Published : 22 Apr 2020, 02:36 PM
বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব এখন অবরুদ্ধ। অর্থনীতির চাকা গেছে থেমে। অদৃশ্য নভেল করোনাভাইরাস কেড়ে নিচ্ছে প্রাণের পর প্রাণ। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশসমূহের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও হিমশিম খাচ্ছে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায়। পরিস্থিতির গভীরতা ও ব্যাপকতা দাবি রাখে সম্মিলিত প্রয়াসের- দেশের ভেতর বিভিন্ন শক্তির, একইভাবে বিভিন্ন দেশের। যদিও এটা অনস্বীকার্য, কোনও দেশে মূল দায়িত্ব বর্তায় ওই দেশের সরকারের উপর। আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ/চিন্তাশীল ব্যক্তির বিভিন্ন লেখা, ব্যক্তিখাতের সংগঠনসমূহের দাবি-বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে- এখানে যারা অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করেন তাদের অনেকের অর্থনীতির মৌল ধারণা সম্পর্কে কতিপয় মারাত্মক বিভ্রান্তি রয়েছে।
এর কয়েকটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি:
১. সরকারের টাকা কোথা থেকে আসে? বাংলাদেশে ট্যাক্স-ননট্যাক্স রাজস্ব থেকে (৮০ভাগ) এবং দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ থেকে (২০ ভাগ)। সরকার অবশ্যই কখনও কখনও টাকা ছাপিয়ে তার দায় বা ব্যয় মেটাতে পারে। তবে সেটা বিভিন্ন কারণে করা ঠিক নয়। মূল কারণ হচ্ছে, তা হলে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি অবশ্যম্ভাবী। তাই সরকার ইচ্ছে করলেই খরচ করতে পারে না। চাইলেই ভর্তুকি দিতে পারে না। পারে না সীমাহীন প্রণোদনা দিতে। ব্যক্তির ব্যয় যেমন তার আয় দ্বারা নির্ধারিত হয়, সরকারকেও তেমন একটা ব্যয় সীমা বা বাজেট সীমার (Budget Constraint) ভেতর কাজ করতে হয়।
২. ট্যাক্সের প্রতিটি টাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিখাত থেকে আসে। সেখানে প্রতিটি টাকার এক ধরনের উৎপাদনশীলতা থাকে। কোনও অর্থনীতির প্রবাহ থেকে সরকার ট্যাক্সের মাধ্যমে টাকা তুললে- প্রাথমিকভাবে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই, ট্যাক্সের টাকাটা উৎপাদনশীল হতে, সরকারি খাতে তার ব্যবহারের উৎপাদনশীলতা ব্যক্তি খাতের উৎপাদনশীলতার চেয়ে বেশি হতে হয়। অর্থাৎ ততক্ষণই সরকার বাজেট ঘাটতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তার প্রভাব প্রবৃদ্ধির উপর ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সামষ্টিক সূচক বিবেচনায় এনে বাজেট ঘাটতির ঊর্ধ্ব সীমা জিডিপির ৫ শতাংশ ধরা হতো। উদ্ভূত করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায়, বিদ্যমান রাজস্ব ও মুদ্রা সুযোগ (fiscal and monetary space) থাকায়, এ বছর এবং আগামী দুবছর বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬ থেকে সর্ব্বোচ ৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। তবে, মনে রাখতে হবে, এ সময়ে জিডিপির আকার পূর্বের প্রাক্কলিত জিডিপির আকার থেকে যথেষ্ঠ কম হবে।
৩. বাংলাদেশে দেশে মোট প্রকৃত সরকারি খরচ জিডিপির ১৬ শতাংশ। সেখানে অন্যান্য অগ্রাধিকার বিবেচনায় স্বাস্থ্যখাতে ২ শতাংশ ব্যয় কি খুব একটা কম? মূল হচ্ছে- সরকারি ব্যয়ের উপযুক্ত দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা।
৪. আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে গত চল্লিশ/পঞ্চাশ বছরে ধরে আর্থ-সমাজনীতিতে সমস্যা দেখা দিলেই, সবাই উদ্যত হই 'good governance' নামক এক অবয়বহীন সোনার হরিণ খুঁজতে। সুষ্ঠু ব্যয় নিশ্চিত করতে সাদামাটাভাবে প্রয়োজন:
ক. অগ্রাধিকার অনুযায়ী ব্যয়
খ. ব্যয়-ফলাফল পরিবীক্ষণ এবং
গ. সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর 'কমিটমেন্ট'
৫. ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া মাত্রই খারাপ কোনো পদক্ষেপ নয় । সরকারের ঋণ নেওয়া মানেই ব্যক্তিখাতের ক্ষতি হয়ে যাওয়া নয়। সরকার অবশ্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিতে পারে- যদি ব্যাংক ব্যবস্থায় যথেষ্ঠ অলস অর্থ পড়ে থfকে এবং/অথবা আমাদের মত দেশে এই ঋণ নিয়ে সরকার যদি ব্যক্তিখাতের প্রতিবন্ধকতাসমূহ, যেমন অবকাঠামো ও সামাজিক খাতের উন্নয়ন করে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ-বাঁধাসমূহ দূর করতে পারে। এবং আমরা জানি, শিক্ষা স্বাস্থ্যখাতের মত জন খাতে অনেক সময় সরকারি ব্যয় শুধু প্রয়োজনীয়ই নয়। কাম্যও বটে।
৬. গত দুশ বছরের প্রায়োগিক অর্থনীতি পাঠ থেকে এখন প্রায় সবাই জানে- দেশের কোন অর্থনৈতিক দুর্যোগে কোন নীতি- রাজস্ব (ফিসকাল) বা মুদ্রা নীতি গ্রহণ করতে হয়, এবং এ দুটো নীতির মধ্যে সমন্বয় করতে হয়। এখানে দুটো বিষয় প্রাসঙ্গিক:
ক। কেন্দ্রিয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বলতে মূলত বোঝায়, তারা রাজস্ব নীতির প্রভাবের বাইরে থেকে মুদ্রা নীতি করতে পারে কি না, তার উপর। কেন্দ্রিয় ব্যাংক পৃথিবীর কোনো দেশেই রাষ্ট্রের চতুর্থ কোনো স্তম্ভ নয়, সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার একটি অবশ্যম্ভাবী অংশ মাত্র।
খ। স্বল্পমেয়াদে অর্থের প্রবৃদ্ধির উপর ইতিবাচক থাকলে দীর্ঘমেয়াদে এর অর্থাৎ অর্থের কোনো ইতিবাচক প্রভাব প্রবৃদ্ধির উপর থাকে না। তাই, টাকা বাড়ালেই প্রবৃদ্ধি বাড়ে না। তবে হ্যাঁ, প্রবৃদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে অর্থ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। এতে অর্থনীতির আর্থিক গভীরায়ন (financial deepening) নিশ্চিত হয়।
এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, উদ্ভূত করোনা পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষণীয়-
অ. সারা পৃথিবীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তুলনামূলকভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে
আ. সাথে সাথে আরও জরুরি- এটার ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে? সরকার-বেসরকারি সমন্বয়টা কীভাবে হবে? স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন উপখাতে ব্যয়ের বিভাজন কেমন হবে? এসব বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত।
ই. সম্ভবত আগামী পৃথিবীতে এ ধরনের বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে নতুন বৈশ্বিক ভালবাসার বন্ধন গড়ে তুলতে হবে (যুদ্ধ ব্যয় না বাড়িয়ে)। মানুষে মানুষে। দেশে দেশে। পৃথিবী বাঁচলে, দেশ বাঁচবে। বাঁচব আমি আপনি। বাঁচবে আমাদের সন্তানেরা।
লক্ষণীয়, যেসব দেশে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি প্লান করেছিল, তারা অপেক্ষাকৃত দ্রুত মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং শ্রীলঙ্কা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে, তবে তার জন্য চাই পর্যাপ্ত এবং সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ। এবং যথাযথ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ডাক্তার-জন অনুপাত যেমন দেখতে হবে। দেখতে হবে ডাক্তার-নার্স অনুপাত, ডাক্তার-মেডিক্যাল সহকারী অনুপাত, ডাক্তার-টেকনিশিয়ান অনুপাত এবং একজন ডাক্তারের প্রতিনিধিত্ব ভূমিকা (agency role)। এ ধরনের প্যানডেমিক মোকাবেলা করার জন্যে জনস্বাস্থ্য (Public Health) কাঠামো এবং জনস্বাস্থ্যে উপযুক্ত বিনিয়োগের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, ভবিষ্যতে আরও গুরুত্ব বাড়বে। পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলার মহামারীর সময় একটা বিষয় স্পষ্ট বোঝা গেছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভঙ্গুর হলে প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণে আনা অনেক দুরূহ হয়। শক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, প্রস্তুতি আর সমন্বয় ঠিক মত করা হলে অপেক্ষাকৃত কম অর্থেও মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সময় মতো সঠিক পদক্ষেপ নেয়াটাই বড় কথা।
আমার মতে, বাংলাদেশে করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে তিন ধরনের নেতৃত্ব এই মুহূর্তে অতি জরুরি:
১। সমর্পিত (committed),অন্তর্ভূক্তিমূলক (inclusive) রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ঢাকা থেকে উপজেলা পর্যন্ত;
২। স্বাস্থ্য ক্রাইসিস ম্যানেজ করার জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ও নেতৃত্বে বিশেষ টিম; এবং
৩। আসন্ন অর্থনৈতিক মহামন্দা (catastrophe) সামলানোর জন্য একটি সম্মিলিত সমাজ-বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ নেতৃত্ব।
জাতির সামনে মহাকালের কোনো মাহেন্দ্রক্ষণ আসে- যখন সবাইকে তার নিজ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হয়, গোষ্ঠীকে গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে এবং নেতাকে নেতাদের নেতা হয়ে উঠতে হয়। এই করোনাকাল, সেই মহাসময়। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়। এই সহস্রাব্দে মানবজাতির জন্যে। অর্থনীতি হোক মানুষের, জীবন বাঁচার। অর্থনীতি হোক মেলবন্ধনের। ভালোবাসার। কৃষকের প্রতি ভালোবাসার, শ্রমিকের প্রতি ভালোবাসার, নতুন সৃজনের প্রতি ভালোবাসার। বৈভব হোক ভাগ ও ত্যাগের, শুধু ভোগের নয়।