Published : 17 Jul 2020, 12:33 PM
'অপরাধ প্রমাণ না-হওয়া অবধি সকলেই নির্দোষ' এই নীতিকে আমরা লজ্জাকরভাবে বিসর্জন দিয়েছি। একজন সন্দেহভাজন বা অভিযুক্ত ব্যক্তি পেলেই আমরা তাকে 'অপরাধী' সাব্যস্ত করে ঝাঁপিয়ে পড়ছি তার চরিত্র হননে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই কাজটি হচ্ছে ভয়ঙ্করভাবে। এখানে যেহেতু কোনও সেন্সর নেই, কোনও নিষেধ করার ক্ষমতাওয়ালা কর্তা নেই। তাই যা খুশি বলা যায়, এবং যে কোনও ভাষায় বলা যায়। এই লাইসেন্স পেয়ে সবার আগল খুলে গিয়েছে। অবাধ ইতরামির জন্য কেউ কেউ বেছে নিয়েছে এই সোশ্যাল মিডিয়াকে। অশালীন ভাষা প্রয়োগের উৎসব চলছে। যে যত জঘন্য গালাগাল প্রয়োগ করতে পারে তার লেখায়, সে তত স্মার্ট। সেই লেখার লাইক-কমেন্ট শেয়ার বেশি!
বর্তমানে অনেক মানুষেরই 'সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল' হয়ে যাচ্ছে। কারো যদি একটুখানি দোষ খুঁজে বের করা যায়, অমনি সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তার উপর। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে-ফেনিয়ে তিলকে তাল করে চলছে গণধোলাই। একজনকে অপমান ও হেয় করে জ্যান্ত মেরে ফেলার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার চেয়ে কার্যকরী মাধ্যম দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই।
একদল 'ফেসবুক যোদ্ধা' জন্মেছে যাদের কাজ এর-ওর-তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। কোনো একটা ছুতো পেলেই হলো। অমনি আক্রমণ! যত অশালীন শব্দ ব্যবহার করা যায়। যত নোংরা উপমা, কুযুক্তি, অবান্তর সব তথ্যপ্রমাণ দেওয়া যায়। কেউ প্রশ্ন করবে না। কেউ খারাপ বলবে না। বরং অনেকেই সহমত জানাবে! লাভ ইমো দেবে। ফেসবুক আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু দিয়েছে কাউকে খুঁচিয়ে-কুচিয়ে-কচলিয়ে রক্তাক্ত করবার মহান সুযোগ!
এই সুযোগ পেয়ে আমরা প্রত্যেকেই যেন একেকজন দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার! এই 'যোদ্ধা'দের আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে যে-কেউ। তবে নারী হলে জমে ভালো। আর যদি সে একটু 'লাস্যময়ী', 'আধুনিকা' কেউ হয়, তবে তো আরও ভালো। আদিরস মিশিয়ে নিজেদের যাবতীয় বিকৃতির প্রকাশ ঘটাতে সুবিধে হয়। কিছু কিছু ইতর প্রাণীর যেমন কামড়ানোর সময় বিষাক্ত লালা ঝরে, ঠিক তেমনি এই নব্য 'ফেসবুক-যোদ্ধা'দের শব্দ এবং বাক্যে এক ধরনের কামনাতাড়িত রোষের বিষাক্ত লালা নিঃসৃত হয়। এই লালার বিষে সেই ব্যক্তি জর্জরিত হয়! এতেই এই 'ফেসবুক-পোকা'দের আনন্দ!
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনের কথাই ধরা যাক। প্রতারণার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিকেজি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন তার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী। এই প্রতিষ্ঠানটি টেস্ট না করেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে শত শত মানুষের কাছে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ডা. সাবরিনা এই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ছিলেন-এই অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতারণার। তিনি এবং তার স্বামী দুজনেই মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। কোভিড পরীক্ষা না করে মনগড়া রিপোর্ট দিয়েছেন। দুজনে মারাত্মক অপরাধ করেছেন। কিন্তু তাকে প্রেপ্তারের পর প্রতারণার চেয়েও অনেক বেশি আলোচিত হয়ে উঠেছে তার শরীর, তার চলাফেরা, বেশভূষা, ব্যক্তিগত জীবন।
ড. সাবরিনার আসল অপরাধটা কী? পোশাক-আশাক নাকি জালিয়াতি? কোন অপরাধে তার বিচার হবে? আসল অপরাধের ধারেকাছে না থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় নিয়ে মাতামাতি লক্ষ করা যাচ্ছে। একজন নারী হিসেবে তিনি কী পোশাক পরেছেন, কীভাবে চলাফেরা করেছেন তা নিয়ে নোংরামির প্রতিযোগিতা চলেছে যেন। একইসঙ্গে চলছে চরিত্রহনন। ফেসবুকে তার প্রোফাইল ঘেঁটে বের করে আনা হয়েছে তার যত ব্যক্তিগত জীবনের ছবি। এসব ছবির সঙ্গে বিভিন্ন গল্প-কাহিনি যোগ করে চেষ্টা করা হচ্ছে তার চরিত্রহননের। তাকে নিয়ে মিডিয়ায় যা হচ্ছে তা ধর্ষণেরই শামিল।
এই ঘটনায় নারীর প্রতি আমাদের সমাজে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিই যেন ফুটে উঠেছে। সেটা হচ্ছে, নারীর অপরাধকে যৌনতার মোড়কে ঢেকে উপস্থাপন। এই দৃষ্টিভঙ্গির ধারক-বাহকদের কাছে পুরুষের প্রতিপক্ষ একা নারী, মন সেখানে অস্বীকৃত-উপেক্ষিত, কেবল আছে নারীর শরীরটুকু আর তাকে ঘিরে আদিমতার উল্লাস। 'ভোগের' সেই উৎসবে শামিল শত-সহস্র-লক্ষ জন! নিজেদের অতৃপ্ত যৌন লালসাকে একজন নারীর ওপর 'আরোপ' করে বিকৃত আনন্দলাভের চেষ্টা। এই নারীর বিরুদ্ধে যেহেতু গুরুতর প্রতারণার অভিযোগ আছে, তাই তাকে নিয়ে আদি রসাত্মক কথা বলায় অপরাধ নেই। এই মানসিকতা ও বিশ্বাসে মূলধারার মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সবাই যেন বুঁদ হয়ে আছে।
অপরাধীর শাস্তি চাওয়া এক জিনিস। আর শাস্তি চাওয়ার নামে নিজেদের বিকৃতির প্রকাশ আরেক জিনিস। এই পুরুষতান্ত্রিক বিকৃতির বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়নি বিষয়টি অনেক নারী মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু তারা প্রতিবাদ করারও সাহস পায়নি। প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক বিকৃতির যে সুনামি চলছে, তাতে একজন নারী আরেকজন নারীকে নিয়ে করা নিকৃষ্ট ট্রলের প্রতিবাদ করতে খুব একটা সাহস দেখায় না। প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি আবার তাকেও নিশানা করা হয়। তাকেও 'যৌনকর্মী' হিসেবে দেগে দেওয়া হয়। যদি তারও ব্যক্তিগত জীবন খুঁড়ে কোনো চরিত্রহীনতার আলামত হাজির করা হয়! মেয়েরা তাই ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। মানুষের জীবনে তো অনেক রকম ঘটনাই থাকে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেকের জীবনেই থাকে লুক্কায়িত নানা অধ্যায়। সেগুলো সব সময় যে 'চয়েস' থাকে, তাও নয়। 'সমাজসিদ্ধ' পথেও সব ঘটে না। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ সেই সব দুর্বলতাগুলোকে সামনে তুলে এনে সামাজিকভাবে 'খেলো' চেষ্টা করেই যায়। এটা যে কত বড় অসভ্যতা, তা কে কাকে বোঝাবে?
আসলে আমরা এক ভয়াবহ বিকারের মধ্যে বসবাস করছি। এখানে এক শ্রেণির মানুষ ধর্মের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। কিন্তু নারীদের ব্যাপারে যারপরনাই অসংবেদনশীল। প্রবল নারীবিরোধী মানসিকতা লালন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষ যেন এখনো নারীকে কেবল 'ভোগ্য' বলেই মনে করে। চারদেয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে যারা বাইরে বেরোয় তাদেরই চরিত্রহীন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শিক্ষত-সচেতন-আধুনিক নারী মানেই তাদের কাছে 'খেলুড়ে।' সমস্ত যোগ্যতা-দক্ষতাকে অস্বীকার করে তাদের 'দেহজীবী' হিসেবে দেখা হয়। তারা 'শরীর দেখিয়ে', 'বিছানায় শুয়ে' যাবতীয় সাফল্য অর্জন করেন বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। এই শ্রেণির পুরুষরা নারীকে অপমান-অপদস্থ আর হয়রানি করে আনন্দ পায়। তাদের কাছে নারীর অপমান, নির্যাতিত হওয়া, এমনকি ধর্ষণ পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত আচরণ ও চরিত্রের 'সমস্যা'। তার পোশাকের সমস্যা। যুক্তি-বুদ্ধি-কাণ্ডজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে আমরা এক অদ্ভুত বিশ্বাসের জগতে বাস করছি। এই 'বিশ্বাস' কেবলই নারীকে 'ভোগ' করতে, 'দখল' করতে, 'নিয়ন্ত্রণ' করতে শেখাচ্ছে। আর একটি শিক্ষা ইদানীং ব্যাপক মাত্রায় চালু হয়েছে তা হলো আগুনে পোড়া রোগীর মতো নারীকে কাপড়ে একেবারে আগাগোড়া মুড়ে 'ব্যান্ডেজ' করে ঢেকে রাখা! এর আরেক নাম দেওয়া হয়েছে 'পর্দা!' এই উন্মত্ততার যুগে ধর্ম হয়ে উঠেছে অনেক কামতাড়িত পুরুষের বর্ম। তাদের কাছে পুরুষের চোখের 'পর্দা' নয়, নারীর শরীরের পর্দা গুরুত্বপূর্ণ। এই নিয়ে তারা গগণবিদারি মাতম তুলছে!
সোশ্যাল মিডিয়া না হয়, 'আহাম্মকের পাঠশালা', যেখানে ব্যক্তিগত শিক্ষা, রুচি ও বিবেকই একমাত্র 'নিয়ন্ত্রক' বা ছাঁকনি, এখানে কাণ্ডজ্ঞান আশা করা দুরাশা মাত্র। কিন্তু আমাদের মূলধারার মিডিয়াগুলো কী ডা. সাবরিনা ইস্যুতে দায়িত্বশীল খবর পরিবেশন করতে পেরেছে? মানুষ শিখবে কোত্থেকে? সমাজে রুচিবোধ তৈরি হবে কাদের হাত ধরে? কেবল কাটতি, টিআরপি বাড়ানোর জন্য রগরগে কাহিনি, 'আপত্তিকর' ছবি প্রকাশ করা হবে? নীতি-নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দেওয়া হবে?
পরিশেষে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুর ফেসবুকে লেখা একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করছি: ''সাংবাদিক ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী অনেকে সোৎসাহে মিডিয়া ট্রায়াল করে অভিযুক্ত সবাইকে শয়তান বানিয়ে ফেলছেন বিচারের আগেই। এই অভিযুক্তদের যে নিরপরাধ পিতা-মাতা সন্তান-সন্ততি আছে, সে বিচার কারও নাই। অথচ ক'জন সাংবাদিক আসামিদের অপরাধ প্রমাণে তথ্য-রসদের সন্ধান করছেন, যা পুলিশকে সাহায্য করতে পারে? বা অপরাধী নয় শুধু, অপরাধ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা জাগাতে সাহায্য করছেন? এবার তো প্রমাণ হলো, অনেক নেতৃস্থানীয় সাংবাদিক দুর্নীতির বিষয় জেনেও রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদের সঙ্গে সামাজিক মাখামাখি করেছেন। যদি বলেন, পার্টিতে-রিসেপশনে অনুরোধে ছবি তুলেছেন; দুর্নীতির কথা জানতেন না, তাহলে এই না-জানার জন্য কবুল করুন যে, আপনারা সাংবাদিকতায় ব্যর্থ অথবা ধরে নিতে হবে, এখন মিথ্যা বলছেন।
অপরাধ ও আইন-বিচারের খবর পরিবেশনে সংবাদমাধ্যমে পেশাদারিত্বের দুর্বলতা দেখে লজ্জা পাই। এই দুর্বলতার পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গি অসৎ। কেন সাহেদের পার্টি পিকচার্স ও ডা. সাবরিনার দৈহিক রূপ ও জামাকাপড় এত গুরুত্ব পাবে?
সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির অভিযোগে ধরপাকড়ের খবরগুলো পরিবেশনে আমাদের অধিকাংশ মিডিয়া যা করছে, তা তিনটি ইংরেজি শব্দে ব্যক্ত করা যায়, to GLAMORIZE, to DRAMATIZE or sometimes to SEXIFY news and information. এতে প্রকৃত সংবাদ খুঁজে বের করার দায়িত্বশীলতা কম; বেশি আছে উপরভাসা ও জানা খবর নাটকীয়তার মোড়কে পরিবেশন করা।
আমি বিনীতভাবে বিষয়টির প্রতি দেশের মিডিয়া সম্পাদকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় আচরণিক ভদ্রতা শিখতে আমাদের সময় লাগবে-সেটা মেনে নিয়ে তাকিয়ে থাকবো সমাজসচেতন নাগরিকদের দিকে।''