Published : 26 Dec 2018, 03:38 PM
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি বাংলাদশেরে বাইরে এবং সম্ভবত আর কোনওদিন স্থায়ীভাবে দেশে ফেরা হবে না। সেটা সত্ত্বেও প্রধানত দুটো প্রধান কারণে আমার মাতৃভূমির সব ঘটনা প্রবাহের সাথে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রথমত, আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম। ষাটের দশকরে শেষোর্ধ থেকে ছাত্র আন্দোলনের সেই সোনালী উত্তালময় দিনগুলোর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং পরর্বতীতে আমাদরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে সক্রিয় সম্পৃক্ততা, গণহত্যা এবং যার পরিণতিতে ত্রিশ লক্ষ সন্তানের আত্মাহুতির মাধ্যমে অর্জিত দেশ আমাকে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। দ্বিতীয়ত, অনেক দেশ ঘুরে গত চব্বিশ বছর আগে যে দেশে এসে বসতি স্থাপন করেছি সেটাকে বলা যায় গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা, মুক্তচন্তিা এবং মানাবাধাকিাররে স্বর্গভূমি। আমার প্রিয় মাতৃভূমি এবং এবং বর্তমান বাসভূমির মাঝে এ বৈপরিত্য আমাকে নিরন্তর দগ্ধ করে।
অতি ধর্মীয় পরিবারে বেড়ে উঠা বিশোর্ধ্ব একজন যুবক হিসেবে যেদিন ধর্ম নিরপেক্ষতা আমাদের সংবধিানে সন্নিবেশিত হয়েছিল সেদিন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ছেলিাম এই ভেবে যে মধ্যযুগ থেকে আমার জন্মভূমি এক আধুনিক যুগে উঠে এসেছে। কিন্তু সবকিছু তছনছ হয়ে গেল ১৯৭৫ সালের কালো রাতে।
স্মৃতি থেকে সেদিনের আমার অনুভূতির সবার সাথে কিছুটা ভাগ করে নিচ্ছি। সেদিনটি ছিল শুক্রবার। আমি যুক্তরাষ্ট্রের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স থিসিস ডিফেন্ড করে হলে ফেরার সাথে সাথেই হল সুপারভাইজার মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি তো বাংলাদেশের?" আমি 'হাঁ' বলার সাথে সাথেই তিনি বললেন, "তোমার দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়েছে।"
আমি বললাম, "তুমি ভুল বলছো। এটা অসম্ভব"। ভদ্রমহিলা তখনই লাউঞ্জের টিভি খুলে দিলেন। আমি খবরটি দেখার সাথে সাথে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন "উনি কি তোমার আত্মীয়?" কান্নাভেজা কণ্ঠে আমার উত্তর ছিল, "তিনি আমার আত্মার আত্মীয়, আমার দেশের জাতির পিতা"।
সেদিন শুধু স্বাধীনতার মহানায়ককেই হত্যা করা হয়নি, পাশাপাশি তিরোহিত করা হলো যে মন্ত্রসমূহের ভিত্তিতে বাঙালি জাতিসত্তার উম্মেষ ঘটেছিল। তারপর থেকেই পিছনে ফেরা শুরু। মুছে দেওয়া হলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বানানো হলো এক মিনি পাকিস্তান।
আমাদের ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত সব মূল্যবোধের বিসর্জন প্রবাস থেকে অবলোকন করে আমার হৃদয় এর অনুভূতি আর প্রতিক্রিয়াকে দেশবাসীর সাথে ভাগ করে নেওয়ার অভিপ্রায়ে প্রকৌশলবিদ্যার অধ্যাপক হয়েও লেখা শুরু করলাম রাজনৈতিক কলাম। ইন্টারনেটের প্রসার এ প্রচেষ্টায় সাহায্য জোগালো।
বিশেষ করে যে বিষয়গুলো আমাদের চেতনা আর অনুভূতিকে বিশেষভাবে আঘাত করেছে সেগুলো থেকেই কিছুটা তুলে ধরবো এ নিবন্ধের স্বল্প পরিসরে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কত শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল সেটার অনুমান নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলীর ভাষায়, "বাংলাদেশের জনগণের ৯০ শতাংশ শেখ মুজিব এর ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিল এবং তারা বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য তাদের জীবন বলিদানে প্রস্তুত ছিল"। এই অনুমান যদি গ্রহণ করা যায়, তাহলে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কমবেশি ১০ শতাংশ মানুষ সহযোগিতা করেছে।
আজকে যদি আমরা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নিজেদেরকে যারা মুক্ত করেছে সে সমস্ত জাতির ইতিহাসের দিকে নজর দেই, তাহলে দেখা যাবে খুব কম দেশের সংগ্রামই বাংলাদেশ সৃষ্টির আন্দোলনের মতন মানুষের ব্যাপক সমর্থন লাভের সমান্তরাল ছিল। তবে মৌলিক পার্থক্য হলো অন্যান্য দেশগুলি যখন স্বাধীনতা অর্জনের নীতির পথনির্দেশক শক্তি হিসেবে কাজ করে যে মূল্যবোধ ও গুণাবলী সেগুলো তারা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, যেটা বাংলাদেশ মর্মান্তিকভাবে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এ সন্ধিক্ষণ হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট। সেই থেকেই শুরু হলো দুঃখজনক পিছনের দিকে যাত্রা। পরবর্তী দুদশক ধরে, বিকৃতি, ছলচাতুরি, ধ্বংস, বিচ্যুতি ও বৈপরীত্য জাতীয় জীবনের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে স্থান করে নিয়েছিল। ১৯৭১ সালে কি ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের পথ ধরে অর্জিত একটি দেশে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী শক্তিকে বলা হবে 'মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি', যার অর্থ হলো 'মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি'ও থাকবে আমাদের দেশ তথা রাজনৈতিক অঙ্গনে – এটা কী কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল?
অনেকে প্রশ্ন করেন 'মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি' আবার কী? কেনই বা তাদের 'মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি' হিসেবে অভিহিত করা হয়? মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক আদর্শিক যুদ্ধ। অনেকেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কথিত 'মুসলিম সৈনিকদের আত্মসমর্পণের' স্মৃতি মুছে ফেলতে যিনি শিশু পার্ক নির্মাণ করেছিলেন তিনি 'স্বাধীনতার ঘোষক' হলেও কী তাকে কি 'মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি' বলা যাবে? আজকে যিনি বিপক্ষ শক্তির মূলনেত্রী তার অতীতের দিকে নজর দেওয়া যাক।
১৯৭১ সালের বিভীষিকাময় অবস্থার কথা এখনও যাদের স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাইনি, তারা অবশ্যই দ্বিমত পোষণ করবেন না, যে সেদিনে একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পরিবার ছাড়া আর কোনও পরিবারের কোন সদস্যকে, বিশেষ করে নারী সদস্যও (এমনকি তাজউদ্দীন বা সৈয়দ নজরুল পরিবারেরও) প্রতিরক্ষামূলক হেফাজতে নেয়ার প্রশ্নই উঠে না। অথচ একজন মধ্যম পর্যায়ের সেনা অফিসার (যে সময়ে একটি অপরিহার্য পরিচয় ছিল না যার) এর স্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্দি বা প্রতিরক্ষামূলক হেফাজতে ছিল সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সে সময় বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা বিপদসঙ্গকুল অভিযান চালায় তাকে ভারতে তার স্বামীর সাথে যোগ দেয়ার জন্য। কিন্তু অনেক বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে যে তিনি ভারতে তার স্বামীর সাথে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। উপরন্তু তিনি তার স্বামীকে 'দেশে ফিরে' আসার আহ্বান জানান।
তার দলে অনেক সুপরিচিত মুক্তিযোদ্ধা আছেন। কিন্তু বিএনপি রাজনীতিতে দিক্ষিত হবার আগে তাদের আমাদের স্বাধীনতার সর্বোচ্চ এবং অবিসংবাদিত নেতাকে শুধু অস্বীকারই করতে হবে না, সেদিনের এক নাম না জানা সামরিক অফিসারের আহ্বানে জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং সেটা না হলে নাকি মুক্তিযুদ্ধই সংগঠিত হতো না, সে জ্বাজল্যমান মিথ্যাগুলো বার বার উচ্চারণ করতে হবে। নৈতিকতার কতটকু অবনতি ঘটলে সেদিনের প্রখ্যাত ৪ জন ছাত্র নেতার একজন বিএনপি রাজনীতিতে দিক্ষিত হবার আগে বলতে পারেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার আহ্বানের কারণেই নাকি তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন!
বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত বই "The Blood Telegram: Nixon, Kissinger and a Forgotten Genocide"— প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি ব্যাস রচিত বইটি– আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি তথ্যচিত্র, প্রমাণ-দলিল। ৪০০ পৃষ্ঠার বইটির ছত্রে ছত্রে সেদিনের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কণ্ঠস্বর হিসেবে যার নাম উল্লেখিত হয়েছে তিনি আর কেউ নন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। বইটির একটি ছত্রেও জিয়াউর রহমান নামক কোনও ব্যক্তির নাম উল্লেখ হয়নি।
গত বছর ডিসেম্বরে দেওয়া এক বক্তব্যে বিএনপি নেত্রী বললেন– "মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। বলা হয়, এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে, আসলে কত শহীদ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, এটা নিয়েও বিতর্ক আছে। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না।"
ওই নেত্রী ৫১ বছর বয়সে তার নয়া আবিষ্কৃত জন্মদিন যে পালন করেন সেটা শুধু তার বিকৃত মানসিকতার পরচায়কই নয়, পাকিস্তান ভাঙ্গার নায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি চরমও ঘৃণা থেকেই তার এ মানসিক বিকৃতি, যদিও বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে তিনি নিগৃহীত তো হননি, বরঞ্চ এটা সর্বজনবিদিত বঙ্গবন্ধু তার সংসারকে রক্ষা করেছিলেন । তার একাধিক মামলায় দণ্ডিত ব্রিটেনে নির্বাসিত সন্তানকে প্রাক্তন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি অভিহিত করেছেন, "লোভ-লালসা-চোরামি আর দুর্নীতিবান সরকারের এবং হিংস্র রাজনীতির প্রতিবিম্ব" হিসেবে। তিনি বলেছেন, তারেক বঙ্গবন্ধুকে বলে পাক বন্ধু!
এই দুই নেতার ছবি মাথায় নিয়ে নিজেকে বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ ছেলে হিসেবে পরিচয়দানকারী কাদের সিদ্দিকী, কামাল হোসেন আর আ স ম রবের মতন এককালীন মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিকেরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন! হায়রে আমার স্বদেশ!
আমাদের জাতির আরও একটা বেদনাদায়ক দিক হলো আপনি যদি 'জয় বাংলা' বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেন, জাতির পিতা বলেন, তাহলে আপনাকে একটি বিশেষ দলের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জয় বাংলা ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মরণজয়ী স্লোগান। পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালেহ তার বইতে একজন মুক্তিযোদ্ধা কিভাবে তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত 'জয় বাংলা' বলতে বলতে আত্মদান করেছে তার বিবরণ। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর তাকে বলা হলো তুমি যদি 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বলো তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেয়া হবে, নতুবা এখনই গুলি করে হত্যা করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাটি বলল সে কোনও অবস্থাতেই পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলবে না। তখন তারা তাকে গুলি করার জন্য প্রস্তুত হলে সে বলল আমাকে এক মিনিট সময় দাও। তখন সে এক খণ্ড মাটি কপালে নিয়ে বলল, "হে বাংলার মাটি আমি তোমায় মুক্ত করে যেতে পারলাম না। আমার রক্তে তুমি পবিত্র হবে। আমার রক্তের বিনিময়ে তুমি মুক্ত হবে। জয় বাংলা"।
সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা তাকে গুলি করে এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই মরণজয়ী স্লোগান স্বাধীন বাংলাদেশে একুশ বছর নিষিদ্ধ ছিল। আমি এখনো এমন দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন মুক্তিযুদ্ধের এ মরণজয়ী 'জয় বাংলা' একদিন জাতীয় স্লোগানে পরিগণিত হবে। এটা উচ্চারণ করতে হলে শুধু বাঙালি হওয়ার প্রয়োজন পড়বে, একটি বিশেষ দলের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে না।
গত স্বাধীনতা দিবসে আমাকে এক 'সম্মিলিত' অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এ শর্তে যে আমি বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করলে আর একজনের কথা বলতে হবে। আমার উত্তর ছিল, 'বঙ্গবন্ধুর কথা বলার পর ওই নেতার নাম নেওয়ার আগে আরও অনেক অনেক নেতার নাম নিতে যে সময় লাগবে সে সময়টুকু আমাকে দেওয়া আপনাদের পক্ষে সম্ভব হবে না'। বলাবাহুল্য ওই অনুষ্ঠানে আমি যায়নি।
সত্যিকারভাবে ১৯৭১ সালে নয়, আজকে জাতি দুটি স্পষ্ট শিবিরে বিভক্ত। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭১ সালে টরন্টো অবস্থানরত কয়েক ডজন বাঙালি তাদের নেতার বিশাল প্রতিকৃতি বহন করে শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণের মাধ্যমে তাদের জন্মভূমিতে সংগঠিত গণহত্যা প্রতিরোধের এবং তাদের নেতার মুক্তির দাবিতে এককণ্ঠে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল।
তার বিপরীতে আজ ১ লক্ষেরও অধিক বাঙালি বা বাংলাদেশি নিরুপায়ভাবে তাকিয়ে থাকেন যখন ১৪ বা ১৫ অগাস্ট টরন্টোর রাস্তায় হাজার হাজার পাকিস্তানি বা ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা তাদের জাতির প্রতিষ্ঠাতা পিতা এম এ জিন্নাহ ও মহাত্মা গান্ধীর প্রতিকৃতি বহন করে টরন্টোর রাস্তা প্রদক্ষিণ করেন। আমাদের ব্যর্থতা আসে যখন আমরা 'সম্মিলিত' কোনও অনুষ্ঠানে এককণ্ঠে আমাদের ইতিহাস এবং বন্ধনমুক্তির গৌরবগাঁথা পাঠ করতে ব্যর্থ হই এবং আমাদের মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদী নায়কের প্রতিকৃতি বহন করতে আমাদের অক্ষমতা থেকে।
বস্তুত, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল অবধি বিএনপি-জামায়াত সরকারের যুগের সময় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছিল যেখান থেকে ১৯৭১ সালে এ মাটির সন্তানেরা কেন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল এবং ৩০ লক্ষ মানুষ কেন স্বাধীনতার বেদীমূলে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিল বর্তমান প্রজন্মের সদস্যদের জন্য সেটাকে প্রতিফলিত করা ছিল এক কঠিন কাজ।
বস্তুতপক্ষে, ২০০৭ সালে সরকার পরিবর্তন না হলে বিএনপি-জামায়াত আমাদের একমাত্র গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে যে বিস্মৃতির অতল গহব্বরে নিপতিত করেছিল সেখানে আমাদের জাতির জন্মের প্রকৃত ইতিহাস, প্রকৃতপক্ষে, একটি অজানা অখ্যাত উপলক্ষে পরিণত হতো।
আমার সুচিন্তিত বিশ্লেষণ, জিয়া পরিবার হলো বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস স্বীকার করার প্রধান অন্তরায়। আমার বিশ্বাস জিয়া পরিবারমুক্ত বিএনপিও হতে পারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সত্যতা স্বীকার করে নেওয়া আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি। আজকে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনীতিবিদেরা আওয়ামী লীগের প্রতি অভিমান বা কোনও কারণে বিরাগ হয়ে জিয়া পরিবার নিয়িন্ত্রত বিএনপি'র নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন, আসছে নির্বাচনে তাদের পরিকল্পনা হওয়া উচিৎ জিয়া পরিবারের কবল থেকে বিএনপি-কে মুক্ত করা, যার ফলে আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি হিসেবে এমন একটি দল গড়ে উঠবে যে দলটি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা ড. কামাল হোসেন চিঠির প্রথম বাক্য – "জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা" স্বত:সিদ্ধকে স্বীকার করে নিয়ে শুরু করতে পারে তাদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিভাজন, যেটা যে কোনও বহুদলীয় গণতন্ত্রের চিরপ্রচলিত পন্থা। আমি অধীর আগ্রহে সেদিনের প্রতিক্ষায় রইলাম।