মনসা, কালী ও শিবের পুজা করে থাকেন তারা। পাশাপাশি তারা শিশু জন্মের পঞ্চম দিনে 'পাঞ্চুত', বিয়ের সময় 'ডুতাম' এবং মৃত্যুতে 'রাপা সেনিহা' উৎসব পালন করেন। তাদের আরেকটি প্রধান উৎসব হচ্ছে 'রাখাল উৎসব'। ফসল কাটার পরে, খোলা মাঠের গোপন জায়গায় একটা ডিম পুতে রাখা হয় । তখন সবার সব গরুকে মাঠের মধ্য থেকে নিয়ে আসা হয়, যার গরু লুকানো ডিম ভেঙ্গে ফেলে তাকে উৎসবের সমস্ত খরচ বহন করতে হয়। রাখাল পূজা উৎসবে টক, গম, ভাত, কাউন চাল ব্যবহার করে হাঁড়িয়া তৈরি করতেন ও সমাজের সবাই মিলে তা পান করতেন। মারুয়ার রুটি, খেসারি ও মুসুরির মিশিয়ে তৈরি করা লাগের বা ঘণ্ট ছিল তাদের অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য। কড়া সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ছিল পাগড়ি, ধুতি, পান্দরি এবং পেন্ত্রি (ধুতির মতো পোশাক)। পাগড়িতে তারা ময়ূর এবং অন্যান্য পাখির পালক ব্যবহার করতেন। কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেছে।
অনন্যা আদিবাসীদের মত কড়ারাও ছিলেন নিজ গোত্রে বিয়ের প্রথায় বিশ্বাসী। কিন্তু স্বগোত্রের জনসংখ্যা কমে যাওয়ায় কড়া জনগোষ্ঠী তুরি, ওরাও, বুঁন সম্প্রদায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে শুরু করে। কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের এবং ভাষাগত ফারাক থাকার কারণে সাঁওতাল ও বাঙালিদের সাথে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপনে এ জনগোষ্ঠীর লোকেরা বিরত থাকেন। আগে বিয়ের প্রথায় ছেলের বাড়ি থেকে মেয়ে পক্ষকে বিভিন্ন রকম পণ দেওয়ার প্রচলন ছিল। বর্তমানে তা পালটে গেছে। এখন মেয়েপক্ষকে ছেলের বাড়িতে পণ পাঠাতে হয়।
কড়া গ্রামের ৭১ শতাংশ কড়াদের চাষের জমি দীর্ঘদিন ধরে জোরপূর্বক দখল করতে চেয়েছে বাঙালি দখলদাররা। এ জমিনে কড়ারা ধান আবাদ করেন। মওসুমে বেগুন, আলু, মরিচ, টমেটোসহ নানা সবজি আবাদ করেন। কিন্তু এখন জমিগুলো অনাবাদী পড়ে আছে। কড়া গ্রামের সবার উত্তরাধিকার সূত্রের জমিই আজ বাঙালিদের ভূমিদখলের অব্যর্থ নিশানা। কড়ারা কোথাও কোনও বিচার পাননি। মুক্তিযোদ্ধা থপাল কড়াদের প্রায় ৫ বিঘা এবং মুক্তিযোদ্ধা কিনা কড়ার ৭ বিঘা জমিও আজ জবরদখল হয়েছে। একইভাবে কামান কড়ার ২ বিঘা, যগেন কড়ার ৩ বিঘা, কেদু কড়ার ৫ বিঘা, কৃষ্ণ কড়ার ৪ বিঘা, রঞ্জন কড়ার ৪ বিঘা, বিমান কড়ার ৩ বিঘা, কাটমার কড়ার ২ বিঘা, কাইচাল কড়ার ২ বিঘা, রতন কড়া ৩ বিঘা, অঞ্জল কড়ার ৪ বিঘা, বাবা কড়ার ২ বিঘা, গোপেন কড়ার ২ বিঘা, সমারু কড়ার ২ বিঘা, মানিক কড়ার ২ বিঘা, শুনিয়া কড়ার ৫ বিঘা জমি বাঙালিরা নানাভাবে নানাসময়ে জোরজবরদস্তি করে বেদখল করেছে। একটা সময় হালজায় ও রাঙ্গন-ঝিনাইকুড়ি মৌজার প্রায় ৫২ একর (১ একর = ৯৬ শতক) জমি ছিল কড়াদের। এর ভেতর অধিকাংশই কড়াদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পত্তনি জমি। দেশ স্বাধীনের পর থেকে কড়াদের প্রায় ৪৫ একর জমিই জবরদখল হয়ে গেছে। কোনোমতে টিকে থাকা মাত্র ৫ একর জমি নিয়েই কড়াদের নিরন্তর সামাল দিতে হচ্ছে বাঙালি হামলা।
জমি সংক্রান্ত হামলার বাইরেও আদিবাসী কড়া সম্প্রদায় বহুমুখী বৈষম্যের শিকার। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই সনদ এবং সম্মানী পাননি। এদের মধ্য থপাল কড়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বর্তমানে চলৎশক্তিহীন অবস্থায় রয়েছেন। তার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ১৯৮৮ সালের বন্যায় নষ্ট হয়ে যাবার পর তিনি আর তা নতুন করে ওঠাতে পারেন নি। পরিতাপের বিষয়, স্থানীয় একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তার কাছে সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য ৩০০০ টাকা দাবি করেন; কিন্তু সেই টাকা দেবার সামর্থ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা থপাল কড়ার না থাকায় তিনি আজও সনদ পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। যে বীরেরা দেশকে শত্রুমুক্ত করতে শত্রুর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন বুক পেতে, আজ তাদেরকেই মাথা নিচু করে বাঁচতে হচ্ছে দারিদ্র্যের কারণে। এ লজ্জা পুরো জাতির!
পার্বতীপুর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের সাঁওতাল সম্প্রদায়
হাবিবপুর গ্রাম, আদিবাসীদের কাছে যা চিড়াকূটা নামে পরিচিত। এ গ্রামে ৫৬ পরিবার সাঁওতাল সম্প্রদায় বাস করে। গ্রামের সিংহভাগ আদিবাসী মানুষ জীবিকার জন্য কৃষি কাজের উপর নির্ভিরশীল। তাই গ্রাম সংলগ্ন কৃষি জমিই তাদের জীবিকার একমাত্র সম্বল। জমির মালিকানা, কাগজ, দলিল নিয়ে দীর্ঘ দিনের সমস্যার জের ধরে ২০১৫ সালের এক সকালে ভূমিদস্যুরা সেখানে হামলা চালালে বাঙালি মুসলিম আর সাঁওতালদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। সংঘাতের এক পর্যায়ে সাঁওতালদের তীর-ধনুকের আক্রমণে একজন বাঙালি কৃষক মারা গেলে চিড়াকূটা গ্রাম আর পাশের গ্রামের বাঙালিরা সাঁওতাল আদিবাসী গ্রাম আক্রমণ করে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। ভূমিদস্যুরা শুধু হামলা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, আদিবাসীদের সহায়-সম্বল সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যায়। এমনকি গ্রামের টিউবওয়েল পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায় এবং ঘটনাস্থল ত্যাগের আগে আদিবাসীদের বাড়ি-ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয় ও গর্ভবতী একজন নারীসহ আদিবাসী নারীদের মারধর ও শ্লীলতাহানি করে। পুলিশি হয়রানির ভয়ে সাঁওতাল পুরুষেরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। নারী এবং শিশুরা সহায় সম্বলহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে খুবই মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকে। এ ঘটনাটি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আদিবাসীদের সাথে ভূমিদস্যুদের সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার পরে ভূমিদস্যুরা খুবই চতুরতার সাথে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে আদিবাসীদের পুরো গ্রামটিকে ধূলিস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। নিহতের পরিবারের পক্ষে ২৮ জনের নামসহ ১৪ জনকে অজ্ঞাত করে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে সংঘাতপূর্ণ জমি জেলা প্রশাসক নিজের এখতিয়ারে এনে পুলিশি প্রহরা বসান। সময় গড়িয়ে গেলে পরবর্তীতে সেই জমি সাঁওতাল আদিবাসী নয়, বরং বাঙালি মুসলমান কৃষকদের করায়ত্ব হয় এবং এখন তারাই ভোগ দখল করছে।
বৈষম্যের মৌলিক কারণ
সুলতানপুর গ্রামের ভূইয়া/মুশহর সম্প্রদায় এবং হালজায়-ঝিনাইকুরি গ্রামের কড়া সম্প্রদায় কেন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন সেটি বিশ্লেষণ করলে আমরা যা পাই তা হলো-
আদিবাসী হিসেবে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় এবং রাষ্ট্র কর্তৃক সমতলের আদিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় অস্বীকার করা। তাদের পরিচয় অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে তাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। পরিচয় সংকটের কারণে আদিবাসীরা তাদের সংবিধানিক অধিকারসমূহ সম্পর্কে অজ্ঞানতায় রয়ে গেছেন।
ভূমি দখলের মধ্য দিয়ে সমতলের আদিবাসীদের সঙ্গে ভূমির সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে তাদের জীবিকার পথও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে তাদের নিজস্ব ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা এবং দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সমতলের আদিবাসীদের জমির মালিকানা প্রচলিত ভূমি রেজিস্ট্রেশন নীতিমালার আওতায় নির্ধারণ করা হয়৷ দলিল, পর্চা, নামজারি সবই প্রযোজ্য৷ কিন্তু তাদেরও কৌশলে উৎখাত করা হচ্ছে৷ জমির জাল কাগজ-পত্র, গায়ের জোর, ভয় আর প্রতারণার মাধ্যমে তাদের উৎখাত করা হচ্ছে৷ সমতলের আদিবসীদের ভূমি যাতে কেউ তাদের ঠকিয়ে না নিতে পারে, সেজন্য আইন আছে৷ কিন্তু সেই আইনে তাদের জমি রক্ষা পাচ্ছে না৷
অদিবাসীদের সনাতনী জীবন প্রথা, আচার, ধর্ম, উৎসব, অভ্যাস ইত্যাদির প্রতি বৃহৎ সমাজের কটাক্ষ, বৈষম্য, ঘৃণা এবং রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিজস্ব ঐতিহ্যগত বৈচিত্রতা হারানোর পথে। এই সংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে আদিবাসীদের ভাষা, পোশাক, জীবনাচরণ ও পরিচয় হারাতে বসেছে।
নেতিবাচক সংস্কৃতিক অভিযোজন যেমন নিজস্ব ভাষার বদলে বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং পড়ালেখা করে, সনাতনী পোশাক ছেড়ে সালোয়ার-কামিজ, হিজাব ব্যবহার, স্কুল রেজিস্ট্রেশন, ভোটার রেজিস্ট্রেশন এবং জাতীয় পরিচয়পত্রে গোত্রের টাইটেল ব্যবহার না করার মধ্য দিয়ে বাহ্যিকভাবে মুসলিম বলে পরিগণিত হওয়ার মধ্য দিয়ে হীনমন্যতার সংস্কৃতিতে সমতলের এসব আদিবাসীরা বাস করছেন।
আইনের অনুপযুক্ত অথবা সীমিত প্রয়োগ। আইএলও'র ১০৭ তম সভায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয় যে, আদিবাসীরা যে অঞ্চলে বসবাস করবে সে অঞ্চলে তাদের সম্পত্তি অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে এবং সম্পত্তির অধিকারে তাদের কোনভাবেই সুবিধাবঞ্চিত করা যাবেনা। ২২ জুন ১৯৭২ এর এই সভায় অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও এ বক্তব্য সমর্থন করে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের রাষ্ট্র কী করছে?
আদিবাসীদের পিছিয়ে থাকার কারণ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়নে আদিবাসীদের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নেওয়া। একটি উদাহরণ; সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিনের। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকার পরবর্তী মেয়াদে সে দাবি বাস্তবায়ন করবে বললেও এখন পর্যন্ত তা কোনও আলোর পথ দেখেনি।
গবেষণা ও লেখায় সহযোগিতা করেছেন: আবুল হাসনাত এবং ভুপেশ রায়।
ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক