Published : 25 Apr 2020, 07:01 PM
আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা বড়লোকদের পক্ষে। যাদের টাকা আছে, তারা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার সুযোগ পায়। কোচিং, প্রাইভেট-এসবও টাকাপয়সারই কারবার। নাচ-গান-আর্ট-ল্যাঙ্গুয়েজ-ম্যাথ-সুইমিং-সব কিছুতেই এগিয়ে থাকে বড়লোকের ছেলেমেয়েরা। এখন সন্তানের পেছনে যত টাকা ঢালা যায়, তত তাদের দক্ষ-যোগ্য করে গড়ে তোলা যায়। কাজেই যাদের টাকা আছে, তারা অনেক বেশি যোগ্য-দক্ষ হওয়ার সুযোগ পায়। গরিবরা এই ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে। যন্ত্রপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই চিত্র।
যন্ত্রপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা হলাম `ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া' জাতি। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, সামর্থ্য, দক্ষতা, জ্ঞান, প্রশিক্ষণের আগেই এদেশের মানুষের হাতে যন্ত্রপ্রযুক্তি তুলে দেয়া হয়েছে। অনেকটা হনুমানের হাতে খোন্তা তুলে দেয়ার মতো, যন্ত্রপ্রযুক্তির উপর অনেক কিছু নির্ভরশীলও করে ফেলা হয়েছে। ফেসবুক চালানোর নিয়ম না জেনেই অনেকে ফেসবুক ব্যবহার করছে। এতে নানা ধরনের বিড়ম্বনায় পড়ছে। অনেকে এখনও ইমেইল ব্যবহার করতে পারে না। তবু তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়, ইমেইলে যোগাযোগ করতে। ফলে সে পিছিয়ে পড়ছে। যন্ত্রপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড়লোকরাই এগিয়ে থাকছে। তাদের রয়েছে উচ্চগতির ইন্টারনেট। নামি-দামি ব্র্যান্ডের সব গেজেট। সঙ্গে আছে শিখিয়ে দেবার মানুষ। তারা দ্রুত সব কিছু শিখে যন্ত্রপ্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠছে। কিন্তু দরিদ্র ছেলেমেয়েরা সস্তার মোবাইল, 'এমবি' গুনে কম টাকার ইন্টারনেট প্যাকেজ নিয়ে 'দিনে তিন দাগ' হ্যোমিওপ্যাথির ঔষধের মতো অর্থাৎ নিয়ম করে অল্প সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। ভুল হলে শোধরানোর সুযোগ খুব একটা থাকে না। কারণ গরিবের আত্মীয়-স্বজনরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে গরিব হয়। তাদের শিখিয়ে-বুঝিয়ে দেয়ার মানুষ খুব একটা থাকে না। নিজেদের আগ্রহে যতটুকু শেখার শেখে। ট্রেন্ড বা 'সামাজিক ক্রেজ' দেখে বড়জোর ফেসবুক চালানোটা শেখে। কিন্তু হ্যাং-আউট, জুম, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার ব্যবহার করতে শেখে না। 'ইন্টারনেট ব্রাউজিং' অর্থাৎ প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজে বের করার বিদ্যাতেও তারা পিছিয়ে। অনেকের তো স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ কেনার সামর্থ্যই নেই। ইন্টারনেট তো দূরের কথা। তাদের জন্য অনলাইন শিক্ষা আকাশের চাঁদের মতো। সুন্দর, স্নিগ্ধ, কিন্তু অধরা!
করোনাভাইরাস মাহমারী শুরু হওয়ার পর অনলাইন বা ডিজিটাল লেখাপড়া নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় চলছে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'পাঁচতারা' মানের হলেও সেখানকার সব শিক্ষার্থীরা অবস্থাপন্ন পরিবার থেকে আসে না। বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনও সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া করে। অনলাইনে পাঠদানের ক্ষেত্রে তাদের কথা সবার আগে বিবেচনায় নিতে হবে। অনলাইন ক্লাসে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়, কিন্তু শিক্ষার্থীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ভালোভাবে বিচার করে দেখা উচিত।
আমাদের দেশে যারা লেখাপড়া করে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব স্তরেই এখনও পর্যন্ত ধনীর চেয়ে গরিবের সংখ্যা বেশি। শহরের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী মফস্বল বা গ্রামে থাকে। প্রথমটার সঙ্গে যুক্ত কম্পিউটার বা স্মার্টফোন কেনার ক্ষমতা। এবং দ্বিতীয়ের সঙ্গে যুক্ত ইন্টারনেট সংযোগের গুণমান। নানা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বহাল থাকার পরও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার শক্তি হল, সমাজের সব অংশের ছেলেমেয়েরা একই ক্লাসঘরে পাশাপাশি বসে একই শিক্ষকের থেকে পড়া শোনে। যত কমই হোক, লাইব্রেরিতে তাদের সকলের জন্য একই রকম বই সাজানো থাকে, তাতে সকলের একই রকম অধিকার। তারা একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে একই ডিগ্রি পায়। পুরো ব্যবস্থাটা ডিজিটালে উঠে গেলে প্রাথমিক ভাবে এই সৌন্দর্যটা হারিয়ে যাবে। যার বেশি টাকাপয়সা নেই, তার দামি স্মার্টফোন নেই, দ্রুত গতির ইন্টারনেট নেই, সে ক্লাসে পিছিয়ে পড়তে থাকবে। লাইব্রেরি না থাকায় নিজের সাধ্য অনুযায়ী বইপত্র জোগাড় করতে হবে। যাদের আর্থিক জোর নেই, এ ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে পড়বে। ইউনেস্কো বলেছে— 'অনলাইন পড়াশোনা সবাইকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এই ভাবনা বিভ্রম বই কিছু নয়।' বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে ইন্টারনেট ভিত্তিক পড়াশোনা আসলে বৈষম্যকে আরও পোক্ত করবে। টাকাপয়সা না থাকলে লেখাপড়া হবে না। এ কথা কিন্তু আমাদের শিক্ষার মর্ম ও সংবিধানের সাম্য ভাবনার পরিপন্থী।
অনেকে বলেন, এখন তো অনলাইনে অনেক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া, ফরম ফিল-আপ, বেতন জমা ইত্যাদি নানা কাজ চলে। সেটা তো সবাইকেই করতে হয়, তাহলে পড়াশোনাই বা হবে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, প্রথমত সেটা দৈনন্দিন কাজ নয়। দ্বিতীয়ত, এ ক্ষেত্রে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার অনেকাংশে গোষ্ঠীগত, অনেকে বিভিন্ন দোকানে বা সাইবার ক্যাফেতে কাজ সারে।
কিন্তু দৈনন্দিন লেখাপড়ায় সেটা সম্ভব বলে মনে হয় না। তা ছাড়া বিদ্যুতের ঝামেলা, নেটওয়ার্ক সমস্যা ইত্যাদি তো আছেই। প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কি ডিজিটাল ব্যবস্থা পরিত্যাগ করতে হবে? নিশ্চয়ই নয়। ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটা স্থান ও কালের সীমারেখা ঘুচিয়ে দিয়েছে। এত দিন ধরে মানুষের যা অসাধ্য ছিল, তার অনেক কিছুই প্রযুক্তি করে দেখিয়েছে। সেই অসামান্য সুযোগ কাজে লাগিয়ে ছাত্রছাত্রীদের যতটা সুবিধা করে দেওয়া যায়, ততটাই তার উপকারিতা। অর্থাৎ এই দীর্ঘ ছুটির সময়ে কিছু মালমশলা, ভাবনার খোরাক তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। তবে সিলেবাসের পড়াশোনা নিয়ে এই প্লাটফরমকে পরিপূর্ণ ক্লাসঘরের বিকল্প বানিয়ে ফেলার মতো সময় সম্ভবত আমাদের দেশে এখনও আসেনি। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবশ্য এই কাজটা ইতোমধ্যে করছে। কিন্তু তারা কতটা ঠিক করছে, সে প্রশ্নটা করতে হবে।
তবে ডিজিটাল প্লাটফরম কাজের গতিকে মসৃণ করে দিলেও তা কিন্তু গায়েগতরে খাটনিকে বিদায় দিতে পারেনি। অনলাইনে ক্লাস চললেও নোট লিখতে হয় খাতায়-কলমে। ডিজিটাল ব্যবস্থায় আমরা নিশ্চয়ই এগোতে পারছি, কিন্তু তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবা যাবে কি? তাই লেখাপড়ার সম্পদ সকলের কাছে সমান ভাবে পৌঁছোচ্ছে কি না, নতুন এই ডিজিটাল প্লাটফরম ব্যবহারে ফলে কেউ বঞ্চিত হচ্ছে কি না, যাদের সামর্থ্য কম তাদের কেউ বাদ পড়ে যাচ্ছে কি না, এগুলো লক্ষ রাখতে হবে। আসলে, ডিজিটাল প্লাটফরমের কারণে যদি বড়লোক-গরিব বা শহর-গ্রামে কোনও বিভাজন ঘটে যায়, তাহলে তার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। যে শিক্ষার্থী এখন পিছিয়ে পড়ল, সে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তেই থাকবে। এই ব্যবস্থা হয়তো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এই তৈরি হওয়া ফাঁকটা চিরস্থায়ী হয়ে যেতে পারে। ইন্টারনেট বা কম্পিউটার নেই বলে যে কম শিখল বা শিখল না, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তার পড়া গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কেউ নেবে?
আমাদের দেশে ডিজিটাল সাক্ষরতার হার এখনও দশ শতাংশে উন্নীত হয়েছে কিনা, সন্দেহ। এ অবস্থায় সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। আপাতত অন্য উপায় নেই ঠিকই। কিন্তু যারা ডিজিটাল প্লাটফরম ব্যবহার করে শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে চাইছে, তারাও কিন্তু সুবিধা করতে পারছে না। চীনও একই সমস্যায় জর্জরিত। এমনকি ধনী দেশগুলোতেও দেখা যাচ্ছে অনলাইন শিক্ষা সমস্যাবিহীন নয়, কেননা অধিকাংশ ধনী দেশেও প্রচুর পরিমাণ অসচ্ছল জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাই বলা যেতেই পারে যে, কেবল এ দেশে নয়, বিশ্বের অন্যান্য কোণেও করোনাভাইরাস মহামারীর শিকার হতে চলেছে স্কুলশিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা। এর থেকে পরিত্রাণের পথ কেবল ডিজিটাল শিক্ষা চালুর মাধ্যমেই নয়, সৃজনশীল কোনো উদ্যোগের কথা ভাবতে হবে।