Published : 08 Sep 2019, 03:56 PM
প্রধানমন্ত্রী 'মৎস সপ্তাহ ২০১৯' উদ্বোধন করে বলেছেন, 'মাছ চাষ বাড়াতে জলাশয়গুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে নদনদীর ড্রেজিং কাজ শুরু হয়েছে। ড্রেজিং করে পানি প্রবাহ ও পানির ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। যত বেশি পানি প্রবাহ বাড়বে মাছের উৎপাদনও তত বাড়বে। এতে মানুষের মাছের চাহিদা পূরণ হবে।' তিনি মাছের উৎপাদন বাড়িয়ে স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রফতানির জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপরেও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বাস্তবতা এই যে, আমাদের আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ক্ষেত্রে উজানের দেশের একতরফা পানি প্রত্যাহারের সাথে জাতীয় অবহেলার যুগলবন্দিতে নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়গুলো প্রতিনিয়ত স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়ে ফেলছে। সারাদেশে মানুষ জলাশয়গুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন সংগ্রামে রত। তাই পরিবেশ সচেতন মানুষ প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগে আশান্বিত হয়ে উঠেছে। কারণ বাংলাদেশে এখন জনগণের ভরসার স্থল প্রধানমন্ত্রী আর হাইকোর্ট। বাকি যারা আছে তারা যে মশা মারার যোগ্যতা রাখেন না তা প্রমাণিত।
জলাশয়গুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারলে শুধু মাছের চাহিদা পূরণ বা রফতানি প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে জাতীয় আয় বাড়বে না সাথে সাথে পরিবেশের ব্যাপক উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সহায়ক হবে। পরিবেশের জন্য পানির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সে কারণেই বোধ করি সারাদেশে শুধু নয় সারাবিশ্বে আজ পরিবেশ সচেতন মানুষ পানি সমস্যার সমাধানে আন্দোলন সংগ্রাম করে চলেছে। আর আমাদের দেশে সরকার আশু সমস্যার আশু সমাধান করতে গিয়ে পুরা পানি ব্যবস্থাপনাকে জট পাকিয়ে ফেলেছে। সবুজ বিপ্লবের নামে জলাভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। গোলাপী বিপ্লবের নামে মূল ভূখণ্ডে লবণাক্ততা নিয়ে আসা হয়েছে। সুপেয় পানি আর নদীমাতৃক দেশে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যাপক গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে পানির স্তরকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুধু নয় সারাদেশে আর্সেনিক নিয়ে আসা হয়েছে। এসবের সাথে যোগ হয়েছে দেশের জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, দারিদ্র, বাসস্থান, কৃষি সম্প্রসারণ, গাছকাটা, কলকারখানার বর্জ্য ফেলা, অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ, ব্রীজ-কালভার্ট, ঘরবাড়ি, কলকারখানা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, জমিতে বিষাক্ত কীটনাশক ও সার প্রয়োগ, জলাভূমি ভরাট ও দখল ইত্যাদি নানাবিধ কারণ। ফলে দেশের জলাভূমি ও জলসম্পদ আজ আর আমাদের অনুকূলে নেই। সারাদেশে জলাভূমির সবচাইতে ছোট ইউনিট পুকুরও বেশুমার ভরাট করা হয়েছে। তাই দেশ ও জাতির কল্যাণে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ পরিবেশবাদীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছে।
বাংলাদেশের জলাভূমিগুলো এক বিশাল জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল। এখানে প্রচুর দেশীয় ও যাযাবর পাখি, অসংখ্য বিলুপ্ত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের বাস। জলসম্পদ আহরণে বৈজ্ঞানিক সর্বোত্তম প্রদ্ধতি গ্রহণ না করে, ধ্বংসাত্মক পদ্ধতিতে মাছ ধরে, চারা পোনা ধরে, প্রকৃতিগতভাবে মাছসহ অন্যান্য জলসম্পদ সাধারণ মাত্রার অতিরিক্ত আহরণ করার পাশাপাশি জলসম্পদ সংরক্ষণ নীতি না মেনে, নীতিমালার আধুনিকীকরণ ও কঠোর বাস্তবায়ন না করে, জল সম্পদের গুরুত্ব বিবেচনায় জাতীয় পরিকল্পনা না করে এবং জলসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টিতে ব্যর্থ হওয়ায় জলাভূমির অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় থেকে শুরু করে পুকুর পর্যন্ত সব জলাশয়ই সংকটের মধ্যে আছে। সবধরনের জলাশয়কে সংকটের বাইরে আনতে হলে জাতীয় মহাপরিকল্পনা জরুরী। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেই কাজ শুরু করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী নদ-নদী ড্রেজিং শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন। সাধারণ মানুষ মনে করে, দেশ ও জাতির কল্যাণে পর্যায়ক্রমে দেশের সব জলাশয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের মধ্যে আসবে।
দেশে জলাশয়গুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়ার কাজটা খুব কঠিন। যশোর-খুলনা অঞ্চলের দুঃখ ভবদহ। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সারাদেশে পোল্ডার নির্মাণের অংশ হিসেবে এখানেও তা নির্মাণ করে। ফলশ্রুতিতে এলাকার মানুষ ধান উৎপাদন করে সুখের মুখ দেখে। সোনার তৈরি কাস্তে দিয়ে ধান কেটে গভর্নর সাধারণ মানুষকে সরকারের গৃহীত প্রকল্পের সুফল স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু দশ বছর যেতে না যেতে এলাকাবাসীর উপর প্রকৃতির অভিশাপ নেমে আসে। জলাবদ্ধতার প্রকোপ শুরু হয়। আজ ৩৫/৪০ বছর ধরে ভবদহ দেশের অন্যতম জলাবদ্ধ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। মুক্তির পথ খুঁজতে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত দেশের রথী-মহারথীরা। সব হিসেব করলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজও মুক্তির জন্য এলাকাবাসী হাহাকার করে চলেছে। এমনভাবে ভুল পরিকল্পনা করে, আশু সমস্যার আশু সমাধান করতে গিয়ে, একটা ভুলের সংশোধন করতে গিয়ে বড় ভুলের মধ্যে ফেলার উদ্যোগ নিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে কীভাবে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে?
সারাদেশে ভবদহ যদি একমাত্র উদাহরণ হতো তাহলে সাধারণ মানুষ বেঁচে যেতো। কিন্তু তা হয়নি। সারাদেশেই এমন অনেক ভবদহ সৃষ্টি করা হয়েছে। ভুল পরিকল্পনায় আমাদের চলন বিল ধ্বংস হয়েছে আবার প্রয়োজনের চাইতে ছোট স্লুইচ গেট নির্মাণ করে বড়াল নদী খুন হয়েছে। এভাবে সারাদেশে জলাভূমি ধ্বংস করার ফলে আজ রাজধানীসহ সর্বত্র জলাবদ্ধতা দেখতে হচ্ছে। উজানের দেশের একতরফা পানি প্রত্যাহারের সাথে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্বজ্ঞানহীন পরিকল্পনার কারণে জলাভূমি ও জলসম্পদ আমাদের অনুকূলে নেই। সরকার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে সারাদেশে নদী ড্রেজিংয়ের কাজ করছে। হাইকোর্ট নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছে। এতে লাভের লাভ কী হয়েছে বা কী হবে? ইতোমধ্যে যেসব নদী ড্রেজিং করা হয়েছে সেগুলোর বর্তমান অবস্থা দেখে এখনকার ড্রেজিং-এর ফলাফল সাধারণ মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুভব করছে। ড্রেজিং করে নদীকে যদি উৎসে পানির যোগান নিশ্চিত করে বহতা করা যেতো তবেই মহাপরিকল্পনার সুফল সাধারণ মানুষ দেখতে পেতো। যশোর-খুলনা অঞ্চলের ভৈরব নদ সংস্কারের কাজ বর্তমানে চলমান। এটা যে বহতা ভৈরব নদে পরিণত হবে তার কোনো আলামত এখনো এলাকাবাসী দেখতে পায়নি। এটা একটা পানি নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প হিসেবে কিছুদিন এলাকাবাসীকে সেবা দিতে সক্ষম হবে। প্রকল্প শেষে এর চাইতে বেশি কিছু হবে বলে মনে হয় না। মোদ্দা কথা হচ্ছে, প্রকল্প যদি শেষ হয় তবে তাতেই সরকার খুশী। প্রকল্প তার লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হলো কিনা তা দেখার কেউ নেই। আমাদের দেশে যেহেতু সংশ্লিষ্টদের কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। তাই প্রকল্প শেষ করার আনন্দে নতুন কোনো প্রকল্পের দায়িত্ব পেতে অসুবিধা হয় না। দেশ ও জাতির কপালে যাই জুটুক এরা দায়িত্ববান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েই যান।
সরকার নদী রক্ষায় কমিশন গঠন করেছে। বিগত বছরগুলোতে কমিশন কী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তা সাধারণ মানুষ জানে না। আইনিভাবে কমিশন নদীর অভিভাবক। কিন্তু তারা নিজেদের কাগুজে বাঘ করে রেখেছে। সরকারি নীতিমালাও এক্ষেত্রে দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। আসলে নদীর মালিকানা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যার অনুমতি ছাড়া নদী নিয়ন্ত্রণ, নৌপথ ব্যবহার, মৎস্য আহরণ, নদীর ভূমি ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থা, দূষণ, ভরাট, দখল ইত্যাদি কিছুই করা যাবে না। ছোট বড় সব নদীকে এই কমিশনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এমন কী সরকার পরিকল্পিত ড্রেজিংও কমিশনের অনুমোদন ছাড়া করতে পারবে না। আমাদের দেশে এসব না করার ফলে যার যেভাবে ইচ্ছা নদীকে ব্যবহার করে চলেছে। সাধারণ মানুষ এভাবেই নদীকে ব্যবহৃত হতে দেখছে। পৃথক পৃথকভাবে সবাই নদীকে ব্যবহার করে কিন্তু কোনো সমন্বয়ের প্রয়োজন কেউ বোধ করে না। ফলে হাইকোর্ট রাজধানীর নদী রক্ষায় টাইম ফ্রেম করে নদীর ভূমি চিহ্নিতকরণ, দখল ও ভরাট রোধে আইন শৃংখলা বাহিনী মোতায়েন করার নির্দেশ দিলেও তা যথাযথভাবে পালিত হতে জনগণ দেখতে পায়নি। দেশের পরিবেশবাদীরা শুধু নয় আইনি ব্যবস্থাও নদী রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। এখন আবার নতুন করে শোনা যাচ্ছে নদীর প্লাবনভূমি ফিরিয়ে দেয়ার কথা। সার্বিক অবস্থায় ইতোমধ্যে নদী রুপান্তরিত হয়ে খাল বা খাল থেকে নালায় পরিণত হয়ে গিয়েছে। এখন খালের মতো নদী পাওয়াও জনগণের ভাগ্যের ব্যাপার। নদীর প্লাবন ভূমি কোথায় পাওয়া যাবে? নদীর প্লাবন ভূমি ধরে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ তাই জনগণ আর্শীবাদ হিসেবে গ্রহণ করবে।
সরকারি হিসেবে জলাশয় বলতে যদি শুধু নদীকে বলা হয় তবে তা পূর্ণতা পাবে না। বড় বড় জলাশয়ের পাশাপাশি পুকুরেরও পরিবেশ রক্ষা ও মাছ চাষে ভূমিকা আছে। উন্নয়নের জন্য সরকারি বেসরকারিভাবে জলাশয় দখল ও ভরাটের যে প্রতিযোগিতা দেশব্যাপী চলছে সেখানে পুকুরের অবস্থা খুবই সঙ্গীন। তাই জলাশয়গুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের পরিকল্পনায় নদ-নদী থেকে শুরু করে পুকুর পর্যন্ত আসতে হবে। সংস্কারের অভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পুকুরগুলো ইতোমধ্যেই পিরিচের আকার ধারণ করেছে এবং তার উপর নিবিড় মাছ চাষের কারণে সেগুলোর অধিকাংশই আর ব্যবহার উপযোগী নেই। শুধু তাই নয় গন্ধে পাশ দিয়ে হাটা যায় না। জনগণের আমিষের চাহিদা পূরণে মাছ চাষ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু স্থানীয় পরিবেশ রক্ষার বিষয় বিবেচনার মধ্যে নিয়ে সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী পানির প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান জরুরী। তাই দেশ ও জনগণের কল্যাণ বিবেচনায় পূর্ণ জলসম্পদ পরিকল্পনা আজ কালের দাবি। পানির গুরুত্ব বিবেচনায় আর কালক্ষেপন কাম্য নয়।