Published : 27 Jun 2020, 11:07 AM
'লক আপ' মানে পুলিশের হেফাজতে থাকা। আর 'লকডাউন' মানে বউয়ের হেফাজতে থাকা!
-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্ট্যাটাস
যার বউ নেই সে লকডাউনে কার অধীনে থাকবে? যাই হোক আমার মনে হয়েছে আসল 'লকডাউন' সম্ভবত 'পূর্ব রাজাবাজারে' থাকা। রাজাবাজার আবার পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত। রাজার হালে থাকলেও সম্ভবত সেখানে বিভাজন আসে, বিভাজিত হতে হয়। সরকারি ঘোষণা মোতাবেক বাংলাদেশের প্রথম লকডাউন এলাকা পূর্ব রাজাবাজার। পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দা হিসেবে লকডাউনের অভিজ্ঞতা একদম খারাপ না! শুরুতেই দুই লাইন সমালোচনা দিয়ে শুরু করি। একজন কোভিড-১৯ বিশেষজ্ঞ একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় লিখেছেন- "পূর্ব রাজারাজারে যে লকডাউন ওটা আসলে 'পকেট লকডাউন'! প্রায় পুরো শহর লকডাউন না করলে পকেট লকডাউনের ফল ভালো পাওয়া যাবে না। যা শুরুতেই (মাচের্র শেষ বা এপ্রিলের শুরুতে) প্রয়োজনে কারফিউ জারি করে করা যেত!"
আমার বাসা খেকে বের হলেই পান্থপথ মোড়। অনেকে বলে থাকেন গ্রিনরোড সিগন্যাল। এই রাস্তার একপাশে সোনারগাঁ মোড় অন্যপাশে রাসেল স্কোয়ার। এই রাস্তায় আবার লকডাউন নেই। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়া যায় না। গেটে তালা মেরে লকডাউনের নোটিশ টানিয়ে রাখা হয়েছে! প্রথম দিন (১০ জুন) ভাগ্য ভালো ছিল। যাদের হাতে গেটের চাবি ছিল তারা আমাকে গেট পার করে দিল। যে গেট খুলে দিল আমি ঐ গার্ডের নম্বর নিয়ে রাখলাম। রাতে ফেরার সময় তাকে পাওয়া গেল না, তার মোবাইলও বন্ধ পাওয়া গেল। বেশ খানিকটা পথ ঘুরে আইবিএ হোস্টেলের পাশের গলি দিয়ে রাজাবাজারে ঢুকে আরো অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরলাম। ভাবলাম স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য এইটুকু পথ হাঁটাই যায়!
পরদিন সকালবেলা আমার বাসার নীচে মানুষজন জমে গেল। সাংবাদিকতার কার্ড থাকার কারণে মূল রাস্তার গেট আমার কারণে খোলা হতে পারে। আমি যখন বের হব তখন সবাই বের হবেন। আমি বাসা থেকে নীচে নামার পর সেই গার্ডকে আর পাওয়া গেল না। শব্দ করে এবং খুব দ্রুত মোটর সাইকেল চালিয়ে এসময়ে একটা মোটরসাইকেলে দুজন এলো। এদের গায়ে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের 'কটি টাইপ' জ্যাকেট। এরা ঘটনা জেনে একজন বললো- স্যার মোটরসাইকেলের পেছনে ওঠেন। আমি উঠছি না দেখে একজন নেমে বললো-'বস' ভালোবেসে কিছু বললে শুনতে হয়। মোটরসাইকেলে ওঠেন। আমি উঠলাম। একজন মোটরসাইকেলে আমাকে আইবিএ হোস্টেলের গেট পার করে দিল! আমাকে সকালের থিতু হতে থাকা 'গুমোট রোদে' খানিকটা পথ পায়ে হাঁটতে হলো না। এই দুদিন ভালোই ছিলাম। 'এনিমেল ফার্ম' উপন্যাসের সেই বিখ্যাত দুই লাইন তৃপ্তির সাথে মনে পড়ল। এভরিবডি ইজ ইকুয়াল বাট সামবডি ইজ মোর ইকুয়াল (সবাই সমান তবে কেউ কেউ বেশি সমান!)
অফিসে যেতে যেতে কয়েকটা জিনিস মনে পড়ল। প্রথমটা হচ্ছে, কতজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী থাকলে লকডাউন ও রেডজোন ঘোষণা করা হয়? সম্ভবত ত্রিশের বেশি রোগী থাকতে হয়। ১০ জুন পূর্ব রাজাবাজারের করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী ছিলেন একত্রিশ জনের মতো। ১৪ দিন পরে এই সংখ্যা ছিল পঞ্চাশের কাছাকাছি। মৃত্যবরণ করেছেন একজন, যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাই ভালো হয়ে উঠেছেন। আমার মনে হলো যে ছেলেটা মোটরসাইকেলে খানিক পথ পার করে দিল সে কী সুস্থ? খানিক আরামের জন্য তাকে বিশ্বাস করে লিফট নেয়া কি ঠিক হলো? অবরুদ্ধ হওয়া মানুষজনের জন্য প্রতিদিন পণ্যবাহী খাবার, নিত্যপ্রয়াজনীয় জিনিসপত্র ও তরিতরকারির গাড়ি ঢোকে। যারা এইসব গাড়ি চালান কিংবা পণ্য পৌঁছে দেন তারা সবাই কী সুস্থ? যারা ময়লা পরিষ্কার করেন তারা? এই চিন্তাও মাথায় এলো এর বিকল্প বা কী হতে পারত? সাহায্য কিংবা সরকারি কর্তব্য পালনে নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে তো আসতে হতো। মানুষ মানুষের জন্য, মহামারীতে অনেক মানুষই সেটা ভোলেননি!
অবশ্য তৃতীয়দিনের পর পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকল। যে গার্ড প্রথম দিন গেট খুলে দিয়েছিল সে অনেকের জন্য গেট খুলে দিতে থাকল। হয়তো জনপ্রতি দশটি টাকা তার জন্য অনেক! চারদিনের দিন বিচার বসল। ঐ গার্ডের কাছ থেকে পান্থপথের দুইগেটের তালার চাবি কেড়ে নেয়া হলো। মাইকিং করা হলো ফার্মগেটের কাছাকাছি আইবিএ হোস্টেলের পাশের গলির যে রাস্তা সেখানকার 'সার্ভিস গেট' দিয়ে সবাইকে পূর্ব রাজাবাজারে ঢুকতে এবং বের হতে হবে। নিয়ম পালনে পুলিশ ও প্রশাসনকে কঠোর হতে দেখা গেল। প্রতিটা রাস্তার গেটের কাছে পুলিশ প্রহরা বসানো হলো। 'সার্ভিস গেটে' সার্বক্ষণিক প্রচুর লোক আর টেলিভিশন ক্যামেরা ও সাংবাদিকদের আনাগোনা বাড়তে থাকল। বদ্ধ জীবনে একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে আসল।
লকডাউন এরিয়ায় 'সচেতন হোন, মাস্ক গ্লোভস পরুন, গরম পানি লেবু খান' টাইপ মাইকিং চলতে থাকল। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের গাড়ি পূর্ব রাজাবাজারের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সেখানেও মাইকিং-ছোট মাছ কত আর ইলিশ কত, মুরগি কত আর গরু বা কই মাছ কত সেসবের দাম ঘোষণা করা হলো। আমি যে বাসায় থাকি তার কেয়ারটেকার মন খারাপ করে বলল- 'স্যার কারওয়ান বাজার যাইতে পারলে এর চেয়ে অনেক সস্তায় জিনিসপত্র কেনা যায়। সব সমস্যা স্যার গরীবের'!
লকডাউনের চতুর্থ ও পঞ্চম দিন থেকে আইবিএ হোস্টেলের পাশের গলি যেখানে সার্ভিস গেট বসানো হয়েছিল সেখানে নাম লিখে কার্ড দেখিয়ে যাবার নিয়ম চালু করা হলো। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী, পূর্ব রাজাবাজারের স্বেচ্ছাসেবক, কাউন্সিলরের লোকজনের নাম লিখতে হয়নি। সাংবাদিকদের তাহলে কেন নাম লিখে বের হতে হবে সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না। নাম লেখার সময় যে নম্বর দেয়া হতো সেটা মুখস্থ রাখতে হতো। না হলে আইডি কার্ড থাকলেও ঢোকা যাবে না বলে জানিয়ে দেয়া হলো। আমার এমনিতেই স্মৃতি শক্তি খারাপ। কোনোদিন এন্ট্রি নম্বর বলতে পারিনি এবং বলতেও হয়নি। রাত এগারটার দিকে পুলিশ ছাড়া সার্ভিস গেটে যারা থাকত তারা আড্ডা দিতেই পছন্দ করত। কে বের হচ্ছে আর কে ঢুকছে সেটা কারো নজরে পড়ত না!
পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দারাও 'ফানি'। কেউ বাসার ছাদে বারবিকিউ করার জন্য রাত একটায় মুরগি কিনতে স্বেচ্ছাসেবকদের টেলিফোন দিয়েছেন। কেউ জরুরি ওষুধ কেনার জন্য মাঝরাতে রিং দিয়েছেন। দেখা গেল সেটা ব্রনের ওষুধ! চেহারা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে একারণে কেউ কেউ মেকআপ কেনার জন্যও রিং দিয়েছিলেন, কেউ যেতে চেয়েছিলেন বিউটি পার্লারে! তারপরও লকডাউনের পর পূর্ব রাজাবাজারের করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সংক্রমণ কমেছে। আক্রান্তদের পরীক্ষা করারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। বাসিন্দাদের ভেতর 'অবস্ট্যাকল জাম্প' দেয়ার অভ্যাস বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ বানরের মতো গেট পার হয়ে বাইরে আসতেন। অনেকটা পথ ঘুরে অনেকেই যেতে চাইতেন না সার্ভিস গেট দিয়ে। কয়েকজন গার্ড ছাড়াও বাড়ির মালিক স্যারদের (মূলত যারা বহু বছর ধরে বাড়ি করে পূর্ব রাজাবাজারে বাস করছিলেন) ড্রাইভারদের কাছেও পান্থপথের দিকের চার গেটের চাবি পাওয়া যেত। যখন খুশি তারা বের হতো, চাবি দিয়ে তারা অনেককে গেট খুলে দিত! স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল পূর্ব রাজাবাজার থেকে কোনো গাড়ি বের হবে না, কোনো গাড়ি ঢুকবে না! কিন্তু প্রতিটা দিন একাধিক গাড়ি ঢুকেছে এবং বের হয়েছে। জানতে চাইলেই জানা যেত- ডাক্তারদের গাড়ি! সম্ভবত রাজাবাজারে ডাক্তাররা বেশি থাকেন! লকডাউনের পর একটা শুমারি করা যেতে পারে! ত্রিশ জুন শেষ হবে সব। পূর্ব রাজাবাজারের পরিস্থিতি যেন আরও ভালো হয় সেই কামনা করি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: তিনটি ঘটনা মনে দাগ কেটেছে।
এক. সার্ভিস গেট দিয়ে বের হচ্ছি। এক ভদ্রলোক খুব অনুনয়-বিনয় করছেন বাইরে যাবার জন্য। বলছেন- বাবার ক্যান্সার। জরুরি একটা ওষুধ কিনতে মিটফোর্ড যেতে হবে। স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশের মন গলল না। তারা খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বললো- আপনি এই নম্বরে রিং দেন। আশেপাশের সবচেয়ে বড় দোকানের কোনো একটা দিয়ে কিনে দেয়া হবে! আমি ভদ্রলোকের মোবাইল নম্বর নিয়ে বিকেলের দিকে রিং দিলাম। জানতে চাইলাম- ওষুধ পেয়েছেন কিনা? ভদ্রলোক জানালেন পাননি! যাদের কাছে গেটের চাবি ছিল সেই গার্ড আর 'বাড়িওয়ালা স্যারদের' ড্রাইভারের নম্বর দিলাম। উনি মিটফোর্ড থেকে ওষুধ কিনতে পেরেছিলেন। ফেরার পথে গার্ড বা ড্রাইভারদের পাওয়া যায়নি। উনি গেট টপকে ভেতরে ঢুকলেন। জীবন বাঁচানোর জন্য মাঝে মাঝে এমন নিয়ম ভাঙ্গতে হয়!
দুই. পূর্ব রাজাবাজারে ছেলে ও মেয়েদের 'হোস্টেল' ভাড়া দেয়া হতো। অনেকেই গত চারমাস ভাড়া দিতে পারেননি। এদের বিছানা খাট, বালিশ কম্পিউটার আটকে রাখা হয়েছিল। একজন দুই মাসের টাকা যোগাড় করে জিনিসপত্র নিতে এলেন। প্রতিটা জিনিস দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে বের করতে হলো। তারপর একটা ঠেলা গাড়ি ও রিকশায় কমলাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। তারপরও ছেলে হাসিখুশি। জানতে চাইলাম কারণ কী? সে জানাল চারমাস পরে আজ কমলাপুরে তার প্রেমিকার সাথে তার দেখা হবে! করোনাকালেও যে প্রেম টিকে থাকে সেটা লাইলি মজনুর প্রেম!
তিন. পূর্বরাজাবাজারের প্রতিটা অলিগলিতে পুলিশ প্রহরা থাকত। সকালে বাসা থেকে নেমে দেখি পুলিশের এক সাব ইন্সপেক্টর একটা নাস্তার প্লেট ধরে আছেন এক লোকের সামনে। সে খাচ্ছে না। হাউমাউ করে কাঁদছে। আর মাতম করে বলছে- 'ভাই আমার শাস্তি হওয়া উচিত। যে মা আমারে জন্ম দিছে সে করোনায় মইরা গেল। দেখতে যাইতে পারলাম না। মারে দাফনও দিতে পারলাম না। এইডা আল্লাহর কেমন পরীক্ষা, কেমন বিচার?