Published : 04 Nov 2020, 10:59 AM
গত পহেলা নভেম্বর এক সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকার বদ্ধপরিকর। কোনো ধরনের গুজব বা উস্কানিমূলক কোনো বক্তব্যে কান না দেওয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তথ্য বিবরণীতে গুজব সৃষ্টিকারী সম্পর্কে কোনো ধরনের খবর পেলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এই তথ্য বিবরণী প্রচারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানিয়ে সবিনয়ে তিনটি প্রশ্ন:
১. গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকার কি সত্যি বদ্ধপরিকর? গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে গুজবনির্ভর বেশ কয়েকটি অপ্রীতিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ফেসবুকে বানোয়াট খবর প্রচার করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোনো ঘটনায় কি প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে? যদি কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েও থাকে তা কি দেশের মানুষকে জানানো হয়েছে?
২. আইনশঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য জানানোর মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি কি সত্যি দেশে আছে? কিছু জানাতে গিয়ে উল্টো নাজেহাল হওয়ার ভয়ে সাধারণ মানুষ গুটিয়ে থাকে। অপরাধীকে ধরার চেয়ে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করার কথা কে না জানে? কেউ থানা-পুলিশের কাছে কোনো তথ্য বা অভিযোগ নিয়ে গেলে সহানুভূতিশীল আচরণ পাবে, তেমন নিশ্চয়তা কি দেওয়া যাবে?
৩. গুজব বা উস্কানিতে কান না দেওয়ার মতো নাগরিক সচেতনতা তৈরির কোনো বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ কি আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আছে? আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষের হুজুগে মেতে ওঠার ঝোঁক প্রবল। চিল কান নিয়েছে শুনে চিলের পেছনে দৌড়ায়, কানে হাত দিয়ে না দেখেই। এটা বহুদিনের পুরনো প্রবাদ। অনেক কিছু বদলেছে, অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু হুজুগে মাতার অভ্যাস সেভাবে বদলায়নি।
তাই গুজব রটনা প্রতিহত করতে চাইলে সরকারকেই আগে উদ্যোগী হয়ে মানুষের মনে আস্থা-বিশ্বাস তৈরির পরিবেশ নির্বিঘ্ন করতে হবে। মানুষ যদি বুঝে যে, প্রশাসন দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন চায়, তাহলে সহযোগিতা পেতে বেগ পেতে হবে না।
দুই.
গত ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে মসজিদে পবিত্র কোরান শরিফ অবমাননার গুজব ছড়িয়ে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে এবং আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রাথমিক তদন্তে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, কোরান শরিফ অবমানার বিষয়টি ভিত্তিহীন। কিন্তু আকস্মিকভাবে ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেনি। এখন এটা স্পষ্ট যে, পরিকল্পিতভাবেই ঘটানো হয়েছে। কারা এই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি, কীভাবে সেখানে 'গুজব' ছড়িয়ে শত শত মানুষকে জড়ো করা হলো, প্রশাসন কেন কিছুই জানতে পারল না – এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে তদন্ত কমিটিকে। বিষয়টি যেন কোনোভাবেই ধামাচাপা পড়ে না যায়।
আবু ইউসুফ মোহাম্মদ শহীদুন্নবী নামের যে ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তিনি নাস্তিক ছিলেন না। তার আত্মীয় পরিজনেরা জানিয়েছেন, তিনি একজন সৎ এবং ভালো মানুষ হিসেবেই পরিচিত। রংপুরের একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিনি গ্রন্থাগারিক এবং শিক্ষক ছিলেন। মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় তিনি চাকরি হারান। তিনি নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তার বাড়িও রংপুর শহরে। ওষুধ আনার জন্য বুড়িমারী গিয়ে তিনি উন্মত্ত জনতার নৃশংসতার শিকার হন। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক।
প্রশ্ন হলো, একজন মানুষ সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে তার বিরুদ্ধে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ অবমাননার অভিযোগ তোলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? তারপরও যদি ধরে নেই যে, কেউ একজন অতি আবেগতাড়িত হয়ে অভিযোগ তুললেই অন্য সবাই তার সত্যাসত্য যাচাই না করে উন্মাদের মতো আচরণ করবে? আমাদের দেশের মানুষ কি সত্যি এত ধর্মপ্রাণ? মানুষ ধর্মের পবিত্রতা রক্ষায় এত ব্যাকুল, অথচ দেশ অনাচারে ভরে যাচ্ছে কীভাবে? ধর্ম নিয়ে এত বিচলিত হলে তো দেশে ঘুষ দুর্নীতি অন্যায় অপকর্ম হওয়ার কথা নয়।
ধর্ম মানুষকে মানবিক এবং সহনশীল করবে – এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া ইসলামকে বলা হয়, শান্তির ধর্ম। এই শান্তির ধর্মের নামে যারা হিংসার বিস্তার ঘটায় তারা কি আসলেই ধর্মপ্রাণ বা ধর্মবিশ্বাসী? ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার কথাই পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে।
তিন.
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অজুহাতে যেহেতু প্রায়ই সহিংস পরিস্থিতির তৈরি করা হয়, তাই সরকারের উচিত, ধর্মীয় অনুভূতি বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করা। কি কি করলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে সেটা স্পষ্ট করা থাকলে এ নিয়ে কোনো বিভ্রম সৃষ্টির সুযোগ থাকে না। যেকোনো অপরাধই প্রমাণ সাপেক্ষ। অভিযোগ করলেই সেটা সত্য হয় না। আদালতে গিয়ে অভিযোগ করা মাত্রই তার বিচার হয় না। সাক্ষ্য প্রমাণ লাগে।
একজন নারী ধর্ষণের শিকার হলেই যেমন বিচার পান না, সেটা প্রমাণ করতে হয়, তেমনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার বিষয়ে কেউ অভিযোগ উত্থাপন করলেই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে ওঠা ঠিক নয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া সভ্য দুনিয়ার রীতি। কেউ কারো বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত শত্রুতা বা অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে। এমন ঘটনা যে ঘটে না, তা তো নয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় সবগুলোই পরে মিথ্যা বলে প্রমাণ হয়েছে। তারপরও কেন গুজব ছড়ানো বন্ধ হয় না, মানুষ কেন গুজবে বিশ্বাস করে – তার একটি আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-মনোস্তাত্ত্বিক কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে হলে যেকোনো বিষয়ে সুশৃঙ্খল জ্ঞান থাকা দরকার।
চার.
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তবে অন্য ধর্ম বিশ্বাসী মানুষও দেশে আছে। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলা হয়। তবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে যে উদ্বেগ-শংকা নেই তাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। অন্য দেশে, বিশেষ করে ভারতে মুসলিম নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। একজনের অপরাধে আরেকজনকে শাস্তি দেওয়ার রীতি খুবই বিপজ্জনক। এই বিপজ্জক পথ থেকে সরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এটাই বেদনার বিষয়।
মানুষের ধর্ম বিশ্বাস মানুষকে উদার এবং সংকীর্ণতা মুক্ত করবে – এটাই হওয়ার কথা। ধর্ম প্রচারকরা কেউ হিংসার বাণী প্রচার করেননি। সবাই মানুষকে ভালোবাসার কথাই তারা বলেছেন। ধর্ম তো অন্তরের জিনিস, ভালোবাসার জিনিস, বিশ্বাসের জিনিস। ধর্ম জরবদস্তির বিষয় হলে তা বিরূপতা এবং বিদ্বেষ বাড়ায়। শক্তি দিয়ে রাজ্য জয় করা গেলেও মন জয় করা যায় না
পৃথিবীটা এক ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের বানানোর চেষ্টা কেউ করতেই পারে, তবে সেটা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। ধর্ম নিয়ে মানুষের মধ্যে যারা ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত, তাদের উদ্দেশের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, মুক্তবুদ্ধি বা চিন্তার স্বাধীনতার নামে কারো বিশ্বাস নিয়ে তামাশা করা উচিত নয়। সবাইকে যুক্তির মধ্যে থাকতে হবে। জেনে বুঝে কাউকে আঘাত দেওয়া, আহত করা কোনো সুস্থ চিন্তার মানুষের কাজ হতে পারে না। ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তাই পরিত্যাজ্য হওয়া উচিত। আপনি অবিশ্বাসী হতে পারেন কিন্তু তাই বলে বিশ্বাসীকে উপহাস করতে পারেন না। মানুষ যেহেতু সবজান্তা নয়, সব জ্ঞানও কোনো একক মানুষের আয়ত্তে নেই, তাই সবারই উচিত সীমার মধ্যে থাকা, সীমা লংঘন না করা। সীমা লংঘনকারীকে কেউ পছন্দ করেন না।
আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার, ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সাময়িক ফায়দা কিছু পাওয়া গেলেও আখেরে তাতে ক্ষতিই হয়। মানুষ কখনই এক মত, এক পথে চলবে না। মানুষে মানুষে ভিন্নতাকে সম্মান জানানোর উদারতা রপ্ত করাও একটি বড় গুণ।
মানব সভ্যতার ইতিহাস অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ারই কথা বলে। পেছনে ফিরে যাওয়া নয়, অগ্রসরমানতাই জীবনের ধর্ম। ধর্মের নামে যারা হিংসার চাষ করতে চান, তারা হত্যার মতো নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারেন, ঘৃণাও ছড়াতে পারেন কিন্তু শেষে গিয়ে দেখবেন হিসাবের খাতায় জমা হয়েছে একটি বিশাল শূন্য বা জিরো।
শুভবোধ ও কল্যাণ চিন্তার বিকল্প নেই।