Published : 13 Jun 2020, 03:28 PM
আমেরিকায় সম্প্রতি কলম্বাসের ধাতু-প্রস্তর-মূর্তি ভাঙা হয়েছে। বেশ কয়েকজন দাসব্যবসায়ীর মূর্তি ভাঙা হয়েছে ইওরোপে, আমেরিকায়। পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল ষাটের দশকে নকশাল আমলে। বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই দুর্গা বা কালীমূর্তি ভাঙার খবর আসে। গ্রীক-রোমান-আরব-মোগল-পাঠান-তালেবান, মূর্তি কে না ভেঙেছে যুগে যুগে! মূর্তিভাঙার ঘটনা ইতিহাসের মতোই সুপ্রাচীন।
মূর্তিভাঙা একটি জনপ্রিয়, সহজ সন্ত্রাস বটে, কিন্তু ধর্মের ওপর আঘাত হানার কার্যকর কোনো উপায় নয়। মূর্তিভাঙা মূলত পণ্ডশ্রম। সুকুমার রায় যেমনটা লিখেছিলেন: 'ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গাত্রে হলো ব্যথা!' মূর্তি ঈশ্বর বা দেবতা নয়, বিশ্বাসী মানুষের বিবেচনায় ওদের ছায়া মাত্র। ছায়াকে আঘাত করলে গায়ে ব্যথাই শুধু হবে, ঈশ্বর বা ধর্মের গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না। যুগে যুগে দেখা গেছে, মূর্তি ভেঙে দিলেই ধর্ম দুর্বল হয়ে যায় না, বরং এর ফলে সাম্প্রদায়িক রেষারেষি বেড়ে যায়।
বর্ণবাদ আমেরিকার যুগান্তরের ধর্ম। কলম্বাস এই ধর্মের অন্যতম প্রতীক দেবতা। কলম্বাসের মূর্তি ভাঙলেই বর্ণবাদ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে – এমন ধারণা সত্য না হবার সম্ভাবনাই বেশি। মূর্তি ভাঙাতে ইতিহাস বদলাবে না। মূর্তি থাকলে বরং ইতিহাস মনে রাখতে সুবিধা হতো। অতীতের ভুল শুধরানোর জন্যে ইতিহাস স্মরণে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। একই ভুল মানুষ স্থাননামের ক্ষেত্রেও করে। 'জিন্নাহ অ্যাভেনিউ' নাম বদলে 'বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউ' করাতে জনগণের পক্ষে ভুলে যাওয়া অসম্ভব নয় যে চল্লিশের দশকে 'জিন্নাহ' নামক অবিমৃষ্যকারীতার এক ভূত বাঙালি মুসলমানের কাঁধে চেপে বসেছিল, যার চড়া মূল্য দিতে হয়েছে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব বাঙালিকে, ১৯৭১ সালে।
'কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন' – এই কথাটার মধ্যেই বর্ণবাদ নিহিত রয়েছে। 'ভাস্কো দা গামা ভারতবর্ষ আবিষ্কার করেন' – এমনটা বলা হয় না, কারণ, 'ভারতবর্ষ' জায়গাটা যে পৃথিবীতে আছে, ইওরোপীয়রা যেমন সেটা জানতো, তেমনি ইওরোপ, অন্ততপক্ষে 'গ্রীস' নামে একটা দেশ যে আছে, ভারতবর্ষীয়দেরও সেটা অজানা ছিল না, সেই খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকেই। কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা – অতলান্তিক সাগরের ওপারে এই দুটি মহাদেশ যে আছে, ইওরোপীয়রা সে খবর জানতোই না চতুর্দশ শতক পর্যন্ত। বাণিজ্য বা লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে জলপথে ভারতবর্ষ পৌঁছানোর চেষ্টা করতে গিয়ে প্রথমে আমেরিগো ভেসপিউচি এবং তার পর কলম্বাস আমেরিকায় গিয়ে পৌঁছালেন। ইওরোপীয়দের চোখে আমেরিকা জায়গাটা 'আবিষ্কৃত' হলো।
'আবিষ্কার' ক্রিয়াটির ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা যাক। যিনি আবিষ্কার ক্রিয়ার কর্তা, তিনি অবশ্যই মানুষ। আবিষ্কার ক্রিয়ার কর্ম সাধারণত হয় কোনো বস্তু, প্রাণী বা স্থান। কোনো ব্যক্তি যদি আবিস্কৃত হন, তিনি অবশ্যই আবিষ্কারকের তুলনায় হীন কেউ হবেন। ধরা যাক, কোনো কারণে 'ভদ্রলোক আমি' জানতাম না, 'ছোটলোক তুমি' আদৌ রয়েছো। তুমি, তোমার বাসস্থান যখন হঠাৎ আমার চোখে পড়বে, আমি বলবো, আমি তোমাকে 'আবিষ্কার' করেছি। পক্ষান্তরে তুমি কিন্তু হাজার চেষ্টা করলেও আমাকে আবিষ্কার করতে পারবে না। ভদ্রলোক আবিষ্কার করে, ছোটলোক আবিষ্কৃত হয় – এটাই যুগান্তরের নিয়ম। আবিষ্কার যারা করেন, সেই ভদ্রলোকদের মূর্তি স্থাপিত হয় শহরের রাস্তার মোড়ে। আবিষ্কৃত যারা হয়, তাদের মূর্তি কখনই নির্মাণ করা হয় না। কলম্বাস বা আমেরিগো ভেসপিউসিচির মূর্তি আছে আমেরিকায়। কিন্তু আবিষ্কৃত নতুন মহাদেশের কোনো মানুষের মূর্তি ইওরোপ বা আমেরিকার কোথাও, কখনই স্থাপিত হয়নি।
যেহেতু তুমি আমার আবিষ্কার, তুমি আমারই সম্পত্তি, পুত্রতুল্য (পুত্রও পিতার সম্পত্তিই ছিল এক কালে)। পিতামাতাই সাধারণত সন্তানের নাম দেয়। 'মূর্খ আমি' নিজের অজ্ঞানতার কারণে প্রথমে আবিষ্কৃত তোমার নাম দিলাম 'ইন্ডিয়ান'। পরে যখন আমার ভুল ভাঙল, তখন তোমার নামটা শুধরে নিলাম। 'বদমাইশ' আমি' আমার চোখে তোমার গায়ের রঙ অনুসারে তোমার নাম দিলাম: 'রেড ইন্ডিয়ান'। নিজের ভুলটা স্বীকার তো করলামই না, বরং গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো তোমার নামের উপরে আমার বর্ণবাদ চাপিয়ে দিলাম। 'ভদ্রলোক আমি' যা খুশি করতে পারি না কি?
তারপর 'উড়ে এসে' আমি তোমার দেশে 'জুড়ে বসলাম'। জাহাজে করে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে অচিরেই তোমার জায়গাজমি সব দখল করে ফেললাম, ঠিক এখন যা করছে ইসরাইলীরা পশ্চিম তীরে, গাজায়। 'পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই। আমি তো সেই ঘরের মালিক নই!' আমাদের 'মহান' আমেরিগো ভেসপিউচি কিংবা কলম্বাসের নামানুসারে ছোটলোক তোমার জন্মস্থানের নতুন নাম হলো 'আমেরিকা' কিংবা 'কলাম্বিয়া'। আমার ছেড়ে আসা দেশের জায়গা, ভাষা কিংবা অনুসৃত ধর্মব্যক্তিত্বের নামানুসারে একে একে তোমাদের দেশের জায়গাগুলোর নাম বদলে দিলাম: নিউ ইয়র্ক, লস এ্যাঞ্জেলেস, লাস ভেগাস কিংবা মন্ট্রিয়ল, যাতে দেশটি কাগজেপত্রে চিরদিনের জন্যে 'আমাদের' হয়ে যায়। তোমার ভাষায় তোমার বাসস্থানের কোনো নাম আদৌ আছে কিনা, তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনই বোধ করিনি কখনও। এরপর তোমাকে, তোমাদের সবাইকে আমি নির্দয়ভাবে খুন করলাম তুচ্ছ কোনো অজুহাতে বা বিনা অজুহাতে, শ্রেফ জায়গা খালি করার জন্যে। কিংবা আমার শরীরে বয়ে আনা সংক্রামক যৌন ব্যাধিতেই মরে সাফ হয়ে গেলে তোমরা বেশির ভাগ।
অবস্থা এমন দাঁড়াল যে দখল করা জমিতে কাজ করার লোকই আর খুব বেশি রইল না। এই সমস্যার সমাধানে আফ্রিকা থেকে কালো মানুষদের পশুর মতো পাকড়াও করে জাহাজে করে নিয়ে আসলাম আমার নতুন দেশে। তাদের সঙ্গে পশুর মতো ব্যবহার করতাম, কারণ মানুষ হলেও আমরা ককেশিয়ানদের মতো উন্নত মানুষ তো তারা নয়। গায়ের রঙটা কালো, চেহারার ছিরিছাঁদ এতটাই বিশ্রী যে পশুর কাছাকাছি কোনো জীব বলা যেতে পারে তাদের। মশামাছি মারতে গিয়ে মানুষ যেমন দুবার ভাবে না, তেমনি কালো মানুষের জীবনেরও কোনো দাম থাকার কথা নয়: 'ব্ল্যাক লাইভস শুড নট ম্যাটার!'
অনেক দিন পর, ধীরে, অতি ধীরে অবস্থা অবশ্য পাল্টেছিল। দাসব্যবসা, দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সাদা মানুষের মানসিকতা পাল্টায়নি। পাপ, করোনাভাইরাস এসব এক দিনে যায় না। সাদা পুলিশের হাতে কালো মানুষেরা অত্যাচারিত হয়েই চলেছে, মারাও যাচ্ছে অনেকে। গত শ খানেক বছরে যে সকল কালো নেতা কালো মানুষদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন, তাদের প্রায় সবাইকে খুন করা হয়েছে। এমন নয় যে রিপাবলিকানরাই শুধু এর জন্যে দায়ী। যত আফ্রো-আমেরিকান খুন হয়েছেন গত কয়েক দশকে, তাদের অনেকেই খুন হয়েছেন ডেমোক্র্যাট সংখ্যাগরিষ্ট রাজ্যগুলোতে। এমনকি এক কালা আদমি যখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হয়েছিল, তখনও কালোদের অবস্থা খুব একটা বদলায়নি, কারণ নিজের গায়ের রঙ কালো হলেও বসার চেয়ারটা তো ওর সাদা এবং কে না জানে, 'চেয়ার মেকস দি ম্যান!' ট্রাম্পের জায়গায় জো বাইডেন আসলেও অবস্থা খুব একটা পাল্টানোর কথা নয়।
সাদা মানুষের চোখে আবিষ্কারক আমেরিগো ভেসপিউচি বা কলম্বাস অবশ্যই মহান, কারণ এই ব্যক্তিরা কয়েক শতাব্দী ধরে লুণ্ঠন ও শোষণের সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে। বর্ণবাদ এই লুণ্ঠনের অন্যতম ধর্ম, দর্শন। এই ধর্মের প্রয়োজন ছিল প্রথমত, কালা আদমিদের বিরুদ্ধে সাদা মানুষদের ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্যে এবং দ্বিতীয়ত, কালো মানুষদের পশুর মতো খাটানোর জন্যে। আমেরিকার অর্থনীতিই গড়ে উঠেছিল কালোদের শোষণ করে। যুগে যুগে বিপুল ধন মাত্রেই বিপুল ও বিচিত্র পাপের ফলশ্রুতি।
হ্যাঁ মানুষে মানুষে সাম্যভিত্তিক আইন ছিল বৈকি আমেরিকায়। আমেরিকার সংবিধানেই তো লেখা আছে: সকল মানুষ সমান, স্বাধীন। কিন্তু সাদারা সেইসব আইনের তোয়াক্কা করত না। জেল থেকে গায়ের জোরে বের করে নিয়ে এসে কালা আদমিকে ফাঁসি দেবার ঘটনা ঘটেছে দেদার, তাও প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে, বাংলায় যাকে বলে ঢোড়া পিটিয়ে। সাদা পুলিশ পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত অকুস্থলে, রা'টি কাড়তো না। একবার এক সাদা মহিলা স্বপ্ন দেখলেন, এলাকার এক কালা আদমি তাকে ধর্ষণ করছে। ব্যস সেই কালা আদমিকে ফাঁসিতে লটকানো হলো। আরেকবার মিথ্যা অভিযোগে এক কালা আদমিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। ঘোষণা দেয়া হলো, টাউনহলের সামনে তার শরীরের অঙ্গগুলো একটি একটি করে কর্তন করা হবে। মৃত্যুভয়ে জেল থেকে পালাতে গিয়ে সেই কালা আদমি ধরা পড়ল। মৃত্যু অনিবার্য দেখে সাজানো অপরাধী সাদা জনতাকে শেষ অনুরোধটুকু করলো: 'গুলি করে মারুন আমাকে!' সেই অনুরোধ গ্রাহ্য হয়নি। কষ্ট দিয়ে না মারলে ক্ষমতা দেখানো যায় না, কালা প্রজাদের কানে সাদা শাসকদের শ্রেষ্ঠতা এবং জ্যেষ্ঠতার সঠিক বার্তাটি পৌঁছে দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশে এক হিন্দু বিধবার কিশোরী কন্যাকে ধর্ষণ করতে এসেছিল এক দল স্থানীয় গুণ্ডা। কোন দলের ছিল তারা, আপনারা জানেন, যদি সব দলেই এমন গুণ্ডা আছে এবং গুণ্ডাদের কোনো দল নেই, সেটাও সত্যি। বিধবা নাকি ধর্ষকদের অনুনয় করে বলেছিল: 'বাবারা আপনারা একজন একজন করে আসুন। আমার মেয়েটি ছোট!' জানি না, সেই অনুরোধ গ্রাহ্য হয়েছিল কিনা। এই ঘটনার অন্তর্নিহিত বার্তা হচ্ছে: 'তুমি, তোমরা এদেশে এখনও আছো কেন? তুমি বিদায় হলেই তো তোমার বসতভিটাটি আমি দখল করে নিতে পারি! বাবরি মসজিদ ভেঙে মূলতঃ মুসলমানদের জানিয়ে দেয়া হয় সেই পুরনো দাবি: 'পাকিস্তানে কবে যাবি?' একই দেশের একদল মানুষ অন্য একদল মানুষের সঙ্গে এমন নৃশংস, অকথ্য আচরণ করে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, প্রায়শই সরকারি মদতে, শ্রেফ ক্ষমতা দেখানোর জন্যে। ক্ষমতা দেখানোর প্রয়োজন হয় একান্তই অর্থনৈতিক কারণে, আমেরিকায়, বাংলাদেশে, কোথায় নয়?
বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা একেকটি সামাজিক পাপ। যে কোনো সামাজিক পাপে দুই একজন বা অল্পসংখ্যক ব্যক্তির সুবিধা হয় বটে, কিন্তু আখেরে সমাজের কোনো মঙ্গল হয় না। একটি জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা মানে এমন কিছু প্রতিভার জন্মের সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট করা, যারা মানুষের জীবনে, সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা লিখেছেন: 'তুমি যারে নিচে ফেলো, সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে। পশ্চাতে ফেলিছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।' সমাজের একটি গোষ্ঠীকে আজীবন পিছনে রেখে সমাজ সামনে এগোতে পারে না। আজ মানব সমাজ প্রযুক্তির যে পর্যায়ে রয়েছে, বিভিন্ন সামাজিক পাপ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে হয়তো তার চেয়ে এগিয়ে থাকত। অন্য ধর্মাবলম্বীদের উচ্ছেদপ্রক্রিয়া দীর্ঘদিন জারি রেখে একটি দেশ যখন একধর্মাবলম্বী হয়ে যায়, তখন তার কী যে করুণ দশা হয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিচারে, পাকিস্তান-আফগানিস্তান – এই দুই দেশ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সুতরাং বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার মতো সামাজিক পাপের মূলোৎপাটন দেশ ও সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনেই অপরিহার্য।
যুগে যুগে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন কালো ও সাদা মানুষেরা, আমেরিকায়, ইওরোপে। সামনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। করোনা-আকালে লোকজন মাস তিনেক গৃহবন্দী হয়ে আছে, কোটি কোটি লোক বেকার হয়ে পড়েছেন। একেতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকানদের মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মহামারী নিয়ন্ত্রণে কমবেশি ব্যর্থ, তার ওপর কিছু উসকানিমূলক বার্তাও তিনি দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত জেনে বা না জেনে। বিভিন্ন কারণে এবারকার বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভটা একটু প্রবলই বটে। এই বিক্ষোভের অংশ হিসেবে বর্ণবাদের প্রতীক দাসব্যবসায়ী বা তথাকথিত অভিযাত্রী-আবিষ্কারকদের মূর্তি ভাঙা হচ্ছে। মূর্তি ভাঙাকে বর্ণবাদ সমস্যার সমাধান ভেবে অনেকে উচ্ছসিতও হচ্ছেন।
সমস্যা হচ্ছে, দূর্গামূর্তির মাথাটা কিংবা পাঁচশো বছর আগের বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেললেই ধর্মের গজদন্তমিনার যেমন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে না, তেমনি এখানে ওখানে কলম্বাসের দুই একটি মূর্তি গুড়িয়ে দিলেই আমেরিকায় বর্ণবাদ রাতারাতি অতীতের স্মৃতি হয়ে যাবে না। এর কারণ, প্রথমত, মূর্তি বা প্রার্থনাগৃহ ধর্মের অন্যতম উপকরণ বটে, কিন্তু অপরিহার্য উপকরণ নয়। দ্বিতীয়ত, মূর্তি অনেক রকম হয়: ধাতুমূর্তি, কথামূর্তি, লিপিমূর্তি, ভাবমূর্তি। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি ধর্মই মূর্তি সৃষ্টি করে, কারণ মূর্তি ছাড়া প্রার্থনা অসম্ভব। মূর্তি নির্মাণের জন্যে ধাতু-কাঠ-পাথর অপরিহার্য উপাদান নয়। মনের মূর্তি কথা আর ভাব দিয়ে নির্মিত হয়। প্রতিটি গ্রন্থে মূর্তি সৃষ্টি করা হয়েছে, শ্রেফ কথা দিয়ে। 'খোদার আসন, আরশ ছেদিয়া উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর!' ঈশ্বরের ঘর, ঈশ্বরের আসন… ইত্যাদি শব্দবন্ধ কথামূর্তি নির্মাণের অন্যতম মালমশলা। তীর্থ, সে যে কোনো ফর্মেই হোক না কেন, মূর্তিপূজা বৈ নয়। আপনি ঈশ্বরের সন্ধানে স্থানান্তরে যান – এর মানে হচ্ছে, আপনি বিশ্বাস করেন, ঈশ্বর সব জায়গায় নেই। যার সন্ধানে বিশেষ এক জায়গায় যেতে হয়, তিনি নিরাকার হতেই পারেন না, অন্ততপক্ষে বিশ্বাসীর মনে।
মূর্তি রক্তবীজ অসুরের মতো, অর্থাৎ অচিরেই পুনরায় স্ব-সৃজনের ক্ষমতা রয়েছে তার। ধাতু-ইট-পাথরের মূর্তি ভাঙলে তার ধ্বংসস্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো নতুন শত শত কথামূর্তি, ভাবমূর্তি গজিয়ে উঠে। ধাতুমূর্তি ভাঙা সহজ, লিপিমূর্তি, কথামূর্তি ভাঙা তার চেয়ে কঠিন, ভাবমূর্তি ভাঙা সবচেয়ে কঠিন। দুস্কৃতকারীরা মাটির দুর্গা কিংবা কালীমূতি ভাঙে বাংলাদেশে, কাজটা সহজ বলেই। এই সহজ কাজটাই নাদান জনতা সোৎসাহে করছে আমেরিকায়।
আলোচনার উজানে বলেছি, বর্ণবাদ একটি ধর্ম। যেকোনো ধর্মের মতো এই ধর্মের আসল মূর্তিগুলোও কথা, ধারণা, নিত্যদিনের অভ্যাস দিয়ে তৈরি। শুধু সাদা মানুষের মনে নয়, কালো মানুষের মনেও বর্ণবাদ আছে। আমেরিকার অনেক রাজ্যে কালো মানুষেরা বর্ণবাদী প্রার্থীদের ভোট দেয়, কারণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থানের বিচারে নিজেদের তারা 'সাদাটে' মনে করে। সুতরাং বর্ণবাদের দেবতাদের ধাতুমূর্তি ভাঙলেই বর্ণবাদ দূর হবে না। বর্ণবাদের কথামূর্তি এবং ভাবমূর্তি ভাঙার চেষ্টা করতে হবে।
কাজটা সহজ নয় এবং এ কারণে বর্ণবাদ সমস্যার কোনো শটর্কাট সমাধান নেই বলেই মনে হচ্ছে। মূর্তিভাঙা পণ্ডশ্রম শুধু নয়, এটি একটি ক্যামোফ্ল্যাজ বা বিভ্রান্তি সৃষ্টির উপকরণও হতে পারে এই অর্থে যে মূর্তিভাঙার ফলে বর্ণবাদের আসল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরে যেতে পারে: কলম্বাসের মূর্তিই যখন ভেঙে ফেলা হয়েছে, তখন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে আর লাভ কী? এভাবে বর্ণবাদ সমস্যার সমাধান হতে আরও বহু শতাব্দী লেগে যেতে পারে।