অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী– স্মরণে বরণে

মাত্র ৫২ বছর বেঁচে ছিলেন। ১৯৩২ সালের ৮ জানুয়ারি জন্ম এবং ১৯৮৪ সালের ৩০ মার্চ মৃত্যু। অল্প সময়ের জীবনকালেই তিনি অগুণিত বন্ধু-সুহৃদ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা-মমতা-ভালবাসায় সমুজ্জ্বল এক অমলিন স্মৃতি রেখে গেছেন।

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 29 March 2023, 06:02 PM
Updated : 29 March 2023, 06:02 PM

মাত্র ৫২ বছর বেঁচে ছিলেন অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী। ১৯৩২ সালের ৮ জানুয়ারি জন্ম এবং ১৯৮৪ সালের ৩০ মার্চ মৃত্যু। অল্প সময়ের জীবনকালেই তিনি তাঁর অগুনিত বন্ধু-সুহৃদ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা-মমতা-ভালবাসায় সমুজ্জ্বল এক অমলিন স্মৃতি রেখে গেছেন। বায়োকেমিস্ট্রি (স্বাধীনতা লাভের পরপর প্রাণরসায়ন এবং তার আরও পরে বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনকালে ২০০৩ সালে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান) বিভাগে শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে তাঁর কর্মময় জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে। তবে তাঁর আরাধ্য ও স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ প্রতিষ্ঠা, তা তিনি বহু বছরের নিরবচ্ছিন্ন শ্রম ও অধ্যবসায়ী কর্মোদ্যোগে বহু বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ফলবতী করেছিলেন ১৯৭৯ সালে। বড়ই পরিতাপের কথা, মাত্র পাঁচটি বছর অধ্যাপক চৌধুরী তাঁর প্রিয় বিভাগে কাজ করে যেতে পেরেছেন। মৃত্যুর মাত্র একদিন আগে তিনি তাঁর বিভাগটি দেখতে এসেছিলেন। হয়তো মহা প্রস্থানের বার্তাটি পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জীবনের চূড়ান্ত ক্ষণে গিয়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের বরেণ্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের সাথে শেষ দেখা করতে। স্যারের মৃত্যুর এক বছর পর ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ জার্নাল অফ মাইক্রোবায়োলজির ২য় ভল্যুমের ১ম ও ২য় খণ্ড একসাথে প্রকাশিত হয়। এই জার্নালটি উৎসর্গ করা হয় তার প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরীকে। উৎসর্গপত্রটি রচনা করেছিলেন অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। পরম ভালবাসা ও মমতায় উৎসর্গপত্রটির শিরোনাম করেছিলেন, “Professor Anwarul Azim Choudhury– The Uncut Diamond”। স্যারের জীবন, শিক্ষা ও গবেষণার কর্মময় জীবনের উপর আরও কিছু কথা বলবো পরে।

বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে যে দু’জন শিক্ষক আমার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেছিলেন, বলতে কি আমার জীবনের মোড়ই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক কামালুদ্দিন আহমদ এবং একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী। ১৯৬৭ সালে আমি বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে ভর্তি হই। সে সময় থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়কালটি ছিল আমাদের প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এক সোনালি সময়। পরাধীনতার ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা লাভের স্বপ্নে বিভোর ছিলাম আমরা। ১৯৬৮, ’৬৯ এবং ’৭১-এ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিপ্লবী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়েছিলাম আমি। আবার কামাল স্যারের কৃপাধন্য হয়ে পুনঃভর্তির সুযোগ লাভ করে লেখাপড়ায় ফিরতে পেরেছি। যদিও বারবার লেখাপড়া ছেড়ে দেয়ায় অনার্সে আমি একবছর পিছিয়ে পড়েছিলাম। ১৯৬৯ সালে চৌধুরী স্যার জার্মানির গোটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষণা শেষে দ্বিতীয়বারের মত বিভাগে যোগ দিয়েছেন সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে। এর আগে ১৯৬৩ সালে এই গোটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ মাইক্রোবায়োলজি থেকে পি-এইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে প্রথমে গবেষণা সহযোগী ও পরে সিনিয়র লেকচারার পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন চৌধুরী স্যার। সম্ভবত অনার্সের দ্বিতীয় বছরে চৌধুরী স্যারের ক্লাস পেলাম বিভাগে তাঁর যোগ দেয়ার পরপরই। সদা হাস্যময় ছাত্র-বান্ধব একজন শিক্ষক পেল প্রাণরসায়ন বিভাগ।

১৯৭২ সালে বিভাগীয় শিক্ষক ড. পারভেজ আহমেদ বায়োকেমিস্ট্রির বাংলা নাম হিসেবে প্রাণরসায়ন নামটি প্রস্তাব করেন এবং তা বিভাগের নাম হিসেবে গণ্য হয় শুধু নয়, পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের বাংলা নাম হিসেবে প্রাণরসায়ন নামটি গ্রহণ করা হয়। এর আগে বাংলা হিসেবে জীবরসায়ন নামটি ব্যবহার হতো। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বিজ্ঞান অধ্যয়নে ইংরেজির সাথে বাংলা ব্যবহারের চর্চা শুরু করা পারভেজ স্যারের জন্ম পুরোনো ঢাকার নবাব পরিবারে। বাংলার বদলে উর্দু ভাষায় কথা বলতেন গৃহে। আর তিনি কিনা ‘প্রাণরসায়ন’ বাংলা নামটি প্রস্তাব করেছিলেন! আমাদের পড়াতেন ‘হরমোন’। পুরো কোর্সটি ইংরেজি পাঠ্য থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন পারভেজ স্যার। হরমোনের ইংরেজি সংজ্ঞা, ‘Secretion of endocrine glands is called Hormone’-এর বাংলা করেছিলেন, ‘আন্তনিসারি গ্রন্থিসমূহের রস’। এত বছর পর এসব ভাবতেই পারভেজ স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় মাথা নুইয়ে আসে।

মাইক্রোবায়োলজি প্রাণরসায়নের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি বিষয়। গোটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিশ্বখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পি-এইচ.ডি. করেছেন, এমন একজন শিক্ষক পেয়েছি মাইক্রোবায়োলজি পড়বার জন্য। আমরাতো ধন্য। গল্প করতেন স্যার। বলতেন দারুণ খটোমটো জার্মান ভাষা শিখতে হয়েছিল তাকে। মাইক্রোবায়োলজির স্বনামধন্য বিজ্ঞানী অধ্যাপক হান্স গুন্টার শ্লেগলের তত্ত্বাবধানে পি-এইচ.ডি. গবেষণায় একই ল্যাবরেটরিতে তার সহপাঠী Gerhard Gottschalk। এই নামটিতো আমাদের বড় পরিচিত! Gerhard Gottschalk রচিত Bacterial Metabolism আমাদের পাঠ্যবই। আমরা মোহিত হই। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পরে এই নিবন্ধ লিখতে গিয়ে গুগলে খোঁজ নিয়ে জানলাম G. GOTTSCHALK and A. A. CHOWDHURY’র যৌথ গবেষণায় দু’টো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র যথাক্রমে Federation of European Biochemical Societies Letters (FEBS LETTERS) ও Biochemical and Biophysical Research Communication (BBRC) জার্নালে প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালের মার্চ এবং আগস্ট তারিখে। দু’টোই বায়োকেমিস্ট্রি, মলিকুলার বায়োলজি এবং বায়োফিজিক্স বিষয়ে নামজাদা জার্নাল।

শর্করা ও অন্যান্য প্রাণঅণুর বিপাকীয় কত পথের বর্ণনা করেন স্যার। আমাদের জীবকোষে এইসব বিপাকীয় পথের কথা আমরা পড়েছি প্রাণরসায়নের মেটাবলিজম ক্লাসে। এবারে এককোষী ব্যাকটেরিয়ায় এসব বিপাক কিভাবে সম্পন্ন হয়, তা স্যার বুঝিয়ে দেন। বহুকোষী প্রাণী বা উদ্ভিদের সাথে তার পার্থক্য কোথায়, তাও বলেন। জীবজগতের বিবর্তনে এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে বহুকোষী উদ্ভিদ বা প্রাণীর উদ্ভবের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা শুনি তাঁর কাছ থেকে। ব্ল্যাকবোর্ডে কঠিন বানানের নানা ব্যাকটেরিয়ার নাম কি অবলীলায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখে যান চৌধুরী স্যার। কখনও বানান ভুল হয় না। কথা বলা যায় স্যারের সাথে। কিভাবে মুখস্ত রাখেন এই কঠিন নামগুলো? স্যারের মুখে মৃদু হাসি। বারবার লিখলে তোমরাও মনে রাখতে পারবে। আহা, অর্ধ শতাব্দীরও বেশি পরে কেমন উজ্জ্বলভাবেই না মনে পড়ছে স্যারের ক্লাসের কথা। ৭৩ বছর পেরিয়ে ৭৪-এ পড়েছি। তারপরও মনে পড়ে গেল ‘Leuconostoc mesenteroides’ নামটি। শুধু নামটি মনে আছে। গুগলে গিয়ে খোঁজ করে দেখলাম বিভিন্ন সব্জি, যেমন শশা, বাঁধাকপি, মূলা - ইত্যাদির আচার বানাবার প্রক্রিয়ায় ল্যাক্টিক এসিড ব্যাক্টেরিয়া হিসেবে কাজ করে লিউকোনস্টক মেসেন্টেরয়েডস। ভাবলাম আমাদের পরিচিত এমন বাস্তব উদাহরণ দিয়ে পড়াতেন বলেই না ল্যাক্টিক এসিড ব্যাক্টেরিয়া গোষ্ঠীর এমন কঠিন নামটি মনে পড়ে গেছে এত বছর পর।

এবারে কিছু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। চৌধুরী স্যার কিভাবে আমার জীবনের মোড়টিই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন, তা বোঝাবার জন্যই এই প্রসঙ্গ। মুক্তিযুদ্ধের পর আবার বিভাগে ফিরে এসেছি। কিন্তু পড়াশুনায় মন নেই। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ নতুন স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে। সমাজ বদলের স্বপ্ন। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, স্বজনহারা মানুষের গভীর দুঃখ, যাতনা; খাদ্যের, বাসস্থানের অভাব। নানাভাবেই স্বপ্ন ভঙ্গ হচ্ছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রটি রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে। মনে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার চাইতেও বড় কর্তব্য হচ্ছে গ্রামে ফিরে যাওয়া, দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাদের সঙ্গবদ্ধ করে উন্নত সমাজ গড়ার লড়াইয়ে সামিল করা। এসব নিয়ে কথা হয় চৌধুরী স্যারের সাথে। তিনি দ্বিমত করেন না, তবে বোঝাতে চেষ্টা করেন লেখাপড়াটা শেষ করা উচিত। দেশ গড়ার জন্য প্রয়োজন নিজেকে যোগ্য করে তোলা। আমি ইতোমধ্যে যুক্ত হয়ে গেছি স্বাধীন দেশে সমাজ বদলের লড়াইয়ে। পড়াশোনার চেয়ে বেশি সময় দেই সংগঠনের কাজে। স্যার সব জানেন। তারপরও চেষ্টা করেন তার প্রিয় অবাধ্য ছাত্রটিকে অন্তত পরীক্ষায় সামিল করতে। আমাদের অনার্স ছিল তিন বছরের। মনে আছে তত্ত্বীয় পরীক্ষা শেষে ব্যবহারিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। দোতালার ল্যাবরেটরিতে আমরা পরীক্ষা দিচ্ছি। প্রধান পরীক্ষক চৌধুরী স্যার। কনিষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে ডেইসে তিনি বসে থাকেন। নানা বিষয়ে তত্ত্বাবধান করেন। সেদিন ছিল সল্ট পরীক্ষা করা। আমাদের যে দুটো অজানা সল্ট দেয়া হয়েছে, তার নাম ও ধর্ম বের করতে হবে নানা পরীক্ষা করে। আমি সহজেই একটি সল্ট সঠিক ভাবে সনাক্ত করে পরীক্ষার খাতায় লিখে স্যারের হাতে দিলাম। তিনি একটু অবাক হলেন। চোখ বুলিয়ে বললেন, “দ্বিতীয় সল্টটি কি আমার করে দিতে হবে”? আমি বললাম, “স্যার আমার জরুরি একটা কাজে এক্ষণই যেতে হবে। একটি সল্ট যে ঠিকমত বের করতে পেরেছি, তাতেই আমার পরীক্ষা পাশ হয়ে যাবে”। এই বলে আমি বের হওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করলাম। “কি বলে এই ছেলে, শেষ পরীক্ষার চেয়ে আর জরুরি কি কাজ থাকতে পারে? আটকাও তাকে”। কে শোনে কার কথা। দ্রুতই আমি বেরিয়ে এলাম। জানতাম আমার দিকেই তিনি তাকিয়ে আছেন। আমাকে নিয়ে গভীর কোন ভাবনায় হয়তো ডুবেও গেছেন।

ফল প্রকাশ হতে বেশ কিছু সময় লাগবে। আমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দুই বন্ধু ময়মনসিংহ শহরের কাছে খাগডহর গ্রামে চলে এলাম। পদার্থ বিজ্ঞানের শাহজাহানের বাড়ি সেই গ্রামে। ভূগোল বিভাগের মাহমুদও ছিল আমাদের নতুন এই অভিযাত্রায়। ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে এরা দুজন ছিল আমার সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু। ব্রহ্মপুত্র নদীর পারে আমরা উন্নত চাষাবাদ শুরু করবো, সাথে পোল্ট্রি। এটমিক এনার্জি কমিশনের বিজ্ঞানীরা নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন গামা ইরাডিয়েশানের মাধ্যমে। নাম দিয়েছেন ‘ইরাটম’। আমাদের কিছু বীজ দিলেন তাঁরা। মাঠ পর্যায়ে ইরাটমের এটাই হবে প্রথম চাষ। ‘টেকামসে’ নামের একটি আমেরিকান লো লিফট পাম্প সাশ্রয়ী মূল্যে পেলাম আমরা পাকিস্তানি মালিকের ছেড়ে যাওয়া শাহনেওয়াজ বাংলাদেশ লিমিটেড নামের সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে। আমার মেজভাই আবু ইউসুফ বীর বিক্রম স্বাধীনতার আগে থেকেই সেখানে কাজ করতেন। ‘টেকামসে’ নিয়ে একটু কথা বলতেই হবে।

১৯৯০-এর শেষে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা স্টেটে পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ‘টেকামসে’ ট্রেইলের কথা জানলাম। মার্কিনিরা যাঁদের নাম দিয়েছিল রেড ইন্ডিয়ান, সেই আদিবাসীদের বিভিন্ন গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন ‘শোনি’ গোত্রের টেকামসে। আমেরিকা ও কানাডার বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে বহু যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। টেকামসে ট্রেইলে শ্বেতাঙ্গ বাহিনীর বিরুদ্ধে এক নির্ধারক যুদ্ধে পরাজয় ও টেকামসের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমেরিকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান রাজত্ব। পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে টেকামসে ট্রেইলে স্থাপিত জাদুঘরে গিয়ে এসব কথা জেনেছি। হানাদার আমেরিকান শব্দটি আমি ব্যবহার করেছি সচেতনভাবেই। তবে টেকামসে জাদুঘরে গিয়ে দেখলাম টেকামসকে একজন প্রকৃত সাহসী বীর এবং হৃদয়বান নেতা হিসেবে চিত্রিত করেছে মার্কিনিরা। তাঁর নামে তৈরি করা টেকামসে পাম্প দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি তুলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীমুক্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা চাষ করেছিলাম ইরাটম ধান! এখন ভাবতেই কেমন লাগে।

পোলট্রির জন্য হোয়াইট লেগহর্ন, রোড আইল্যান্ড রেড এবং ব্ল্যাক মিনরকা এই তিন জাতের মুরগির তিনশ বাচ্চা আমরা কিনেছিলাম সরকারি ফার্ম থেকে। মধুপুরে অবস্থিত ‘কারিতাস’ এনজিও খুব অল্প মূল্যে একটা মিতসুবিশি পাওয়ার টিলার দিল। সারা দিনমান আমরা ক্ষেতে, পোল্ট্রিতে কাজ করি। ব্রহ্মপুত্রের টলটলে পানিতে গোসল করি। রাতে নৈশ স্কুলে বয়স্কদের লেখাপড়া শেখাই, সাথে নানা বিষয়। আমাদের বানানো মুরগির ঘরের ভেতরেই একপাশে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি গভীর নিদ্রায়।

কখন যে অনার্সের ফল বেরিয়েছে, তাও জানি না। একদিন দুপুরে আমাদের ফার্মে হাজির হলো বন্ধু আশরাফ। এক বছর পিছিয়ে আশরাফদের ব্যাচে পরীক্ষা দিয়েছি। চৌধুরী স্যারের প্রিয় ছাত্র আশরাফ। পরীক্ষার ফলের খবর নিয়ে এসেছে সে। আমাদের ব্যাচে একজন প্রথম শ্রেণি পেয়েছে। বাকি অধিকাংশ দ্বিতীয় শ্রেণি। অবাক হয়ে শুনলাম আমার অবস্থান উপরের দিকেই। তবে আশরাফের আসার কারণ ভিন্ন। চৌধুরী স্যার তাকে পাঠিয়েছেন আমাকে পাকড়াও করে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে। যেন আমি মাস্টার্সে ভর্তি হই। একবার অন্তত যেন তার সাথে দেখা করি। সেভাবেই ঢাকায় ফেরা এবং এম.এস.সি.তে ভর্তি হওয়া, থিসিস গ্রুপে অধ্যাপক কামালুদ্দিন আহমদ স্যারের তত্ত্বাবধানে থিসিস সম্পন্ন করা। আমি চেয়েছিলাম চৌধুরী স্যার হবেন আমার তত্ত্বাবধায়ক। স্যারের ইচ্ছাও ছিল তাই। কিন্তু বিভাগীয় প্রধান কামাল স্যারের নির্দেশে তাঁরই তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করতে হলো। মন বিষণ্ণ ছিল। চৌধুরী স্যার বোঝালেন এটাই ভালো হবে। বললেন, “তোমার কাজতো অণুজীব নিয়েই”। কমলা রঙের রডোটরুলা ইস্টে বিটা ক্যারোটিনের উপস্থিতি দেখা ছিল আমার কাজ। কারণ হলুদ-কমলা রঙের বিটা ক্যারোটিন থেকে তৈরি হয় ভিটামিন ‘এ’। যদি রডোটরুলা ইস্টে বিটা ক্যারোটিনের সন্ধান পাই, তবে তা প্রথমে ইঁদুরের খাবারে মিশিয়ে দেখা হবে, এই বিটা ক্যারোটিন ভিটামিন ‘এ’র ভাল উৎস হতে পারে কিনা। তখন বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের খাবারে ভিটামিন ‘এ’র স্বল্পতার কারণে রাতকানা রোগ এবং শিশুদের অন্ধত্ব ছিল ব্যাপক। রডোটরুলা ইস্টের বিটা ক্যারোটিন মানুষের খাদ্যে ভিটামিন ‘এ’র বিকল্প হতে পারলে, তা হবে দারুণ ব্যাপার।

কামাল স্যার বিভাগীয় প্রধান। নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তাঁকে। গবেষণা বিষয়ে কিছু জানতে হলে আমি যাই চৌধুরী স্যারের কাছে। সব বুঝিয়ে দেন চৌধুরী স্যার। মাস্টার্স এক বছরের হলেও থিসিস গ্রুপের জন্য বেশি সময় লাগে। প্রায় দেড় বছর রাতদিন কাজ করেছি ল্যাবে। পড়াশোনাও করেছি মন দিয়ে। পরীক্ষার ফলাফল যখন বেরুলো, তখন আমি আমাদের গ্রামের বাড়িতে। সে সময় নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ সড়কে বড় বড় খানা-খন্দক। বাস চলাচল খুবই কঠিন। সাধারণ মানুষের যাতায়াতে বড় কষ্ট। আমি একটি ম্যাসি-ফারগুসন ট্র্যাক্টর চালানো শুরু করলাম ট্রেলারে যাত্রী নিয়ে। ট্র্যাক্টরটি কিনেছিলেন আমার সেজ ভাই কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম, যার অধিনায়কত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কেমন হবে তা নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে তিনি পদত্যাগ করে বেসামরিক জীবনে ফিরে এসেছিলেন ১৯৭২ সালের শেষে। গ্রামে ফিরে চাষাবাদ করবেন, এমন চিন্তা তাঁর ছিল। একদিন ট্র্যাক্টর চালিয়ে ময়মনসিংহ যাচ্ছি। ভাঙা রাস্তা দিয়ে একটি ছোট যাত্রীবাহী বাসকে জায়গা দিতে পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বাসের যাত্রী ছোট চাচা ঢাকা থেকে ফিরছেন এম.এস.সি.’র ফলাফলের খবরটি নিয়ে। খোলা ট্রাক্টরে বসা তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র মলিন পোশাক পরিহিত ড্রাইভার যুবকটি যে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণি লাভ করেছে, এই সংবাদ তিনি উচ্চস্বরে জানাচ্ছিলেন বাসের যাত্রীদের। সে বছর মাস্টার্সে তিনজন প্রথম শ্রেণি পেয়েছে। পড়ুয়া মামুন রশিদ চৌধুরী যথারীতি প্রথম, আশরাফ দ্বিতীয় এবং আমি তৃতীয় খুব কাছাকাছি নম্বর পেয়ে। ঢাকায় ফিরে চৌধুরী স্যারের সাথে দেখা করি। স্যার আমাকে জড়িয়ে অভিনন্দন জানালেন। কত কথা মনের পর্দায় ভিড় করছিল। আমার চোখ ভিজে এসেছিল।

এবারে জানাই আশরাফের কথা। আগে বলেছি একবছর পিছিয়ে আমার পরের ব্যাচে আশরাফদের সাথে পড়েছি। বয়সে আমার ছোট। তাই তুমি করে বলি। সে আমাকে আনোয়ার ভাই সম্বোধন করে। এই আশরাফই হচ্ছে প্রাণবিজ্ঞানের জগতে বরেণ্য বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতিমান ড. সৈয়দ আশরাফ আহমেদ। মামুন, আশরাফ ও আমি – তিনজনই বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম ১৯৭৫ সালের পয়লা জানুয়ারি তারিখে। বক্ষ্যমাণ লেখাটির সূত্রও আশরাফ। অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী স্যারের উপর স্মারক গ্রন্থ রচনার চিন্তাটি তার। আমেরিকায় বসবাসরত আশরাফ যখন ফোনে এমন একটি উদ্যোগের কথা জানালো, তখন বড় খুশি হয়েছি।

আবার ফিরে আসি চৌধুরী স্যারের জীবন ও কীর্তির কথায়। ফরিদপুরে ১৯৩২ সালে জন্মের পর তাঁর বাল্যকাল কেটেছে কোলকাতায়। দেশভাগের পর ঢাকার গেন্ডারিয়ায় পিতা-মাতার সাথে বসবাস করতেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা কলিজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫০ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আই.এস.সি. পাশ করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল সায়েন্স বিভাগে। তাঁর সহপাঠী ছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও স্বনামধন্য অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ও বহু গুণে গুণান্বিত অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম। আমাদের বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ভারতবর্ষ উপমহাদেশের বরেণ্য প্রাণরসায়নবিদ অধ্যাপক কামালুদ্দিন আহমদ এবং সয়েল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ ওসমান গণির জামাতা। আত্মীয়তার এই সংযোগ পরবর্তীকালে কিভাবে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল তা পরে বলবো।

সয়েল সায়েন্স বিভাগ থেকে ১৯৫৩ সালে অনার্স ও ১৯৫৫ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করে একই বিভাগে গবেষণা সহযোগী হিসেবে যোগ দেন চৌধুরী স্যার। ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৯ – এই সময়কালে মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ক গবেষণায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন অধ্যাপক চৌধুরী। অতি ক্ষুদ্র অণুজীবের অপার রহস্য নিয়ে পিএইচডি করার মনোবাসনার কথা তিনি ব্যক্ত করেন সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের হারুন-অর-রশিদের কাছে। তাঁর কথা আগে লিখছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাথ সাহার সার্থক উত্তরসূরিদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক এ.এম. হারুন-অর-রশিদ ছিলেন ‘বোস অধ্যাপক’ ও তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের নানা দুরূহ বিষয়, যেমন, বোস-আইন্সটাইন কণা এবং আরও বহু বিষয়ে সবার বোধগম্য করে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন। ১৯৯১ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৯ সালে স্বাধীনতা পদকে এই বরেণ্য বিজ্ঞানীকে সম্মানিত করা হয়। এই স্তরের মানুষদের সাহচর্য পেয়েছিলেন আমাদের চৌধুরী স্যার।

যাই হোক কথা হচ্ছিল চৌধুরী স্যারের স্বপ্ন পিএইচডি গবেষণা নিয়ে। জার্মানির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় জর্জ অগাস্ট ইউনিভার্সিটি অফ গোটিঙ্গেন। এ পর্যন্ত এইবিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া, শিক্ষকতা অথবা গবেষণা করে ৪৪জন নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। আগেই বলেছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেছিলেন চৌধুরী স্যার। এক উচ্চতর মনুষ্যত্ববোধ, মানুষের প্রতি সহজাত মমতা, বিশাল হৃদয়, প্রবুদ্ধ মানুষ হিসেবে কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা– এসব উচ্চতর গুণাবলি অর্জনে সেই ১৭৩৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বহু দার্শনিক ও পণ্ডিত গবেষকদের জ্ঞানে সমৃদ্ধ গোটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিশ্চয়ই স্যারের মনোজগতে প্রভাব ফেলেছিল। দেশে তাঁর চারপাশে কত গুণীজন জড়ো হয়েছিলেন! তাঁদের কয়েকজনের পরিচিতিতেই তা স্পষ্ট হবে।

মাইক্রোবায়োলজি গবেষণার সাথে যুক্ত আর্মড ফোর্সেস ইন্সটিটিউট অফ প্যাথলজি অ্যান্ড ট্রান্সফিউশনের প্রধান মেজর জেনারেল এম.আর. চৌধুরী, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিস রিসার্চে কর্মরত বিজ্ঞানী ড. খাজা মো. সুলতানুল আজিজ ও ড. ইমদাদুল হক, ইন্সটিটিউট অফ পাবলিক হেলথের ড. ফরিদা হক, বাংলাদেশ কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের ড. ফ্লোরা মজিদ, এটমিক এনার্জি কমিশনের ড. সুজায়েতুল্লাহ চৌধুরী ও ড. নাইয়ুম চৌধুরী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফজলে রাব্বি চৌধুরী, ইন্সটিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল রিসার্চের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক কাজী মশিউর রহমান প্রমুখের সাথে ছিল চৌধুরী স্যারের অন্তরঙ্গ যোগাযোগ। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ বিভাগ সয়েল সায়েন্স এবং শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিনের কর্মক্ষেত্র বায়োকেমিস্ট্রি ছাড়াও, উদ্ভিদ বিজ্ঞান ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের কি জ্যেষ্ঠ কি কনিষ্ঠ বহু শিক্ষকের সাথে ছিল তাঁর সখ্য।

মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে পাঠদানকালে স্যার আমাদের পাঠাতেন আই.সি.ডি.ডি.র’এর ড. ইমদাদুল হকের কাছে। এই ভাল মানুষ বিজ্ঞানীর কথা আমার খুব মনে আছে। তাঁর ল্যাবরেটরিতে হাতে-কলমে তিনি আমাদের শেখাতেন মাইক্রোবায়োলজির বিভিন্ন পরীক্ষা। বিভাগে ফিরে গিয়ে যেন আমরা নিজেরা তা করতে পারি, তার জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল আমাদের দিয়ে দিতেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তখন এসব দামি বিদেশী কেমিক্যাল পাওয়া ছিল কঠিন। পরে যখন মাস্টার্স থিসিস করছি রডোটরুলা ইস্ট নিয়ে, তখনও তিনি নানাভাবে সাহায্য করেছেন আমাকে।

অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী স্যারের বহুদিনের স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা। বহু পথ এবং বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সে স্বপ্ন তিনি ফলবতী করতে পেরেছিলেন। এবারে সে সম্পর্কে কিছু বলবো। ১৯৬৩ সালে পিএইচডি. ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে প্রথমে গবেষণা সহযোগী ও পরে সিনিয়র লেকচারার পদে তাঁর যোগদানের কথা বলেছি। এই সময়কালে বিভাগে মাস্টার্স পর্যায়ে মাইক্রোবায়োলজির একটি স্বতন্ত্র শাখা খোলার লক্ষ্য নিয়ে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামালুদ্দিন আহমদ ও সয়েল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের সাথে চৌধুরী স্যার গেলেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. ওসমান গণির সাথে সাক্ষাৎ করতে। এর আগে উপাচার্যের সাথে অধ্যাপক কামাল ও অধ্যাপক ইসলামের আত্মীয়তার সূত্রটির কথা বলেছি। অচিরেই বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে এস.এসসি-তে মাইক্রোবায়োলজি শাখা খোলার অনুমতি পাওয়া গেল। জীব বিজ্ঞানের আরও কয়েকটি বিভাগও পত্র দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের এই শাখা প্রতিষ্ঠার আবেদন জানায়। ১৯৬৯ সালে পোস্টডক্টরাল গবেষণা শেষে বিভাগে প্রত্যাবর্তনের পর মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ খোলার জন্য আবারো জোরেশোরে চেষ্টা শুরু করলেন চৌধুরী স্যার। এই উদ্যোগে পুর্বে উল্লেখ করেছি এমন দেশের প্রায় সকল পরিচিত মাইক্রোবায়োলজি গবেষকদের যুক্ত করলেন তিনি। একই বছর ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর ১০টি বছরের অপেক্ষা। এই দীর্ঘ অপেক্ষা ছিল স্যারের জীবনে স্বপ্ন পূরণে অপারগ হওয়ার বেদনা ও চাপা কষ্টের। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৮-৭৯ শিক্ষাবর্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরীর সময়কালে অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্যারের বহু বছরের স্বপ্ন মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ। আমি তখন কারাগারে। সে বিষয়ে পরে উল্লেখ করছি। তার আগে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ নিয়ে কিছু কথা বলে নিই।

কথা হচ্ছিল মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও Centre for Advanced Research in Sciences (CARS)-এর প্রাক্তন পরিচালক ড. এম.এ. মালেকের সাথে। সয়েল সায়েন্স বিভাগ থেকে অনার্স ডিগ্রি লাভ করে এম.এ. মালেক নব প্রতিষ্ঠিত মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ৩য় ব্যাচের ছাত্র হিসেবে চৌধুরী স্যারের তত্ত্বাবধানে মাস্টার্স থিসিস সম্পন্ন করেছিলেন। শুরুতে তাদের ক্লাস হতো বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের ৩য় তালার ছোট একটি ক্লাসরুমে বিকেলে, যখন ওই বিভাগে কোন ক্লাস থাকতো না। নতুন বিভাগের জন্য প্রাণিবিদ্যা বিভাগের নিচতলার পুর্বাংশে ৮০০ বর্গফুটের জায়গা পাওয়া গেলেও ক্লাস নেয়ার মত কক্ষ এবং বেঞ্চ-টেবিল, চেয়ার ইত্যাদির ব্যবস্থা তখনও হয়নি। অন্য বিভাগে গিয়ে ক্লাস করতে হয়। কথাও শুনতে হয় মাঝে মধ্যে। ড. মালেক বলছিলেন, এ নিয়ে ছাত্রদের মনে দুঃখ ছিল। চৌধুরী স্যারকে এ বিষয়ে তারা বলতেন। স্যার তাদের ধৈর্য ধরতে বলতেন। একদিন মালেককে বললেন, “অনেক কষ্ট করেছো, চলো সামনের শুক্রবারে তোমাদের ব্যাচের সবাই মিলে বায়োকেমিস্ট্রি থেকে ক্লাসরুমের জন্য কিছু আসবাবপত্র নিজেরাই বহন করে নিয়ে আসি।” সেভাবেই ছুটির দিনে একটি হাইবেঞ্চ, একটি করে টেবিল ও চেয়ার, সাথে একটি ব্ল্যাকবোর্ড নিয়ে ৮০০ বর্গফুটের নিজস্ব জায়গায় ক্লাস শুরু হলো। বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে স্যারের নিজ ল্যাবরেটরি থেকে আপন সংগ্রহের একটি অটোক্লেভ, একটি মাইক্রোস্কোপ, একটি স্যেকার এবং একটি ইনকিউবেটর দিয়ে ল্যাবের যাত্রাও শুরু হলো। মাস্টার্সে প্রথম ব্যাচে ৫ জন, ২য় ব্যাচে ৮ জন এবং ৩য় ব্যাচে ১২ জন- এই তিনটি ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীদের পেয়েছিলেন চৌধুরী স্যার। বায়োকেমিস্ট্রি, সয়েল সায়েন্স, প্রাণিবিদ্যা ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান থেকে অনার্স ডিগ্রি লাভ করে এই ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে এসেছিলেন মাইক্রোবায়োলজি। চৌধুরীর স্যারের সরাসরি এই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা বিস্তারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতিলাভ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ড. আক্তারুজ্জামান মোল্লা, ড. আশফাক হোসেন, ড. মো. মজিবুর রহমান, ড. এম.এ. মালেক, ড. চৌধুরী রফিকুল ইসলাম ও ড. আবুল কালাম আজাদ। স্যারের মৃত্যুর পর উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের কৃতি অধ্যাপক মাহবুবার রহমান মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। এই নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী নতুন বিভাগটির উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা রাখেন। কালক্রমে অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ বাংলাদেশে এই বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা প্রসারে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এই বিভাগ থেকে পাশ করে দেশে এবং দেশের বাইরে অনেকে স্বনামধন্য হয়েছেন। এই নিবন্ধে শুধুমাত্র চৌধুরী স্যারের সাথে কাজ করেছেন এমন কয়েকজনের কথা বলেছি।

আগে উল্লেখ করেছি ১৯৭৫ সালের পয়লা জানুয়ারি তারিখে প্রাণরসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে আমার যোগদানের কথা। সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী। সে সময় বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল হক খান ছাড়াও সদস্য ছিলেন বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক কামালুদ্দিন আহমদ ও দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কুদরাত-এ-খুদা। এমন একটি নির্বাচনী কমিটির সুপারিশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়েছিলাম, তা ভেবে আজও পরিতৃপ্ত বোধ করি। উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী প্রসঙ্গে পরে আবার বলবো।

বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর চৌধুরী স্যারের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হই। মাঝে মধ্যেই তাঁর বাসায় যেতাম চা আর আড্ডার জন্য। সে সময় বিভাগে আমরা তিন প্রভাষক উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষকদের জন্য একটি ‘টি ক্লাব’ গড়ে তুলি। দ্বিতীয় তলায় ল্যাবরেটরির দুই প্রান্তে দুটি করে চারটি ছোট কক্ষ ছিল শিক্ষকদের জন্য। এর যে কোনো একটা আমরা ব্যবহার করতাম বেলা ১১টার পরপর চায়ে মিলিত হওয়ার জন্য। প্রধানত নবীন শিক্ষকেরা টি ক্লাবের সদস্য ছিলেন। ব্যতিক্রম চৌধুরী স্যার। ক্লাবে তিনি আমাদের নিয়মিত সাথী। স্বভাবজাত কৌতুকে সবাইকে উৎফুল্ল রাখতেন তিনি। বাড়ির খবর, প্রেমিকার খবর- কি না জানতে চাইতেন তিনি!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকতা জীবন বেশিদিন স্থায়ী হলো না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। দেশ ডুবে যায় অতল অন্ধকারে। এক অরাজক ও চরম অস্থিতিশীল মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতিতে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলতে থাকে দেশে, প্রধানত সেনাবাহিনীতে। এমনি পরিস্থিতে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী অভ্যুত্থান ঘটে। আমার জীবনেও নেমে আসে কঠিন সময়। ১৯৭৫-এর নভেম্বর মাসে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আসার পর গ্রেপ্তার এড়াতে আমাকে চলে যেতে হয় আত্মগোপনে। এই সময়ে বন্ধু আশরাফের মাধ্যমে নিয়মিত আমার খবরা-খবর নিতেন চৌধুরী স্যার। এ অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ১৫ মার্চ তারিখে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আমাকে গ্রেপ্তার করে। তিন মাসের অধিককাল ক্যান্টনমেন্টে সামরিক গোয়েন্দা ‘সেফ হাউসে’ রিমান্ড শেষে আমাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। কারাভ্যন্তরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় স্পেশাল মার্শাল-ল ট্রাইব্যুনালে এক গোপন বিচারে অনেকের সাথে আমাকে ১২ বছরের সাজা দেয়া হয়। ওই তথাকথিত বিচারে আমার বড় ভাই কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের ফাঁসি কার্যকর হয়।

প্রায় পাঁচ বছর কারাবাসের পর ১৯৮০ সালের শেষে আমি মুক্তিলাভ করি। আমার কারাজীবনের সময়কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ। প্রতিষ্ঠাকালীন এই সময়ে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের নানা কাজে আমার বন্ধু আশরাফ, মামুন ও অন্যান্য শিক্ষকেরা চৌধুরী স্যারের নতুন বিভাগে বিনা বেতনে পাঠদানসহ তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করেন। এ কথা বলতে পারি কারান্তরীণ না থাকলে আমিও তাঁদের সাথে সামিল থাকতাম।

কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর প্রাণরসায়ন বিভাগে আমার সহকর্মীরা আমাকে পুনরায় বিভাগে যোগ দিতে বলেন। চৌধুরী স্যার ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। স্যার সে সময় শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট। বলে রাখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের নির্বাচিত সদস্যও ছিলেন স্যার। একদিন সন্ধ্যায় তাঁর প্রভোস্ট বাংলোতে তিনি আমাকে আসতে বললেন। উপস্থিত হয়ে দেখলাম সে সময়কার উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃস্থানীয় স্বনামধন্য বেশ কয়েকজন শিক্ষক উপস্থিত আছেন স্যারের বাসায়। চৌধুরী স্যার আমাকে উপাচার্য মহোদয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে বললেন, “আনোয়ারকে প্রাণরসায়ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে আমরা আবার দেখতে চাই”। জানিয়ে রাখি আমার সাজা হয়ে যাবার পর আমি একটি পদত্যাগপত্র কারাগার থেকে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল হক খানের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী আমাকে বললেন, “আপনি বিভাগ থেকে পদত্যাগ করতে গেলেন কেন? তা না করলে আপনি সবেতনে অবিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষকতায় থাকতে পারতেন, নতুন করে শিক্ষক হবার জন্য আবেদনও করতে হতো না।”। মনে আছে, বলেছিলাম, “স্যার শিক্ষক হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারছিলাম না, তাই শিক্ষক পদটি আটকে রাখা আমার কাছে নৈতিক বলে মনে হয়নি।” উল্লেখ্য জিয়ার শাসনামলে উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরীকেও গ্রেপ্তার করে সামরিক আইনে এক বছরের সাজা দেয়া হয়েছিল অন্যায়ভাবে। মুক্তিলাভের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট তাঁকে সসম্মানে তাঁর অধ্যাপক পদে পুনর্বহাল করেছিল চাকুরি অবিচ্ছিন্ন রেখে।

মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ নিয়ে অধ্যাপক মালেকের স্মৃতির কথা আগে উল্লেখ করেছি। তিনি চৌধুরী স্যার সম্পর্কে নতুন একটি তথ্যও জানিয়েছিলেন। পূর্বে উল্লেখ করেছি মৃত্যুর আগের দিন স্যার তাঁর বিভাগে এসেছিলেন। মালেক বললেন, ৩০ মার্চ, ১৯৮৪ তারিখটি ছিল শুক্রবার, সেদিনও স্যার এসেছিলেন বিভাগে। কাছেই ফজলুল হক হল থেকে মালেক আসছিলেন। বিভাগের কাছে লিচুতলায় স্যারের সাথে দেখা হতেই মালেককে বললেন, “তোমার তো আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে বিভাগের দরজা খোলার কথা ছিল? দেরি দেখে আমিই চাবি নিয়ে এসেছি।” ছুটির দিন বলে মালেকের বের হতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল। চাবি নিয়ে মালেক দরোজা খুললেন। স্যারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বুয়েটের অধ্যাপক প্রথিতযশা স্থপতি ও মুক্তিযুদ্ধকালে বিখ্যাত ক্রাক প্লেটুনের বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোবাশ্বের হোসেনের নকশায় বিভাগটি মাত্র সাজানো হয়েছে। তাই দেখতে এসেছিলেন স্যার। নতুন রঙের গন্ধ তখনও বেশ কড়া। স্যার বললেন, জানালাগুলো খুলে রাখ। তারপর মালেককে সাথে নিয়ে ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগের দিকে চললেন। উপরে উঠবার সিঁড়িতে বসলেন। শরীর ভাল লাগছিল না। মালেককে পাঠালেন দোতালায় বন্ধু হারুণ-অর-রশিদ আছেন কিনা জানতে। শুক্রবারেও তাঁর দেখা মেলে বিভাগে। মালেক জানালেন এখনও আসেননি তিনি। তারপর মালেককে নিয়ে চললেন শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট অফিস লিটন হলের দিকে। মালেককে ফিরে যেতে বললেন। মালেকের কাছে শোনা পরবর্তী ঘটনাগুলো ছিল এমন : প্রভোস্ট অফিসে অল্পক্ষণ থেকে প্রভোস্ট বাংলোর দিকে চললেন স্যার। পথে হলের রান্নাঘরে ঢুকে ভাতের হাঁড়ির ঢাকনা খুলতে বললেন। রেশনের চালে দুর্গন্ধ। ছাত্ররা তা জানিয়েও রেখেছিল। তাই বাজার থেকে ভাল চাল কিনে ভাত রান্নার নির্দেশ দিয়েছিলেন স্যার। দেখলেন পুরনো চালের ভাতই রান্না হয়েছে। পাচকদের বললেন নতুন চালের ভাত আবার রান্না করতে। বাংলো কাছেই। কিন্তু বুকে তীব্র ব্যাথা। গৃহে প্রবেশের পর দ্রুতই স্যারের স্ত্রী অ্যাম্বুলেন্সে করে স্যারকে নিয়ে চললেন পিজি হাসপাতালের দিকে। জানা গেল পথেই টি.এস.সি.’র কাছে স্যারের জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে।

স্যারের মৃত্যুর খবরটি যখন পাই, তখন আমি জাপানের কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি। মন ভারী বিষণ্ণ হলো। মনের পর্দায় কত ঘটনা থমকে দাঁড়াচ্ছিল। মাঝখানে ১৯৮৩ সালে দেশে ছুটিতে এসে বিয়ে করেছি। খুবই সাদামাটা বিয়ের অনুষ্ঠান। মতিঝিলে আমিন কোর্টের ছাদে ‘প্লাজা’ রেস্তোরায় চা-নাস্তার বিয়ের অনুষ্ঠানে স্যার এসেছিলেন। কণে আয়েশাকে দেখে স্বভাবজাত কৌতুকে স্যার বললেন, “আনোয়ার এই কথা! এমন সুন্দরী কন্যাটিকে ঘরণী করবে, তাই হেলায় ঠেলেছিলে আমার দেয়া বিয়ের প্রস্তাব? ভেবে কি হবে, ‘জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে - বিধাতাকে নিয়ে’।” কারাগার থেকে মুক্তির পর স্যার একবার তাঁর বাসায় যেতে বললেন। আগে কিছু বলেননি। সেখানে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার জীবন তখনও অনিশ্চিত। শিক্ষকতায় ফিরে আসবো, না পুরোদস্তুর রাজনীতিতে যোগ দেব, সে বিষয়ে মনস্থির করতে পারিনি তখনও। বিয়ের কথা ভাবিনি। তাই নানা কারণেই স্যারের প্রস্তাবে এগুনো সম্ভব হয়নি। প্লাজা রেস্তোরাঁয় বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার পর একটি বছরও পার হলো না। তখন কি মনে হয়েছিল, স্যারের সাথে এই শেষ দেখা, শেষ কৌতুক শোনা?

কার্জন হলে জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সমাধির পাশে সমাহিত হলেন আমাদের প্রিয় মানুষটি। ২০১৮ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে বাস করছি উত্তরায়। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে স্যারের সমাধি পাশে দাঁড়ানো হয়নি। আসছে ৩০ মার্চ, ২০২৩। অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরীর ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। আয়েশাকে সাথে নিয়ে যাব কার্জন হলে স্যারের সমাধি পাশে।