আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী

বাঙালির চেয়ে বড় শত্রু বাঙালির আর কে আছে? নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারার কথা তো বাংলা ভাষাতেই আছে। এই বাঙালিই হত্যা করল তার স্বাধীনতার মহানায়ককে। এই মহানায়ক বিদেশ থেকে আসা কোনো সেন নয়, সুলতান নয়, বাঙালির নিজের বুকে তিলে তিলে বড় হয়ে ওঠা আত্মজ, নিজেরই আত্মার একটি অংশ। তাকে হত্যা করে স্বোপার্জিত স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তোলার এক নির্বোধ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হলো উন্মূল অজাতটি।

মাসুদ আনোয়ারমাসুদ আনোয়ার
Published : 19 August 2022, 11:15 AM
Updated : 19 August 2022, 11:15 AM

গল্পটা যদি এমন হতো! ওই যে রূপকথায় যেমন হয়। অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বাস করিতে লাগিল। কিন্তু কিছু লোক ‘সুখে-শান্তিতে বাস করিতে’ চায় না। কিছু লোক স্বর্গ পছন্দ করে না। তারা স্বর্গের পাখি হতে চায় না। নরকের কীট হওয়াটাই তাদের বেশি পছন্দের। তাদের শেকড় নেই, উন্মূল থাকাটাকেই মনে করে জীবনের সারাৎসার। তারা নিজেদের সম্মান করতে জানে না, কারণ তাহলে যে সম্মান আহরণ করার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়! কিন্তু যোগ্যতা অর্জন করতে গেলে তাদের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে পড়ে। আর মেরুদণ্ডহীনতাই হলো তাদের সব চেয়ে প্রিয় অবস্থান। একজন মুজিব তাই যখন তাদের ঘাড় সোজা করে দাঁড়াতে বলেন, তারা তখন তার দিকে তলোয়ার উঁচিয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাসের রূপকথায় এভাবে লেখা হয়েছে গল্পটার পরিণতি। সুখে-শান্তিতে বাস করার স্বপ্ন তাই সত্যি হলো না। ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’র মতো বাঙালির নিজের স্বভাবই তার বড় শত্রু; বাঙালির দোজখে তাই পাহারাদার লাগে না। তার ঊর্ধ্বগতি রোধ করার জন্যে নিচ থেকে টানাটানি শুরু করে দেয় অসংখ্য হাত। বাঙালির হাত।

আবার এ বাঙালির একটি হাতই একবার সাড়ে সাত কোটি হাত হয়ে আকাশ ছোঁয়ার উপক্রম করেছিল। কিংবা ছুঁয়েই ছিল। সে ছিল মুজিবের হাত। আর সে হাতের তর্জনী ছিল আকাশের দিকে উঁচানো। সে উল্লম্ব তর্জনীর স্বচ্ছ নখে যেন বিচ্ছুরিত হয়েছিল আলোকচ্ছটা। সে আলোয় হাজার বছরের ঘুমন্ত বাঙালি চোখ মেলে চেয়েছিল। ওই প্রথমবার তারা জেনেছিল, মানুষ আসলে আলোকপ্রয়াসী; অন্ধকার তার চোখে, তার চেতনায় সাময়িক প্রলেপ দিতে পারে মাত্র। কিন্তু শাশ্বত আলোকাভাসে তাকে জেগে উঠতেই হয়, নিজেকে চিনতে হয়, তারপর এগিয়ে যেতে হয় অপরাজেয় বোধ আর বিশ্বাস নিয়ে চিরন্তন মনুষ্যত্বের দিকে। সে মনুষ্যত্ব সত্যান্বেষী, যে সত্য বুদ্ধি আর বিশ্বাসের মিশেলে চিরন্তন।

এরই মধ্যে একেকজন মানুষের হৃদয় হয় মহাসমুদ্রের মতো পারাপারহীন। বোধের গভীরতা আর বিশ্বাসের ব্যাপকতায় অনন্যসাধারণ। বাঙালি-জীবনের হাজার বছরের প্রবহমানতায় যে নিরবচ্ছিন্ন আটপৌরে দৈনন্দিনতা, তাতে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ তরঙ্গের উদ্গাতা হয়ে যে মানুষটির আগমন ঘটেছিল, তিনি মুজিব। প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুর বিরুদ্ধে তর্জনী তুলে গর্জে ওঠার মতো স্পর্ধা তিনিই প্রথম দেখাতে পেরেছিলেন। গলা উঁচিয়ে বলতে পেরেছিলেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো...

মূলত এ রক্ত দেয়ার ব্যাপারটাই হলো আসল ব্যাপার। শরীর আর মনের রক্তক্ষরণ ছাড়া পৃথিবীতে কোনো কিছু অর্জনের আকাঙ্ক্ষা করাটা স্রেফ সোনার পাথর বাটি। ইতিহাসের পরতে পরতে তাই রক্তের মহাপ্লাবন। রক্তের বন্যায় অত্যাচার, ভয় আর অন্যায় ভেসে যাওয়ার কাহিনি। আর তারই মধ্যে ফুটে ওঠে স্বাধীনতা আর বিজয়ের প্রগাঢ় লাল গোলাপ, দিগন্ত প্রসারিত নীলপদ্ম। মুজিব আমাদের তর্জনী প্রসারিত করে ওই গোলাপ আর পদ্মের ঠিকানা বাতলে দিয়েছিলেন।

তিনি তো নতুন কোনো দর্শনের জন্ম দেননি। তিনি অলৌকিক কোনো বস্তু এনে দেননি। ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েই ছিল, তিনি শুধু ওই ক্ষেত্রটাই আমাদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন। আসলে চিনিয়েও দেননি। তিনি নিজে চিনে নিয়ে আমাদের সঙ্গে করেই ওই মোক্ষার্জনের পথে যাত্রা করেছিলেন। আমরা তার অনুবর্তী হয়েছিলাম। অথচ ওই ক্ষেত্রের দিকে তারও আগে তিতুমীর বাঁশের লাঠি হাতে, বীরকন্যা প্রীতিলতা আঁচলে বিষের পুটুলি বেঁধে, সালাম-বরকতেরা ১৪৪ ধারা ছিন্ন করে যাত্রা শুরু করেছিলেন; ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেনরা ফাঁসির দড়ি গলায় পরে ওই পথের দিকে বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। আর এদের সবার সমন্বিত প্রচেষ্টাই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল মুজিব নামের এক বাঙালির জীবনদর্শনে। মুজিব তাই পদ্মা-মেঘনার স্রোতোধারায় মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন বাঙালি জীবনকে। তারপর একাত্তরের মহাপ্লাবন সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে ওই কাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রে বাঙালিকে নিয়ে ফেলেছিল স্বায়ত্ত সত্তায়, স্বোপার্জিত স্বাধীনতায়।

বাঙালি যেন এক অদ্ভূত জাতিসত্তা। এতটা রহস্য যেন পৃথিবীর আর কোনো জাতিই নিজের মধ্যে ধরে না। এমন বীরত্ব, এতটা কাপুরুষতা, এমন আত্মমর্যাদা, এরকম হীনন্মন্যতা, এতটা মননশীলতা, এমন নির্বুদ্ধিতা, এরকম স্বকীয়তা আর এত বেশি আত্মঘাতপ্রবণতা পৃথিবীর আর কোনো জাতির মধ্যে এক সঙ্গে ক্রিয়া করে না। এদের আত্মসচেতনতা যেমন বিস্ময়কর, আত্মবিস্মৃতিও তেমন ভয়াবহ। স্বাজাত্যবোধে গরীয়ান বাঙালিই আবার দাস্যমনোবৃত্তিরও চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। নিজের তিল তিল করে গড়ে তোলা অর্জনকে মুহূর্তে ছুড়ে দিতে পারে অবহেলায়। তার মধ্যে রয়েছে এক ভয়ানক আবেগসঞ্জাত মনোবিকার। ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে মুহূর্তের নোটিসে বিশাল সব কাণ্ড ঘটায়। এমন সব কাণ্ড, যা একটা জাতিকে চিরদিনের জন্য তুলে নিতে পারে এক অনন্যসাধারণ উচ্চতায়; কিন্তু আরেক মুহূর্তের ভাবালুতায় বাঙালি তা ধুলোয় ছড়িয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। বাঙালির যে সন্তান মুজিব হয়ে উঠে পৃথিবীকে নিজের মহিমাময় সত্তার ঝলকানি দেখায়, বাঙালি তার সে সন্তানকে হত্যা করে নিজের কদর্যতা আর মূর্খতা প্রদর্শনেও পিছপা হয় না। তাই যে মুজিব বাঙালি-ইতিহাসের মহানায়ক, তাকে সমূলে বিনাশ না করলে যেন বাঙালির বাঙালি নাম সার্থক হয় না। একজন বাঙালি নীরদ সি চৌধুরী তাই নিজের জাতিগত বৈশিষ্ট্যকে রূপায়িত করেন ‘আত্মঘাতী’ শব্দের অভিধায়।

১৫ আগস্ট তাই বাঙালির আত্মঘাতের কলঙ্কিত দলিল।

কিন্তু আসলেই কি বাঙালির কোনো ইতিহাস আছে? বাঙালি কি কখনো ইতিহাসের উপজীব্য হতে পেরেছিল? আরও সহজ করে বলতে গেলে ইতিহাসের বিষয় হওয়ার মতো উপকরণ বাঙালির জাতীয় জীবনে কখনো ছিল কি? এটা নিয়ে তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণের অভাব হবে না। কিন্তু কেবল তত্ত্ব দিয়েই যদি মানুষের জীবনাচরণের সঠিক ব্যবচ্ছেদ করা যেত, তাহলে অনেক জটিলতার অবসান হতো, অনেক রহস্যের দ্বারোন্মোচন ঘটত।

বাঙালির স্বকীয়তা মানে কী? বাঙালির জাতীয়তার উৎস কোথায়? উৎস আদৌ আছে কি? ভারতীয় উপমহাদেশের একটি সঙ্কর নরগোষ্ঠীর উৎস খুঁজতে যাওয়ার মানে হলো অসংখ্য নরগোষ্ঠীর পিছু ধাওয়া করা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, শক-হুনদল পাঠান-মোগল এক দেহে হলো লীন...। এক দেহে লীন হওয়ার ব্যাপারটা এখন বাস্তবতা, কিন্তু এক মনে গঠিত হওয়াটা কখনো কি হয়েছে? বাঙালি জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় দুটো ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুশাসনে। মধ্য এশিয়া থেকে আগত বহুঈশ্বরবাদী আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা একেশ্বরবাদী দুটি ধর্ম বাঙালির সঙ্কর জাতিসত্তাকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। জাতিসত্তার মৌল বৈশিষ্ট্যের অভাবে বাঙালি কখনো অখণ্ড চেতনা নিয়ে কোনো বিষয়ে চিন্তা করতে পারে না। রক্তকণিকায় নিজেরই অজান্তে হাজার বছর ধরে বয়ে আনা ভিন্নতাবোধ তার চিন্তাকে সমন্বিত করে না। বাঙালির চিন্তা তাই কোনো ক্ষেত্রে একক নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে না। জাতীয়তার চেয়ে সাম্প্রদায়িক চিন্তাই তাদের কাছে চূড়ান্ত বিবেচ্য হয়ে ওঠে।

৪৭-এর ক্রান্তিলগ্নে বাঙালি একক চিন্তায় ভাস্বর হয়ে উঠতে পারেনি। একদল ‘বন্দে মাতরম’ আর একদল ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর মোহে নিজেদের জাতিসত্তার মূলে বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে দিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। শেরেবাংলা ফজলুল হক আর শরৎ বোসদের একক বাঙালি রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা তাই হালে পানি পায় না। অথচ ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবনাচারের গণ্ডিতে আবদ্ধ রেখে বৃহত্তর বৈষয়িক পরিমণ্ডলে একক জাতিসত্তাবোধের চর্চা করতে পারলে উপমহাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হয়ে লেখা হতো। হাজার বছরের বাঙালিত্ববোধ একটি নরগোষ্ঠীকে মর্যাদাসম্পন্ন বৈশিষ্ট্যে উন্নীত করতে পারত। কিন্তু প্রবল ধর্মীয় চেতনা যুক্তির ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিল বলে আবেগটাই মানবিকবোধকে পাথরচাপা দেয়। ফলে পাকিস্তানের অংশভুক্ত বাঙালি আর ভারতভুক্ত বাঙালি বিভাজনের বিষে নীল হয়ে এখন ধুঁকে ধুঁকে মরছে। বাঙালির একক জাতিসত্তা না বাংলাদেশে না পশ্চিমবঙ্গে পূর্ণতা পাচ্ছে।

আর বাঙালির এমনই এক দ্বিখণ্ডিত সত্তার মধ্যে আগমন হয়েছিল মুজিব নামের এক ব্যক্তির, যিনি বাঙালির একক সত্তায় উজ্জীবনের গান গেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেও তো এই বিভাজনের বাইরে ছিলেন না। বৈরী ক্ষেত্র তাকেও সীমিত পরিসরে জাতিসত্তার ডাক দিতে বাধ্য করেছিল। পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার ডাক ছিল সাড়ে সাত কোটি মুসলিম বাঙালিকে উদ্দেশ্য করে। ভারতীয় হিন্দু বাঙালি তাতে আমন্ত্রিত ছিল না। ভারতীয় হিন্দু বাঙালি ততদিনে নিজেদের একক সত্তা হারিয়ে সর্বভারতীয় বহুজাতিক সত্তায় বিলীন হয়ে গেছে। তাই মুজিবের হাত যতই ওপরে প্রসারিত হোক, ওই হাতের ছায়ায় সন্নিবেশিত হওয়ার সাহস তাদের ছিল না। মুজিব তাই পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা মুসলমান বাঙালির নেতা হিসেবে খণ্ডিত হয়ে যান। তাই তিনি নিজের ঠিকানা হিসেবে নির্দেশ করেছিলেন পদ্মা-মেঘনাকে, গঙ্গা-গোদাবরীকে নয়। একটা সর্বব্যাপ্ত হওয়ার মতো হাত তাই গুটিয়ে গিয়েছিল পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে।

কিন্তু সেটা ভৌগোলিক বিভাজন। জাতিসত্তার নেহাত গণ্ডিবদ্ধতা। তার চেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার ছিল মানসিক দ্বিখণ্ডতা। এটা শুধু যে হিন্দু বাঙালিদের সঙ্গে ছিল তা নয়। মুসলিম বাঙালিদেরও নিজেদের শক্তির ওপর নির্ভরতা নষ্ট করে দিয়েছিল সঙ্কর মানসিকতার এ টানাপোড়েন। তাই মুজিবের স্বাধিকারের ডাক সব মুসলমান বাঙালিকে একই সঙ্গে উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। কিছু বাঙালি মুসলমান জাতিসত্তা চর্চার মহা আমন্ত্রণেও উদাসীন থেকে যায়। নিজের শক্তির ওপর আস্থাশীল হতে পারে না তারা। ফলে একাত্তরের মতো সর্বগ্রাসী সময়ও তাদের নির্বীর্য দৈনন্দিনতায় সামান্যতম আঁচড় কাটতে পারেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের ওই মহাপ্লাবন জাগানো ঘটনা তাদের কাছে কোনো আবেদনই সৃষ্টি করতে পারেনি। বাঙালির রক্তে লুকনো দাস্যবৃত্তির অভিশাপ থেকে তারা মুক্ত হতে পারেনি। নিরবচ্ছিন্ন সুখপ্রত্যাশায় যেনতেনভাবে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা যাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য, তারা বড় কিছু অর্জনের জন্যে নিজেদের চ্যালেঞ্জের মুখে নিয়ে যেতে পারে না। তারা প্রভুত্বপরায়ণতার বশংবদ হয়ে আটপৌরে জীবনযাত্রায় নিত্যতুষ্ট থাকতে পারাটাকেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য মনে করে। তাই মুজিবের বিরুদ্ধবাদীর সংখ্যাও কম ছিল না। মুজিবের সাহসের সমাচারকে তাদের মনে হলো আস্পর্ধার আস্ফালন। তাদের চামচিকে চোখে তাই হঠাৎ আলোর ঝলকানি তীব্র জ্বালা ধরিয়ে দিল। তারা গর্তে মুখ লুকাল। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তীরে তাদের স্বাধীনতার স্লোগান শোনা গেল না। তারা ধর্মের জিগির তুলে নিজেদের মর্যাদাকে ভুলুণ্ঠিত করল। অথচ ধর্মই মানুষকে শেখায়, মানুষ হয়ে ওঠার জন্যে আত্মমর্যাদাবোধ কতটা জরুরী। কোনো ধর্মেই তাই ন্যায্য স্বাধীনতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়নি। তবে এখানে ধর্মের ভূমিকাটা স্রেফ আরোপ করা হয়েছিল। শোষকরা যা সর্বদাই করে থাকে। কারণ ধর্মের নামে শোষণটাই হলো সবচেয়ে আরামদায়ক, নিরাপদ ও ফলপ্রসূ। মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই ধর্মের অনুসারী– তাই তার কাছে পৌঁছানোর জন্যে ধর্মের দোহাই ছাড়া বড় দোহাই আর হয় না। মুজিবের স্বাধীনতার ডাক শাসক-শোষক যেমন পছন্দ করেনি, তেমনি পছন্দ করেনি তাদের বশংবদ কিছু আত্মসম্মানহীন মানুষও। তারা জ্ঞানে-অজ্ঞানে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে ধর্মের আফিম, নিজেদের দাস্যমনোবৃত্তিকে মহিমান্বিত রূপ দেয়ার জন্যে। মুজিবের স্বাধীনতার ডাক তাদের কাছে উচ্ছৃঙ্খলতার নামান্তর হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তীরের কোটি কোটি মানুষ যখন ওই স্বাধীনতার জন্যে বুকের তরতাজা রক্ত ঢালতে শুরু করে দিল, তখন তাদের জন্য পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তখন গাঙ্গেয় বদ্বীপে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। সেখানকার কিছু মানুষ তাদের বহমান ইতিহাসে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ পেল। আসলে ইতিহাসে বাঙালি নামের এক সঙ্কর নরগোষ্ঠী সর্বপ্রথম স্বোপার্জিত স্বাধীনতায় মাথা তুলে দাঁড়াল। এর কারিগরের নাম শেখ মুজিবর রহমান।

কিন্তু বাঙালির চেয়ে বড় শত্রু বাঙালির আর কে আছে? নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারার কথা তো বাংলা ভাষাতেই আছে। এই বাঙালিই হত্যা করল তার স্বাধীনতার মহানায়ককে। এই মহানায়ক বিদেশ থেকে আসা কোনো সেন নয়, সুলতান নয়, বাঙালির নিজের বুকে তিলে তিলে বড় হয়ে ওঠা আত্মজ, নিজেরই আত্মার একটি অংশ। তাকে হত্যা করে স্বোপার্জিত স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তোলার এক নির্বোধ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হলো উন্মূল অজাতটি। আহ, বাঙালি আর কখনো অখণ্ড জাতিসত্তায় পরিণত হতে পারল না। হাজার বছরের অর্জন মাত্র তিন বছরেই শেষ! নীরদ সি চৌধুরী যে উদ্দেশ্যেই বলে থাকুন, শব্দটি কিন্তু ঠিকই বেছে নিয়েছিলেন। আত্মঘাতী বাঙালি!

শেখ মুজিবহত্যা প্রতিটি বাঙালিকে সারা জীবন কাঁদানো উচিত। না, তার জন্য নয়, বাঙালির নিজের জন্যে।

মানুষ মরণশীল। শেখ মুজিবও মারা যেতেন। এভাবে না হলে অন্য কোনোভাবে। তিনি মারা গেছেন, তার কোনো ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হয়েছে সমগ্র বাঙালি জাতির। বর্ণ-ধর্মনির্বিশেষে যে একজন বাঙালি মানুষ মহামানবতার পথের যাত্রী হয়ে নিজের জাতিকে তার সবক দিতে পারতেন, তাকেই আমরা খুন করেছি সপরিবারে, প্রায় সবংশে। এ এক অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয়, অনভিপ্রেত খুন, যার কখনো কোনো কাম্যতা ছিল না। কিছু ঈর্ষাপরায়ণ মানুষের ক্ষুদ্রতা পারেনি নিজেদের ক্ষতি মেনে নিতে। তাই যে মুজিবের দ্বারা সে ক্ষতি, তাকে নিহত না করে তাদের স্বস্তি ছিল না। আর তারা ছিল শুধুই ব্যক্তি, সমাজ-জাতি-সম্প্রদায়ের ধারায় পড়ার অনুপযুক্ত বর্বর একটি শ্রেণি।

১৫ অগাস্টের বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর এটাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে। এটার বৈধতা আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে সমসাময়িক সমাজ ও ইতিহাসের কাছে। কিছু লোক কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, কিন্তু সব মানুষকে সব সময়ের জন্যে ফাঁকি দেয়া সম্ভব হয়নি। যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক মৃত্যুর পর জানাজার সময় রাষ্ট্রীয় সম্মানটুকুও পাননি, সে রাষ্ট্রই ফের তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে তার প্রাপ্য সম্মান। আজ মুজিব বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত জাতির পিতা। সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, তাকে অপমান বা অবহেলা করা যাবে না।

কিন্তু প্রতিটি ১৫ অগাস্ট একই কলঙ্ক বাঙালির! একই লজ্জাষ্কর আত্মহত্যার কাহিনি রচিত হয়েছে পাললিক বদ্বীপের এই লোকগুলোর আগামীর ইতিহাসে? নিজের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জনকে মাত্র সাড়ে তিন বছরে ধূলিসাৎ করেছে, আর তার পর থেকে চলছে নিজের ইতিহাসের মহানায়ককে নিয়ে, নিজের জাতিসত্তার মহত্তম অর্জন আর মহত্তম সন্তানদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর তাদের চরিত্রহননের অপচেষ্টা। আজ তথাকথিত ‘বাংলাদেশী জাতি’র চোখে মুজিব খলনায়ক। নিজের পিতৃ কিংবা মাতৃভূমিকে একটি বিশেষ দেশের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করার জন্যই নাকি সারাজীবন জেল জুলুম আর কারাভোগ করেছিলেন শালপ্রাংশু শরীরের উন্নতমস্তক ওই লোকটি। ভাগ্যের পরিহাস এ নয়, এ হলো উন্মূল মানুষের নিজেকে নিয়ে নির্বোধ রসিকতা। অন্যের পদানত ইতিহাসের বাঁকে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো যে মহত্তম অর্জন, তাকে রসাতলে পাঠানোর আত্মধ্বংসী প্রবণতা। বাঙালি আর মানুষ হলো না, বাঙালিই রয়ে গেল।