Published : 04 Nov 2019, 02:56 PM
সময়ের নিরিখে পেশা এবং পেশাজীবীর সার্বিক চরিত্রের অদল-বদল ঘটে। ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হওয়ার আগে বাংলার বেশিরভাগ মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের যে উপায় ছিল, তার আদব-কায়দাতে একটা বড় ধরনের অদল বদল নিয়ে আসে কোম্পানির শাসন। ধীরে ধীরে কোম্পানির শাসনের যতো বিস্তার ঘটেছে, ততো মানুষের জীবন-জীবিকার পর্যায়ক্রমের অদল বদল ঘটেছে।
উনিশ শতকের মানুষের জীবন জীবিকার তাগিদ, বিশ শতকের প্রারম্ভে একইরকম থাকেনি। আবার বিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে যখন ধীরে ধীরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার অদল বদলের আভাস আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রবল হয়ে উঠতে শুরু করে, সেই সময়কালে, এই জীবন-জীবিকার আঙ্গিক বদলেছে। ক্ষমতা হস্তান্তর, জীবন-জীবিকার আঙ্গিকে একটা বড় অদল বদল ঘটিয়েছে। পরবর্তীকালে সময় যতো এগিয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই রাজ্যের যেমন, তেমনই গোটা ভারতবর্ষের মানুষের জীবন-জীবিকার প্রেক্ষাপট বদলেছে।
যে গান্ধীজী একদিন মানুষকে স্বাবলম্বী হওয়ার তাগিদে জীবনমুখী শিক্ষাকে চর্চার আঙ্গিক হিসেবে নেওয়ার উপর পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই গান্ধীজি যদি আজকে, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষভাগে জীবিত থাকতেন, তাহলে মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার তাগিদে কম্পিউটারের মাউস ধরবার তাগিদকে কোনো অবস্থাতেই আশাকরি অস্বীকার করতে পারতেন না।
মাটির টানে ফিরে চলার ডাক রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন। 'যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মোদের পানে' বলে যে মাটিকে তিনি গায়ে মাখবার উদার আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেই আহ্বানের অর্থ এই ছিল না যে, সামনের দিকে এগিয়ে চলার সময় এবং তাগিদকে অস্বীকার করে, পিছনের দিকে ফিরে চাওয়া। অতীতকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দিয়ে, অতীতের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে জীবনকে পরিবাহিত করে, আগামীর দিকে এগিয়ে যাওয়া, সমাজ জীবনের প্রবাহমানতা– এই অবিনশ্বরতার জয়গানই রবীন্দ্রনাথ তার সামগ্রিক চিন্তা-চেতনা সৃষ্টির ভিতরে বারবার আমাদের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করে গেছেন।
তিনি তার বিশ্বভারতীর অঙ্গ হিসেবে শ্রীনিকেতনের কর্মকাণ্ডে কৃষিকে কি করে আরো বেশি নিত্যনতুন গবেষণা নিরিখে প্রবাহমান বিশ্বের অদল বদলের সঙ্গে সংগতি রেখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তার চিন্তায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তার সেই চিন্তাকে প্রসারিত করবার জন্য এলমহার্স্টের মতো বিশ্ববিশ্রুত কৃষিবিজ্ঞানী, নিজের জীবনকে অর্পণ করেছিলেন।
এই যে গোটা পর্যায়ক্রমের ভিতরে কিন্তু অতীতের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে, আগামী রূপরেখা নির্মাণের এক অবিচল প্রবাহমান ধারার কথাই বারবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এই পর্যায়টি যদি আমাদের সামাজিক জীবনে, অর্থনৈতিক জীবনের, রাজনৈতিক জীবনে, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তাহলে যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হবে, সেই সংকট থেকে তীব্র বেকারি, সেই বেকারিকে কেন্দ্র করে গোটা সমাজ জীবনের পরিমণ্ডল, যার ভিতরে রাজনীতি থেকে শুরু করে ধর্ম-সংস্কৃতি সবকিছুই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সেই সবকিছুই যে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে; এই সতর্কবাণী কিন্তু রবীন্দ্রনাথ থেকে গান্ধীজী– তারা বারবার আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে সতর্ক করে দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক স্তরে কার্ল মার্কস থেকে শুরু করে লেনিন, কিংবা তলস্তয় থেকে বার্নাড শ, অথবা ম্যাক্স মুঁলার থেকে রোমাঁ রোঁলা কিংবা আলবার্ট আইনস্টাইন আলবার্ট সোয়াইৎজার– এরা সকলেই সতর্ক করে দিয়েছেন। বহু ঘাত-প্রতিঘাত, পারস্পরিক সংঘাত, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল, সবকিছুর ভেতরেই সাতচল্লিশ সালের ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন পথের, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে মনীষীদের এই সতর্কবাণীকে একটা মর্যাদা দিয়ে চলতেন।
এই প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে স্বাধীনতা-উত্তরকালে সবথেকে ব্যতিক্রমী চরিত্র হলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আধুনিকতাকে মর্যাদা সহকারে গ্রহণ করার পরিবর্তে একটা প্রাগৈতিহাসিক ধ্যান-ধারণাকে প্রগতিশীলতার মুখোশ পরিয়ে, প্রবল গণসংগ্রামের তকমা লাগিয়ে তিনি যেভাবে উপস্থাপিত করেছেন, এমনটা ভারতবর্ষের রাজনীতিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা বিরোধী জাতীয় আন্দোলনেরকালেও কেউ করতে পারেননি। পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতবর্ষেও কেউ করতে পারেননি।
রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি যে ধ্যান ধারণার কথা বলেন, সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার-প্রসার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা কখনো কোনোরকম প্রগতিশীলতার মুখোশ পরেন না। তারা যে অনাধুনিক, তারা যে ভয়ঙ্কর রকমের প্রতিক্রিয়াশীল, জার্মান নাগরিক নিৎসের দেওয়া চিন্তা-চেতনার অনুকরণের জগতে অত্যন্ত কৃতি মানসপুত্র তারা– এই পরিচয় কখনো গোপন করেন না রাজনৈতিক হিন্দুরা।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাধীন ভারতবর্ষের এমন এক রাজনৈতিক বৈচিত্র্যময় চরিত্র যিনি নিজের রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে অসামান্য সাফল্যের ভিতর দিয়ে, একটা প্রগতিশীলতা ও বিপ্লবীয়ানার আবরণ দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপিত করে কেবল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটিতে নয়, গোটা ভারতবর্ষের সামাজিক প্রেক্ষিত কি অত্যন্ত সফলভাবে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছেন।
রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির যে কর্মকাণ্ডের অভিমুখ, সেখানে পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণার বিকাশের ক্ষেত্রে এতোটুকু গোপনীয়তা নেই। তারা যে ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাস করেন না– একথা তারা সুস্পষ্টভাবেই বলেন। যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত ভারতবর্ষের সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনার ধারা প্রবাহে তারা যে বিশ্বাসী নন– একথাও তারা খুব স্পষ্টভাবে বলেন।
ভারতবর্ষের মানুষ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিবর্তে গোমূত্র পানে সমস্ত রকমের অসুখ-বিসুখ সারিয়ে ফেলতে পারবেন– একথা তারা খুব গর্বের সঙ্গেই উচ্চারণ করেন। মহাকাশের কক্ষপথে উপগ্রহ স্থাপনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি অপেক্ষা একাদশী, পূর্ণিমা, অমাবস্যা তিথি নক্ষত্রের অবস্থানকেই যে তারা অনেক বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন, এ কথা প্রকাশ্যে বলবার মতো হিম্মত তারা দেখান!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু একটিবারের জন্য প্রকাশ্যে বলেননি যে; পশ্চিমবঙ্গের আগামী প্রজন্মের মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য আধুনিক কলকারখানার সুযোগ সুবিধের ভিতরে না গিয়ে, গাই বলদ নিয়ে মাঠে গিয়ে হাল চাষ করুন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু একটিবারের জন্যও বলেননি যে; আধুনিক শিক্ষায় এই বাংলার সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ শিক্ষিত হয়ে ওঠার পরিবর্তে একজন পুরোহিতের ছেলে বংশানুক্রমে পুরোহিতগিরি করে যান। একজন ইমাম- মুয়াজ্জিনের ছেলে বংশানুক্রমে ইমাম মুয়াজ্জিনের কাজই করুন।
রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির থেকে এখানে নিজেকে খুব বড় রকমের ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবে তুলে ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এটাই সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেয়েছেন যে; আধুনিক বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা, প্রযুক্তি বিজ্ঞানগত শিক্ষা আত্মস্থ করার কোনো প্রয়োজন একজন পুরোহিত বা একজন ইমাম বা একজন বিশপের পুত্রের বা কন্যার এতোটুকুনিও নেই।
সরকারি কোষাগারের টাকা দিয়ে, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে, তিনি পুরোহিতের ছেলেকে বংশানুক্রমে পুরোহিতগিরি করবার জন্য উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। ইমাম-মুয়াজ্জিনের সন্তানদের বংশানুক্রমে ধর্মভিত্তিক পেশাতে নিয়োজিত থাকবার জন্য প্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন। এই যে প্রগতিশীলতার ছদ্মবেশ ধরে, একাংশের খাতায় কলমে বামপন্থী নামধারী মানুষজনকে পর্যন্ত পাশে নিয়ে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের জীবন-জীবিকা রক্ষার প্রশ্নে, মান্ধাতা ঠাকুরদার আমলে টেনে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম শুরু করেছিলেন বিরোধী নেত্রী হিসেবে এবং ক্ষমতায় থাকার নয় বছর সময়কালে, ধারাবাহিকভাবে রাজ্যের মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্নে, কখনো তেলেভাজা শিল্প, কখনো বা চায়ের দোকান করা– এইসব কথাগুলি বলবার ভিতর দিয়ে এতো সুদক্ষ পরিচালনায় সমাজ জীবনের গোটা প্রবাহকে পশ্চাৎপদ ধারায় ঘুরিয়ে দেওয়ার অত্যন্ত কৌশলী প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, তার তুলনা গোটা রাজ্য বা দেশে তো দূরের কথা, গোটা বিশ্বে মেলা ভার।
কৃষি বিজ্ঞানের সঙ্গে আধুনিকতার সংযোগ ঘটিয়ে, বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের সংযোগ ঘটিয়ে, প্রযুক্তিবিদ্যার নিত্য নতুন কৌশলের প্রয়োগ ঘটিয়ে, উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল রূপান্তরের ফলে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতির যে ইতিবাচক পরিবর্তনের ভাবনা রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, সেই ভাবনার ভিতরে মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠিত করবার যে উচ্চারণ তিনি করেছিলেন, সেই উচ্চারণই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আগের প্রজন্মের কার্ল মাক্স করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িককালে লেনিন করে গেছেন, গান্ধীজী করে গেছেন, নেহরুজি করে গেছেন। তার পরবর্তীকালে মুজাফফর আহমেদ, জ্যোতি বসু করে গেছেন।
সেই উচ্চারণ থেকে সম্পুর্ণ বিপরীত অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, নিজের চিন্তাকে বিস্তৃত করে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে কৌশলে, এই পশ্চাৎপদ ধারণার পিছনে এক ধরনের তাত্ত্বিক অবস্থান নিয়ে এসেছেন, শাসকের অত্যাচারের তত্ত্বের অবতারণা করেছেন, একাংশের আপাত প্রগতিশীল মানুষদের নিজের পাশে জড়ো করেছেন, প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে যে মানুষজন কার্যক্রমে চরম প্রতিক্রিয়াশীলতাকে তাদের জীবনের একমাত্র ধর্ম বলে মনে করতেন, তাদেরকে সমবেত করেছেন– তার তুলনা বাংলা বা ভারত কেন, গোটা বিশ্বে মেলা ভার।
এদিক থেকে বিচার করে আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অবশ্যই গোটা বিশ্বের প্রবাহমান কালের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ভিতরে এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমী চরিত্র বলে চিহ্নিত করতে পারি। মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে মনসবদারী প্রথার সংকটকালে সম্রাট আওরঙ্গজেব একটি ঐতিহাসিক উক্তি করেছিলেন। গাঙ্গেয় বদ্বীপ, কৃষি উৎপাদনের স্বর্ণভূমি ছিল। তাই সব মনসবদার, জায়গিরদারই গাঙ্গেয় বদ্বীপে মনসবদারি, জায়গিরদারির দাবিদার ছিলেন।
এই দাবির প্রেক্ষিতে সম্রাট আওরঙ্গজেব ঐতিহাসিক উচ্চারণ করেছিলেন;"ইয়েক আনার সাদ বিমার"। অর্থাৎ; একটি মাত্র বেদানা রয়েছে। আর শত শত রোগী। ঠিক তেমনই যেন আরঙ্গজেবের কয়েকশো বছর পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই একটি মাত্র বেদানা, অর্থাৎ; কৃষিকে কেন্দ্র করে, শতশত রোগীদের, অর্থাৎ; গোটা বাংলার লাখো লাখো ভুখা পেটের সাথে চরম প্রতারণা করলেন তার একান্ত নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে।
আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি স্থাপিত হয়েছে, সেগুলির অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পাওয়া যায় যে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করবার পর ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু বেশিরভাগই কৃষিবিদ্যাকে সমৃদ্ধ করা সংক্রান্ত পেশার ভিতরে আর নিজেদেরকে ফিরিয়ে আনেন না। ব্যাংক ইত্যাদি যেসব ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট মোটা অংকের উপার্জন আছে, তারা সেসব বিষয়গুলিকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পছন্দ করেন।
কৃষিকে ঘিরে শিল্পের বিরুদ্ধতা করতে গিয়ে 'ফিরে চল মাটির টানে', মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন করেছিলেন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ঘিরে এই সব অভিজ্ঞতার কথা জানা মানুষ কিন্তু তখন তার সাথে ছিলেন না– এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অম্লান দত্তের মতো মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই পশ্চাৎপদ আন্দোলনের পাশে ছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, কৃষিক্ষেত্রে আধুনিকতা আনবার বিদ্যা আয়ত্ত করা, উচ্চশিক্ষা নেওয়া ছেলেমেয়েরা যে কোনো অবস্থাতেই হাল নিয়ে মাঠে নতুন করে নামবে না– একথা অম্লান দত্তের মতো মানুষদের না জানা ছিল না।
তবুও অম্লান দত্তের মতো মানুষেরা এই সহজ সরল সত্য কথাটি কিন্তু এক গভীর আন্তর্জাতিক রাজনীতির শরিক হয়ে, একটিবারের জন্যেও সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেননি। আর এই যে অম্লান দত্তদের মতো মানুষদের সত্যকে গোপন করে রাখবার কৃতিত্ব, সেই বিষয়টির জন্য সার্বিক সাফল্যের জয়মাল্য কিন্তু দিতে হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন স্বাধীন ভারতের সেই অবিসংবাদী রাজনৈতিক নেত্রী, যিনি আধুনিক কৃষি বিজ্ঞান থেকে শুরু করে, শিল্পবিজ্ঞান– সবকিছুর ক্ষেত্রেই কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে সেই সব বিষয় সম্পর্কে জানা একটা বড়ো অংশের মানুষদের সত্যি কথাটা বলার ক্ষেত্রে চুপ করিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। এমন কৃতিত্বের দাবিদার কিন্তু পরাধীন ভারতবর্ষে কোনো ভারতীয় রাজনীতিকের ভাগ্যে জোটেনি। স্বাধীন ভারতে নেহেরু, প্যাটেল, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, জ্যোতি বসু, চন্দ্রশেখর, জগজীবন রাম, মোরারজি দেশাই, চরণ সিং, এম জি রামচন্দ্রন, এন টি রামা রাও, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, কে করুনাকারান, আনোয়ারা তাইমুর, শেখ আবদুল্লাহ, ফারুক আব্দুল্লাহ ইত্যাদি কারোর ভাগ্যেই জোটেনি।
এই আঙ্গিকের বিচারে ভারতবর্ষের রাজনীতির সবথেকে ব্যতিক্রমী চরিত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমাদের বিচার করতে হবে। সাধারণ মানুষকে, 'রোটি-কাপড়া-মাকান' এর স্বপ্ন দেখিয়ে, সেই সাধারণ মানুষের উপরে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছিলেন পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো। প্রায় সমকালীন সময়ে 'সবুজ বিপ্লবে'র নাম করে, সেই একই পথ অবলম্বন করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু ভুট্টো বা শ্রীমতী গান্ধীর সেই তথাকথিত প্রগতিশীলতার ফসল তোলার সময় কাল ছিল কিন্তু যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর 'রোটি কাপড়া আউর মকান' এর আওয়াজ, ইন্দিরা গান্ধীর 'গরিবী হঠাও' এর ঢক্কা নিনাদ বা পরবর্তীকালে বিশ দফা কর্মসূচির শিবা কীর্তন– এসব রাজনীতিকদের কখনোই দীর্ঘমেয়াদি সুখ দিতে পারিনি।
এক্ষেত্রেও ভারতবর্ষ তথা ভারতীয় উপমহাদেশ, এমনকি বিশ্বের রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক চরিত্র। যার প্রতিক্রিয়াশীলতা, পশ্চাৎপদতাকে প্রতিষ্ঠিত করবার তাগিদে, প্রগতিশীলতার মুখোশটির ডিভিডেন্ড প্রায় নয় বছরেরও বেশি সময় ধরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দিয়ে চলেছে।