Published : 13 Oct 2019, 01:51 PM
প্রায় দেড়যুগ আগে ২০০২ সালের ৮ জুনটেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষেরছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি মারা যান। বিশাল অঙ্কের টেন্ডার কেন্দ্র করে সংঘর্ষেজড়িয়ে পড়ে বুয়েট ছাত্রদল সভাপতি মোকাম্মেল হায়াত খান মুকি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরএসএম হলের টগর গ্রুপ। দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে বুয়েটের আহসান উল্লাহ হলেরসামনে সাবেকুন নাহার সনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর আসামিদেরবিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০০৬ সালের ১০ মার্চ হাইকোর্ট মুকিত, টগর ও সাগরেরমৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এ ছাড়া যাবজ্জীবনকারাদণ্ড-প্রাপ্ত এসএম মাসুম বিল্লাহ ও মাসুমকে খালাস দেন হাইকোর্ট।
কিন্তু সনির হত্যাকারীদের আজও শাস্তিহয়নি। হাইকোর্টে দণ্ড-প্রাপ্ত দুই আসামি এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যাবজ্জীবনকারাদণ্ড-প্রাপ্ত আসামি মোকাম্মেল হায়াত খান মুকি পালিয়ে যান অস্ট্রেলিয়ায়। পলাতকরয়েছেন নুরুল ইসলাম সাগর ওরফে শুটার নুরু; জেলে রয়েছেন টগর।
আরিফ রায়হানদ্বীপ বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়তেন। তিনি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগেরযুগ্ম আহ্বায়কও ছিলেন। এই ছেলেটি গণজাগরণ মঞ্চের সমর্থনে লেখালেখি করেছিল, কেবল এইঅপরাধে শিবির ও হেফাজতে ইসলামের সক্রিয় সমর্থক স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষেরছাত্র মেজবাহের তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল।
মহানগরগোয়েন্দা পুলিশের একবারে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মেজবাহ অকপটে স্বীকার করেছিল যে কীভাবেসে দ্বীপকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছিল। একাধিকবার পুলিশের কাছে দৃঢ়চিত্তে অকপটে মেজবাহ বলেছিল এই যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুইনাকি দ্বীপের প্রাপ্য ছিল!
এই মেজবাহরপরিণতি কি হয়েছে? কিছুই না! মেজবাহ 'মানসিক ভারসাম্য' হারিয়ে আদালত থেকে জামিনপেয়েছিল। জামিনের সময় শেষ হওয়ার পর কোর্টে আর হাজিরা দেয়নি। আইনের ভাষায় মেজবাহএখন ফেরারি!
সর্বশেষ গত রবিবার গভীর রাতে দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী নির্মমভাবে পিটিয়েহত্যা করে।
হ্যাঁ, দোষছাত্রলীগের। তারা শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সন্ত্রাসের লীলাভূমি বানিয়েছে। হলে হলে তাদের আধিপত্যও শাসন কায়েম করেছে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানিয়েছে। তারা ভিন্নমত ভিন্নদলের অস্তিত্বমুছে দিয়েছে। তাদের কথার নড়চড় হলে শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে আসছে সীমাহীন নির্যাতন। ওরাপিটিয়ে খুন করে। গুলি করে মারে। নির্যাতন করে তিলে তিলে মারে।
কিন্তু প্রশ্নহলো, এগুলো কি শুধুই ছাত্রলীগ করে? এদেশে বিএনপির শাননামলে কি ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরএকই কায়দায় সন্ত্রাস-হত্যা-ভিন্নমত দলন, দখল, নিয়ন্ত্রণ, নির্যাতন-ইত্যাদি কাজ করেনি?আমরা যারা আজ বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছি, আমরাই কি আমাদের দায়িত্ব ঠিকঠাকমতো পালন করছি? আমরাকি আমাদের রাজনৈতিক সমর্থন পরিবর্তন করেছি? ছাত্রদল ও শিবির দীর্ঘদিন আমাদের দেশেরশিক্ষাঙ্গনগুলোতে একচ্ছত্র সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম রাখে। তখনও অনেক আক্ষেপ-বিক্ষেপহয়েছে। ব্যস, এ পর্যন্তই!
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন দেখেছি, আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসটি কী ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের লীলাভূমি হয়ে উঠেছিল। সে সময় প্রতিদিনই গোলাগুলি হতো। তখন ছিল ছাত্রদলের একচ্ছত্র আধিপত্য। অভি-নীরু-ইলিয়াস-সজলরা একেকজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী। তারা সশস্ত্র ক্যাডার-গ্যাং নিয়ে চলাফেরা করত। পুরানা আমলের রাজা-রাজরাদের মতো একেকদিন একেক হলে অভিযান চালাতো। হল দখল, পাল্টা দখলের উদ্দেশ্যে পরিচালিত এসব অভিযানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতো। রক্তের বন্যা বয়ে যেত। সেই সময় আজকের মহাপ্রতাপশালী ছাত্রলীগ ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল। কাউসার মোল্লা, মাসুম, টোকনরা ছিল অভি-নীরু-ইলিয়াস-সজলদের কাছে নিতান্তই শিক্ষানবিশ। তারপরও লড়াই চলত। জগন্নাথ, সলিমুল্লাহ আর জহুরুল হক হল ছিল ছাত্রলীগের দখলে। এর বাইরে জিয়া, মুজিব, মুহসীন, জসিমউদ্দীন, এফ রহমান ও শহীদুল্লাহ হল ছিল ছাত্রদলের দখলে। সারাক্ষণ ক্যাম্পাসে একটা আতঙ্ক বিরাজ করত। এই বুঝি গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। বহু নিরীহ ছাত্রকে সেই সময় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এসএম হলে আরিফ নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর ক্যাম্পাস সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। আমরাও তখন সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। 'হল থেকে দল থেকে সন্ত্রাসীদের বহিষ্কার কর'-এই স্লোগান তুলেছি। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। সন্ত্রাসীরা বহাল তবিয়তে থেকেছে। তারা ঠিকই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে গেছে। কখনও প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, কখনও ভাগ-বাঁটোয়ারা ও কর্তৃত্ব নিয়ে নিজেরাই অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। সেই সময় জাসদ ছাত্রলীগও অস্ত্র ও সন্ত্রাসের রাজনীতিতে যুক্ত ছিল। জিন্নাহ ও মুরাদ ছিল জাসদ ছাত্রলীগের নামজাদা সন্ত্রাসী।
সেই সময়হলগুলোতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পাহারা বসাতো। সাধারণ শিক্ষার্থীদের তীব্র আতঙ্ক, ভয়আর হয়রানির মধ্যে দিয়ে দিন কাটাতে হতো। অনেক শিক্ষার্থীকে মিছিলে যেতে বাধ্য করা হতো।অনেক সময় সারারাত ধরে চলত গোলাগুলি, দখল, পাল্টা দখলের লড়াই। সে সময় অনেককেই অস্ত্রেররাজনীতির সপক্ষে বলতে শুনেছি, এরশাদের সন্ত্রাস মোকাবিলার জন্য অস্ত্র-সন্ত্রাস দরকারআছে। যদিও এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের যথাযথ প্রয়োগ তেমন একটা চোখে পড়েনি।
১৯৮৯ সালেডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জোট বিজয়ী হয়।সে সময় ছাত্রলীগের সুলতান মুহম্মদ মনসুর ভিপি, জাসদ ছাত্রলীগের মুশতাক আহমেদ জিএস এবংছাত্র ইউনিয়নের নাসির উদ-দুজা এজিএস নির্বাচিত হন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিজয় মিছিলেছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা ন্যক্করজনক হামলা চালায়। ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করে। সারাদেশে নিন্দারঝড় বয়ে যায়। তারপরও ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের প্রতি সমর্থনের কোনো কমতি ছিল না। পরের বছরডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের আমান-খোকনরা বিপুল ভোটে ডাকসুর ভিপি-জিএস নির্বাচিত হয়।এমনকি মেয়েদের হলগুলোতেও ছাত্রদলের প্যানেল বিজয়ী হয়।
তখন অনেকেরমুখেই শুনেছি: বীরভোগ্যা বসুন্ধরা! সন্ত্রাসীরাও যে 'বীর' হয়, সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েপড়ার সময় বুঝেছিলাম!
নব্বইয়ের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসের রাজনীতি পরিবর্তিত হয়। আদর্শভিত্তিক বামসংগঠনগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। বিপরীতে অস্ত্র ও পেশিনির্ভর রাজনীতি গ্রাস করে নেয়। ছাত্রদলের মহাজোয়ারের সেই কালে নতুন নতুন সশস্ত্র ক্যাডার অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। এক পর্যায়ে এরশাদের পক্ষাবলম্বনকারী অভিগ্রুপের ক্যাডারদের ছাত্রদল থেকে বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের বিস্মিত করে তারা সবাই ছাত্রলীগে ভিড়ে যায় এবং জগন্নাথ ও এসএম হল দখল করে রাখে। অস্ত্র ও সন্ত্রাসী-নির্ভর রাজনীতিটা ছাত্রদল ও ছাত্রলীগে ভাগাভাগি হয়ে যায়।
এরপর বেগমখালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলে ছাত্রদল আরও বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ হয়ে যায়। পিন্টু-লাল্টুরাক্যাম্পাসে আরও বেশি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। প্রতিপক্ষকে ঝেঁটিয়ে-পিটিয়ে বিদেয় করারপর নিজেরাই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠে যে বেগমজিয়া ছাত্রদলের কমিটি বিলুপ্ত করে এর কার্যক্রম স্থগিত করতে পর্যন্ত বাধ্য হন।
সময়ের পরিক্রমায়আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার শুরু হয় ছাত্রলীগের আধিপত্য। তাদের দমন-পীড়ন-সন্ত্রাস-নির্যাতন।সন্ত্রাস, খুন, প্রতিপক্ষ দমন, হামলা, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি কারণেছাত্রদল কিংবা ছাত্রলীগের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, আদালতের বিচারেদণ্ড হয়েছে-এমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ গত সাড়ে তিন দশকে ছাত্রলীগও ছাত্রদলের ইতিহাস হচ্ছে সন্ত্রাস সৃষ্টির ইতিহাস, খুন নৈরাজ্যের ইতিহাস, চাঁদাবাজি,টেন্ডারবাজি, দখল, পীড়নের ইতিহাস। আমরা এই ইতিহাসের নীরব এবং অসহায় সাক্ষী!
ছাত্রলীগযে আজ এত এত ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড করছে, এর জন্য আমরাও কি দায়ী নই? এই ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলেরসন্ত্রাসী কার্যকলাপকে কী আমরা কখনও প্রত্যাখ্যান করেছি? তাদের কার্যক্রমের প্রতি ঘৃণাপ্রকাশ করে সমর্থন প্রত্যাহার করেছি? যে ছাত্র শিবির চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এক সময়রগকাটা-গলাগাটা রাজনীতির আমদানি ও চর্চা করেছে, তারা কি এসব করার পরও ছাত্রসংসদ নির্বাচনেবিজয়ী হয়নি? বিশাল সমর্থন নিয়ে টিকে থাকেনি? যে ছাত্রদল জন্মলগ্ন থেকে সন্ত্রাসের সঙ্গেসমার্থক হয়েছে, তারাও কি বিপুল সমর্থন অর্জন করেনি? এইসব সন্ত্রাসী দলের সমর্থক কারা?তারা আমার-আপনার মতোই দেশের মানুষ। আর রাজনৈতিক দলগুলো তো জেনেবুঝেই এই ছাত্রসংগঠনগুলোরদস্যুতা উপভোগ করেছে। তা না হলে অনেক আগেই এদের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করত! পুলিশদিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে তাদের হাজতে ভরে রাখত!
তাহলে দোষকাকে দেব? ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, শিবিরকে? নাকি এদের পৃষ্ঠপোষক মূল রাজনৈতিক দলগুলোকে?আমরাও কি দায়ী নই? আমরাও কি এই দস্যুদেরকেই সমর্থন যুগিয়ে যাইনি? কয়জন অভিভাবক তাদেরছেলে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ কিনা সেই খবর নিয়েছেন? তাদের বিপথগামী সন্তানদের সুপথে ফিরিয়েআনার চেষ্টা করেছেন? ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়ে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন? কয়টি পত্রিকায় ছাত্রলীগ,ছাত্রদলের ক্যাডারদের অপকর্ম নিয়ে লেখালেখি হয়েছে? কয়জন শিক্ষার্থী বেনামে তাদের উপরনির্যাতনের তথ্য প্রকাশ করেছেন?
রবিঠাকুরেরভাষায় বলতে হয়: ''ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি।/মাথা করোনত।/এ আমার এ তোমার পাপ।''