বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসে পঞ্চাশ বছর পাড়ি দেওয়া পুরোনো গল্পেরা আছে, কিন্তু অল্প করেও কোথাও কি উচ্চস্বরে আছে সেই কৃষক, মজুর, শ্রমিকের কথা যাদের স্বার্থহীন অবদানে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ?
Published : 24 Jan 2024, 02:45 PM
‘বাপের নাম ভুলিয়ে দেব’— বহুল উচ্চারিত ও ব্যবহৃত এই ছোটখাটো বাক্যের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, এমন বাঙালির দেখা পাওয়া ডুমুর ফুলের মতো। বন্ধু মহলে মস্করা বা ইয়ার্কিতে, রেগে প্রতিপক্ষের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া এই বাক্যটা বোকাসোকা ভঙ্গিতে থাকলেও ব্যাপক ও বিস্তৃত ষড়যন্ত্রের মূলসূত্র। ক্ষত ও উৎখাতের বাস্তবতায় বাক্যটি করোনার চেয়ে শক্তিশালী, মহানদের থেকেও ব্যাপক প্রভাববিস্তারী। এমন ভাবনা-চিন্তা আমারও ছিল না, কাটা নখের মতো বাপের নাম ভুলিয়ে দেব বাক্যটাকেও কাগজে মুড়ে ছুঁড়ে দিয়েছি বহুবার। কিন্তু শেকড় কেটে দেবার পর শতবর্ষী গাছের সুউচ্চ শিরও যখন মাটিতে আছড়ে পড়ল, তখন বাপের নামের গুরুত্বটা উঁকি দেওয়া শুরু করল সুন্দরী পড়শির মতো। এমন হৃদয় সংলগ্ন ব্যাপারে ন্যাড়া ও বেলতলার গল্পের চেহারা ভুলে পা ফেলি অস্তিত্ব ও অস্থি সংক্রান্ত সংকটের দৈর্ঘ্য-প্রস্থে।
প্রসঙ্গক্রমে একটা প্রশ্ন পুঁতে রাখলাম প্রথমেই— বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসে পঞ্চাশ বছর পাড়ি দেওয়া পুরোনো গল্পেরা আছে, কিন্তু অল্প করেও কোথাও কি উচ্চস্বরে আছে সেই কৃষক, মজুর, শ্রমিকের কথা যাদের স্বার্থহীন অবদানে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ? এই থাকা না থাকার বাঁকা, পিচ্ছিল, অমসৃণ আয়োজনে আয়েশ করে মগজের ওঠাবসা জরুরি ভীষণ। নইলে ঢলে পড়বে দেশ ও জাতি অন্য পায়ে, তারপর ক্ষয়ে যাবে কসকো সাবান অজস্র হাতের ময়লা ধুয়ে ধুয়ে— যা ছিল এককালের তুমুল জনপ্রিয়।
আমরা পোশাক পরি, পায়ে বাহারি জুতা, হাতে ঘড়ি— সময় দেখি, কিন্তু সময়ে দেখি না নিজের দিকে। ফিকে হয়ে আসে মুখ, কুয়াশার মাঝে যেন হেঁটে আসছে কেউ, সৈকতে মিলিয়ে যাওয়া দূরবর্তী ঢেউ। বাজারে গেলে গায়ের মাপেই জামা কিনি। ঘড়ি, জুতা সবই কিনি হাত ও পায়ের মাপে। পছন্দ হয়েছে একটা জামা— মাপে মেলে নাই। জামার মাপে নিজেকে বদলাই না কোনোকালেই, পারেও না কেউ তা। কিন্তু ঠিকই নিজেকে ভুলে অনুকরণ-অনুসরণে আমরা ঢুকে যাচ্ছি অন্য আলোর ছাঁচে।আবারও প্রশ্ন— এভাবে কী কোনো জাতি বাঁচে? বেঁচে থাকার চেয়ে বেঁচে থাকাটা আনন্দদায়ক, আত্মতৃপ্তিরও। কিন্তু নদীর ওপারেই আমাদের সুখ। বুক ফুলিয়ে উজবুক, কথা কয় ময়ুরের পাখায় কাক। আমরা কী বাঙালি মুসলমান নাকি মুসলমান বাঙালি? এইসব দ্বিধাবিভক্তির ফায়দা বহুত— রাষ্ট্র জানে, শোষকেরা জানে আর জানে ব্যবসায়ী ধার্মিকেরা। ধর্মস্বরূপ ব্যক্তিগত চর্চা দিব্যি খরচা হয়ে যাচ্ছে শোষকের আয়েশি ভঙ্গির খেদমতে। কী সঙ্গীতে, কী নৃত্যে— সর্বত্র নিত্য বাঁ-হাত ঢুকিয়ে দেয় উগ্রবাদের কালো ছায়া। মায়া কিংবা মুগ্ধতার বিপরীতে কর্কশ কাকের কথায় মুখর অলিগলি। কীভাবে ভুলি! ভুলে যাই, মুছে দেই, মুছে যাই শেকড়ের আচার-বিচার?
যত বিভাজন, বিভেদ রেখা,
বিভক্তির নিক্তি না হোক বাঁকা
শোষণের ঠোঁটে ঠাট
শাসকের গজায় পাখা।
পিপীলিকা তবু গজায় পাখা মরিবার তরে। কিন্তু পাখা গজালেও শোষকেরা কিন্তু মরে না। এখানে জনগণ যেন তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হইতে না পারে— এমন শিক্ষাব্যবস্থার চাষবাসই চলছে লেজ উঁচিয়ে। জনগণ সচেতন হইলে তো তারা অধিকার নিয়ে কথা বলবে। কথা বলতে দেওয়া যাবে না— ছলে, বলে কৌশলে গণ্ডার বানাইতে হবে। তাই তো দেশের শিক্ষা ও শিল্পকে বনসাই করে রাখা হয়েছে শোষকদের স্বার্থের ছাঁচে ফেলে। এইসব প্যাঁচের জালে আটকে গেছে সাধারণ জনগণের জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাস। বিশ্বাস মরীচিকায় মগ্ন জাতিকে আরও অন্ধকারে পাঠানোর পাঁয়তারা দুর্দান্ত উর্বর এই তল্লাটে। সবাই জল খায় একই ঘাটে— বাঘে আর মহিষে। ঘোলাজলে পথহারা জনগণ খাবি খায় তৃষ্ণায়, ক্ষুধায়।
জলের দেশে জলের হাহাকার, শস্যের দেশে কে খায় কার খাবার! চাষীর হাঁড়িতে হাহাকার তুমুল, ফুল ফোটে শোষকের দরবারে। গল্প বাড়ে। বানোয়াট গল্পের হাঁটে বেচা হয়ে যায় অজস্র উন্নয়ন যন্ত্রণা। শেকড় আলগা হয়ে যায়। ভোলগা থেকে গঙ্গা, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া— বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যে প্রস্তরময় ইতিহাস, ঐতিহ্য; তা মুখোশের গল্পে অল্প অল্প করে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। শেকড় আলগা করছি শীর্ষে যাবার নেশায়। কিন্তু ভুলে যাই, বুর্জ খলিফার ভিত্তি অনেক গভীরে। মাটি সংলগ্নতাকে উপেক্ষা করে ছুঁড়ে দিলে ইতিহাস-ঐতিহ্য দুমড়ে-মুচড়ে যাবে অস্তিত্বের আয়তন।
নিজ ঘরে পরবাসী
তবু আসি, তবু ভাসি
আলো নেই, অন্ধকার
আহা কী চিৎকার!
মুখ তুলে চেয়ে দেখি
আহা এ কী!
লুট হয়ে গেছে
যা ছিলো আপনার কাছে।
কোথায় গেল আমার লোকজ হাওয়া, জল, আলো? কিছুই নেই কোথাও, ধুকেধুকে বুকে কিঞ্চিৎ শ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে কিছু। তাও টুঁটি চেপে ধরা হাত শক্তিসমেত রাষ্ট্র ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। নেমেছি জলে ইচ্ছের কৌশলে, এখন আমার সাঁতার বন্দী বেদাতের নামে-বেনামে লেখা সব চিঠিতে। আরবের অধিবাসী আগে অ্যারাবিয়ান পরে ধার্মিক— পুষে রেখেছে নিজেদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি। আমার বেলায় হাঁসফাঁস শ্বাসনালি। এইসব হেয়ালি প্রচেষ্টায় ঠাঁই হলো, স্রোতে ভেসে যায় খড়কুটো উদ্বাস্তু আলো। আমাকে পাই না খুঁজে, যা পাই বুঝে যাই, তাতে আমি নাই, আমি নাই। এইসব সংকটে সঙ কতক ক্ষত বুনে যাচ্ছে ক্ষমতার মমতায়— তর্ক-বিতর্ক, আমি বাঙালি মুসলমান নাকি মুসলমান বাঙালি? সব যেন হেঁয়ালি স্রোতে ভেসে যাচ্ছে স্বেচ্ছায় অন্যের কোলে। নিজের কোমর বেঁকে যাচ্ছে অন্যের পায়ের কাছে। ঝুঁকে আছে মাথাটাও বেশ আগে থেকেই। কী আশ্চর্য আয়োজন— নিজে বেড়ে উঠি নিজের গতরে অথচ আমরা বেড়ে উঠতে চাই অন্যের ছাঁচে। কিন্তু বিশ্বের ইতিহাস বলছে বাপের নাম ভুলে বেঁচে থাকে নাই কেউ, ঢেউ— যে হারিয়ে গেছে তীর ছুঁয়ে দেবার আগেই। আমরাও কী সেই পথেই হাঁটতেই থাকব? কেন শরীর বানাব অন্যের জামার মাপে? কেন ভেসে যাব, ডুবে যাব সময়ের স্রোতে? কেন দাঁড়াব না দুপুরের সূর্যের মতো? কেন হব না পূর্ণিমা রাতের পূর্ণ চাঁদ? কেন ফাঁদে পা দেব? অন্যের গন্ধে মুগ্ধ-মাতাল, নতুন দাঁতাল, নয়া ধার্মিকের ঢেড় মাস্তানিতে ক্ষয়ে যাব নত মস্তকে!
চার খুঁটিতে দাঁড়িয়ে চালা,
চ্যালার দলে উস্কে দিয়ে চালার চাটে পা
খুঁটি সব উপড়ে দিলে
খুঁটি, চালা কিছুই থাকে না।
ঘাটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম মাটি সংলগ্ন দুমড়ে যাওয়া চালার দৃশ্যটা। অজস্র মানুষ লুটছে মজা, কেউ নাচতে গিয়ে ভাঙছে মাজা, নানা রকম রঙ। তারপর আরও কিছু ঘর উঠল, ঘরে ঘরের মানুষেরা এলো কিন্তু জায়গা হলো না সাধারণ মানুষের। শোষণের এই গল্পে সকল শাসকই শোষক দেখা যায়। জাতীয়তাবোধের প্রশ্নে ভিন্নমতের পথ আজও পথ বাড়ায় শুধু— পথ বাড়ে, মত বাড়ে। অজস্র বাকা-ত্যাড়া পথের ভাঁজে কাজে-অকাজের নানা আয়োজন আরও ভাঙনের গল্প চাষ করে। কী যে মধু আত্মকে ভোলায়! বুঝে আসে না। সভ্যতার আলো, আলোয় দেখি কেবল মেকি মুখোশের কারবার। জামার মাপে নিজেকে গড়ার অদম্য ইচ্ছেরা আলগা করে দিচ্ছে শেকড়। মেকাপের আড়ালে ক্যান্সার ঢেকে বাঁচা যায় না বাছা। বাপের নাম ভুলে গেলে হেলে যায় শরীরের শ্রেষ্ঠত্ব। বাপের নাম ভুলিয়ে দেব বাক্যটা কেবলি বাক্য নয়, বিজয়ীর মুখের ইতিহাস।