Published : 15 Oct 2020, 03:42 PM
দেশের বিভিন্ন আদালতে নারী নির্যাতনের মামলা ঝুলে আছে এক লাখ ৬৪ হাজার ৫৫১টি (মার্চ ৩১, ২০১৯ পর্যন্ত)। এসব মামলার বড় অংশ ধর্ষণের মামলা। যারা আদালতে বিচারের জন্য যায়, তারা রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থাপনার উপর ভরসা করে সরকারকে রাজস্ব দিয়ে বিচার প্রার্থী হয়। সুতরাং সুবিচার প্রদান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং বিচার পাওয়া নাগরিকের অধিকার। অথচ রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ তার দায়িত্ব পালন করতে পারছে না; মানুষ বিচার বঞ্চিত থাকছে। গত বছরের ১৮ মে ডেইলি নিউ এজে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল "Bangladesh sees nearly 13 rapes every day". অর্থাৎ দেশে প্রতিদিন প্রায় ১৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল "Only 3% convicted for rape in Bangladesh"। অর্থাৎ ধর্ষণ মামলায় মাত্র ৩ শতাংশ আসামী আদালতে দণ্ডিত হয়। সরকার আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড চালু করতে যাচ্ছে। এর ফলে ধর্ষণের ফলে বিচার প্রাপ্তির হার আরও কমে যাবে। কারণ মৃত্যুদণ্ডের মতো রায় দেয়ার ক্ষেত্রে আদালত এবং তদন্তকাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সঙ্গত কারণেই অধিকতর সতর্ক হবে। এটি একটি মানবিক ইস্যু। সাধারণভাবে কেউ চাইবে না, ভুল তদন্ত বা ভুল জাজমেন্টের কারণে একজন ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হোক।
মৃত্যুদণ্ড প্রবর্তনের ফলে সাজানো মামলা দায়ের এবং দুর্নীতি উভয়ই বাড়বে। সোজা কথায় আসামীরা জমিজমা বিক্রি করে সর্বোচ্চ পরিমাণ ঘুষ দিয়ে হলেও পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন পক্ষে নেওয়ায় চেষ্টা করবে। রেপ কেস থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বাদীপক্ষকেও প্রভাবিত করার সর্বোচ্চ পন্থা অবলম্বন করবে আসামীরা। তার মানে আমরা ধরে নিতে পারি, ধর্ষণের মামলায় সাজা দেওয়ার হার আরও কমবে। বিচারহীনতা বাড়বে। অথচ বেশি সাজা নয়, বেশি প্রয়োজন ছিল বিচার নিশ্চিত করা।
আরেকটি চিন্তার বিষয় আছে। ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড চালু হওয়ায় ধর্ষণের সঙ্গে হত্যার ঘটনা বাড়তে পারে। পেশাদার অপরাধীরা রেপের পর মেরে ফেলা উত্তম বলে মনে করবে। কারণ সাজা একই।
কিছু ক্ষুব্ধ মানুষের অবিবেচক দাবি এবং আন্দোলন ধামাচাপা দেওয়ার জন্য একটি দুর্বল সরকারের জনতুষ্টিবাদী তড়িঘড়ি পদক্ষেপ আরেকটি খারাপ আইনের জন্ম দিতে যাচ্ছে। এই আইনের ফলে ধর্ষণ কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। দেশে হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চালু আছে। এতে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি, কমেওনি। সাধারণ বিবেকবান মানুষ হত্যার মত বিভৎস অপরাধ করতে পারে না। যারা এরকম অপরাধ করতে পারে, তারা মুত্যুদণ্ডকেও কেয়ার করে না। সাধারণ মানুষের হাত দিয়েও অনেক সময় হত্যার মতো মারাত্মক অপরাধ ঘটে যায়। রাগে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষ যখন মানুষ থাকে না, তখন এরকম ঘটনা ঘটাতে পারে। মুত্যুদণ্ড দিয়ে এর সুরাহা হয় না। আইনের লক্ষ্য ন্যায় বিচার। অবিবেচকের মতো শাস্তি চাপানো আইনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। যেসব দেশ মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণ তুলে দিয়েছে সেসব দেশে অপরাধ বাড়েনি। বরং অপরাধ কমে যাওয়ায় তাদের জেলখানা গুটিয়ে নিতে হয়েছে। পৃথিবীর জন্য এর চেয়ে সুন্দর সংবাদ আর কি হতে পারে? অথচ আমাদের দেশে এর বিপরীত সংবাদ তৈরি হচ্ছে।
আমি সামগ্রিকভাবে মুত্যুদণ্ডের বিরোধী নই। চরম কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। তবে বিষয়টি ডালভাতের মত হতে পারে না। বুঝতে হবে এটা "মৃত্যুদণ্ড," যে দণ্ড একবার কার্যকর হলে তা ফিরিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য মানুষের নেই। মনুষ্যকূলের জন্য নিষ্ঠুরতম বিচারটি প্রয়োগ করার আগে দশবার ভাবতে হবে বৈকি!
দরকার সমাজকে উন্নত করা, এমন সমাজ বানানো যেখানে অধিকাংশ মানুষ অপরাধপ্রবণ নয়। এমন সমাজ, যেখানে পোশাককে দোষ দিয়ে কোনও মানুষ কোনও নারীকে ধর্ষণ করার কথা ভাবতে পারে না। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও আমাদের গ্রামের নারীরা শাড়ীর নিচে ব্লাউজ এবং পেটিকোট পরতেন না। তখনও ধর্ষণ হতো, কিন্তু হাতাকাটা ব্লাউজ পরা বা ব্লাউজ না পরার কারণে নারীদের ধর্ষণ করা হয় – এরকম জঘন্য কথা মানুষ বলত না। একটা সময় সুতিবস্ত্র আবিষ্কার হয়নি। রেশম, ডেনিম, জিন্সের মতো উন্নত পোশাক তখন আবিষ্কার হয়নি। পোশাক তৈরির মতো উন্নত যন্ত্রপাতি তখন ছিল না। আজ থেকে ৫০ বা ১০০ বা হাজার বছর আগের মানুষ আজকের চেয়ে অনুন্নত ছিল। কিন্তু সেই অনুন্নত মানুষ ধর্ষণের কারণ হিসেবে উন্নত বস্ত্রের অভাবকে আবিষ্কার করেনি। কোন শিক্ষা মানুষের মনে এ ধরণের বিভৎস ধারণা ঢুকিয়ে দিল তা খতিয়ে দেখা দরকার। এর সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের বিভীষিকা সংযুক্ত করার মনোস্তত্ত্ব থেকেও মুক্তি দরকার।