Published : 30 Apr 2020, 06:36 PM
চীনের উহানে গত ডিসেম্বরে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্তের পর এখনও ভাইরাসটি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছেন না। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় কার্যকরী ঔষধ বা করোনাভাইরাস প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কার হয়নি। ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্য, ছড়ানোর গতিপ্রকৃতি, জড় এবং জীবদেহে সক্রিয়তা কাল ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে জানতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। ফলে ভাইরাসটির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণেই জোর দেওয়া হচ্ছে বেশি আর সেজন্য নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে এবং ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে ঘন ঘন হাত জীবাণু মুক্ত করতে এবং মাস্ক পরতে বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা কাজে জড়িত ব্যক্তিদের সুরক্ষা পোশাক পরতে বলা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, করোনাভাইরাস কোনোভাবেই যেন নাক, মুখ কিংবা চোখ দিয়ে মানুষের শ্বাসযন্ত্রে প্রবেশ করতে না পারে। ভাইরাসটি বায়ুবাহিত (airborne) কিনা কিংবা আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ মানুষের কাছ থেকে ছড়াতে পারে কিনা এসব বিষয়েও স্পষ্ট করে কিছুই বলা হয়নি। আজকের আলোচনায় এই দুইটি বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে ভাইরাসটি বায়ুবাহিত (airborne) নয় বলা হলেও ভাইরাসটি যে বায়ু (air) দ্বারা ছড়াতে (spread) পারে বা বায়ুতে ছড়িয়ে (dispersed) থাকতে পারে তা বিজ্ঞানের সাধারণ জ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করলে ভাইরাসটির বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর বা সংক্রমিত হওয়ার প্রক্রিয়াটা পরিষ্কার হবে বলে মনে করি। একই সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং ঘরে থাকার কারণও বুঝা যাবে।
অ্যারোসল (aerosol): সাধারণভাবে যেকোনো ভারি পদার্থ (matter) অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে ভূপাতিত হয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভারি "কণা" (particles/droplets) তরল পদার্থ বা গ্যাসের মধ্যে ঝুলন্ত (suspended) থাকতে পারে। গ্যাসের মধ্যে তরল বা কঠিন পদার্থের কণা ঝুলে থাকলে তাকে অ্যারোসল (Aerosol) বলে। যেমন কঠিন ধুলাবালি এবং তরল জলীয় বাষ্প (কুয়াশা) বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এই দুইটিই অ্যারোসল। আর এ কারণেই করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে রেস্পিরেটরি ড্রপলেট বা হাঁচি-কাশির ফলে বের হওয়া জলকণাকে (Droplets) অ্যারোসল বলা হচ্ছে।
ট্রাজেক্টরি (Trajectory): কোনো একটি বস্তু সময়ের সাপেক্ষে শূন্যে যে বক্রপথ অতিক্রম করে তাকে ট্রাজেকটরি বলে। যেমন, আপনি কৌণিকভাবে ওপরের দিকে একটি ঢিল ছুড়লেন। ঢিলটি খানিকটা সময় শূন্যে ভেসে ভেসে বক্রাকার পথে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে (flight path) এবং এক সময় ভূপাতিত হবে।
হাঁচি (Sneeze): মানুষ যখন হাঁচি দেয় তখন নাকি তার শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হাঁচি দেওয়ার কাজে জড়িয়ে পড়ে। যাই হোক, হাঁচি কী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুটি তথ্য এখানে উল্লেখযোগ্যঃ হাঁচির গড় গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় ১০০ মাইল। আর প্রতিবার হাঁচিতে ১ লক্ষাধিক ড্রপলেট (তরল কণা) ১০০ মাইল/ঘন্টা বেগে ছড়িয়ে পড়ে।
এবার আসুন আমরা উপরের তথ্যগুলো মিলিয়ে দেখি। কেউ যদি হাঁচি দেয় তবে তা হাঁচির গতিবেগের (speed) কারণেই একটা উল্লেখযোগ্য বক্রাকার দূরত্ব (ট্রাজেক্টরি/flight path) পর্যন্ত এগুবে। বলা হয়ে থাকে সেটা ২৮ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। লক্ষাধিক ড্রপলেটের মধ্যে সবার আকার (size) এবং ভর (mass) এক সমান হবার কথা নয় (unequal size distribution)। ফলে কিছু ড্রপলেট ট্রাজেক্টরি পথ অতিক্রম করে মাটিতে পড়ে যাবে। অপেক্ষাকৃত হালকা ড্রপলেটগুলো কুয়াশার মত বাতাসে অনেকটা সময় ভাসতে থাকবে (suspended)। এখানে হাঁচির সাথে বেরিয়ে আসা জলকণাগুলো অ্যারোসল-এর মতো আচরণ করবে। তখন যদি বাতাসের বেগ থাকে (wind flow) তবে সে আরও অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। এই সময়কালের মধ্যে ড্রপলেট সমৃদ্ধ বাতাসের (air) মধ্যে কেউ অবস্থান করলে বা ওই এলাকার মধ্যে দিয়ে কেউ হেটে গেলে তার গায়ে ড্রপলেটগুলো লেগে যেতে পারে। এ কারণেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে কম করে হলেও দুই মিটার বা প্রায় ছয় ফুট দূরে থাকতে বলা হয়। এতটা দূরত্বে থাকলে ট্রাজেক্টরি বা অ্যারোসলের মধ্যে সরাসরি পড়ে যাওয়া এড়ানো সম্ভব। অন্যদিকে আপাতদৃষ্টিতে জনশূন্য স্থানে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকে নিঃসৃত অ্যারোসল (যে ড্রপলেটগুলো বেশ খানিকটা সময় বাতাসে ভাসতে থাকবে) বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। কেননা, করোনাভাইরাসের গড় সাইজ হচ্ছে ১২০ ন্যানোমিটার। ফলে হাঁচি থেকে নিঃসৃত জলকণা বাতাসে উবে (vaporized) গেলেও ভাইরাসটি বাতাসে ভেসে থাকতে পারার কথা। কারণ তার চেয়ে ভারি এবং আকারে বড় ধুলাবালিও কিন্তু বাতাসে অনেকক্ষণ ভাসতে থাকে। তাছাড়া করোনাভাইরাসের গায়ে থাকা স্পাইকগুলো (spikes) তাকে বাতাসে ভাসতে সাহায্য করার কথা। তাই এই অ্যারোসলের স্পর্শ এড়াবার জন্য মাস্ক পরতে হয়, গ্লাভস পরতে হয়। তবে ট্রাজেক্টরি (বক্রাকার পথ) এবং অ্যারোসল দুটোকেই এড়িয়ে চলার জন্য উত্তম উপায় হচ্ছে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে থাকা।
অন্যদিকে কোনো প্রকার লক্ষণ না থাকলেও করোনাভাইরাস যে কারও শরীরে থাকতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাস পজিটিভ এমন অনেক রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা যায়নি। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে লক্ষণ দেখা দেওয়া, না দেওয়া, অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করতে পারে। একটু সাধারণ জ্ঞান খাটালে তার কার্যকারণ বুঝা যায়। ভাইরাস শরীরে ঢুকলেই শরীরের নিরাপত্তা বাহিনী, অ্যান্টিবডি তাকে আক্রমণ করে দমাতে চেষ্টা করে। যার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যত শক্তিশালী করোনাভাইরাস তার শরীর থেকে তত দ্রুতই হারিয়ে যায় অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তিকে এই ভাইরাস কাবু করতে পারে না এবং তার শরীরে ভাইরাসজনিত লক্ষণ দেখা দেওয়ার কথা নয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাত্রার উপর ভিত্তি করে কারও শরীরে লড়াই করে ভাইরাস এক সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কারও শরীরে কয়েকদিন যুদ্ধ চলে, লক্ষণ দেখা যায় এবং এক সময় সেরেও যায়। আবার কারও শরীর ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে টিকতে পারে না, লক্ষণ প্রকট হয় এবং বাহির থেকে তাকে সাপোর্ট দেওয়ার প্রয়োজন হয় এবং এক সময় সেরে উঠে। আবার কেউ কেউ সেই সাপোর্ট দেওয়ার পরেও ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে পেরে ওঠে না এবং অবশেষে মারা যান। এই হচ্ছে মোটামুটি লক্ষণ দেখা যাওয়া না যাওয়ার অবস্থা।
ধরুন কারও শরীরে ভাইরাস আছে, অ্যান্টিবডির সাথে যুদ্ধ চলছে কিন্তু লক্ষণ এখনও দেখা দেয়নি। এই অবস্থায় অন্য কেউ তার সংস্পর্শে এলে তারও করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর এ কারণেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিত, লক্ষণ নেই তেমন কারও সাথেও মেলামেশা করা উচিত নয়। সর্বোপরি লক্ষণ নেই তেমন ব্যক্তি বাইরে থেকে আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক নিঃসৃত অ্যারোসল গায়ে মেখে আসেননি তা তো নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তাই নিজেকে নিরাপদে রাখার উত্তম উপায় হচ্ছে ঘরে থাকা, একান্তই বাইরে যেতে হলে মাস্ক, গ্লাভস পরে থাকা, দ্রুত কাজ সেরে ঘরে ফেরা এবং ঘরে এসে প্রথমে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে, পরিধেয় কাপড়সহ ভালভাবে গোসল করা।
লেখাটি তৈরি ও সম্পাদনায় সহযোগিতা করেছেন: অধ্যাপক ড. এস. মোছাদ্দেক আহমদ, ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম, ও ড. ফারজানা খলিল। সকলেই আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (AIUB) এর রসায়ন বিভাগের শিক্ষক।