Published : 17 Dec 2020, 06:24 PM
চলতি বছর নিজেদের দারিদ্র্যমুক্ত ঘোষণা করে বিশ্বকে সত্যিই চমকে দিয়েছে চীন। এত বড় একটি দেশ যার জনসংখ্যা ১৪০কোটির বেশি, সেই দেশটি কিভাবে তার জনগণকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করলো সে এক বিস্ময়ের কাহিনীই বটে।
এ সাফল্য অর্জন করতে তারা এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যা ছিল বিভিন্ন দিক দিয়ে অভিনব। দেখা যাক তারা কী পদ্ধতি ব্যবহার করে এমন অভাবনীয় সাফল্য পেল।
দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমের চূড়ান্ত বছরে দশ কোটি বা ১০০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করে চীন। গত আট বছর ধরে চলা দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করে শিনচিয়াং, ইউনান, নিংশিয়া, সিচুয়ান, কুয়াংসি ও কানসু আলাদা আলাদাভাবে নিজেদের সকল জেলাকে দারিদ্র্যমুক্ত ঘোষণা করে।
চীনের প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি শি চিন পিং সম্প্রতি বলেছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির সাফল্য এবং চীনের উল্লেখযোগ্য বিজয় বিশ্বকে অভিভূত করেছে। সিপিসির কেন্দ্রিয় কমিটির পলিট ব্যুরোর স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় এ কথা বলেন তিনি।
সিপিসির ১৮তম ন্যাশনাল কংগ্রেস থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে কমিউনিস্ট পার্টি বিভিন্ন উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করছে এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তা মানব ইতিহাসে বৃহত্তম।
গত আট বছরের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে চীনের সকল গ্রামীণ মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়।
বছরে জনপ্রতি ৩ হাজার ২১৮ ইউয়ান বা ৪৯০ মার্কিন ডলারের বেশি আয়কে দারিদ্র্য রেখা হিসেবে ২০১৯ সালে স্থির করে চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস। ২০১০ সালে এই রেখা ছিল ২ হাজার ৩০০ ইউয়ান।
দারিদ্র্য বিমোচনে চীনের সাফল্যের পিছনে রয়েছে গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থায় শিল্পায়নের উন্নয়ন যা এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
চীনের কৃষি ও গ্রাম মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৮৩২টি দারিদ্রপীড়িত কাউন্টি এক মিলিয়নের(দশ লাখ) বেশি শিল্পায়ন প্রকল্প নিয়েছে এবং ৩ লাখ শিল্প ভিত্তি তৈরি করেছে। প্রতিটি কাউন্টিতে ২-৩টি নেতৃস্থানীয় শিল্প রয়েছে যা ৯৮ শতাংশ দারিদ্র্য পীড়িত মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। দারিদ্র্য-মুক্তি কর্মশালা থেকে শিল্প সমবায়ের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকাগুলো নিজেদের পরিবেশ ও সুবিধা অনুযায়ী অবস্থার ক্রম উন্নতি ঘটিয়ে চলেছে। গ্রামীণ শিল্পায়নের মধ্যে রয়েছে কিউয়ি ফলের চাষ, সবজি চাষ, মৌমাছি পালন, স্থানীয় হস্তশিল্পের সমবায়, স্থানীয়ভাবে জন্মায় এমন বিশেষ ধরনের কোন ফল বা সবজির চাষ, খামার গড়ে তোলা, গবাদি পশু পালন ইত্যাদি।
চীনে ৫৬টি জাতিগোষ্ঠি রয়েছে। এদের মধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক জাতি রয়েছে যারা নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ব্যবহার করে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নিয়েছে। এর একটি উদাহরণ হলো 'মিয়াও' জাতির সাফল্য।
নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ব্যবহার করে দারিদ্র্য বিমোচন করেছে চীনের 'মিয়াও' জাতি। দক্ষিণ চীনের কুয়াংশি চুয়াং স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলে 'মিয়াও' জাতির স্বায়ত্ত্বশাসিত জেলা রংশুইতে এমনটি ঘটেছে। কুয়াংশি চুয়াং স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলের রংশুই হলো 'মিয়াও' স্বায়ত্ত্বশাসিত জেলা।
এই অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যপীড়িত ২০টি জেলার অন্যতম রুংশুই। এখানে ২৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ মানুষের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। এখানে ১৩টি এথনিক গ্রুপের মানুষ বাস করে। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবহার করে তারা নিজেদের জেলাকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। ৩০ হাজার স্থানীয় গ্রামবাসী চীনের সাম্প্রতিক দারিদ্র্য বিমোচন সাফল্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। নভেম্বরের ২০ তারিখেই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের দারিদ্র্যমুক্তি ঘটিয়েছে।
'মিয়াও' জাতির এমব্রয়ডারি খুব ঐতিহ্যবাহী। এই এমব্রয়ডারি দক্ষতাকে তারা ব্যবহার করেছে পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য। এমব্রয়ডারি করা বিভিন্ন সামগ্রী তারা তৈরি করেছে যেগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে পর্যটকদের মধ্যে।
এই এলাকার আরেকটি গ্রাম ডংথোউ। এখানে 'ডং' এথনিক গ্রুপের মানুষরা বাস করেন। তাদের নবান্ন উৎসব খুব বিখ্যাত। এ নবান্ন উৎসব উপলক্ষে এখানে প্রচুর পর্যটক আসেন। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে এখানে পর্যটন এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে।
এইভাবে বিভিন্ন জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ব্যবহার করে পুরো এলাকাটিকে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এতে ওই এলাকার অর্থনীতি নতুন গতি পেয়েছে।
বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের দারিদ্র্যমুক্তির অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করেছে পর্যটন শিল্পের বিকাশ। দেশি ও বিদেশি অসংখ্য পর্যটক প্রতিবছর চীন সফর করেন। বৈদেশিক পর্যটকের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের জন্য নানা রকম ট্যুর প্যাকেজের আয়োজন করেছে স্থানীয় সরকার।
ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিকভাবে বিখ্যাত এলাকায় সাংস্কৃতিক পর্যটনকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন সিনিক স্পট। সেসব জায়গায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো হয়েছে।
চীনের এই দারিদ্র্য বিমোচন সাফল্যের প্রশংসা করেছেন বি এফ এর (বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া) চেয়ারম্যান এবং সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন।
তিনি বলেন, "কিভাবে প্রতিশ্রুতি পূরণে বদ্ধপরিকর একটি সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারে তার ভালো উদাহরণ হলো চীন।"
বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া তাদের দারিদ্র্যের হার কমানো বিষয়ক ২০২০ সালের রিপোর্টে চীনের সাফল্যর কথা উল্লেখ করে। বিএফএ'র মহাসচিব লি বাওডং রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, মহামারির কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ধীর হওয়ার বাস্তবতার মধ্যেও চীনের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। চীন মহামারিসংক্রান্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পেরেছে।
৮৩২টি দারিদ্র্যপীড়িত জেলাকে আট বছরে দারিদ্র্যমুক্ত করতে গিয়ে প্রতি ঘণ্টায় ১৫০০ মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। এটি একটি বিস্ময়কর ঘটনা। জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডার নির্ধারিত সময়ের আগেই চীনের এই সাফল্য বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোও এগিয়ে যেতে পারে দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যে। চীনা জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনের এই বিজয় বিশ্বের অন্য দেশগুলোর জন্যও প্রেরণা হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।