Published : 15 May 2020, 02:33 PM
আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৪ মে বিকেল পাঁচটার দিকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। তিনি ছিলেন আমার থেকে মাত্র সোয়া দু বছরের বড়। সহপাঠী হলেও সেটা অসম্ভব হতো না। কিন্তু না, আমার যে-কজন শিক্ষককে আমি শিক্ষক বলে সবচেয়ে উচ্চাসনে বসিয়ে শ্রদ্ধা করেছি, তিনি তাঁদের একজন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, গায়ের জোরে গুরু হওয়া যায় না; যে-মানুষ গৌরব পায় সে-ই গুরু হয়। তিনি গৌরবের অধিকারী হয়ে গুরু হয়েছিলেন। তাঁকে দেখলে এমনিতেই মাথা নত হয়ে যেত।
কিন্তু তাঁর পরিচয় কেবল শিক্ষক হিসেবে নয়। তাঁর আর-একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক এবং সমাজহিতৈষী একজন অসামান্য মানুষ। যেকালে মানুষকে অনায়াসে কিনে নেওয়া যায় অর্থ দিয়ে, উচ্চপদে বসিয়ে, পুরস্কার দিয়ে, সেই গ্রহণগ্রস্ত কালে তিনি ছিলেন একজন আপসহীন অকুতোভয় চির-উন্নতশির মানুষ। যখন সবাই ক্রীতদাসের হাসি হেসে 'জি হুজুর' বলে কুর্নিশ দিতে ব্যস্ত, তখন তিনি নির্ভীক সমাজ-বিবেক হিসেবে এক অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। সে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হোক, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিপর্যস্ত বাংলাদেশে হোক, বন্দুক-ওঁচানো শাসন-কালে হোক, নৈরাজ্য-কালে হোক, দালাল-রাজাকারদের পতাকা-ওড়ানো কালে গণ-আদালতে হোক, তিনি বারংবার সমাজ-সৈনিক হিসেবে তাঁর ভূমিকা পালন করেছেন। সংকট-কালে তিনি পালন করেছেন বিবেকের দায়িত্ব পালন।
কিন্তু একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে এবং পণ্ডিত হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন, সে কথা লেখার মানুষ অনেক আছেন, আমি লিখবো তাঁকে কাছ থেকে একজন শিক্ষক এবং মানুষ হিসেবে যেমনটা দেখেছি।
যে-যুগে শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গেছে, অধ্যাপকের সঙ্গে পাণ্ডিত্যের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, নীরন্ধ্র অন্ধকারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যা লয় প্রাপ্ত হয়েছে, সেই সংকটকালে যে-স্বল্পসংখ্যক মনীষী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ আলোকিত করে রেখেছিলেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন তাঁদেরই একজন।
কিন্তু আমি তাঁর একেবারে পেছনের কাতারের ছাত্র। তাঁর পাণ্ডিত্যের মূল্যায়ন করা দূরে থাক, তাঁর পাণ্ডিত্য নিয়ে আলোচনা করাও আমার পক্ষে ধৃষ্ঠতা। মানুষ ও শিক্ষক হিসেবে তাঁকে যেমনটা দেখেছি, কেবল সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।
মনে আছে গ্রাম-থেকে-আসা মুখচোরা এবং লাজুক যুবক হিসেবে বাংলা বিভাগের সমস্ত শিক্ষকের কাছ থেকে আমি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আনিস স্যার আমাকে সামনে টেনে এনেছিলেন। মনে পড়ে এমএ চূড়ান্ত পরীক্ষায় আমি দৈবক্রমে প্রথম হয়েছিলাম। কিন্তু রেজাল্ট প্রকাশিত হবার পর বিভাগের কোনো শিক্ষক চিনতে পারলেন না আমি কে। কেবল আনিস স্যার বললেন, তিনি আমাকে চেনেন। তারপর থেকে কতোবার যে-আমি তাঁর কাছে সাহায্য নিয়েছি, তার হিসাব নেই। মনে আছে, আমার প্রথম বই বৈষ্ণব পদাবলী প্রবেশক-এর পাণ্ডুলিপি আমি তাঁকে দেখিয়েছিলাম। তিনি সবটা দেখে মৃদু হেসে আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে বলেছিলেন যে, বৈষ্ণব পদাবলীর এমন গোত্র-ছাড়া ব্যাখ্যা অন্য কেউই দেয়নি। আমার প্রিয় শিক্ষক আহমদ শরীফ স্যার তো রীতিমতো তিরস্কার করে আমার লেখাটি কিচ্ছু হয়নি বলে সাবধান-বাণী উচ্চারণ করেছিলেন।
আমার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ যখন রচনা করি, তখনো তিনি তা আগাগোড়া পড়ে তাঁর মূল্যবান মতামত দিয়েছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্যার সপরিবারে কলকাতায় ছিলেন। আমিও ছিলাম সপরিবারে। তখন পেট চালানোর জন্যে আমি আনন্দবাজার পত্রিকা আর দেশ পত্রিকায় প্রায় চল্লিশটি লেখা প্রকাশ করেছিলাম। এসবের মধ্যে ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক পটভূমি নিয়ে পাঁচ কিস্তির একটি রচনা, 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'কে জাতীয় সংগীত করার পক্ষে দুই কিস্তিতে একটি রচনা, 'ছায়ানট' নিয়ে একটি লেখা ইত্যাদি। এখনো মনে আছে এই লেখাগুলোর অনেকটাই লিখতে আনিস স্যারের সাহায্য নিয়েছিলাম। স্যার অকৃপণভাবে সহায়তা করেছেন।
অনেক বছর পরে যখন দেশ পত্রিকায় আমার আশার ছলনে ভুলি: মাইকেল-জীবনী বইটি সপ্তাহে সপ্তাহে প্রকাশিত হচ্ছিল, তখনও তাঁকে লেখাটির একটা অংশ পড়তে দিয়েছিলাম। স্যার তা পড়ে তাঁর মূল্যবান মতামত দিয়েছিলেন। আমার ধারণা, এ রকমের সাহায্য তিনি তাঁর অন্য ছাত্রদেরও করতেন। কারণ, সাহায্য এবং উপকার করার মনোভাব ছিল তাঁর সহজাত। এ ছিলো তাঁর উদার চরিত্রের অচ্ছেদ্য অংশ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে 'বিদ্যাসাগর বক্তৃতামালা' দেওয়ার জন্যে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল ১৯৭২ সালে। সেখানে যে-বক্তৃতাগুলো দিয়েছিলাম, তা রবীন্দ্রমানস ও সৃষ্টিকর্মে পূর্ববঙ্গ, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রচর্চা নামে পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিলো। সে পাণ্ডুলিপিটিও স্যার পড়ে দেখে তাঁর মূল্যবান মন্তব্য করেছিলেন।
কিন্তু তাঁর পাণ্ডিত্য, গবেষণা, সামাজিক ভূমিকা পালন ইত্যাদির থেকেও যে-কারণে আমি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তা হলো তাঁর ব্যক্তিত্ব। তাঁর মতো এমন অমায়িক, মিষ্টিভাষী এবং অন্যের উপকার করতে সর্বদা প্রস্তুত মানুষ আমি আর দেখিনি। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা একান্ত বন্ধুর প্রতিও সঙিন উঁচিয়ে থাকি, পেছনে নিন্দায় পঞ্চমুখ হই। অপর পক্ষে, তিনি শত্রুর প্রতিও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে থাকতেন। এমন অজাতশত্রু এ যুগে একান্ত বিরল। সেই বিরল মানুষটিও চলে গেলেন।
আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার পর তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয়। সত্যিকার অর্থে তাঁর সঙ্গে এই যোগাযোগ থেকে আমি অত্যন্ত লাভবান হয়েছি। আমি বস্তুত গত অর্ধ-শতাব্দী ধরে তাঁর ছাত্রই রয়ে গেছি। আপসোসের বিষয় তিনি যতোটা দিয়েছিলেন, আমি তাঁর কাছ থেকে ততোটা নিতে পারিনি।
প্রতিভাবান লোকেদের অনেকেই উৎকেন্দ্রিক হন। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও অসাধারণ প্রতিভাবান হলেও, আশ্চর্যজনকভাবে আর-পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো। তাঁর মতো এমন নিরহঙ্কার, নিজেকে জাহির না-করা, বিনয়ী, মৃদুভাষী, আপাদমস্তক ভদ্রলোক আমি খুবই কম দেখেছি। তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল, কিন্তু পাণ্ডিত্যের সঙ্গে সচরাচর যুক্ত অসহিষ্ণুতা অথবা অহংকার ছিল না। তাঁর পাণ্ডিত্য সম্পর্কে আর-একটা কথা না-বলে পারা যায় না – এই বিশেষজ্ঞতার যুগে অনেক ক্ষেত্রে অসামান্য পাণ্ডিত্যও সীমাবদ্ধ থাকে একটা গণ্ডীর মধ্যে। অধ্যাপক আনিসুজজ্জামানে পাণ্ডিত্য সে রকম সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি বিবিধ বিষয় নিয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন করেছেন। বিবিসির পক্ষ থেকে আমি বহুবার নানা বিষয় সম্পর্কে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সাহিত্য এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে। প্রতিবারই লক্ষ করেছি, তিনি তথ্যপূর্ণ বক্তব্য রাখতেন। সেই সঙ্গে দিতেন নিজের মৌলিক পর্যবেক্ষণ।
তাঁর পাণ্ডিত্য এবং ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্যে তিনি দেশ-বিদেশের বহু স্বীকৃতিও লাভ করেছিলেন। এবং বহু পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু পুরস্কার আজকাল মূল্যহীন – অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ওপর নির্ভরশীল। পুরস্কার-প্রাপ্তদের নাম পর্যন্ত লোকেরা জানে না। অপর পক্ষে, আনিস স্যার পুরস্কার পেয়ে পুরস্কারগুলোকে গৌরব দান করেছিলেন। আমরা অমর কথাটা এখন যত্রতত্র ব্যবহার করে শব্দটাকে মূল্যহীন করে ফেলেছি। তবু সেই অমর শব্দটি দিয়েই বলবো, পণ্ডিত হিসেবে, সমাজ-বিবেক হিসেবে এবং সর্বোপরি একজন ব্যক্তি হিসেবে তাঁর খ্যাতি বহুকাল টিকে থাকবে। তাঁর একজন নগণ্য ছাত্র হিসেবে তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।