শাসন যত দীর্ঘ হয় মানুষ ততই হাঁপিয়ে ওঠে। তাদের ক্লান্তি আর হতাশা ততই বাড়তে থাকে। এই জন্য জনগণের কথা শুনতে হয়। তাদের মনের ভাষা বুঝতে হয়। ক্ষমতাকে দীর্ঘতর করতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হয়।
Published : 24 Jul 2024, 06:46 PM
আমি তখন বারো বছরের বালক। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার মোড়ে দাঁড়িয়ে। ভোরের সূর্য তখন গনগণে হয়ে উঠছে। এখনকার চট্টগ্রাম আর তখনকার চট্টগ্রামে দুস্তর ব্যবধান। আন্দরকিল্লা তখন শহরের প্রাণ কেন্দ্র। একপাশে জামে মসজিদ। আরেক পাশে নবাব সিরাজদৌল্লার নামে সড়ক। সে সড়কের ওপ্রান্ত থেকে ঘন ঘন মিছিল আসছিল। ছাত্র যুবক তরুণ-তরুণীদের সে মিছিলে সবাই উচ্চকিত স্লোগান আর বজ্রনিনাদে ধ্বনি তুলছিলেন, জয় বাংলা। বাংলার জয় তখন অনিশ্চিত।
আমি বলছি একাত্তরের কথা। সেই যে জয় বাংলা ধ্বনি আমাদের কানে অমৃত ঢেলে দিয়েছিল তার প্রমাণ মিলল নয় মাস পর। তখন সারাদেশে জয় বাংলা পরিণত হয়েছিল জয়ধ্বনিতে। একসময় সাহস আর শক্তির প্রতীক হয়ে উঠল এই স্লোগান। আজ ৫৩ বছর পর বহুল ব্যবহারে দীর্ন স্বার্থপরতায় ক্লান্ত সুবিধাবাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে হতে এটি তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে প্রায়। হয়তো সে কারণেই তরুণ প্রজন্মে এখন আর তা পুলক জাগায় না।
কী আশচর্য! যে স্লোগান বা ধ্বনি আমরা গালগালি অর্থে ব্যবহার করতাম ঘৃণা সহকারে উচ্চারিত হতো সে রাজাকার ফিরে এসেছে। রাজাকার শব্দটি যারা রাজাকার তারাও বলতে কুণ্ঠিত ছিল। মনে রাখতে হবে ইতিহাস লেখেন বিজয়ীরা। যে কোনো যুদ্ধেই দুটি দল থাকে। শ্রী কৃষ্ণ না থাকলে আর মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবরা জয়ী হলে পাণ্ডব বা অর্জুন কী বীর বলে গণ্য হতেন? বিশ্বযুদ্ধে যদি হিটলার জিতে যেতেন আমরা কি আজকের ইতিহাসকে ইতিহাস বলে জানতাম ? তখন আমাদের মনে হতো হিটলারই ছিলো সর্বজন মান্য এক বীর। তেমনই একাত্তর সালে বাঙালিরা হেরে গেলে পাকিস্তানিরা জয়ী হলে ইতিহাসে আমরা হতাম গাদ্দার। আমরা যে তাদের চোখে গাদ্দার তার প্রমাণ এখনো আছে। আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের কবর পাকিস্তানে। তারা সে কবরে লিখে রেখেছে, এখানে শায়িত আছে এক গাদ্দার বা বেঈমান। আমরা জিতেছি আর স্বাধীন হয়েছি বলেই মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধ সম্মান পেয়েছে।
এই সম্মানের ধারাবাহিকতা কেবল একটি দল বা সরকারের কাজ হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। যে যুদ্ধে বাংলাদেশের সকল মানুষেরই ভূমিকা ছিল। আমরা আম-জনতার দলে। আমার বাবা ছিলেন সাধারণ একজন ব্যাংকার। পাঁচ সন্তান ফেলে রেখে যুদ্ধে যাবার মতো পরিস্থিতি ছিল না তার। কিন্তু যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণা সহ্য করে আমরা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলাম তা কোনো যুদ্ধের চাইতে কম কিছু না। শুধু কি তাই? সে সময় আমাদের কম করে হলেও একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো পরিবেশে পড়তে হয়েছিল। দেশের ভেতরে বাইরে এমন অজস্র মুক্তিযোদ্ধা বা পীড়িতদের আমরা ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। এরজন্য দায়ী সমাজের নিয়ন্ত্রকরা। তারা কোটা আর অ-কোটার ভেতর দিয়ে এমন এক পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে যেখানে আজ ভাই ভাইয়ের দুশমন।
মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের গর্ব। যোদ্ধারা শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের লড়াই তাদের অবদানের তুলনা হয় না। তারা দেশ এনে না দিলে কি হতো সবাই জানেন। কিন্তু ৫০বছরেরও অধিক সময় পর যখন তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে মাঠে নামে বা তাদের রাগ-অভিমান এভাবে তাদের মাঠে নামায় আমরা কি বলব না যে এ আমাদের ভুল? আমাদের পাপের কারণে আজ এই দশা? বাংলাদেশ এক সময় প্রগতিশীলদের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। যৌবনে আমরা মনে করতাম বিরোধী দল হয়েই দিন কাটাবে আওয়ামী লীগ। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর মুক্তিযুদ্ধের কারণেই মানুষ তাদের প্রতি মনোযোগী হতো। জামাত-শিবিরের সর্বত্রগামী যোগাযোগ আর বিএনপির দাপটের পরও আওয়ামী লীগ দেশ শাসনে ফিরে এসেছে। এই শাসন যে ২০০৮ থেকে এত দীর্ঘ হবে সেটা হয়তো দলও ভাবে নি। এর নাম হ ওয়া উচিত ছিল দেশ পরিচালনের সুবর্ণ সুযোগ। সে সুযোগ যে পুরোপুরি ব্যর্থ তা বলব না। কিন্তু তা আদর্শিকভাবে সার্থকও হয়নি।
উন্নয়ন হয়েছে। রাস্তাঘাট, উড়ালপুল, পাতাল পথ, মেট্রো রেল– বহু শানদার উন্নয়ন আমরা দেখেছি। একটি আধুনিক রাষ্ট্র বা দেশের অবকাঠামো হয়তো আমরা পেয়েছিও। কিন্তু নতুনের মনোজগৎ বা যুবমানস বলে যে বিষয় তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। আমি বহুবার এ কথা লিখেছি ও বলেছি পাশের বঙ্গে কমিউনিস্টরা তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজত্ব করতেন। তারা আমাদের এসব নেতা- উপনেতাদের চাইতে হাজারগুণ মেধাবী আর নিষ্ঠাবান ছিলেন। সেসব মেধাবীরাও জনগণের ভোটের চাপে শাসন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। আজ এমন হাল তাদের দূরবিন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। শাসন যত দীর্ঘ হয় মানুষ ততই হাঁপিয়ে ওঠে। তাদের ক্লান্তি আর হতাশা ততই বাড়তে থাকে। এই জন্য জনগণের কথা শুনতে হয়। তাদের মনের ভাষা বুঝতে হয়। ক্ষমতাকে দীর্ঘতর করতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হয়। আর একটা সমস্যা হচ্ছে সবকিছু এককেন্দ্রিক করে ফেলা। বাংলাদেশে এ দুই সমস্যা প্রকট। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত কোথাও কোন সমাধান মেলে না। এখন তিনিও একজন মানুষ। সবসময় তার পক্ষে সঠিক কথা বা সমাধান দিতে পারা সম্ভব নাও হতে পারে। একটি কথার রেশ ধরে আজ দেশ জ্বলছে। ছাত্রদের আপাত নিরীহ একটি আন্দোলন ব্যাপক সহিংসতার জন্ম দিয়েছে।
দেশে বিদেশে এ ঘটনা যে কুপ্রভাব ফেলেছে তা সহজে নিরাময় হওয়ার মতো নয়। আরেকটা বিষয় পরিষ্কার পদ-পদক আর অর্থ প্রত্যাশী স্তাবকেরা খারাপ সময়ে পাশে থাকে না। সেটা আমরা ৭৫ থেকে আজ পর্যন্ত বারবার দেখে আসছি। তবু এরাই ঘিরে থাকে। এবারের দুর্যোগে তাদের কেউ দাঁড়ায়নি। যারা মার খেয়েছে তারা সাধারণ। আর যারা কোটা আন্দোলনের জন্য মারা গেছে তারা আরো সাধারণ। তাদের ভেতর কে ঢুকে আছে কে ঢুকে নেই এসব বলে পার পাওয়া যাবে না। ঘটনা বলে দিয়েছে বলে দিচ্ছে কাচের স্বর্গে বসবাস করে কেউ নিরাপদ থাকে না। আর সম্মান ও ইজ্জত ভেঙ্গে পড়তে সময় লাগে না। এ জন্যই সুশাসনের বিকল্প নেই। দুর্নীতি বন্ধের বিকল্প নেই।
আমরা যারা প্রবীণ বা প্রবীণ হবার পথে আমাদের মনে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কার কাছে আমরা বিচার চাইব? যে দেশে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা ছিলেন যে সমাজে হাজারও জ্ঞানী-গুণী বিবেকবান বাঙালি আছেন সে দেশে এমন ক্রাইসিস হয় কি করে? কি করে অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি হয়? বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে দোষারোপ করার আগে এগুলোর জবাব পাওয়া জরুরি। শুরুতেই লিখেছি অন্ধকার একদিনে ঘনীভূত হয়নি। সে অন্ধকারকে যারা লালন করেছিলেন আজ তারাই ভুগবেন। তা ছাড়া কোনো চাওয়া-পাওয়া না মিললে সেটা নিয়ে কথা বলা মানেই কি দেশদ্রোহিতা? এ সব প্রশ্ন আর উত্তরের ভেতরেই ভবিষ্যতের শান্তি লুকিয়ে। বাংলাদেশ তুমি ভালো থেকো। থাকো রক্তপাতহীন শান্তিতে।