Published : 27 Jul 2020, 02:13 PM
কয়েক মাস আগে অবধি অনেকেই সম্ভবত ছুটি কাটাতে কোনও আত্মীয়ের বিয়েতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। অনেকে বাচ্চাদের সাথে গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা করেছিলেন, এমনকি টিকিটও বুক করে ফেলেছিলেন। বাধ্যতামূলকভাবে ঘরে আটকে থাকার কথা কে ভেবেছিলেন তখন? যখন আমাদের তিন সপ্তাহের জন্য বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছিল তখনই এটি অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। আমাদের সামনে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল এবং আমরা এরপর কী করব তা ভাবতে শুরু করি।
এটি কি 'নির্জন কারাবাস' বা 'বিচ্ছিন্নতা'? লকডাউনের প্রথম দিককার দিনগুলি অতিবাহিত করা আমাদের বেশিরভাগের পক্ষে কঠিন ছিল কারণ আমাদের চলাচল সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। যাইহোক, দিন যেতে লাগল শিশুদের সাথে সময় কাটিয়ে, টিভিতে সিনেমা দেখে, নতুন রেসিপি চেষ্টা করে, বই পড়ে বা ইনডোর গেমস খেলার মধ্য দিয়ে। তবে এটিতেও একঘেয়েমি চলে আসল এবং আমরা কাজ করতে না পারার জন্য, বন্ধুদের সাথে দেখা না করতে পারার জন্য বা হাঁটতে বাইরে বের না হতে পারার জন্য অকার্যকর বোধ করতে শুরু করি।
কীভাবে কেউ এই চিন্তাভাবনাটি কাটিয়ে উঠবে এবং উত্সাহ না হারিয়ে ফলপ্রসূ সময় অতিবাহিত করবে? অতিরিক্ত চিন্তা করার পরিবর্তে, আমাদের যা করা দরকার তা হল কী আমাদের আনন্দিত করে বা আমরা কিসের জন্য কৃতজ্ঞ তার দিকে মনোনিবেশ করা এবং আমাদের মনকে সর্বদা ইতিবাচকভাবে চিন্তা করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া। এটি নেতিবাচক চিন্তাগুলির ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া রোধ করবে যা শেষ পর্যন্ত আমাদের মানসিক প্রশান্তি ছিনিয়ে নেয়। খুব কমই আমরা নিজেকে সময় দেওয়ার সুযোগ পাই এবং জীবনে ইতিবাচক কিছু করার জন্য এটিই সেরা সময়।
আগামীকাল উপভোগ করার জন্য আজ কাজ করুন। তারপরে আগামীকাল যখন আসবে, পরের দিনটি উপভোগ করার জন্য আবার কাজ করুন। আমরা প্রায়শই অফিসের কাজ বা ব্যবসায়ের রুটিনে এইরকম চাপ পড়ে যাই যে, আমরা জীবনের সান্নিধ্য উপভোগ করতে পুরোপুরি ভুলে যাই। আমরা বেশ কয়েকটি ছদ্ম আবেগের পেছনে দৌড়ানোর অভ্যাস করে ফেলেছি এবং এই প্রক্রিয়াটিতে সাফল্য পাওয়ার জন্য প্রতিদিনের জীবনের অভিনব বৈশিষ্ট্যগুলিকে উপেক্ষা করে চলেছি।
আমরা যা মিস করি তা আমাদের ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য অপ্রয়োজনীয় হতে পারে তবে আমাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কি কখনও বাচ্চাদের চিন্তাভাবনা শুনেছি, পরিবারের জন্য পছন্দের খাবারটি রান্না করেছি এবং স্নেহ ও যত্নের সাথে আমাদের প্রবীণদের সাথে কথা বলেছি বা পরিবারের সদস্যদের সাথে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছি? না, কারণ, আমরা এ জাতীয় জিনিসের জন্য খুব কমই সময় নির্ধারিত রাখি। কেননা সবসময় মনে করি যে আমরা কোনও মানদণ্ড বা অন্যকিছু অর্জনের জন্য সবসময় অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য জন্মগ্রহণ করেছি।
এটি আমাদের মিথ্যে আবেগকে বিশ্রাম দেওয়ার এবং একটি গুণগত সময় কাটাবার জন্য সৃষ্টিকর্তার পাঠানো একটি সুযোগ যা আমাদের কাছের এবং প্রিয়জনদের জন্য প্রচুর আনন্দ বয়ে নিয়ে আসবে। আমরা নানা উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং আবেগ নিয়ে জীবন শুরু করি। তবে সময়ের সাথে সাথে রুটিনই সবকিছু ঘিরে ধরে এবং আমরা সেসব জিনিসগুলিই ভুলে যাই যেগুলি আমাদের একসময় খুব প্রিয় ছিল। লকডাউনের মতো এই পরিস্থিতি আমাদের ভুলে যাওয়া শখ এবং আবেগকে, আমাদের আনন্দকে অনেকটাই পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে। এটি কমিকগুলি পড়া বা নিবন্ধ লিখতে বসা বা ছবি আঁকা বা গুনগুন করে কোনও গান গাওয়া হতে পারে।
এটি কেবল আমাদের উদাসীন চিন্তাভাবনাকেই সতেজ করে তুলেছে তা নয়, বরং আমাদের মনে মুগ্ধতা এবং উষ্ণতা ফিরিয়ে এনেছে। বলা হয়ে থাকে যে, কোনও ব্যক্তি নিয়মিতভাবে কোনও শখের সাথে জড়িত থাকলে তার সৃজনশীলতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং তা পুনরায় ভালোভাবে অনুধাবন করার জন্যই এই স্থবিরতা যেন আমাদের জীবনে এসেছে। করোনাভাইরাসের এই সময় আমাদের মনের নানা অপুর্ন বাসনা পূরণের সুযোগ এনে দিয়েছে। এটি পৃথিবীজুড়ে জাতি-বর্ণ, মান-মর্যাদা, ধন-সম্পদ, বয়স নির্বিশেষে সকলকে একটি সাধারণ উদ্দেশ্য নিয়ে একত্রিত করেছে।
এই বিরতি আমাদের প্রাণোচ্ছলতার সাথে কীভাবে জীবনের বাস্তবতা, বিকাশ, এবং উন্নতিকে গ্রহণ করতে হয় তা শিখিয়েছে। এত দিন ধরে, আমরা আমাদের অস্তিত্বের কথা ভাবছি। কিন্তু বিশ্বজুড়ে যারা তাদের জীবন ও নিরাপত্তার জন্য দৌড়াচ্ছে তাদের দুর্দশা দেখে আমরা 'সহাবস্থানের' মূল্যকে অনুধাবন করতে শুরু করেছি। সমাজ ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয় না যতক্ষণ না প্রতিটি মানুষ একে অপরের মূল্যকে উপলব্ধি এবং সহাবস্থানে বিশ্বাস করতে পারে।
'প্রকৃতি চিরন্তন'…
আমাদের 'চাওয়া'কে 'প্রয়োজন' থেকে আলাদা করার চিন্তাভাবনাটি যেমন আমরা ধরতে পেরেছি, তেমনি সবকিছু 'চাওয়া'-র অভ্যাসটিতেও সামনের দিনগুলিতে বড় পরিবর্তন আসবে। চাওয়ার চেয়ে প্রয়োজনের দিকেই এখন আমাদের মনোযোগ বেশি। আমরা প্রায়শই পড়েছি 'বনে কোনও ওয়াইফাই নেই, তবে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে তুমি আরও ভাল সংযোগ পাবে।' এই করোনাভাইরাসের সময় একটি বড় সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে 'প্রকৃতি চিরন্তন' এবং সময় এসেছে মানব জাতির এই সত্যকে মেনে নেওয়ার।
আমরা বস্তুগত জগতের তুচ্ছতার সাথে জড়িয়ে পড়েছি এবং প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ ভুলেই গিয়েছি। প্রকৃতির সাথে আমাদের বন্ধন যত বেশি জোরদার করব ততই আমরা চাপমুক্ত ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব। করোনাভাইরাস আমাদের প্রাকৃতি উপভোগ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিয়েছে। চাঁদের মহিমা, তারার ঝলকানি, পাখির আওয়াজের মিষ্টি শব্দ এবং ফুলের সৌন্দর্য প্রায়শই সিনেমায় দেখা যায়।
লকডাউনের এই সময়ে আমরা প্রকৃতির মহত্বের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেছি। প্রকৃতিতে গাছ, ফুল এবং ঘাস কীভাবে নীরবে বৃদ্ধি পায় তা দেখতে পাওয়া এক অবাক করার মতোই বিষয়। তারা, সূর্য ও চাঁদ কীভাবে নিস্তব্ধতায় চলে যায় তাও অবাক হয়ে দেখার বিষয়। হ্যাঁ, আত্মাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হওয়ার জন্য আমাদের নীরবতা প্রয়োজন এবং প্রকৃতি তা পুরোপুরিই সরবরাহ করছে। এই সময়টি প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য আত্মনিয়োগ করার সময়। বিশ্বব্যাপী মানুষেরা বুঝতে পারছে যে ঐক্যই শক্তি।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিত্সা বা ইঞ্জিনিয়ারিং অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্য থাকা সত্ত্বেও, এটা সত্য যে জাতিগুলির মধ্যে সর্বদাই প্রতিযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। এই করোনাভাইরাস আমাদের উপলব্ধি করিয়েছে যে, পার্থক্য ভুলে গিয়ে, কুসংস্কারকে দূরে রেখে বিশ্বজুড়ে দেশগুলিকে একত্রে কাজ করতে হবে। যাতে মানব জাতি শান্তি অর্জন করতে এবং এক হিসাবে একসাথে বাঁচতে পারে।
অবশ্যই এটি লিঙ্গ, ধর্ম বা জাতি নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই ঘটতে হবে। আমরা সকলেই একই জাতিতে আছি এবং তা হল মানবতার জাতি। এবং যা একজনকে প্রভাবিত করে বা দুর্বল করে, তা আমাদের সকলকেই প্রভাবিত করে এবং দুর্বল করে। একে অপরের পরিপূরক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা এই পরীক্ষামূলক পরিস্থিতিতে ভালভাবে বোঝা যায়। এবং দেশগুলি যে পরস্পরের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে তা দেখে ভালো লাগে। সুতরাং, করোনাভাইরাস আমাদের কিছু শিখতে কিছু ভুলতে এবং একইসাথে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দিয়ে পুনরায় আত্মপরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
স্বপ্ন দেখো মন
এই সময়টি আমাদের আমাদের মনন ও চিন্তায় বৃদ্ধি, প্রাণোচ্ছলতা এবং সংস্কারের জন্য জায়গা করে দিয়েছে। দিনশেষে, আমরা আমাদের পরিচয় পুনঃনির্মাণ করে এবং নিত্য নতুন জিনিস অনুশীলন এবং অভ্যাস করে এক নতুন ব্যক্তিত্ব হিসাবে আবির্ভূত হব। এই বিরতি আমাদেরকে উদ্বেগ ও হতাশার মুহূর্তগুলি মোকাবেলা করে তা আশা এবং অধ্যবসায়ের পরিণত করে আমাদেরকে দৃঢ় হতে সাহায্য করবে।
একসাথে থাকার চিন্তাটি আমাদের মনের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে এবং এর ইতিবাচক ও পার্শ্বীয় চিন্তাভাবনার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া সম্পূর্ণই আমাদের ওপর নির্ভর করবে। রোমান দার্শনিক সেনেকা এক্ষেত্রে বলেছিলেন, 'আমরা একই সমুদ্র থেকে ঢেউ, একই গাছের পাতা এবং একই বাগানের ফুল' এবং এটি আমাদের এখন এবং চিরকালই মনে রাখা উচিত।
আশা বেঁচে থাকুক…
একটা আশার খবর দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের তৈরি ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগে প্রাথমিকভাবে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। গবেষকেরা বলছেন, মানবদেহে প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনটি নিরাপদ বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে পুরোপুরি নিরাপদ ঘোষণা করার জন্য আরও পরীক্ষার প্রয়োজন আছে। বলা হচ্ছে, এই ভ্যাকসিনটি নতুন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে কার্যকর করে তুলতে সহায়তা করে (বিবিসি, ২০ জুলাই, ২০২০)।
প্রিয় পাঠক, করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে সাহস হারাবেন না। মনকে শক্ত করুন। আশা জাগিয়ে রাখুন। সবার জন্য রইল শুভকামনা।