Published : 22 Jun 2021, 08:04 PM
আওয়ামী লীগের ৭৩ তম প্রতিষ্ঠার দিনের দুই দিন আগে গত ২০ জুন দেশের ৫৩ হাজার ৩৪০টি পরিবারকে ২ শতক জমির মালিকানাসহ সেমিপাকা ঘর উপহার দেওয়া উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, "মুজিববর্ষে সব ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষ ঘর পাবে। একজন মানুষও আর ঠিকানাবিহীন থাকবে না।" জাতির জনক এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, "মানুষ একটা ঘর যখন পায়, তার মধ্যে যে আনন্দ, তার মুখে যে হাসি, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু নয়। আমি মনে করি, আমার জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না।"
এর আগে জানুয়ারি মাসে প্রথম দফায় ৬৯ হাজার ৯০৪ টি পরিবারকে ঘর উপহার দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় থেকে একটি বিস্ময়কর রেকর্ড তৈরি করেছে। এর আগেও এক মেয়াদে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দেশ নিঃসন্দেহে এগিয়ে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় মানুষের জীবনমানের অবশ্যই উন্নতি হচ্ছে। তবে শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সবসময় বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ অনুসরণ করে চলছে কি না, তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ আছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে নীতি-আদর্শের পরিবর্তনও হয়তো অস্বাভাবিক নয়। তবে দেখার বিষয়- দৃষ্টি সামনে না পেছনে।
দেশের পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে ৭৩ বছরে পা দিল। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আড়াই-তিনশ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামের একটি নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম বার্তা ঘোষণা করা হয়েছিল। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে নতুন দলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার বাহাত্তর বছর অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় দল।
বাংলাদেশের মানুষ সবাই হয়তো আওয়ামী করেন না, অনেকেই আছেন বরং চরম আওয়ামী লীগবিরোধী। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নাকচ করা বা বাতিল করার উপায় কারও নেই। বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগকে আলাদা করা যাবে না। আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ হারলে বাংলাদেশ হারে– এটা কোনও বুলি মাত্র নয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বদানকারী দল মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই গণবিরোধী ভূমিকা এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতির পাঁকে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানের পূর্ব অংশে মুসলিম লীগ রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের হাতে। উপেক্ষিত হন মুসলিম লীগের মধ্যে উদার ও অগ্রসর চিন্তার ব্যক্তিরা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেকে ছিলেন এই ধারায়। এরাই মূলত আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন। প্রতিষ্ঠার ছয় বছরের মাথায় দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ রাখা হয়।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ পথযাত্রার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অনেকই এই দলের নেতৃত্ব দিলেও মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই আওয়ামী লীগ এগিয়েছে। আবার আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়েই বঙ্গবন্ধুও এগিয়েছেন। প্রথম কমিটিতে শেখ মুজিব ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত দলের সভাপতি ছিলেন মাওলানা ভাসানী। ১৯৫৭ সালে ভাসানী ন্যাপ গঠন করলে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ। ১৯৬৪ সালে তর্কবাগীশ সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ সালেই শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বলা যায়, শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ এবং ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাজনীতির এক বড় মোড় পরিবর্তন ঘটে।
বলা প্রয়োজন যে, ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন ছিলেন একজন অসম্ভব প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ এবং শেখ মুজিবের বিশ্বস্ত সহযোগী। দলের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ মুজিব যে তার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেকটা বাধাহীনভাবে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তার একটি বড় কারণ তাজউদ্দীন আহমদের ধীরস্থির পরিকল্পনা এবং নিখুঁতভাবে তার বাস্তবায়ন।
মুজিব-তাজউদ্দীনের সমন্বিত রাজনীতি একদিকে আওয়ামী লীগকে বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, অন্যদিকে দেশের রাজনীতিও একটি বিশেষ লক্ষ্যাভিমুখে অগ্রসর হয়েছে। আওয়ামী লীগের হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্ক শেখ মুজিব হলেও তাজউদ্দীন ছিলেন সেই মস্তিষ্কের অনেকটা জুড়ে।
নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগকে নতুন মুখাবয়ব দিয়ে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য শেখ মুজিবের ভূমিকাই মুখ্য। আওয়ামী লীগের জন্য তিনি সারা বাংলায় চারণের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন। কত মানুষের কাছে গেছেন, কত মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। তারপর এটাও ঠিক যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের এমন কিছু নেতা ছিলেন যারা শেখ মুজিবের অনুসারী ছিলেন, বিশ্বস্ত ছিলেন। ময়মনসিংহে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রাজশাহীতে এ এইচ এম কামরুজ্জামান, পাবনায় এম মনসুর আলী, চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম এ আজিজ, খুলনায় শেখ আব্দুল আজিজ, যশোরে মশিউর রহমান, চাঁদপুরের মিজানুর রহমান চৌধুরী, টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান, ময়মনসিংহে রফিক উদ্দিন ভূইয়া, দিনাজপুরে অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আব্দুর রহিম- এরকম আরও অনেকে ছিলেন যারা তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক সততার কারণে আওয়ামী লীগের জন্য সম্পদে পরিণত হয়েছিলেন। শেখ মুজিব যে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন, আওয়ামী লীগ যে একটি জনপ্রিয় দল হয়ে উঠলো তার জন্য শেখ মুজিব নিজে প্রধান চরিত্র হলেও নেপথ্যে এক ঝাঁক নেতার নিরলস চেষ্টার কথাও মনে রাখতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। শেখ মুজিবের মতো সাহসী এবং দূরদর্শী নেতা না থাকলে, আওয়ামী লীগের মতো দল এবং অসংখ্য নির্ভরযোগ্য সহযোগী না পেলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাঙালির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো কিনা, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে তার স্বপ্নের 'সোনার বাংলা' প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সময় না দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে হত্যা করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং ভারতবিরোধী চক্রের সম্মিলিত আঘাত মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুর দূরতম কল্পনায় এটা ছিল না যে, কোনও বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারে! তিনি যে রাষ্ট্রের স্রষ্টা সেই রাষ্ট্রে তিনি তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই একেবারে নিরুদ্বেগ ছিলেন। তিনি সরকার প্রধান, রাষ্ট্র প্রধান হয়েও কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে বসবাস করেননি। কোনও বাঙালিকেই তিনি তার জন্য অনিরাপদ মনে করেননি। তিনি জাতির পিতা হয়ে ভেবেছিলেন, সন্তান কি পিতৃহন্তারক হতে পারে? তার আস্থা-বিশ্বাস তছনছ করে দিয়েছে একদল ঘাতকের তপ্ত বুলেট পঁচাত্তরের ১৫অগাস্ট।
বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের জন্য এক নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধু নেই কিন্তু আওয়ামী লীগ আছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে মাথা তুলতে না দেওয়ার জন্য অনেক অপচেষ্টাই করা হয়েছে। খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতার চূড়ায় উঠে সামরিক ডিকটেটর জিয়াউর রহমান রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে 'ডিফিকাল্ট' করার যে প্রকল্প নিয়েছিলেন তা মোকাবিলা করেই আওয়ামী লীগকে পথ তৈরি করতে হয়েছে। বৈরী সময়ে ওই কঠিন পথপরিক্রমা আওয়ামী লীগের জন্য ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে । শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নেওয়ায় সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই ছিল আওয়ামী লীগের পুনর্জাগরণের জাদুর কাঠি । ততদিনে জিয়া রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। নীতিহীনতার, বিশ্বাসহীনতার রাজনীতি চাষ শুরু হয়েছে ভালোভাবে। আওয়ামী লীগবিরোধী, ভারতবিরোধী, একাত্তরের পরাজিত শক্তি, সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিচক্রের সম্মিলনে একটি রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলা হয়ে গেছে। সুতরাং শেখ হাসিনা এমন একটি সময়ে দলের প্রধান কাণ্ডারি হলেন যখন রাজনীতির মাঠ একেবারই আওয়ামী লীগের অনুকূল নয়।
কিন্তু ধমনীতে যার শেখ মুজিবের রক্ত বহমান, তিনি তো কঠিনকে ভয় পাওয়ার মানুষ নন। দলের দায়িত্ব নিয়ে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগকেও পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন। জিয়া হত্যাকাণ্ড দেশে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করে। তারপর বিচারপতি সাত্তারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন, সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ – ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটে যে, শেখ হাসিনার সামনে চলে আসে রাজনৈতিক ঝড়ো সময়।
আন্দোলন-সংগ্রামের দল আওয়ামী লীগকে নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে।
১৯৮১ থেকে ২০২১। লম্বা সময়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত। ৮ বছর। আর শেখ হাসিনা ১৯৮১ থেকে এখন পর্যন্ত – প্রায় ৪০ বছর। ৭৩ বছরে পা দেওয়া আওয়ামী লীগের অর্ধেকের বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু এবং চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে যারা ভেবেছিল আওয়ামী লীগ শেষ, এই দল আর ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না, তাদের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। পিতা শেখ মুজিব যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, কন্যা শেখ হাসিনা সেই বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় বিশ্বসভায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। শেখ হাসিনার এই দীর্ঘ চলার পথ কখনও মসৃণ ছিল না। নানামুখী বৈরিতা, প্রতিকূলতা, মৃত্যুভয়-সব উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা এগিয়ে যাচ্ছেন, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চাদমুখী প্রবণতাও আছে।
সবচেয়ে বড় কথা, শেখ হাসিনাকে লড়তে হচ্ছে চরম প্রতিহিংসাপরায়ণ, নিষ্ঠুর এক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। যারা গণতন্ত্রের কথা মুখে বলে মনোজগতে সারাক্ষণ লালন করে হত্যা-সন্ত্রাস-সহিংসতার অগণতান্ত্রিক চিন্তা। দেশের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন তীব্র। বিপক্ষের সবাই ঐক্যবদ্ধ। পক্ষের শক্তি বিভক্ত, দোদুল্যমান। আওয়ামী লীগের বিপক্ষ শক্তির যে অপরাধ অনেকেই ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখেন, আওয়ামী লীগের একই মাত্রার অপরাধ তাদের কাছে ক্ষমাহীন। আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। মানুষের প্রত্যাশা পূরণের চাপে থাকতে হয় আওয়ামী লীগকে সব সময়। এত সব কিছু সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ আছে এবং দৃঢ় অবস্থান নিয়েই আছে।
ইদানিং কেউ কেউ বলে থাকেন, বঙ্গন্ধুর আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এক নেই। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে আদর্শিক ত্রুটি-বিচ্যুতি বেশি। এটা একটি বড় আলোচনার বিষয়। তবে এখানে বলার কথা এটুকুই যে, বঙ্গবন্ধুর সময় এবং শেখ হাসিনার সময় এক নয়। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অবস্থাও এক নয়। রাজনৈতিক শক্তির মেরুকরণে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে লড়তে হয়েছে প্রধানত আঞ্চলিক বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনা এবং গণতন্ত্রের জন্য। আর স্বাধীন দেশে মূলত যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠন এবং নাগরিকদের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করাই ছিল আওয়ামী লীগের কাজ।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে কৌশল এবং আদর্শের ক্ষেত্রে নমনীয় হতে হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতির এজেন্ডার সঙ্গেও খাপ খাওয়াতে হয়েছে। মিত্র বাছাইয়েও শেখ হাসিনাকে অনেক হিসাবনিকাশ করতে হয়েছে। কখনও বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বিপরীত মত-পথের সঙ্গে কৌশলগত সমঝোতা করতে হয়েছে। এক পা এগুনোর জন্য দুই পা পেছানোর রাজনৈতিক কৌশল চর্চা করে শেখ হাসিনা সুফল পেয়েছেন। মোট চার মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার অবস্থা তৈরি করতে পেরেছে শেখ হাসিনার বিচক্ষণ ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণেই। বিশ্ব রাজনীতিতে এখনকার মূল ফোকাস গণতন্ত্র নয়। এক সময় দেশে দেশে গণতন্ত্র আমদানি-রপ্তানির রাজনীতির বেশ বাজার মূল্য ছিল। এখন সেই জায়গা দখল করেছে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করা। বিশ্ব রাজনীতির এই পরিবর্তিত এজেন্ডা শেখ হাসিনা ঠিক সময়ে ঠিকভাবে গ্রহণ করেছেন। এর বেনিফিট তিনি পাচ্ছেন।
দেশের অভ্যন্তরে সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ঘাটতি দূর করতে পারছে না। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোরতা দেখাতে পারছে না। সে জন্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক এবং আদর্শিক অবস্থানে সংস্কার এবং পরিমার্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন অনেকেই। আওয়ামী লীগের কাছে নয়, মানুষের প্রত্যাশী শেখ হাসিনার কাছে। টানা ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ যেসব ক্ষতিকর ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, সেসব ভাইরাস মুক্ত হওয়ার জন্য দ্রুত উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে দলটিকে এক সময় ঐতিহ্যের জাবর কেটেই সময় পার করতে হবে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে আমাদের প্রত্যাশা, দেশ এবং দেশদরদী শেখ হাসিনার অগ্রযাত্রায় আওয়ামী লীগ হোক যোগ্য সহযাত্রী। সময়ের থেকে পিছিয়ে নয়, এগিয়ে থাক আওয়ামী লীগ। সরকার পরিচালনায় রাজনীতিবিদের চেয়ে আমলা নির্ভরতা কমিয়ে এনে বঙ্গবন্ধুর নীতিতে পরিচালিত হোক। ক্ষমতার চাপ যেন দলকে কাবু করতে না পারে। দলের নেতৃত্ব এবং সরকার যেন এক হয়ে না চায়। দল সরকার না চালিয়ে, সরকার যদি দল চালায়- তাহলে ফল ভালো হয় না। টানা ক্ষমতায় থাকার কুফল অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা উচিত।