Published : 13 Jul 2020, 01:34 PM
১.
অসহায় মানে অসহায়। এরমধ্যে কোনো রকমফের নাই। মার্চ থেকে জুন। এই চার মাসেই মানুষের অসহায়ত্বের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। আগামী দিনগুলো আরো ভয়ানক হবে এটাও নিশ্চিত। এই সময়ে মানুষের অসহায়ত্বের যে বর্ণনা আমরা জেনেছি তাতে করে সকল অসহায়ত্বের গল্প উবে যায়। ধনী, গরিব, শিক্ষক, সাংবাদিক, পুলিশ, ডাক্তার, লেখক, চাকরিজীবী, পোশাকশ্রমিক, বাবা, মা, আত্মীয়স্বজনসহ এইরকম অসংখ্য অসহায় মানুষের গল্প বলা যাবে। তাতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে যাবে ঠিকই, কিন্তু গল্প শেষ হবে না।
ধৈর্যচ্যুতি ঘটলেও অসহায় মানুষগুলোর জীবনের গল্প, যাপনের গল্প আমাদের জানা উচিত। বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। এইটা সবাই জানেন। সাংবাদিকরা নিয়মিত বেতন পান না। এই গল্পও এখন ঢাকার কারওয়ানবাজার থেকে শুরু করে সৌদী প্রবাসী শ্রমিক, সবাই জানেন। জানার একটাই কারণ, সবাই খোঁজখবর রাখেন।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, যমুনা টেলিভিশন। এই টেলিভিশন চ্যানেল ব্যয় কমানোর অজুহাতে বেশকিছু কর্মীদের ছাঁটাই করে। বিদায়পথে তাদের সম্বল শুধু যে মাস চাকরি করেছে সেই মাসের বেতন। ঘটনা অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে। চাকরির দুর্মূল্যের বাজারে সেইসব কর্মীদের কেউই আর নতুন কাজ বা চাকরি জোটাতে পারেননি। করোনাভাইরাস আসার আগ পর্যন্ত সবাই ছোটাছুটি করে কাজের চেষ্টা করলেও মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সেইসব কর্মীরা একরকম অর্থাভাবেই দিন যাপন করছেন। তাদের অর্থকষ্টের খবর জানা যায়, শোনা যায়, অনুভবও করা যায় কিন্তু তাদের সাহায্য বা সহযোগিতা দেওয়ার অবস্থা খুব কম লোকের আছে। এই মানুষগুলোর অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব ফুলে ফেঁপে উঠছে। কিন্তু তারা কিছুই করতে পারছেন না। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বাংলাদেশে আরো কতদিন চলবে কেউই বলতে পারছে না। ফলে তাদের অর্থনৈতিক দ্যোতনার গল্প চেতনায় আঘাত দেয়। শুধু কি যমুনা টেলিভিশন? মার্চ মাসে এসএ টেলিভিশনের ৩২ জন এবং গাজী টিভি ও সারাবাংলার বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কারণ অজানা।
ছাঁটাই এক ধরনের বাণিজ্য। এ বাণিজ্য শুধু টেলিভিশনেই থেমে নেই। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাও ভেতরে ভেতরে কর্মীদের ছাঁটাই করছে। কোথাও আবার তিন-চার মাসের বেতন-ভাতাও বাকি আছে। এরপরও কেউ মুখ খুলছে না। কারণ মুখ খুললেই চাকরি হারানোর ভয় আছে। মজার বিষয় হলো, গণমাধ্যমকর্মীরা সবার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, অন্যায়-বৈষম্যের কথা প্রকাশ করেন কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের সংকটের কথা বলতে পারেন না। '৪৫০ জন টিভি সংবাদকর্মী চাকরি হারিয়েছেন ছয় মাসে, ছাঁটাই আতঙ্কে অনেকে' (৮.১২.২০১৯, ডিডব্লিউ)। এই একটি প্রতিবেদনই যথেষ্ট গণমাধ্যমের চালচিত্র তুলে ধরার জন্য। সবকিছুকে ছাপিয়ে করোনাকালীন অর্থনৈতিক অসহায়ত্বের চিত্র সবচেয়ে বেশি পীড়া দিচ্ছে সেইসব সংবাদকর্মীদের।
অসহায়ত্বের চিত্র বড় করুণ হয়ে ধরা দেয় যখন একজন গীতিকার লেখেন, 'লেখার দাম পেলে আমি দামের জন্য লিখতাম না'। গুঞ্জন রহমান। এই সময়ের অন্যতম আলোচিত গীতিকার। যার নাম পরিচিত না ঠেকলেও গানগুলো খুবই জনপ্রিয়। হৃদয় খানের 'বলনা তুই বলনা' বা 'ভালো লাগে না' হাবিব ওয়াহিদের 'হারিয়ে ফেলা ভালোবাসা' সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা এই গুঞ্জন রহমান।
করোনাকালীন সময়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের লেখা পড়ে পাঠকদের ভালো লাগলে 'ক্রাউডফান্ডিং' এর কথা জানিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি যেসব লেখা বা কবিতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছেন তা পাঠকদের ভালো লাগলে পাঠক স্বেচ্ছায় অর্থ অনুদান দিতে পারেন। অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব কতটা প্রবল হলে একজন গীতিকার এইভাবে নিজের কষ্টের কথা সবাইকে সাহস নিয়ে বলতে পারেন। শুধু কি গুঞ্জন রহমান, একজন স্বনামধন্য লেখক তার পাণ্ডুলিপি স্বত্বসহ নিলামে তুলতে চেয়েছেন শুধু করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দাভাবের কারণে। মন্দাভাব এখনো কাটেনি। দরিদ্রতা কতটা অসহায় করে ফেলেছে এইসব সৃষ্টিশীল মানুষদের।
ধরুন, গীতিকার, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, নাট্যনির্দেশকসহ অসংখ্য সৃজনশীল মানুষ তাদের অর্থনৈতিক কষ্টের কথা কাউকে জানালেন না। এতে কি তাদের অভাব উধাও হয়ে যাবে? নিশ্চয় নয়। হয়তো আত্মসম্মানের ভয় তাদের কাছে প্রবল বলেই এখনো অনেকেই মুখ খুলছেন না। যারা নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলছেন তারা কি নিজেদের আত্মসম্মান হারিয়েছেন? অবশ্যই নয়। বরং তারা যে অসৎ কার্যে লিপ্ত না হয়ে নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরেছেন এতে তাদের সম্মান অনেকখানি বেড়ে গেছে।
একজন সৃষ্টিশীল মানুষ যেমন সমাজের জন্য কাজ করেন, সমাজের প্রতিটি মানুষের উচিত তার অসহায়ত্বে পাশে দাঁড়ানো। এতে তার অসহায়ত্ব লোপ পাবে।
২.
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। ডাকসাইটে অধ্যাপক। তার গবেষণা সমৃদ্ধ করেছে বাংলাদেশকে। মুনতাসীর মামুন এবং তার মা জাহানারা খান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থও হয়েছেন। করোনাকালীন সময়ে তাকে নিজে গিয়ে হাসপাতালে ট্রলি জোগাড় করে তার মা'কে ঠেলে নিয়ে যেতে হয়েছিল। সেই সময়টাতে তিনি সবচেয়ে বেশি অসহায় অনুভব করছিলেন। (২৩.৫.২০২০, প্রথম আলো) তার অসহায়ত্বের কথা তিনি প্রকাশ করেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, তার মতো মানুষের কি সাহায্য করার লোকের অভাব? নিশ্চয় নয়। কিন্তু কেউ চাইলেও সাহায্য করতে পারছেন না। কারণ করোনা সংক্রামক ভাইরাস, তাই সবাইকে দূরে থাকতে হচ্ছে। এইটাই নিয়ম।
দেশের অন্যতম শীর্ষ বিত্তশালী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ। তাদের অর্থ এবং বিত্তের পরিমাণ যে কত তা একবাক্যে বলা দুরূহ ব্যাপার। এইরকম একটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের ছয় ভাই, তাদের মা এবং ভাইয়ের স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সরল মনে হলেও তা সরল নয়। দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত নয়। তাদের জীবনযাপন সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা এইটা সহজেই অনুমেয়। সেই জীবনযাপনের মানুষগুলো যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তখন অসহায়ত্বের চরম চিত্র ফুটে উঠে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত সদস্যের মধ্যে পরিচালক মোরশেদুল আলম (৬৫) আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। হাসপাতালে ভেন্টিলেশন ছিল অপ্রতুল। ভেন্টিলেশন থাকলে হয়তো মোরশেদুল আলম আরো কয়েকদিন বাঁচতে পারতেন।
এই একটি মৃত্যুতে একদিকে যেমন স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতা ও সংকটের চিত্র ফুটে উঠেছে অপরদিকে বিত্তশালী মানুষ যে অসহায় হয়ে পড়েন তার চিত্রও ফুটে উঠেছে। আমরা কেউই এই ধরনের মৃত্যু আশা করি না। কিন্তু আমাদের যে স্বাভাবিক মৃত্যু হবে, এর নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারে না।
আমার বন্ধু উৎপল নন্দী। ওর আপন কাকা উত্তম নন্দী (৬১)। তিনি নরসিংদীতে কাপড়ের দোকানে চাকরি করতেন। লকডাউন ঘোষণার পরপরই তিনি নরসিংদী থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় তাদের বাসা পুরান ঢাকার নারিন্দাতে। লকডাউন চলাকালীন উত্তম বাবু সবচেয়ে বেশি নিরাপদে থাকার চেষ্টা করেছেন। খুব কম বাসা থেকে বের হতেন। কিন্তু এই নিরাপদে থাকার মধ্যেও তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত হওয়ার পর কুর্মিটোলা হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
মৃত্যু পরবর্তীতে পরিবারের মাত্র একজন সদস্যের পোস্তগোলা শশ্মানে যাওয়ার অনুমতি মেলে। বাকিরা কেউই তার সাথে শশ্মানযাত্রী হতে পারেননি। এই মৃত্যু কি তিনি আশা করেছিলেন? নিশ্চয় নয়। আমি ভাবছি কতটা অসহায় তার পরিবারের সদস্যরা। এইরকম একটা সময়ে কেউ তার পাশে থাকতে পারল না।
৩.
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সাংবাদিক, চিকিৎসক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সম্মুখভাগে কাজ করছেন। এরমধ্যে চিকিৎসক বা নার্সদের অসহায়ত্ব সবচেয়ে বেশি। কারণ তাদের সঠিক সুরক্ষা উপকরণ নেই। বাংলাদেশ বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটি (বিবিজিএনএস) ও সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের জরিপ বলছে, নার্সদের মধ্যে ৮৬.৯৯ শতাংশই সরকারিভাবে সরবরাহকৃত পিপিইর মান নিয়ে সন্তুষ্ট নন। (২৪.৪.২০২০, বণিক বার্তা) এটি যে শুধু নার্সদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়, চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ব্র্যাকের জরিপ বলছে, সামনের সারিতে থাকা ৭৫ ভাগ চিকিৎসক এবং ৪০ শতাংশ নার্স পিপিই পেয়েছেন। কিন্তু রেইনকোটের মতো যে পিপিই দেওয়া হয়েছে, সেটা আদৌ কাজ করে কি না তা নিয়ে সন্দিহান তারা। (১৮.৪.২০২০, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
এই তথ্য জানার পর আপনি নিজে কি স্বস্তিতে থাকতে পারবেন? অবশ্যই না। আপনি নিজে যদি নার্স বা চিকিৎসক হন তবে আপনার অস্বস্তি, আপনার অসহায়ত্ব ক্ষণে ক্ষণে বেরিয়ে আসবে। এরপর কি আপনি রোগীদের সঠিক সেবা দিতে পারবেন? নিশ্চয় না। তাহলে এই অসহায়ত্বের সমাধান কী? সমাধান নিশ্চয়ই আছে। এখন আমরা কি আদৌ সেই পথে হাঁটছি? প্রশ্ন আপনাদের।
অসহায়ত্ব দুই ধরনের। প্রকৃতিসৃষ্ট অসহায়ত্ব, মনুষ্যসৃষ্ট অসহায়ত্ব। প্রকৃতিসৃষ্ট অসহায়ত্ব আমরা সামলে নিতে পারলেও মনুষ্যসৃষ্ট অসহায়ত্ব আমাদের সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয়। সংস্কৃতিকর্মী থেকে শুরু করে সৃষ্টিশীল সকল মানুষদের জন্য সরকারের আলাদা পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল। খণ্ডকালীন নয়, অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এই সহযোগিতার ফলে সৃষ্টিশীল মানুষগুলো তাদের অর্থনৈতিক দৈন্য থেকে বেরিয়ে আসবে। ফলে দেশ সাহিত্য, সংস্কৃতি, গান, কবিতায় সুদৃঢ় হবে।
মার্চ থেকে জুন এই চার মাসে এখনো স্বাস্থ্যখাতের দৃঢ়তা আসেনি। কবে আসবে তাও জানি না। কেউ বলতেও পারছে না। প্রতিদিন নতুন নতুন সংকট, সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এইসব হওয়ারই কথা ছিল না। কিন্তু হচ্ছে। কারণ যাদের উপর ভর করে এই সংকট মোকাবিলা করার কথা তারা আসলে বড়ই দুর্বল। এই দুর্বলতা কাটিয়ে আরো গভীরভাবে কাজ করা উচিত। তাতে সৃষ্টিশীল মানুষ থেকে শুরু করে সাংবাদিক, চিকিৎসাকর্মী সবার অসহায়ত্ব লাঘব হবে। অসহায়ত্বের অবসান হবে।