পারস্পরিক যোগাযোগ ও মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধিতার কথা মাথায় রাখতেন না তিনি। ছুটে চলতেন মনভোলা পথিকের মতো সরকারের কোনো দাওয়াতে, আবার সেই তিনিই বিরোধী মঞ্চেও সরকারের বিরুদ্ধেই কথা বলতেন। বিরোধিতা কিংবা সমালোচনা করতেন বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্বের গলদ নিয়েও।
Published : 15 Apr 2023, 05:15 PM
জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের নগরকেন্দ্রিক জাতীয় জীবনের এমন এক কণ্ঠস্বর ছিলেন, যিনি একটি কথা যদি কারো পেছনে বলতেন, সেই কথা তার সামনে বলারও সাহস রাখতেন । এমনকি বলতেনও সরল-সহজ ভঙ্গিতে। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু-ভাসানী জীবনধারার প্রভাব খেয়াল করা যায়। তিনি দেশের তাবৎ মানুষকে এক সমাজ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। যে কারণে মতের পার্থক্য থাকলেও সেই পার্থক্যকে সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেন না। তাই তিনি বিচরণ করতেন সমাজ ও রাজনীতির সকল মেরুতে।
তিনি সরকারের সমালোচনা করতেন, বিরোধিতা করতেন। সেই বিরোধিতার মধ্যে তার নিজস্ব যুক্তি প্রস্তাবনা এবং প্রেক্ষাপট স্পষ্ট করতেন। পারস্পরিক যোগাযোগ ও মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধিতার কথা মাথায় রাখতেন না তিনি। ছুটে চলতেন মনভোলা পথিকের মতো সরকারের কোনো দাওয়াতে, আবার সেই তিনিই বিরোধী মঞ্চেও সরকারের বিরুদ্ধেই কথা বলতেন। বিরোধিতা কিংবা সমালোচনা করতেন বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্বের গলদ নিয়েও। তিনি মানুষটা এমনই ছিলেন, যা ভালো মনে হতো তার নিজের বিবেচনায়, তা তিনি বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগী হতেন।
তিনি কেবল কথায় বিশ্বাসী ছিলেন না, কাজে তার প্রমাণ রাখতেন। তার কথা ও কাজের সঙ্গে কেউ একমত হতে পারেন, দ্বিমতও হতে পারেন। কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনে ঢাকা শহরে তার মতো একজন মানুষ যার বিচরণ সকল দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের উর্ধ্বে। তবে তার টানটা ছিল গরিব-দুঃখি শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে। তার সেই ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতা কোনো কথার কথা ছিল না কেবল। তার জীবনাচার ও সাধারণ মাটির মানুষের মতো জীবনদর্শন রপ্ত ও ধারণের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে গেছেন।
তিনি কথা বলে যেতেন, শুনলেওলারা কে কি মনে করলেন বা ভেবে বসলেন, সেসব চিন্তা করে তিনি থেমে যেতেন না। তিনি রাতদুপুর নগরের রাতজাগা পাখি কিংবা ডাক বয়ে চলা রানার কিংবা ভোরের কাকের মতো নিজের জীবনকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিয়োজিত করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য।
গণভবন থেকে শুরু করে শহর-নগর-বন্দর-জনপথ-অলিগলি-ফুটপাত-বস্তি সর্বত্র তার বিচরণ ছিল। তিনি ছিলেন ঢাকার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলের অবিচ্ছেদ্য একটি জীবনদর্শন। তার অনুপস্থিতি বাঙালির হৃদয়ে বাজবে, চোখেও লাগবে। কে সরকারে, কে বিরোধীদলে তা তিনি খুব একটা ধর্তব্যে নিতেন বলে মনে হয় না; যা ভালো মনে করতেন, বলে ফেলতেন। প্রয়োজনে রাজনীতির শীর্ষের মানুষদের নিশানা করে খোলা চিঠি লিখতেন। হতেন বিরাগভাজনও। তাতে তিনি তার জীবনদর্শন থেকে সরে আসতেন না।
যা ভালো বুঝতেন, তা বাস্তবায়নের জন্যে উদ্যোগ নিতেন, পরিকল্পনা করতেন। শেষতক আওয়ামী লীগ দীর্ঘ দেড় দশক ক্ষমতায় থাকার কারণে মনে হতে পারে তিনি বুঝি সরকার বিদ্বেষী। যদিও তার মত অন্যবিধ ভাসানীপন্থীদেরও যোগাযোগ এবং টানটা বিরোধীদলীয় জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গেই বেশি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বিরোধী লোকজন তাকে অনেকটা ঘিরে থাকার কারণে এমনটা মনে হতে পারে অনেকের কাছে।
আদতে তিনি কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষের কেউ ছিলেন বলে মনে হয় না। তার রাজনীতি এবং জীবনদর্শন আর কেউ বুঝুক না বুঝুক, প্রধানমন্ত্রী যে তাঁকে সম্মান দিতেন, গুরুত্ব দিতেন তা যেমন বিগত নির্বাচনের পূর্বে তাদের দুজনের কথোপকথন থেকে প্রতীয়মান হয়েছে। শেষতক তার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর তাৎপর্যপূর্ণ শোকবার্তা থেকেও পরিষ্কার হয়েছে।
তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত চেনা পরিচয় কোনোটাই ছিল না। তবে অনেকবার দেখেছি শহীদ মিনারে নানা অনুষ্ঠানাদিতে। বেশিরভাগ সময় আমজনতার মাঝেই মিশে থাকতেন। কেউ কেউ তাকে বিএনপি ঘরানার মনে করে থাকেন।
বিএনপির ব্যাপারে তিনি পরামর্শ দিতেন প্রকাশ্যেই। যদিও বিএনপি তার পরামর্শ খুব একটা আমলে নিত বলে মনে হয় না। নয়া পল্টন দপ্তর থেকে রিজভী আহমেদের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন তার পছন্দ ছিল না। তিনি চাইতেন জনমত গঠনের জন্যে রাজনীতির মাঠের নেতারা জনতার কাছে যাক। পাড়া-মহল্লায় জনসংযোগ করে মানুষের সমর্থন লাভ করুক, মানুষের মন জয় করুক।
বিলেত বসে দলপরিচালনায় বিএনপির এক শীর্ষনেতার ভূমিকা নিয়েও তার প্রকাশ্য আপত্তি ছিল। তিনি চাইতেন জননেতা যিনি হবেন তিনি জনতার মাঝে থাকবেন। সাত সমুদ্রের ওপার থেকে কেউ ছবক দিয়ে দিয়ে দল চালাবেন এতে তার সমর্থন ছিল না। এসব কারণে বিএনপি তাকে আপন ভাবতে পারেনি। তাই তো তার মৃত্যুর পরও শোকবার্তা এসেছে দলের শীর্ষনেতার কাছ থেকে নয়, এসেছে মহাসচিবের কাছ থেকে। তাও আবার পত্রিকায় দলটির অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পরে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবস্থান ছিল 'নানা মুনির নানা মত থাকবে, পথও থাকবে' – এরকম দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে। কিন্তু মিলনের সূত্রও থাকতে হবে। সেই মিলনের যোগাযোগটাও থাকা চাই। তার জীবন থেকে বোঝা যায় মিলনের সেই কেন্দ্র হলো মানুষের কল্যাণ ভাবনা, দেশের প্রতি দায় এবং দেশপ্রেম।
তিনি ছিলেন উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা এবং মানবের প্রেমের বা কল্যাণের জীবনদর্শনে বিশ্বাসী একজন মানুষ। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন না। তিনি সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে পরিপূরকের ভূমিকায় আসতে চেয়েছেন তার উদ্যোগগুলো নিয়ে। যেমনটা করেছিলেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে মাঠ চিকিৎসালয় স্থাপন করে। সেই উদ্যোগ ১৯৭১-এর পরে পরিত্যাগ করেননি। অবতীর্ণ হয়েছেন নতুন ভূমিকায়। সেবা দিয়েছেন আমাদের বীরাঙ্গনা মা ও বোনদের। অনেকে তাকে কর্মবীর বলবেন। সেরকম নজির তিনি স্থাপন করেছেন।
গোটা দেশকে একটি সমাজ ভাবতেন বলেই বোধ হয়, সরকারের সমালোচনা ঠিকই করতেন। একই সঙ্গে সরকারের ভালো কাজের বিশেষ করে জনকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গেও থাকতেন। তিনি সদ্ভাব রেখেছেন প্রায় সব সরকারের সঙ্গেই। তিনি যেমন বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতির পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় তার হাসপাতাল নিয়ে মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। আবার ১৯৭৫-এর পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সরকার থেকে স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়েছেন। সেই তিনিই সামরিক শাসক এরশাদের সরকারের সঙ্গে ঔষধ নীতি প্রণয়নে একযোগে কাজ করেছেন।
তার উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের জন্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ প্রায় সব সরকারের সঙ্গেই কার্যকর বোঝাপড়ার যোগাযোগটা রক্ষা করে চলতেন। গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল, গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছাড়াও প্রকাশনা, সাময়িকী, গবেষণা, সাংগঠনিক যোগাযোগ এবং নির্বাচন উপলক্ষে নানা মেরুকরণে ভূমিকা রেখেছেন। যেমনটা রেখেছেন ১৯৮০-এর দশকে জেনারেল ওসমানীকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করে। তেমন রেখেছেন ২০১৮ সালে নির্বাচনের পূর্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনে ভূমিকা রেখে। এসব কোনো উদ্যোগেই তার ব্যক্তিগত চাওয়া বা পাওয়ার ছিল না। তা তার জীবনাচার থেকেই স্পষ্ট। তিনি সকলের সঙ্গে একই কাতারে বা সমাজভুক্ত হয়ে চলতেন। কারও কাছে 'স্যার' হবার মনোবাসনা তার ছিল না। তিনি ছিলেন সকলের ভাই।
বেশ কয়েক বছর আগে একবার ডাক্তার দেখাবার প্রয়োজন হয়েছিল। ঢাকা মেডিকেলে বা কোনো সরকারি হাসপাতালে যাব সেরকম সময়ও হাতে ছিল না। আবার কোনো বেসরকারি ক্লিনিকে বা কোনো ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে দেখাবো, সেরকম টাকাও হাতে ছিল না। এমন অবস্থায় সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রশাসন বিভাগের প্রধান রাশিদা বেগম আসমা পরামর্শ দিলেন কাছের মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে যেতে। আমি আসমার পরামর্শ মতো গণস্বাস্থ্য হাসপাতালেই ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। তখন মনে মনে ভেবেছিলাম এরকম উদ্যোগ নগরের নানা প্রান্তে যদি থাকত তাহলে ক্লিনিক ব্যবসায়ীদের খপ্পর থেকে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো বড় বাঁচা বেঁচে যেত।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিরল এক জীবনদর্শন রেখে গেলেন। তার রাজনীতি বা দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে দ্বিমত করার মানুষ অনেক আছে। আমিও তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু তার মানে এই নয় মানুষের কল্যাণ চিন্তায় তার জীবনব্যাপী যে আত্মনিয়োগ তার প্রতি অনুরাগ থাকবে না। যার মৃত্যুতে সব দল সব মত ও পথের মানুষ এক কাতারে আসতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা এক জাতির জীবনে বিশেষ করে এই সময়ে খুব বেশি থাকে না। জাফরুল্লাহ চৌধুরী এরকম 'বেশি না থাকা'র দলের বিরল এক মানুষ ছিলেন।