Published : 02 May 2020, 08:09 PM
বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দেশি বিদেশি সরকার প্রধানদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ছোট কিংবা বড় রাষ্ট্র বলে কথা নয়, কোভিড-১৯ কে থামাতে বেশির ভাগ রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতার চিত্রটি সামনে চলে আসছে। নীতি নির্ধারকদের নির্ঘুম ব্যস্ততা বলে দিচ্ছে কোভিড-১৯ এর কাছে তারা কত অসহায়।
চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম বাঘা বাঘা রাষ্ট্রের। তবু কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে গবেষক, চিকিৎসক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, সাংবাদিক ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা।
অনেকে দেশের সরকার প্রধানদের সিদ্ধান্তহীনতার চিত্র দেখা গেলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোভিড-১৯ মোকাবেলার সিদ্ধান্তগুলো বেশ প্রশংসার দাবি রাখে। অন্যান্য দেশের সিদ্ধান্তগুলো বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সুপারিশে হয়ে এলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত বড়ই পোক্ত, যা অন্য কোনো রাষ্ট্র প্রধানদের ক্ষেত্রে সম্ভবতার সূচকে নিম্নগামী।
দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে যখন প্রধানমন্ত্রী মরিয়া, কোটি কোটি টাকার অতিরিক্ত বাজেটে মানুষকে সুরক্ষা দিতে যখন লড়াই করছেন, ঠিক তখনই নানান মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে তার মন্ত্রী পরিষদের কতিপয় সদস্য, জনপ্রতিনিধি ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত মন্ত্রণালয় হচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গণমাধ্যমে একের পর এক বিতর্কিত বক্তব্য, ভুলভাল সিদ্ধান্ত ও দুর্নীতির খবর সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। বলাই যায়, প্রধানমন্ত্রীর নেয়া কার্যক্রমের বারটা বাজিয়ে দিচ্ছেন সেই মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী।
প্রস্তুতির ঘাটতি ও মন্ত্রীর অসার বুলি
জাতির এই করোনা সংকটকালে সবচেয়ে ভয়ানক ও আতঙ্কের চিত্রটি সামনে এল। সেই চিত্রটি হল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ ও বিতরণের ব্যর্থতা।
চীনের উহানে যখন কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ে, তখন বহু দেশ আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে থাকে। দেশগুলির গোয়েন্দা সংস্থা তাদের নিজস্ব সরকার ও স্বাস্থ্য-বিভাগকে সতর্ক করে দেয়। তাগিদ দেয় এক্ষুণি সকল ধরনের প্রস্তুতি নিতে।
দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও অস্ট্রেলিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। উহানে কোভিড-১৯ যখন ধরা পড়ে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দাদের পরামর্শে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ সকল ধরনের প্রস্তুতি আগাম নিয়ে রাখে। সেই প্রস্তুতির কারণেই দেশটির অর্থনীতিকে বন্ধ করে দিতে হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণাগার, কলকারখানাসহ সবকিছুই স্বাভাবিক মাত্রায় চলছিল, এখনো চলছে।
অস্ট্রেলিয়াতে যখন রোগীর সংখ্যা শূন্য, তখনই হাজার হাজার আইসিইউ বেড প্রস্তুত করে রাখা হয়। সংগ্রহ করা হয় পর্যাপ্ত টেস্টিং কিট। ট্রিপল "টি" দেশটির কোভিড-১৯ মোকাবেলার মূলনীতি ঘোষণা করা হয়। সেই ট্রিপল "টি" হল "Tracing, Testing and Treating"।
উপরে উল্লেখিত উদাহরণগুলি থেকে স্পষ্টই বুঝা যায় দেশগুলির স্বাস্থ্য বিভাগ করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগেই সকল ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। নিজেদের ওপর দেশের মানুষের জীবন রক্ষার দায়িত্ব পালনকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।
কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী দুই থেকে তিন মাস সময় পেয়েও কিছুই করেননি। যা করেছেন তা হল কয়েকটি কমিটি; সেই কমিটি করতে বড়জোর দুই দিনের বেশি লাগার কথা নয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা সারা জাতি ও সরকারকে অসত্য, অর্ধ সত্য ও মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে কলারের সংখ্যা পঁয়তাল্লিশ লক্ষ হলেও টেস্টের সংখ্যা এখনো ত্রিশ হাজার হয়নি। এই ত্রিশ হাজার টেস্টের মধ্য থেকেই রোগী শনাক্ত হয়েছে প্রায় চার হাজারের মত।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অপ্রস্তুতির কারণেই লকডাউন থেকে ম্যাক্সিমাম ফলাফল আমরা পাইনি। এই লকডাউনের মধ্যেই টেস্টের পরিমাণ বাড়িয়ে কোভিড-১৯ কে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা দরকার ছিল। অথচ এই লকডাউনের কারণে রাষ্ট্র প্রতিদিন শত কোটি ডলার আয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এসবের দায় একমাত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
ডাক্তারদের প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবে কয়েকশ ডাক্তার আজ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। স্থানীয়ভাবে তৈরিকৃত মাস্ককে এন-৯৫ মানের মাস্ক দেখিয়ে হাসপাতালগুলিতে সরবরাহ করা হয়েছে। কেন ভুল হল, তার ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলেও অতি গুরুত্বপূর্ণ এই নিম্নমানের মাস্ক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন বিপন্ন করে দিতে পারে। এসব কেবল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একার ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার কারণে ঘটছে বিষয়টি তা নয়; এটি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তার সামষ্টিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মত একটি বিশেষায়িত ইউনিটে নীতিনির্ধারণী স্তরে প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে একাডেমিক যোগ্যতা থাকা আবশ্যক। গতানুগতিক জ্ঞান দিয়ে ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। আমরা সেটি না বুঝলেও আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভাল করেই জানেন। সেই জন্যই তিনি গতবার ঢাকাবাসীকে ডেঙ্গুতে ফেলে মালয়েশিয়া চলে গিয়েছিলেন। তিনি জানতেন তার সারা জীবনের অর্জিত জ্ঞান ডেঙ্গু মোকাবেলায় তেমন কোনো কাজে আসবে না।
ইংরেজি সাহিত্য ও সমাজ বিজ্ঞানের পণ্ডিতদের সরিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দিতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে স্বাস্থ্য কোনো ইট পাথরের অবকাঠামো নির্মাণ নয় যেটি ত্রুটি হলেও চালিয়ে নেওয়া যাবে। এখানে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের আনা জরুরি ছিল, যেটি আমাদের সরকারগুলি সব সময় এড়িয়ে গেছে।
আমরা যুগের পর যুগ ভুল মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়েছি। আগে কেবল আমাদের করের টাকা ছয়-নয়ের মধ্য দিয়ে সেটির মূল্য দিতাম। এখন করোনাভাইরাসে মারা গিয়ে সেটির মূল্য আমাদের দিতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিদিন গণমাধ্যমে ব্রিফ করেন অসাড় বক্তব্য দিয়ে। বাংলাও ভালভাবে পড়তে পারেন না। মন্ত্রী হয়ে "পিপিই"কে "পিপিপি" বলছেন। একবার নয়, বহুবার বলেছেন। তারমানে দাঁড়ায়, মন্ত্রী নিজেই জানে না "পিপিই" কী? অথচ এই পিপিই হচ্ছে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসকদের প্রধান সুরক্ষা সরঞ্জাম।
তার বক্তব্য বিভ্রান্তকরও বটে। তথ্য বিভ্রাট থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের জন্য দিকনির্দেশনার বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হয় তার ব্রিফিং-এ। বরং তার কথায় আমাদের চিকিৎসক সমাজ উষ্মা প্রকাশ করেই চলছে। মূলত সীমাহীন সমন্বয়হীনতায় ভুগছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
চিকিৎসাযন্ত্রে মরিচা ও দুর্নীতির পসরা
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৭ কোটি ও উন্নয়ন ব্যয় ৯ হাজার ৯৩৬ কোটি এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ব্যয় বাবদ ৩ হাজার ৪৫৭ কোটি ও উন্নয়ন ব্যয় ২ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা যা মোট জাতীয় বাজেটের ৪.৯২% এবং জিডিপির ০.৮৯%। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ২২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা।
প্রতিবছরই স্বাস্থ্যখাতে মোটাসোটা বাজেট হয়। এই বাজেটের অর্থ সুষ্ঠু প্রয়োগের বেশ ফাঁক-ফোকর মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে অনিয়ম ও দুর্নীতির পসরা।
গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ ১১টি খাতে দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরেছে। (সূত্র-প্রথম আলো)
গণমাধ্যমে মাঝে মধ্যে শিরোনামে থাকে বিভিন্ন হাসপাতালে যন্ত্রপাতি অকেঁজো কিংবা মরিচা পড়ার খবর। কোটি টাকার লোপাট হওয়ার খবরগুলো বছরজুড়ে হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কার্যত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী কার্যকর ভূমিকা না নেয়ার খেসারত এই করোনাক্রান্তিকালে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
চিকিৎসার টেকনিক্যাল জ্ঞানহীন এসব মানুষের কথায় চিকিৎসকরা যেমন নাখোশ হচ্ছে, ঠিক তেমনি দেশের জনগণও মাঝেমধ্যে বিভ্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গুকালীন সময় গত বছর তিনি মালয়শিয়ায় গিয়ে যে বির্তক তৈরি করেছেন, সেই বিতর্ক নতুন করে শুরু হয়েছে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে তার সিদ্ধান্তহীনতায়। তাই সরকারের উচিত হবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ে থাকা জীবাণুগুলোকে স্যানিটাইজড করা।
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিভিন্নভাবে প্রস্তাবনা আসছে। এসব প্রস্তাবনাগুলো ভাবনার সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বের করতে হবে। ব্রিফিং-এ যতটুকু সময় ব্যয় করেন, তারচেয়ে নিজেদের প্রস্তুতির ফাঁকফোঁকর খুঁজে বের করা জরুরি। আমরা কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরতে চাই। জানি না, আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের এখানে দৃষ্টি দেয়া সম্ভব হবে কি না। এরপরও আমাদের ভাবনাগুলো পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।
চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়াতে হবে
সারাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা কিছুটা হলেও ভেঙ্গে পড়েছে। সাধারণ মানুষ সাধারণ চিকিৎসাও পাচ্ছে না। হাসপাতালগুলোতে রোগীদের সেবা না দেওয়ার নজীর আগে কখনো দেখা যায়নি। প্যানডেমিকের কারণে সারাবিশ্বই এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পার করছে। ফলে, জনমনে এক ধরনের শঙ্কা বিরাজ করছে।
বিষয়টি আঁচ করতে পেরে প্রধানমন্ত্রীও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। চিকিৎসা না পেয়ে রোগী মারা যাওয়ার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ডাক্তাররা নিজেদেরকে সুরক্ষা করে চিকিৎসা দেওয়ার উপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী।
এমন কঠিন পরিস্থিতিতে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী বিশেষ বীমা ও প্রণোদনার ঘোষণা দিলেন। সেই তালিকায় চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, ত্রাণ বিতরণে যুক্ত অন্যান্য কর্মীরাও আছেন।
প্রশ্ন হল তারপরেও কেন চিকিৎসকরা শঙ্কার মুখে? রোগীদের সেবায় এগিয়ে আসতে তাদের অনীহার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই পরিষ্কার। সরকারের নির্দেশনাও অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে উজ্জ্বীবিত করতে পারছে না?
দেখুন, নিজ জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হলে প্রলোভনে কাজ করে না। সাধারণ মানুষ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি লাফিয়ে লাফিয়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। গণমাধ্যমের হিসেব অনুযায়ী সারা দেশে এই সংখ্যা দুইশ ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনই চিকিৎসকরা আক্রান্ত হচ্ছেন; কোয়ারেন্টিনে যাচ্ছেন।
সিলেটের এক চিকিৎসক কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। একইভাবে অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী রাতদিন পরিশ্রম করে কোভিড-১৯ চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসকদের পাশাপাশি তাদের পরিবারও শঙ্কার মধ্যে আছে।
জীবনের নিরাপত্তা যেখানে উপেক্ষিত সেখানে প্রণোদনা কিংবা অর্থ যে কিছুই নয় সেটিও চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও চিকিৎসকরাও শঙ্কার মধ্যে আছেন। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার অনুপাত খুব বেশি।
এর প্রধান কারণ হল, সেসব দেশ রোগীদের চেয়ে চিকিৎসকদের সুরক্ষা আগে নিশ্চিত করেছে। তারা জানে চিকিৎসকেরা আক্রান্ত হলে দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাবে। মূলত এই শঙ্কার জায়গা থেকে অন্য দেশের সরকারগুলো চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সবার আগে নিশ্চিত করছে। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটছে ঠিক উল্টো। দেশের চিকিৎসকরা মনের ভেতর অজানা ভীতি নিয়ে প্রতিদিনই ঘর থেকে বের হচ্ছেন। সংক্রমক হওয়ার চিন্তা সব সময় তাদের মস্তিষ্কে ঘোরাফেরা করে।
বিশেষ করে কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল ছাড়াও অনেকেই কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে তথ্য গোপন করে। এতে চিকিৎসকেরা বড় ধরনের সংক্রামকের ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে। অন্যান্য দেশে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যায়নি; নাগরিক সতর্কতায় চিকিৎসাকেরা রেহাই পাচ্ছে।
চিকিৎসকের সুরক্ষার কোনো বিকল্প নেই
কোভিড-১৯ চিকিৎসায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট) পিপিই ব্যবহার আব্যশক, যা জীবাণুর সংক্রমণ ঠেকাতে সুরক্ষা দেয়। এসব উপকরণের মধ্যে রয়েছে প্রতিরোধমূলক পোশাক, হেলমেট, গ্লাভস, বিশেষ ধরনের চশমা, বিশেষায়িত মুখের মাস্কসহ বিশেষভাবে তৈরি অন্যান্য উপকরণ। মূল উদ্দেশ্য হল এসব ব্যবহার করে জীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া।
শুরু থেকেই আমাদের চিকিৎসকরা পিপিই'র অপ্রতুলতার কথা জানিয়ে আসছিলেন। মানহীন পিপিই চিকিৎসকদের সংক্রমণের অন্যতম কারণ বলেও অভিযোগ উঠেছিল। পিপিই'র দাবি জানানোয় ও মানহীন পিপিই'র প্রতিবাদ করায় চিকিৎসকে শোকজ ও চাকরিচ্যুত করার ঘটনাও ঘটেছে।
স্বাস্থ্যখাতের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, চিকিৎসকদের জন্ম হয়েছে যেকোনো পরিবেশে মানুষদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য। চিকিৎসকদের শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম ভিন্ন। ফলে তাদের কোভিড-১৯ দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভবনা নেই। চিকিৎসকদের মতো তাদের পরিবারও কোভিড-১৯ সুরক্ষিত।
আবার কণ্ঠবাজি করে চিকিৎসকদের ঝুঁকিতে ফেলানোর দায়ভার কেউই নিতে রাজী না। যখন কোনো চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িতের সুযোগ মিলছে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
তাই চিকিৎসকদের সুরক্ষা দিতে হলে সবার আগে চাই পিপিই'র মানন্নোয়ন, পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকাও বাঞ্ছণীয়। সেটা না করা গেলে চিকিৎসকরা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হবেন, ভেঙ্গে পড়তে পারে চিকিৎসা ব্যবস্থা। সেই সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে। রাগ দেখিয়ে কিংবা চাকরিচ্যুতের ভয় দেখানোর সময় এটা নয়। তাদের সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে হবে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার সাথে সাথে দেশের রাজনীতিবিদ ও সাংসদেরা হাইবারনেশনে চলে গিয়েছে। কারণ তাদের কাছে দেশের চেয়ে জীবন বড়। কিন্তু চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা করোনাভাইরাস বিরোধী যুদ্ধে লিপ্ত। সেই যুদ্ধের নেতৃত্বে রয়েছে আমাদের চিকিৎসক সমাজ। চিকিৎসকেরা বাঁচলে আমরা জয়ী হবই, পরাজিত হবে করোনাভাইরাস। তাই চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পবিত্র দায়িত্ব। যদি কেউ সেই দায়িত্ব পালনে করতে অবহেলা করে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
অতিরিক্ত চিকিৎসক নিয়োগ
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল, বিএমডিসির হিসাবে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৯২৭ জন। অধিকন্তু, বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল, বিডিএমসির হিসাবে দেশে রেজিস্টার্ড নার্স রয়েছে ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন। (সূত্র-বিডিনিউজ২৪)
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতালে এখন কর্মরত চিকিৎসক আছেন মোট ২৫ হাজার ৬১৫ জন। বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) ও সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটস সংগঠনের প্রতিনিধিরা গত ২০ এপ্রিল গণমাধ্যমকে বলছে, দেশে এই পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১২৮ জন চিকিৎসক ও ৭১ জন নার্স। তাছাড়া আরো ছয় শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী হোম কোয়ায়েন্টিনে আছেন। (সূত্র-বাংলানিউজ)
সুতরাং এই তথ্য থেকে অনুমেয় যে দেশে করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভে চিকিৎসকদের এভাবে আক্রান্ত হওয়ার খবর অন্যান্য চিকিৎসকের মনে আতংক তৈরি করবে। বাংলাদেশের জন্য সামনের দিনগুলো কতটা কঠিন হবে তা এখনো অজানা। তবে এভাবে চিকিৎসকরা সেবা দিতে গেলে তারা বেশ ক্লান্ত হয়ে উঠবেন।
এমতাবস্থায় আমাদের চিকিৎসক সংকট মোকাবেলা করার প্রস্তুতি এক্ষুণি নিয়ে রাখতে হবে। গত বছর ৮ এপ্রিল স্বাস্থ্য ক্যাডারে চার হাজার ৭৯২ জন চিকিৎসক নিয়োগ দিতে ৩৯তম বিশেষ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে ৩৯ হাজার ৯৫৪ জন চাকরিপ্রার্থী অনলাইনে আবেদন করেন (সূত্র- বিডিনিউজ২৪)। প্রায় ৩৪ হাজার চিকিৎসক চাকরি পায়নি। এরা সবাই তরুণ। সরকার এই ৩৪ হাজার তরুণ চিকিৎসককে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সাময়িক নিয়োগ দিতে পারে। দেশের এই ক্রান্তিকালে আমরা তাদের মেধা ও সাহসকে কাজে লাগাতে পারি।
আমরা যখন এই লেখা শেষ করেছি, তখন জানতে পারলাম সরকার আরো ২ হাজার চিকিৎসক ও ৬ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা আশার আলো হতে পারে।
পরীক্ষা বাড়ানোর জন্য মলিকুলার বায়োলজিস্টদের কাজে লাগানো
করোনাভাইরাস মূলত আরএনএ (রাইবোনিউক্লিক এসিড) ভাইরাস। এই ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতি বেশ সফিস্টিকিটেড। সামান্য ভুলের জন্য নমুনার পজিটিভিটি নেগেটিভিটিতে রূপান্তরিত হতে পারে। আরএনএ ডিএনএ'র মত স্থির নয়। যার কারণে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের এই নমুনা সংগ্রহে বেশ সতর্কতা পালন করতে হয়।
উপরন্তু আমরা আরটিপিসিআর বা থার্মাল সাইক্লার মেশিনে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করছি। সেই মেশিনটির উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করাও জরুরি। দেশের কয়েকটি জায়গায় ইতিমধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। এসব ল্যাবেরেটরিতে নমুনা সংগ্রহ বাড়তে থাকায় প্রতিদিনই কোভিড-১৯ আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে।
বর্তমানে প্রতিদিন তিন হাজারের মত পরীক্ষা করা হচ্ছে। দক্ষ জনবল ও যন্ত্রপাতির সংকটে তা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেক আক্রান্ত রোগীর সময়মত পরীক্ষা না করার ফলে অন্যরাও সংক্রমিত হওয়ার সম্ভবনা তৈরি হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যত বেশি পরীক্ষা/শনাক্তকরণ, তত বেশি প্রতিরোধ। আমাদের উচিত দেশে অন্তত আরো বিশটি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা।
একটি আরটিপিসিআর মেশিনের দাম ১০ থেকে ১৫ হাজার ডলারের মতো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চাইলেই খুব সহজেই ল্যাবরেটরির সংখ্যাটি বাড়িয়ে ফেলতে পারে। প্র্রয়োজন দক্ষ জনবল। এই জনবল আমরা অনায়াসে পেয়ে যেতে পারি।
দেশের প্রায় প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণ-রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান (বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি) বিভাগ আছে। বায়োকেমিস্ট্রি পড়ানোর পাশাপাশি এখানে মলিকুলার বায়োলজি (ডিএনএ/আরএনএ) বিশদভাবে পড়ানো হয়। এছাড়াও বায়োটেকনোলজি বিভাগেও এসব কোর্স পড়ানো হয়ে থাকে।
এসব বিভাগের শিক্ষার্থীরা মলিকুলার বায়োলজির যথেষ্ট জ্ঞান রাখে। এরা জানে কোন পরিবেশে আরএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পিসিআর (পলিমারেজ চেইন রিয়াকশন) যাবতীয় কৌশল এদের নখদর্পনে। বিশ্বাস করি দেশের এই সংকটকালে বায়োকেমিস্ট সোসাইটির সদস্যরা এগিয়ে আসবে। কয়েক হাজার বায়োকেমিস্ট চাকরির জন্য ঘুরছে। এদেরকে করোনাভাইরাস টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে নিয়োজিত করা যেতে পারে। জানা মতে, উল্লেখিত বিভাগগুলোর শিক্ষকরাও তাদের শিক্ষার্থীদের করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কাজে লাগাতে উৎসাহ অনুভব করবে।
ভ্রাম্যমাণ কোভিড-১৯ টেস্টিং ল্যাবরেটরি
এখনো করোনাভাইরাস পরীক্ষা কেন্দ্রের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। একেকটি ল্যাবরেটরিকে কয়েকটি জেলা কাভার দিতে হচ্ছে। আমরা বিশেষ গাড়িতে বায়োসেফটি লেবেল-৩ ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে পারি। সেখানে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের সকল সরঞ্জাম থাকবে। সেই গাড়িগুলো প্রতিটি জেলায় গিয়ে রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে পারে। তাহলে খুব দ্রুততার সহিত করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের শনাক্ত করা যেতে পারে। দেশের অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে যেখানে মানুষজন আক্রান্ত হওয়ার পরও চিকিৎসা নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে না, সেখানে ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরি ফলপ্রসু হতে পারে।
দেশী ও প্রবাসী গবেষকদের কাজে লাগানো
জাপানের কথাই ধরুন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানানোর আগে সেটি নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সাথে বিস্তর আলোচনা করেন। প্যানেলে যারা থাকেন তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাদের কেউ ভাইরোলজিস্ট, এপিডেমোলজিস্ট, মলিকুলার বায়োলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল থেরাপিস্ট, বায়োকেমিস্ট, ইনফরমেশন ও টেকনোলজিস্ট। তারা তাদের একাডেমিক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ।
আমরা সবসময় বলে আসছি, আমাদেরও একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রয়োজন। শুধু আমলা নির্ভর সিদ্ধান্ত কাগজে কলমেই শতভাগ। সেসব সিদ্বান্ত শুনলে রাতে চিন্তামুক্ত ঘুম হয়। কিন্তু সকালে বাস্তবতা ফিরে এসে আবার মাথায় ধরে। আবার আমলাদের কাগজ কলমের হিসাব সামনে চলে আসে। মাথা আবারো চিন্তামুক্ত হয়। এভাবেই ঘূর্ণিয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্র চলে। ফলে আমলা নির্ভরতা কখনোই সুখকর কিছু বয়ে আনতে পারে না।
গত সপ্তাহে সরকার কোভিড-১৯ প্রতিরোধে একটি পরামর্শক কমিটি করেছে, সেই কমিটিতে কেবল চিকিৎসকরা স্থান পেয়েছে। হাস্যকর হল এখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নেই। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি খোলা রেখে লাভ কী?
দেশের ভেতর ও বাহিরে অনেক অভিজ্ঞ গবেষক ও বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তারা টেকনিক্যাল বিষয়ে জ্ঞান রাখার পাশাপাশি সমস্যার বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানে দুর্দান্ত। অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইরোলজি, মলিকুলার বায়োলজি, বায়োমেডিক্যাল ও ঔষধ গবেষণায় নিয়োজিত। এরা আমাদের বড় সম্পদ। দেশের প্রয়োজনে তারা কাজ করতে প্রস্তুত। তাদেরকে নিয়ে একটি পরিপূর্ণ পরামর্শক কমিটি করুন। তাদের মতামতকে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিন। আমরা বিশ্বাস করি, সমন্বিত প্রচেষ্ঠায় কোভিড-১৯ এর মতো অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবেলা করা সম্ভব।