Published : 29 Sep 2019, 05:23 PM
[পূর্বকথা: হিন্দুস্তানের বদমেজাজি বাদশাহ শাহরিয়ার তাঁর তথাকথিত চরিত্রহীনা এক বেগমের পরকীয়ার স্ত্রীজাতির উপর যারপরনাই নারাজ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রতি রাতে তিনি এক যুবতীকে নিকাহ-এ-মুতা করে ভোর হলেই এক রাতের সেই বেগমকে কতল করাবেন। কয়েক বৎসর ধরে শত শত যুবতী কন্যা বেঘোরে ইন্তেকাল ফরমালো। ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী উজিরকন্যা শেহেরজাদি স্বজাতির প্রতি করুণাপরবশ হয়ে ছোটবোন দিনারজাদির সঙ্গে সল্লা করে স্বপ্রবৃত্ত হয়ে নিকাহ করেন বাদশা শাহরিয়ারকে। জীবনের শেষ রাতে শেহেরজাদির আবদার রাখতে বাসরঘরে ডেকে আনা হয় দিনারজাদিকে। রাত গভীর হলে পূর্বপরিকল্পনামাফিক ছোটবোন দিনারজাদি বিভিন্ন বিষয়ে একেকটি সওয়াল পুছতে থাকেন আর বড়বোন শেহেরজাদিও কালবিলম্ব না করে সেই সব সওয়ালের জওয়াব দিতে শুরু করেন। বাদশা সওয়াল-জওয়াব শুনতে খুব মজা পাচ্ছিলেন। কিন্তু ভোরের আজান শোনা মাত্র জওয়াব বন্ধ করে নকশি লেপ মুড়ি দিয়ে দুই বোন শুয়ে পড়েন বলে কথা আর শেষ হয় না। অনুসন্ধিৎসু বাদশাহ পর পর এগারো দিন শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেন। আজ সেই সওয়াল-জওয়াবের একাদশ রাত্রি]
প্রিয় দিদি শেহেরজাদি! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করার অভিযোগটিতোতুমি প্রমাণের অভাবে খারিজ করে দিলে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে আরেকটি মারাত্মকঅভিযোগ আছে। তিনি তাঁর কবিতা ও গানে হিন্দু দেবদেবীর কথা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ যা খুশিলিখতে পারেন, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তাঁর লেখা যখন একটি মুসলিম-প্রধান দেশের সিলেবাসেপাঠ্য হয় কিংবা নির্বাচিত হয় সে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে, তখন মুসলমান সম্প্রদায়েরসে কবিতা পড়তে হয় এবং গাইতে হয় সে গান। 'ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা'কিংবা 'তোমার বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি।' এসব কবিতা পড়া, গান গাওয়া শিরক বলেগণ্য হতে পারে, কারণ মুসলমান এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও বন্দনা করতে পারে না, 'কারওপরে' মাথা ঠেকাতে পারে না। দেশকে মাতৃকল্পনা করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানে ও কবিতায়এবং জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া এক ধরনের দেশবন্দনাতো বটেই। আরও একটা কথা দিদি, 'আমার সোনারবাংলা' গীতটি নাকি লেখা হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে হিন্দুদের তথাকথিত দেশপ্রেমেউদ্বুদ্ধ করার জন্যে। তুমিতো জানো দিদি, বাংলাদেশের মুসলমানদের একাংশ মনে করে, বঙ্গভঙ্গহলে তারা লাভবান হতো এবং ঠিক এই কারণেই বর্ণহিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছে।
প্রিয় বোন দিনারজাদি! গীত লিখেটিখে রবীন্দ্রনাথ মরে ভূত হয়ে গেছেন সেই ১৯৪৩ সালে, দ্বিতীয় ভারতভাগেরও চার বছর আগে ('বঙ্গভঙ্গ' যদি প্রথম ভারত-বিভাগ হয় এবং পাকিস্তান ভেঙে যাওয়া হয় তৃতীয় ভারতবিভাগ!)। তিনি কি কাউকে মাথার দিব্বি দিয়ে বলেছিলেন: 'বাপসকল, যখন তোরা স্বদেশকে ভেঙে প্রথমে দুই টুকরো এবং পরে তিন টুকরো করবি এবং ভাববি যে এভাবে খণ্ডবিখণ্ড করে তোরা একের পর এক স্বাধীন হচ্ছিস, দয়া করে আমার একেকটি গান তোদের একেক খণ্ডের জাতীয় সঙ্গীত করিস, নইলে মরেও আমি শান্তি পাবো না রে!' রবীন্দ্রনাথের হাজার হাজার গানের মধ্যে একটিকে ভারত কিংবা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত করা হলো কি হলো না, তাতে রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বের জীবিতকালেই কিছু যেতো আসতো না, মরার পরেতো আরও না।
তুমিতো জানো দিনারজাদি যে উপমহাদেশের কমপক্ষে দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের রচনা। যাঁরা রবীন্দ্রনাথের লেখা 'আমার সোনার বাংলা' গীতটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন, তারা নিশ্চয়ই মনে করেছিলেন, এই গীতটির মধ্যে বাংলাদেশের জীবন-মনন-দর্শন-প্রকৃতি-বাস্তবতার উপযুক্ত প্রতিফলন হয়েছে। হয়তো তাদের ভুল হয়েছে, কিংবা হয়তো তারাই ঠিক। কিন্তু বাহাস করতে হলে, গালাগালি করতে হলে, সেই নির্বাচকদের মুখোমুখি হলেই ভালো হয় না কি? খামাকা বেচারা রবীন্দ্রনাথকে আসামী করা কেন? ওঁর লিখতে ইচ্ছে হয়েছে, লিখেছেন, তোমার ভালো না লাগলে তুমি তাঁর কবিতা না পড়ো, তাঁর গান না গাও। যাদের ভালো লাগে তারা গাইবে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম। (মরার পর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করে শেষ বিচারের পর) তুমি ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে স্বর্গে চলে যেতে চাও, যাও না! খামাখা আমি বেচারাকে নিয়ে টানাটানি করছো কেন, যখন কিনা তুমি ভালো করেই জানো যে তোমার মতো লোকের সঙ্গ আমি মর্তেই উপভোগ করি না! ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে যেমন জোরজবরদস্তি নেই, থাকা উচিত নয়, তেমনি সংস্কৃতি পালনের ক্ষেত্রের ব্যক্তির স্বাধীনতা থাকা উচিত নয় কি?
শিরক বা শির্ক কাকে বলে? আরবি 'শিরক' শব্দটার মূলে আছে ত্রিব্যঞ্জন ধাতু{শ-র-ক} যার অর্থ ভাগ করা বা একাধিক অংশে বিভক্ত করা। এই ধাতু থেকেই তৈরি হয়েছে 'শরিক',পার্টনার, যেমন বাংলায় আমরা বলি, 'শরিকী ঝগড়া'। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের পুরো কাজটা ঈশ্বরএকা হাতে করেন, দ্বিতীয় কেউ তাঁর সঙ্গে সে দায়িত্ব ভাগ করে নেন না– এই বিশ্বাসের নাম'তৌহিদ'। যদি একাধিক দেবতা মিলে কাজটা করেন, যেমনটা আছে হিন্দু ধর্মের একটি মতবাদে:ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু পালন করেন এবং শিব ধ্বংস করেন– তবে সে ধরনের বিশ্বাসহবে 'শিরক'। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত 'আমার সোনার বাংলা'-য় বাংলাদেশকে 'মা' বলা হয়েছেবটে, কিন্তু সেই দেশমাতৃকাকে ঘূণাক্ষরেও ঈশ্বরের সমপর্যায়ভুক্ত করা হয়নি। অপিচ, সৃষ্টিকর্তারনাম পর্যন্ত নেওয়া হয়নি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে। সুতরাং 'আমার সোনার বাংলা' শতভাগশিরকমুক্ত না হবার কোনো কারণ নেই।
দিনারজাদি, তুমি অবশ্য বলতে পারো, বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীতে দেশকে মাতৃকল্পনা করা হয়েছে। বাঙালিরাই একমাত্র এ দোষে দোষী নয়। মিশরের জাতীয় সঙ্গীতের দ্বিতীয় স্তবকে মিশরকে মিশরীয়দের শুধু নয়, 'সকল দেশের মা' বলা হয়েছে: مصر يا أم البلاد Mæṣre ja 'omm el-belad। দেশকে 'মাতৃভূমি' বলা হয়েছে এশিয়ার মুসলিম দেশ মালয়েশিয়ার জাতীয় সঙ্গীতে। আরবরা নিজেদের দেশকে বলে أرض الآباء (আর্দ আল আবা) অর্থাৎ পিতাদের ভূমি। দেশকে 'বাবা' কিংবা 'মা' বলা, দেশ নামক এক কাল্পনিক বাস্তবতার জন্য জীবন দেয়া যদি শিরক হতো, তবে খোদ আরবরা কি জেনেশুনে তা করতো? বাঙালিরা কি আরবদের চেয়ে ইসলাম বেশি বোঝে, ইংরেজিতে যাকে বলে 'মোর ক্যাথলিক দ্যান পোপ'? জার্মানসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ জাতি স্বদেশকে 'পিতৃভূমি' বলে। প্রাচীন আর্যরাও নিজেদের দেশকে পিতৃভূমি বলতো। ইংরেজরা আগে পিতৃভূমি বলতো, এখন বলে 'মাতৃভূমি'। রুশরা, বাঙালিরা নিজের দেশকে মাতৃভূমি বলে। ভারতবর্ষের অন্য জাতিও মাতৃভূমি বলে। একাধিক মুসলিমপ্রধান দেশের জাতীয় সঙ্গীতে দেশকে 'মা', 'মাতৃভূমি' বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, একাধিক দেশের জাতীয় সঙ্গীতে (ওমান, বাহরাইন) সুলতান বন্দনাও আছে।
যেহেতু দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে পার্থক্য হচ্ছে, সেহেতু বোঝাই যাচ্ছে,দেশকে মাতা কিংবা পিতা কল্পনা করাটা একেকটা দেশের সংস্কৃতি। লক্ষ্য করো দিনারজাদি,দেশকে কোনো জাতিই বোন, ভাই কিংবা জামাই বা বেয়াই কল্পনা করে না! কেন? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেসংস্কারকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কোনো সংস্কারই যৌক্তিক নয়, তবে কয়েক প্রজন্মআগের কিছু সংস্কারকে 'কুসংস্কার' আখ্যা দিয়ে মানুষ সেগুলোকে বাদ দিতে চেষ্টা করে। কখনওতারা সে চেষ্টায় সফল হয়, কখনও হয় না। উদাহরণস্বরূপ ভূতে বিশ্বাস কুসংস্কার, কিন্তুভূতে আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি। সুতরাং যতদিন মানুষ আছে, সমাজ আছে, ততদিন সংস্কারও থাকবেবলে ধারণা করা যায়।
ধর্ম আগে, না সংস্কৃতি আগে? অবশ্যই সংস্কৃতি আগে, কারণ ধর্ম প্রবর্তিত হবার বহু আগে থেকেই সংস্কৃতি বহমান থাকে। ইসলাম ধর্ম প্রবর্তিত হবার আগেও আরব উপদ্বীপে একটা বিশেষ সংস্কৃতি ছিল যেটা পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে ছিল না। উদাহরণ, আজকের সৌদি আরব এলাকার আরবেরা জ্বীনে বিশ্বাস করতো, অথচ গ্রীক কিংবা রোমানরা জ্বীন কাকে বলে জানতোই না। কোনো ধর্ম যখন কোনো একটি অঞ্চলে প্রবর্তিত হয়, সেই অঞ্চলে আগে থেকেও একটি সংস্কৃতি ও ধর্ম থাকে। একেবারে সাংঘর্ষিক না হলে নতুন ধর্ম পুরনো ধর্ম ও সংস্কৃতিকে একেবারে বাতিল না করে এর কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আত্মস্থ করে নিতে চেষ্টা করে, কিংবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আত্মস্থ হয়ে যায়। বিভিন্ন কারণে একজন ব্যক্তি কিংবা সামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক কারণে একটি জনগোষ্ঠী যখন নতুন একটি ধর্ম গ্রহণ করে, তখন সেই ধর্মের সঙ্গে নতুন কিছু সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যও সে অর্জন ও চর্চা করতে বাধ্য হয়, নতুন কিছু শব্দ তার শব্দকোষে ঢুকে পড়ে। কিন্তু তার আগের সংস্কৃতি ও ভাষার সবটাই হারিয়ে যায় না। পুরনো অনেক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অটুট থাকে, পুরনো ধর্মগন্ধী অনেক শব্দ থেকে যায় ভাষার শব্দকোষেও। সেই কবে ওয়েডেন এবং থর দেবতা মরে ভূত হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও যথাক্রমে ইংরেজি 'ওয়েডনেসডে' এবং 'থার্সডে'– এই দুই দিননামে তাদের স্মৃতি বজায় আছে। পুরনো ধর্মের সব বৈশিষ্ট্য এবং শব্দ নতুন ধর্মের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও হতে পারে এবং হয়েই থাকে। দাবি করা যেতে পারে যে সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের কমবেশি সাংঘর্ষিক এই সম্পর্কই শিরকের অন্যতম উৎস। যেহেতু মানব সমাজ কখনোই সংস্কৃতিকে এড়াতে পারে না, ধর্মকেও ছাড়তে পারে না, সেহেতু শতভাগ শিরক এড়ানোও মুশকিল হয়ে পড়ে।
যুগন্ধর ধর্মপ্রচারকদের কাণ্ডজ্ঞান থাকে। তাঁরা একরোখা, মৌলবাদী হন না। সংস্কৃতিকে যথাসম্ভব ছাড় দিয়ে থাকেন তাঁরা, যেমনটা দিয়েছেন হজরত মুহম্মদ (স.) নিজেই (এই মহাপুরুষের কাছে মানব সভ্যতার ঋণ আগামি বরফযুগের আগে শেষ হবার নয়! এই কথা 'বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস' বইতে শিশির ভট্টাচার্য্য প্রমাণসহ উল্লেখ করেছেন)। হজরে আসওয়াদ পাথরটি প্রাগ-ইসলাম যুগেও পবিত্র ছিল, আরবেরা ইসলামপূর্ব যুগেও কাবাশরীফ প্রদক্ষিণ বা 'তাওয়াফ' করতো (তখন তাওয়াফ করতে হতো উলঙ্গ হয়ে, কাপড় পড়ে কেউ তাওয়াফ করলে সেই কাপড় চিরতরে পরিত্যাগ করতে হতো), শয়তানের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারতো। এই সব সংস্কৃতি, তৌহিদের ধারণার সঙ্গে যেগুলো শতভাগ সঙ্গতিসম্পন্ন হয়তো নয় সবার মতে, সেগুলো ইসলামের অঙ্গীভূত হয়েছে, সম্ভবতঃ ১. সমসাময়িক আরব সংস্কৃতিকে (অর্থাৎ সুন্নাহ) সম্মান করার জন্যে, ২. আরবদের গণহারে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যে, ৩. কাবাশরীফের চাবি যে পরিবারের কাছে ছিল (হজরত ওসমানের পরিবার) তাদের রুজিরোজগারের ক্ষতি না করার জন্যে। আমি আলোচনার উজানে বলেছি, সংস্কৃতি 'যথাসম্ভব' ধর্মের অঙ্গীভূত হয়– যার মানে হচ্ছে প্রাকধর্ম সংস্কৃতির সবটুকু নতুন ধর্ম নাও নিতে পারে। যেমন ধরো, মূর্তিপূজাও ইসলামপূর্ব সংস্কৃতি। মূর্তিপূজা ইসলামে স্বীকৃত হয়নি, কারণ মূর্তিপূজা তৌহিদের ধারণার সঙ্গে অতিমাত্রায় সাংঘর্ষিক।
পুরনো সংস্কৃতির ঠিক কতটা নতুন ধর্মে অন্তর্ভূক্ত হবে, কতটা হবে না সেটা যে দেশে, যে সময়ে নতুন ধর্ম প্রবর্তিত হয় সে দেশের, সে সময়ের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক প্রতিবেশের উপরও নির্ভর করে। যেকোনো ধর্মকে দুটি প্রতিবন্ধের মোকাবিলা করতে হয়: বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। বর্তমানকে যেমন ছাড় দিতে হয়, তেমনি ভবিষ্যতের দাবিও মানতে হয়। যেমন ধরো, মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ ইসরায়েল। তুমি হয়তো অবাক হচ্ছো, দিনারজাদি, আমি হঠাৎ ইসরায়েলের প্রসঙ্গ কেন টানছি। কারণ আছে। খুলাফায়ে রাশেদিন যদি ইসলামের আদর্শ হয়ে থাকে, তবে রাজতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্রহীনতা কমবেশি ইসলামের খেলাফতো বটেই। হজরত মুহম্মদ (স.) এর ওফাতের পর স্থির হয়েছিল, কুরাইশদের মধ্য থেকেই খলিফা হতে হবে। এটাও ইসলামের সাম্যের ধারণার সঙ্গে যায় না। এর মানে হচ্ছে, ইসলামকে অতীত ও বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিতে হয়েছে।
তুমি নিশ্চয়ই জানো দিনারজাদি, আমরা মুসলমানদের মতো ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথও তৌহিদী অর্থাৎ একেশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। ব্রাহ্মধর্মেও মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ– জানো নিশ্চয়ই? সুতরাং জেনেশুনে রবীন্দ্রনাথ শিরক করতেই পারেন না। 'ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা' বলে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ দেশকে ঈশ্বরের সমান করে ফেলছেন না। পরের লাইন খেয়াল করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে: 'তোমাতে বিশ্বময়ীর, বিশ্বমায়ের আঁচলপাতা।' 'বিশ্বময়ী', 'বিশ্বমা'– মানে হচ্ছে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। এখানে ঈশ্বরকে মাতৃকল্পনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁর শাড়ির আঁচল দেশের মাটিতে ছড়িয়ে আছে, যে আঁচলের উপরে কিংবা ছায়ায় সন্তান নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে। এই চিত্র বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির অংশ, কারণ ধ্রুপদী বাঙালি মা শাড়ি পরে, শাড়ির আঁচল থাকে। সালোয়ার কামিজ কিংবা বুরখা সম্প্রতি চালু হয়েছে এবং এই দুই পোষাকের অন্য যত সুবিধাই থাক, আঁচলটা নেই। আমরা যদি দেশকে 'মাতৃভূমি' বলতে পারি, আমাদের মা কিংবা বাবার পায়ে নিজেদের আসল মাথা ঠেকাতে পারি, তবে 'দেশ' নামক কল্পিত মায়ের কল্পিত পায়েও কল্পিত মাথা ঠেকালে সমস্যা কী?– এমনটা ভাবতে পারে অনেকেই।
তুমি অবশ্য আপত্তি করতে পারো এই বলে যে 'তোমাতে বিশ্বময়ীর, বিশ্বমায়েরআঁচলপাতা।'– এই চরণে ঈশ্বরকে স্ত্রীলিঙ্গ কল্পনা করা হয়েছে। ঈশ্বরপুরুষ, নাকি স্ত্রী? মধ্যযুগে দেবদূতদের লিঙ্গ কী হবে– এই প্রশ্নে অনেকতর্ক, অনেক দাঙ্গাফ্যাসাদ হয়েছে ইওরোপে, কিন্তু সমস্যাটার সমাধান হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যেরযে জুডেও-খ্রিস্টান ধর্মধারার সর্বশেষ সদস্য ইসলাম, সেই ধারার অন্য দুই ধর্ম ইহুদিও খ্রিস্টান ধর্মে ঈশ্বরকে 'পিতা' বলা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম অনুসারে আল্লাহ পুরুষও নন,স্ত্রীও নন। কিন্তু আরবি ভাষার ব্যাকরণ অনুসারে 'আল্লাহ' কিংবা 'ইলাহ' পুংলিঙ্গ বিশেষ্য('ইলাহ' বিশেষ্যের পূর্বে নির্দিষ্টতাদ্যোতক অব্যয় বা আর্টিকেল 'আল' যুক্ত হয়ে 'আল্লাহ্')এবং এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া ক্রিয়া ও বিশেষণেরও পুংলিঙ্গ রূপ হয়। 'আল্লাহ্' শব্দের বহুবচনওহয়, 'আলেহাতুন'। ইসলামপূর্ব যুগে 'ইলাহ' শব্দের একটি স্ত্রীলিঙ্গ রূপও ছিল: 'লাত'।
আল্লাহ পুরুষও নন, স্ত্রীও নন– এই সত্য আরবি ভাষা ও ব্যাকরণে প্রতিফলিত হচ্ছে না। 'আল্লাহ' শব্দ পুংলিঙ্গ হওয়ার মধ্যে শিরকের ছায়া দেখতে পারেন কেউ কেউ। ইসলাম ধর্মবিশারদেরা এ ব্যাপারে খুব একটা উচ্চবাচ্য করছেন বলে আমার জানা নেই। যাদের মাতৃভাষা আরবি, তারা আরবি ব্যাকরণের প্রভাবে 'আল্লাহ'-কে পুরুষ মনে করে কিনা সেটা জনমত যাচাই ছাড়া বলা মুশকিল। আপাতত এবং সাধারণ বুদ্ধিতে আমি শেহেরজাদি যা বুঝি, তা হচ্ছে এই: ঈশ্বরকে ইহুদি-খ্রিস্টানরা 'বাবা' বললে যদি সমস্যা না হয়, আরবি ব্যাকরণে ঈশ্বর পুংলিংঙ্গ বিশেষ্য বিবেচিত হওয়াটাকে বাধা দেবার কোনো উপায় যদি মরণশীল মানুষের হাতে না থাকে, তবে বাঙালিরা ঈশ্বরকে 'মা বললে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালিরা যেমনটা বলে থাকে: 'মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না', বিশেষত, প্রথমত, পুরো ব্যাপারটাই যখন বিশ্বাসনির্ভর, এবং দ্বিতীয়ত, (মনুষ্য) সৃষ্টিকর্মে নারীর ভূমিকা অবশ্যই পুরুষের চেয়ে বেশি।
যদিও একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম পরিবারে রবীন্দ্রনাথের জন্ম এবং আশৈশব দেবদেবীতেবিশ্বাসও করতেন না তিনি, তাঁর রচনায় হিন্দু দেবদেবীর প্রসঙ্গ এসেছে একান্তই প্রতিবেশেরকারণে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, একজন সাহিত্যিকের দুটি সীমাবদ্ধতা আছে, একটি তার ব্যক্তিগতসীমাবদ্ধতা, অন্যটি সময় ও সমাজগত সীমাবদ্ধতা। বিংশ শতকের প্রথম দশকের সমাজ ও সময় দ্বারাজারিত রবীন্দ্রনাথের মাথায় যে কবিতা ভর করেছে, তিনি তাই লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁরকবিতায় দেশকে মাতৃকল্পনা করেছিলেন, কারণ এই গানগুলো যখন লেখা হয়েছিল, ধরা যাক, বিংশশতকের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় দশকে, তখন বাংলাদেশের চারিদিকে দেশপ্রেমের জোয়ার বয়ে যাচ্ছিল।কবি-সাহিত্যিকেরা স্বাভাবিকভাবেই এই জোয়ার এড়াতে পারেননি। প্রমাণ: একই সময়ে লেখক নজরুলমুসলমান হওয়া সত্তেও দেশকে মাতৃকল্পনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক কড়া পাকের দেবীবন্দনাআছে নজরুলের কবিতায়। দেবীবন্দনার অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে ইদানিং বিষোদগার করে না কোনোবাঙালি মুসলমান, যদিও তাঁকেও এক সময় 'কাফের' আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
হিন্দুরাও তো দেবদেবীর পূজা করে, সুতরাং তারাও কি শিরক করে? অবশ্যই করে, তবে জাহিলিয়া যুগের আরবেরা যে অর্থে শিরক করতো, হিন্দুরা সে অর্থে শিরক করে না। গ্রেকো-রোমান, প্রাচীন মিশরীয় কিংবা আইয়ামে জাহিলিয়া ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভারতবর্ষের ধর্মবিশ্বাসের পার্থক্য আছে। আইয়ামে জাহিলিয়া যুগে আরবের লোকেরা বহু দেবতায় বিশ্বাস করতো, সেখানে একক কোনো সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা ছিল না, সব দেবতাই সমান শক্তিশালী ছিল, তবে তাদের দপ্তর ভাগ করা ছিল। দেবতা সভায় আল্লাহ ছিলেন অন্যতম দেবতা: বৃষ্টি ও সৃষ্টির দেবতা, অনেকটা হিন্দু ধর্মের ইন্দ্র ও ব্রহ্মা– এই উভয় দপ্তর চালাতেন তিনি। মুহম্মদ (স.)-এর পিতার নাম 'আবদ আল লাহ' (বাংলায় 'আবদুল্লাহ') অর্থাৎ 'আল্লার দাস'। এই 'আল্লাহ' অবশ্যই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ নন, ইনি দেবতা আল্লাহ, কারণ যখন এই নামকরণ করা হয় তখনও ইসলাম নাজেল হয়নি। ইসলাম আসার পর আল্লাহ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হিসেবে গৃহীত হয়েছেন, বাকি দেবতারা হারিয়ে গেছে। গ্রেকোরোমান সিস্টেমেও বহু দেবতা ছিল, প্রত্যেকের দপ্তর আলাদা ছিল, তবে সব দেবতার শক্তি সমান ছিল না। কার শক্তি বেশি– এই নিয়ে দেবতাদের মধ্যে প্রচূর ঝগড়াফ্যাসাদ হতো, যাতে অনেক সময় মরণশীল মানুষেরাও জড়িয়ে পড়তো। এ ধরনের ধর্মবিশ্বাস ইসলামের দৃষ্টিতে 'শিরক' বলে বিবেচিত হয়।
প্রতিটি হিন্দু বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর এক এবং তার কোনো শরিক নেই। ধরা যাক, বেদের আমলের শেষ দিকে উপনিষদের যুগের শুরুতে সৃষ্টি হয়েছিল এই বিশ্বাস। কিন্তু ঈশ্বর বিশ্বাসেরও একটা বিবর্তন আছে। বেশিরভাগ সমাজেই প্রথমে বহু দেবদেবী থাকে এবং তারপর এক সময় এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে শুরু করে মানুষ। 'বহু থেকে এক'– এ অনেকটা যেমন একটা অঞ্চলে বহু জাতি কিংবা জাতিরাষ্ট্র থাকে, তার পর এক সময় অনেকগুলো জাতিরাষ্ট্র মিলে একটা সাম্রাজ্য সৃষ্টি হয়, দিগ্বীজয়ের মাধ্যমে (মৌর্য, মোঘল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য) কিংবা সম্মতির মাধ্যমে (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইওরোপীয় ইউনিয়ন)।
তাই যদি হয়, তুমি প্রশ্ন করতে পারো দিনারজাদি, তবে দুর্গা-কালী-গণেশ এইসব দেবদেবী পূজা করার কী অর্থ? উপমহাদেশের যেকোনো বাড়িতে গেলে তুমি দেখবে দিনারজাদি, জিনিসপত্রে একদম ঠাসা তাদের সবগুলো ঘর। বিমান-ভ্রমণের সময় দক্ষিণ এশীয়দের লাগেজ ওভার-ওয়েট হবেই হবে। এর কারণ কী জানো? কিচ্ছু ফেলে না তারা! একেশ্বরবাদ শুরুর আগে বেদের আমলে বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করা হতো ভারতে, তারও আগে প্রকৃতিপূজাও চালু ছিল, বৃক্ষ কিংবা পাথর পূজা করতো ভারতের আদিবাসীরা, যেমন পৃথিবীর দেশে দেশে করেছে অন্য জাতিরা। সাধারণত নতুন ধর্ম চালু হলে পুরনো ধর্ম কমবেশি বাতিল হয়ে যায়, কারণ ধর্মান্তরিতরা পুরনো ধর্মের অনুসারীদের নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়ে, খুন করে তাদের নিজের দলে আসতে বাধ্য করে কিংবা পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেয়। উদাহরণ: ইসলাম নাজেল হবার পর জাহিলিয়া যুগের সব দেবতার মূর্তি (কারও কারও মতে মা মেরীর কোলে যীশুর মূর্তি বা চিত্র বাদে) নষ্ট করা হয়েছিল। খ্রিস্টানরা স্পেন পুনর্দখলের পর মুসলমানদের হয় হত্যা কিংবা ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। ভারতবর্ষ তার অতীতের সবগুলো ধর্ম, ধর্মবিশ্বাসীদের কমবেশি রেখে দিয়েছে। একটি বিপরীত উদাহরণ অবশ্য রয়েছে। হিউয়েন সাং যখন ভারতে আসেন, ষষ্ঠ শতকে, তখন ভারতবর্ষের উত্তরতম অঞ্চল আফগানিস্তানেই জনসংখ্যার অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক বৌদ্ধ। বর্তমানে ভারতবর্ষের ইন্ডিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক চট্টগ্রাম ছাড়া বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আর কোথাও তেমন নেই বললেই চলে। এর পরেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে উপমহাদেশে প্রাক্তন ধর্মকে কমবেশি সহ্য করা হয়। এ কারণে হাজার হাজার বছর আগের ধর্মবিশ্বাসও হিন্দু জীবনাচরণে এখনও সগৌরবে অবস্থান করছে। হিন্দুরা একেশ্বরে বিশ্বাস করে, আবার দেবদেবী, বৃক্ষ ও পাথরেরও পূজা করে। বিয়ে-শ্রাদ্ধের মন্ত্রে একেশ্বরের কথা আছে, আবার দেবদেবী, বৃক্ষ, পাথর, দশ দিক এবং প্রকৃতির কথাও আছে।
মনে রাখা দরকার যে, ভারতবর্ষের দেবদেবীর সঙ্গে জাহিলিয়া কিংবা গ্রেকোরোমান দেবদেবীর তফাৎ আছে। ভারতবর্ষে একেকটি দেবতা একই ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন রূপ, কিন্তু আরবদের কাছে কিংবা গ্রেকোরোমান ধর্মবিশ্বাসে ব্যাপারটা সে রকম ছিল না। জাহিলিয়া যুগের ওয়াদ, সুওয়া, য়াগহুথ, ইয়ায়ুগ, নসর, আল্লাহ (জাহিলিয়া যুগে আল্লাহও ছিলেন অন্য শ তিনেক দেবতার একজন মাত্র, বৃষ্টি ও সৃষ্টির দেবতা ছিলেন তিনি), বাগ ইত্যাদি দেবতা এক ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন রূপমাত্র ছিল না, এরা প্রত্যেকেই আরব-বিশ্বাসে ঈশ্বরের সমকক্ষ ছিল। 'বাগ' দেবতার স্মৃতি এখনও অটুট ইরাকের রাজধানী বাগদাদ-এর নামে। যাইহোক, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়– এ ব্যাপারে সন্দেহ করেন না- এমন কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন রূপ মনে করে দেবদেবীর পূজা, বৃক্ষপূজা, খ্রিস্টানদের গীর্জায় যীশু কিংবা মা মেরির মূর্তি রাখা ইত্যাদি আচরণের কোনো কোনোটি শিরক হবে কিনা– এই প্রশ্নে ইসলামের মাজহাবভেদে মতভিন্নতা রয়েছে, যেমন আমরা আলোচনার উজানে বলেছি, মক্কাবিজয়ের পর কাবাশরীফের সব মূর্তি/চিত্র ধ্বংস করা হলেও মা মেরীর কোলে যীশুর চিত্র বা মূর্তিটা নষ্ট করা হয়নি– এমনটা জনশ্রুতি আছে। এই সিদ্ধান্ত শিরককে কিছুটা ছাড় দেওয়াতো বটেই।
কালভেদে, ব্যক্তিভেদে, অঞ্চলভেদে শিরক-এর অর্থের পরিধি সীমিত হতে পারে এবং প্রসারিতও হতে পারে। বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়ম কিংবা পবিত্র কোরানের সুরা বাকারায় আছে ইহুদি এক ঈশ্বরকে ভুলে গিয়ে স্বর্ণ দিয়ে একটি বাকারা (বকরি) বা বাছুর বানিয়ে তার পূজা শুরু করেছিল, যেন ঐ স্বর্ণময় বাছুরটাই তাদের ঈশ্বর। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা শিরক। হিন্দুরা একটি অশ্বত্থ বা বট গাছকে ঈশ্বরের রূপ মনে করে গাছের গোড়ায় সিঁদুর, ফল-ফুল দেয়। এটাও শিরক, কারণ নিরাকার ঈশ্বরের সাকার কোন রূপ কল্পনা করা ইসলামে নিষেধ। কিন্তু ইরানেও এ ধরনের বৃক্ষপূজা আছে, মনস্কামনা পূর্ণ করতে পবিত্র বৃক্ষের ডালে সুতা বাঁধে ভক্তেরা এবং এই ইরানীরা কারও চেয়ে কোনো অংশে কম মুসলমান ভাবে না নিজেদের।
ইসলামের পারসিক ধারায় মুমীন এবং ঈশ্বরের মাঝখানে তৃতীয় এক ব্যক্তি (জীবিত কিংবা মৃত): ইমাম, পীর কিংবা মুর্শিদের অস্তিত্ব মেনে নেওয়া হয়, অনেকটা বিচারক ও আসামী-ফরিয়াদীর মাঝখানে কোনো উকিলের মতো। অন্য কোনো মাজহাবের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এ ধরনের আচরণও শিরক। পীর-মুর্শিদ মৃত্যুবরণ করলে তাঁর কবরে জেয়ারত করতে যায় ভক্তেরা, বংশানুক্রমে, যাতে মুর্শিদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ থাকে। এই আচরণও শিরক, বিশেষত ওহাবীদের মতে। কোনো বস্তু (যেমন কোনো পাথর), কোনো স্থান, কোনো ব্যক্তিকে পূজনীয়, পবিত্র মনে করা শিরক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে ইসলামে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে হজ্ব, রসুল ও খুলাফায়ে রাশেদিনের মাজার জেয়ারত, হজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া, ছোট-বড়-মেঝ শয়তানের উপর পাথর নিঃক্ষেপ– এগুলোকেও শিরকের অন্তর্ভুক্ত করতে চান– এমন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিরল নয় ইসলামের ইতিহাসে। নবী ও খলিফাদের সম্মান করাটাকেও শিরক মনে করে, এমন মুসলমানও ছিলেন অতীতে, 'আল্লার দল'-এর মতো গোষ্ঠী আছে বর্তমানেও। উমাইয়া আমলে নবী মুহম্মদ (স.) তাঁর স্ত্রী-কন্যা ও খলিফাদের কবর ও স্মারকগুলো এমনভাবে নষ্ট করা হয়েছিল যে, নবীর ওফাতের কয়েক দশক পর খলিফা দ্বিতীয় উমর মক্কা সফরে গেলে জায়গাগুলো চিনতে তাঁকে গাইডের সাহায্য নিতে হয়েছিল। উমাইয়া শাসনের প্রায় একশ বছর ধরে আলভি অর্থাৎ হজরত আলী (রা.) এবং তার বংশধরদের অভিশাপ দেওয়া হতো শুক্রবারের খোৎবায়। এসব তথ্য পাওয়া যাবে আমীর আলীর ইসলামের ইতিহাসে।
তুমিতো জানো দিনারজাদি, আমাদের আরব দেশে ব্যক্তিবন্দনা করে ক্বাসিদা লেখা হতো। যেমন আমাদের প্রিয় নবী মুহম্মদের (স.) পিতামহ আবুদুল মুত্তালিব যখন মৃত্যুপথযাত্রী, তখন তিনি তাঁর নিজের প্রশংসা করে ক্বাসিদা লিখতে আদেশ দেন ছেলেমেয়েদের। সে ক্বাসিদা এবং অন্য অনেক ক্বাসিদা ইসহাক রচিত সিরাতুন্নবীতে পাওয়া যাবে। এটা অবশ্য ইসলামপূর্ব যুগের ঘটনা, কিন্তু ইসলাম পরবর্তী যুগেও ক্বাসিদা লেখা হয়েছে আরবে ও ইরানে। রসুল নিজেই ক্বাসিদা লেখা অনুমোদন করেছেন, যদি তাতে ব্যক্তির বিরুদ্ধে কুৎসা না থাকে। যা কিছু নবী মুহম্মদের (স.) সমসাময়িক কালের কিন্তু ইসলাম-পরবর্তী আরব সংস্কৃতির অংশ তার অধিকাংশই সুন্নাহ বলে বিবেচিত হতো। ক্বাসিদা রচনার সংস্কৃতি আরব দিগ্বীজয়ের সঙ্গে প্রতিবেশি অঞ্চলেও (যেমন পারস্যে) ছড়িয়ে পড়ে। এর মানে হচ্ছে, ঈশ্বর ছাড়া অন্য কারো প্রশংসাভিত্তিক গান ও কবিতা আরবীয়-পারসিক সংস্কৃতির অংশ। ক্বাসিদা নিজেরটা নিজেও লিখতো কেউ কেউ, ছেলে-মেয়ে আত্মীয়-স্বজনও লিখতো, আবার কোনো কবিকে অর্থপ্রদানের মাধ্যমেও ক্বাসিদা লিখিয়ে নেয় যেতো। ক্বাসিদা রচনা বা পড়া যদি শিরক না হয়, তবে বাংলাদেশের ক্বাসিদা 'ও আমার দেশের মাটি' রচনা ও পড়াও মাজহাবভেদে শিরক বলে বিবেচিত নাও হতে পারে।
ইসলামের মূল বাণী কি? ত্রিব্যঞ্জন ধাতু {স-ল-ম} যার অর্থ 'সম্পূর্ণ, প্রশ্নহীনআত্মসমর্পণ' থেকে 'ইসলাম' শব্দের সৃষ্টি। আমি যতটুকু বুঝি দিনারজাদি, আমাদের ধর্মেরমূল কথা হচ্ছে: 'তাকওয়া'। বাংলায় এই শব্দের অর্থ করা হয় 'খোদাভীতি', কিন্তু আমরা আরবেরাএতই ভয়হীন, এতটাই গর্বিত যে কাউকে ভয় করা আমাদের ধাতে সইবে না, তিনি ঈশ্বর হলেও না।{ত-ক-ওয়} ধাতু থেকে সাধিত আরবি 'তাকওয়া' শব্দের মধ্যে বাংলা 'ভয়'-এর ব্যাপারটাই নেই।'তাকওয়া' তাহলে কী? ধরা যাক, তোমার কোনো বন্ধু তোমাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করে এবং তুমিভুল করে কিংবা জেনেশুনে সেই বন্ধুটির সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করে বসলে। বন্ধুটি তখন তোমারদিকে এমন এক দৃষ্টিতে তাকাবে, যার অন্যতম অর্থ হতে পারে: 'তুই, তুই দিনারজাদি, তুইআমার সঙ্গে এই ব্যবহারটা করলি! আহা! তোর উপর আমার কত ভরসা ছিল রে! আল্লাহ যেন তোমারদিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাতে না পারে, সেই বিশেষ ভয়টুকুর নামই হচ্ছে 'তাকওয়া'। যেমন ধরাযাক, তুমি যদি মিথ্যা বলো, যদি দুর্নীতি করো, যদি অকারণে নরহত্যা করো, যদি জাকাত ফাঁকিদাও, প্রতিবেশীকে অভূক্ত রেখে হজ্বে যাও, তবে তোমার তাকওয়া বজায় থাকবে না। তুমি ঈশ্বরেরচোখে এক মহা নির্লজ্জ ব্যক্তিতে পরিণত হবে। শাস্তিটাস্তিতো পরের ব্যাপার।
অনেক চিন্তাবিদের মতে, ইসলামে তাকওয়া অটুট রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, তৌহিদের চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু লোকজন শিরক নিয়ে যতটা উদ্বিঘ্ন, তাকওয়া নিয়ে তাদের অতটা মাথাব্যথা নেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক: সুদ দেওয়া ও নেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ, কিন্তু সিংহভাগ মুসলিমপ্রধান দেশে সুদভিত্তিক আধুনিক ব্যাংকব্যবস্থার রমরমা। কিছু কিছু ব্যাংকে 'সুদ'-কে 'লাভ' নামে ডাকা হয়, কিন্তু যার নাম 'লাউ', তার নামই 'কদু'। এর মানে হচ্ছে, আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে বাস করতে হলে, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে, তাকওয়ার ক্ষেত্রেও ছাড় দিতে হয়, যার মানে হচ্ছে দিনারজাদি, শিরক এবং তাকওয়া উভয় ক্ষেত্রেই আমরা মুসলমানেরা কমবেশি ছাড় দিয়ে থাকি। ধর্মের সব নিয়মের ক্ষেত্রেই হয়তো কমবেশি ছাড় দেওয়া হয়, তা না হলে (আমরা যেমনটা বলেছি আলোচনার উজানে) মিশরের জাতীয় সঙ্গীতে দেশকে 'মা' বলা হবে কেন, একাধিক আরবদেশের জাতীয় সঙ্গীতে সুলতান কিংবা আমীর বন্দনা থাকবে কেন, কিংবা কেনই বা আরবভূমিতে থাকবে রাজতন্ত্র, যেমনটা আইয়ামে জাহিলিয়া যুগেও ছিল না?
প্রতিটি গান একটি ভাষাবস্তু। ভাষা মানেতো শ্রেফ মুখের কিছু ধ্বনি নয়, উচ্চারিত ধ্বনি শুনে মস্তিষ্কে সৃষ্টি হওয়া অর্থ আর উচ্চারিত ধ্বনিক্রম– এই দুয়ে মিলেই ভাষা। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত যখন কেউ গায় বা শোনে, তখন সেই গায়ক কিংবা শ্রোতার মনে কি ঈশ্বরবন্দনার মতো কোনো ভাবের উদয় হয়? নাকি নিছক দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয় মন? কেউ যদি বলে, দেশের মানুষের মনে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে দেশকে স্বাধীন করাই ছিল রবীন্দ্রনাথের এসব গীত রচনার একমাত্র উদ্দেশ্য, তবে সে কি খুব ভুল বলছে।
আরও একটি সমস্যা আছে দিনারজাদি। সমস্যাটা ভাষার, ভাষার সেমিওলজির। তুমিবলছো: 'মূর্তিপূজা, মূর্তিভাবনা নিষিদ্ধ!' আমি মানলাম। কিন্তু বোন, মূর্তিভাবনার চিহ্নমাত্রওনেই এমন কোনো ধর্ম কি আছে পৃথিবীতে? ছোটো, মেঝো, বড় শয়তানের দিকে যখন কোনো বিশ্বাসীনুড়ি পাথর ছুঁড়ে মারে চারতলা ফ্লাইওভারের একেকটায় দাঁড়িয়ে, তখন কি তাকে কল্পনা করতেহয় না যে শয়তান বাবাজীরা আর কোথাও নয়, শুধু ওখানেই ঘাপটি মেরে আছেন? শয়তানদের একেকটাচেহারাও তাদের কল্পনায় আসে বৈকি এবং নিশ্চয়ই সেই চেহারা দেবদূতদের মতো নয়। তুমি বলবে,ওটা একটা প্রতীকী ব্যাপার, কিন্তু বোন, 'প্রতীক' মানেতো এক ধরণের মূর্তিই।
মূর্তি শুধু মাটি-কাঠ-পাথরের হয় না, কথা দিয়েও মূর্তি তৈরি হয়, চিন্তাদিয়েও মূর্তি তৈরি হয় মনের অভ্যন্তরে। বক্তা যখন বলছেন, আল্লাহ এটা করবেন, ওটা ক্ষমাকরবেন না, জিবরাইল ফেরেস্তাকে কোনো নবীর কাছে পাঠাবেন, কিংবা পাঠাবেন না, অথবা যেমনধরুন, কেউ যখন ঈশ্বরের সিংহাসনটিরই (আল কুর্সি) বন্দনা করে, তখন বক্তা এবং শ্রোতা উভয়েরমনে ঈশ্বরের প্রায় একই ধরনের কথামূর্তি গঠিত হয়ে চলে। আরবি বা সংস্কৃত যে বোঝে তারমাথায়তো মূর্তি সৃষ্টি হয়ই, যে বোঝে না তার মাথায়ও কোনও না কোনো মূর্তি সৃষ্টি হয়।সব ধর্মে দাবি করা হয়, ঈশ্বর নিরাকার। কিন্তু ঈশ্বর শুধু নয়, বই, খাতা, কলম… যে কোনোশব্দ উচ্চারণ করা মাত্র মানুষের মস্তিষ্কে কোনো না কোনো মূর্তি তৈরি হয়ে যায়, হতে বাধ্য,কারণ তা না হলে এক মানুষ অন্য মানুষের কথা বুঝতো না। মুখে ভাষা ব্যবহার করতে হলে মনে/মস্তিষ্কেমূর্তিসৃষ্টি মেনে নিতেই হবে– গত একশ বছর যাবৎ ভাষাবিজ্ঞানে এটাসর্বজনস্বীকৃত স্বতসিদ্ধ (শিশির ভট্টাচার্য্য রচিত 'ঈশ্বর-ধর্ম-বিশ্বাস' বইতে এ বিষয়েবিস্তারিত বলা হয়েছে)।
কথা শেষ করি, দিনারজাদি। সুবেহ কাজিব শুরু হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, বৈশ্বিকবিচারে শিরকের একটা মাপকাঠি আছে। সবচেয়ে বেশি শিরক করতো গ্রেকোরোমান ও আইয়ামে জাহিলিয়াযুগের আরবেরা। তারপরে হিন্দুরা, তারপর খ্রিস্টান ও বৌদ্ধরা এবং সবচেয়ে কম শিরক করেহয়তো মুসলমানেরা। ঈশ্বরে যারা প্রকৃত বিশ্বাস রাখেন, তারা এটাও মনে করেন, দিনারজাদি,যে তৌহিদ কচু পাতার পানি নয়, যে সামান্য আঘাতেই গড়িয়ে পড়বে। যদি কারও তাকওয়া অটুট থাকেএবং ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ বজায় থাকে, তবে মুসলমানত্বও বজায় থাকার কথা। শতভাগ নিখুঁতভাবেধর্মপালন করা কারও পক্ষে কি সম্ভব, বিশেষত বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিবন্ধ মেনে? দিনারজাদি,আমি মনে করি, ঈশ্বর বলে কেউ যদি থাকেন, তবে তিনি অবশ্যই সর্বজ্ঞ হবেন এবং প্রধানত তিনিমানুষের মন দেখে থাকেন। তিনি জানেন, কীসে কী হয়। যেমন ধরা যাক, তিনি হয়তো ওমর খৈয়ামেরমতো সুরা ও নারী-প্রেমিক পারসিক কবিকে বেহেস্তনসীব করবেন আবার জীবনে সুরা ও পরনারীস্পর্শ করেনি বিনাদ্বিধায় এমন কাউকে দোজখ-বদনসীব করবেন। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে যারা ব্যাংকথেকে সুদ নিচ্ছেন কিংবা দিচ্ছেন তারাও হয়তো মাফ পেয়ে যাবেন হাসরের ময়দানে।
দিনারজাদি তার দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন: 'পবিত্র গ্রন্থে বারবার বলাহয়েছে, নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান। তাঁর মনে কী আছে, তিনি কার কী বিচার করবেন,বলার ক্ষমতা মরণশীল মনুষ্যের থাকার কথা নয়। কোনো একটা টেক্সট বা রচনা পড়া, যেমন ধরাযাক, ইমরুল কায়েসের লেখা আইয়ামে জাহিলিয়া যুগের কোনো দেবীবন্দনা যদি কোনো আরব পড়ে,কিংবা কোনো বাঙালি মুসলমান যদি মনসামঙ্গল কিংবা চন্ডীমঙ্গল কাব্য পড়ে আনন্দ, শিক্ষাকিংবা গবেষণার প্রয়োজনে, সে কি শিরক করছে? তা যদি না করে, তবে 'ও আমার দেশের মাটি'গেয়ে-পড়ে তৌহিদ অটুট থাকতেও যে বাধা নেই, আমি দিনারজাদি অন্তত এইটুকু বিশ্বাস করি।যারা ভিন্ন রকম বোঝে, তারা তাদের যুক্তি দেখাক। যুক্তিযুক্ত হলে তুমি আর আমি না হয়দুজনেই মেনে নেবো তাদের কথা।
[ইতিমধ্যে পূবের আকাশে সুবেহ কাজিব শেষ হয়ে সুবেহ-সাদিকের আলামৎ দেখা গেল। মুয়াজ্জিন ভোরের আযান দিলে আলাপ থামিয়ে দিলেন দুই বোন এবং ফজরের নামাজ পড়ে নকশি-লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাদশা শাহরিয়ারও বেরিয়ে গেলেন ফজরের নামাজ আদায় করে রাজকার্যে। শিরক নিয়ে কিছু বাঙালির বাড়াবাড়ির কথা বাদশা আগেই জানতেন, কিন্তু তিনি এও বোঝেন যে এই চিরকালীন সমস্যার সমাধান তাঁর হাতে নেই। সুখের কথা এই যে স্ত্রী ও শ্যালিকার সঙ্গগুণে বাদশা শাহরিয়ারের জ্ঞানতৃষ্ণা উত্তরোত্তর প্রবল হয়ে উঠছিল। শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড দ্বাদশ দিন পর্যন্ত মুলতবী হলো।]