Published : 03 May 2020, 04:03 PM
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে সম্মানিত ডিন মহোদয় স্বাক্ষরিত একটি নোটিস আপলোড করা হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন:
"কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহে কোনো সেশনজট ছিল না। সেই ধারাবাহিকতা বহাল রাখতে লকডাউন শেষে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নিমিত্তে প্রতিটি শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ঘরে বসে পরীক্ষার যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে বলা হচ্ছে। এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠার পর আমরা যেন একের পর এক পরীক্ষা নিতে পারি তার সকল প্রস্তুতি কলেজ ও শিক্ষার্থীদের থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে সেশনজট নিরসনে আগে যেমন আমরা ক্রাশ প্রোগ্রাম করে সফল হয়েছি সেই রকম মেথড এইখানেও এপ্লাই করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের মনে রাখা উচিত কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সিংহভাগ কারিকুলাম শিক্ষার্থীকে তার নিজ উদ্যোগে সম্পন্ন করতে হয়। এই মহামারী চলাকালীন শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে এবং নিজ নিজ বাড়িতে বসে তার কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠক্রম গ্রহণ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে।"
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি বেতনভুক শিক্ষক রয়েছেন একশ'র মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটি খুবই আপডেডেট। কীভাবে বিভিন্ন ফিস জমা দিতে হবে, কীভাবে রশিদ সংরক্ষণ করতে হবে, কীভাবে সোনালীসেবা ব্যবহার করতে হবে ইত্যাদি খুঁটিনাটি তথ্য আছে কিন্তু শিক্ষকদের নাম-পরিচিতি কিছুই নাই। বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরূদ্ধে প্রধান অভিযোগ, এই অ্যাফিলিয়েটিং সংস্থাটি কেবল রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে মনোযোগী। তাদের আদায়কৃত অর্থের পুরোটাই শিক্ষার্থীদের। সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এক টাকাও দেয় না। দেশের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অবস্থা নেই। শিক্ষার্থীদের দরিদ্র পিতামাতার কষ্টার্জিত অর্থের সদ্ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পেছনে তেমন কোনো অর্থ ব্যয় করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনভুক শিক্ষকগণও কোনো ক্লাস নেন, এমনটা আমরা দেখিনি। সরকার ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা থাকা অলস ২ হাজার ২৩২ কোটি টাকা জব্দ করার ব্যবস্থা নিয়েছে। তথাপি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে কোনো বিকার দেখা যাচ্ছে না।
গাজীপুরস্থ বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ, একাডেমিক কাউন্সিল, সিনেট, সিন্ডিকেট ইত্যাদি থাকলেও এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যবস্থা অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে থাকেন অর্থ আদায় এবং কায়িক শ্রমের ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিকেন্দ্রীকরণ নীতিতে বিশ্বাসী। কোভিড-১৯ সংক্রমণকালে শিক্ষার্থীদের ঘরে বসে পড়াশুনা করার নির্দেশ দেওয়ার মাধ্যমে তারই একটি নিদর্শন দেখা যাচ্ছে।
যাই হোক, সমালোচনা করার উদ্দেশ্যে এই লেখা নয়। শিক্ষার্থীদের জন্য আমাদের উদ্বেগ রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নির্দেশ আসার বহু আগে থেকে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি। আমার কাছে তথ্য রয়েছে, অধিভুক্ত ২৭৫টি সরকারি কলেজে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকগণ ক্লাস নিচ্ছেন। আমাদের অধিদপ্তরও বিষয়টি অবগত। সম্মানিত মহাপরিচালক মহোদয় আমাদেরকে এই কাজ চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এতদিন পর্যন্ত বিষয়টি এক রকম ছিল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নোটিশের পর সত্যিকারের উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথমত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, কোভিড-১৯ বিদায় নিলে ক্রাশ প্রোগ্রামের থিওরি প্রয়োগ করা হবে। ক্রাশ প্রোগ্রামকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশাল সফলতা বলে দাবি করতে চায়। মাননীয় ডিন বা ভিসি মহোদয় যা-ই বলুন না কেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাশ প্রোগ্রাম নিয়ে প্রচুর সমালোচনা আছে। সেশনজট কমাতে গিয়ে শিক্ষার মানের সাথে মারাত্মক আপস করা হয়েছে। দ্বৈত পরীক্ষণ পদ্ধতি বাতিল করা এবং সিলেবাস শেষ না করে পরীক্ষা নেওয়াটা সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে। আর এখন অফিশিয়ালি ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, বাড়িতে বসে পড়াশুনা করার জন্য। বিষয়টি সত্যি উদ্বেগের।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আহ্বানের সূত্র ধরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার অধিভুক্ত কলেজগুলির শিক্ষকমণ্ডলীকে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছে। সচেতন মহলের প্রশ্ন, এই নির্দেশ দিলেই শিক্ষার্থীদের প্রতি সকল দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? যেকোনো আধুনিক মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহারকে স্বাগত জানাবে। কিন্তু বাস্তবতা হল, আমাদের শিক্ষার্থীদের নব্বইভাগ প্রযুক্তি সুবিধার বাইরে রয়েছে। শিক্ষকগণও প্রশিক্ষিত নন। তারা কোনো লজিস্টিক সহায়তাও পান না। বাইরের মানুষরা শুনলে অবাক হবেন যে, সরকারের অনেক নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা মোবাইল ভাতা পেলেও সরকারি কলেজের সিনিয়র শিক্ষকগণও এরূপ কোনো ভাতা পান না। এমনিতেই আমাদের সমাজে বৈষম্যের শেষ নেই। অনলাইন কার্যক্রমের ফলে ধনী-দরিদ্র এবং গ্রাম-শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যে নানামুখি প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। বিবেচক মহলের বক্তব্য হল, সময়ের প্রয়োজনে অনলাইন বা অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করতেই হবে। তবে কেবল প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এটিকে সফল করা যাবে না।
আশার কথা হল, শিক্ষার্থীদের ক্ষতির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা অধিদপ্তর সজাগ আছে। জরুরি বিবেচনায় তারা ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য ভিডিও ক্লাস ধারণ করে বিটিভির মাধ্যমে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেখানে সরকারি অর্থের অপচয়ের অভিযোগ পাওয়া যায় সেখানে মাত্র সাড়ে সাত কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫২০টি ক্লাস রেকর্ড ও সম্প্রচারের বাজেট করা হয়েছে। শিক্ষকবৃন্দের আন্তরিকতা না থাকলে এত অল্প সময়ে এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখত না। আমরা বিশ্বাস করি, মাধ্যমিক শ্রেণির দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর অল্প সময়ের মধ্যেই উচ্চতর শ্রেণির পাঠদান পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবেন। আমাদেরকে দ্রুত কাজ করতে হবে। কিন্তু সমন্বয়হীন পদক্ষেপের মাধ্যমে ভুল করা যাবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস আদেশ তেমনই একটি ভুল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে শিক্ষার্থীদের জন্য আরও অর্থবহ কিছু করা সম্ভব। জাতীয় বিশ্ববিদ্যলয়ের রয়েছে নিজস্ব অ্যাপস এবং শতাধিক শিক্ষক। তাদের কাজে লাগানো যায়। এ ছাড়া ৪৯ সদস্যের একাডেমিক কাউন্সিল আছে। অধিভুক্ত ২৩০০ কলেজের অন্তত আট-দশ হাজার শিক্ষক, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ধরনের কাজে সম্পৃক্ত। 'স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন ফাইন্যানসিয়াল কর্পোরেশনসহ স্ব-শাসিত সংস্থাসমূহের তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন, ২০২০' অনুযায়ী উদ্বৃত্ত অর্থের ৭৫ শতাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার পরেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে হাজার কোটি টাকা থাকার কথা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে অধিত ৪৪টি বিষয়ের উপর উন্নতমানের ভিডিও ক্লাস তৈরির প্রকল্প হাতে নিতে পারে। মাত্র এক-দেড়শ কোটি টাকা ব্যয় করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে স্থায়ী মেধাসম্পদ চলে আসবে। অর্থ দিয়ে এর মূল্য বিচার করতে গেলে শিক্ষার মানের সাথে আপস করা হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক যে সকল অনলাইন ক্লাস নেওয়া হচ্ছে সেগুলি চলুক। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু এই উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিতে চাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই গতানুগতিক চিন্তার বাইরে কিছু একটা করতে হবে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে লকডাউনকালে তাদের সেশন ফিস মওকুফ করার অনুরোধ জানিয়েছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরও উচিত হবে শিক্ষার্থীদের সেশন ফি মাফ করে দেওয়া।
শিক্ষা বিষয়ে আমাদের দেশে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষাদানের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নন। এরকম কর্মকর্তাদের কাছে অনেকে ভুল তথ্য পরিবেশন করেন। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস, ক্রাশ প্রোগ্রাম ইত্যাদি নানা বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে কি না সন্দেহ হয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কেন্দ্রীয় কমান্ড বজায় রাখা গুরুত্ব পাচ্ছে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলির মধ্যে সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ইত্যাদি বহু ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অনলাইন বা ভিডিও ক্লাসের মতো একটি যুগ পরিবর্তনকারী পদক্ষেপ নিতে হলে যথাযথ ফিল্ড স্টাডি করতে হবে। এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিক্ষিপ্ত নির্দেশ সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলবে। ২০ লক্ষের অধিক শিক্ষার্থীকে সেবা প্রদানের জন্য একটি তহবিল গঠন করতে হবে। প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। কে, কীভাবে তা বাস্তবায়ন করবেন তার খুঁটিনাটি নির্ধারণ করতে হবে। মাননীয় মন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারে। একাডেমিক কাউন্সিলের পরামর্শও নেওয়া উচিত।
আমরা অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো নির্দেশ প্রদানের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় কোনো বাজেট বরাদ্দ করা হয় না। বছর জুড়ে নববর্ষ ও নানা জাতীয় দিবস উদযাপন, সভা-সেমিনার ও র্যালি ইত্যাদি অসংখ্য অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করতে হয় শিক্ষার্থীদের কাছে আদায় করা প্রতিষ্ঠানের বেসরকারি তহবিল থেকে। বরাবর হয়ে যায় বলে কর্তৃপক্ষের কাছে সঠিক চিত্রটি যাচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বরাদ্দ হলে তা হবে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে অর্থ আদায় করা হয় তা যেন সঠিকভাবে ব্যয়িত হয় সে দিকটা দেখাও আমাদের কর্তব্য।