Published : 28 Nov 2018, 06:40 PM
নির্বাচন যখন সমাগত তখন অনেক ঘটনা ঘটবেই। এমন সব খবর আসবে যাতে আমাদের হতাশ বা বিস্মিত হবার বিকল্প থাকবেনা। মনে আছে আমাদের যৌবনে একমাত্র টিভি বিটিভির রাত সাড়ে এগারোটার খবর দেখার কারণ ছিলো এই সব মজার ঘটনা দেখা। সে খবরে সন্ধ্যা অবধি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির জন্য জান দেয়া নেতাদের দেখা যেত রাতে ফুলের তোড়া আর ভাড়া করা মানুষজন নিয়ে যোগ দিচ্ছেন দুশমনের দলে। এই বিষয়ে পুরনো অনেক নেতার ও রেকর্ড আছে। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক বাকশাল করার প্রাক্কালে সাথে পেয়েছিলেন আবদুল মালেক উকিলকে। মালেক উকিল ঝানু রাজনীতিবিদ। তিনি ভালো জানতেন কখন কী করতে হয়! বাকশাল গঠনের জন্য সফরে বেরোনো রাজ্জাককে ট্রেনে তুলে দিয়ে সোজা চলে এসেছিলেন প্রেস ক্লাবে। রাজ্জাক ফরিদপুর পৌঁছানোর আগেই বলেছিলেন- ফরিদপুরের রাজ্জাককে ফরিদপুরের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তরুণ নেতা তুখোর বক্তা মিজানুর রহমান চৌধুরীও দল বদলেছিলেন বহুবার। পদ-পদবী জুটলেও বসন সামলাতে পারেননি- দিগম্বর করে দৌড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল জনগণ।
এ বিষয়ে মওদুদ আহমেদ তুলনাহীন। বিএনপির ডেলিগেট নিয়ে বিদেশ সফর করা ম ওদুদ সাহেব শুনলেন, তার একটা জরুরি কল এসেছে। তিনি জানতেন যদিও। দৌড়ে গিয়ে সে কল রিসিভ করার পর ডেলিগেট ডেলিগেশান সব পড়ে থাকলো পিছে আর তিনি ছুটলেন মন্ত্রী হতে। সোজা এরশাদের কোলে। এরশাদ পতনের দিন টিভিতে দেখেছি এরশাদকে উদ্বুদ্ধ করছিলেন নেমে যেতে। মুখে সহানুভূতির কপট ছায়া। অত:পর ? বিএনপির এমপি ও মন্ত্রী । এই যে এবার সংলাপ শেষ হলো সেখানেও তিনি দেন দরবার করেছিলেন। হারানো বাড়ি ফিরে পাবার আবেদনে সাড়া দেননি শেখ হাসিনা। দিলে কী হতো অনুমান করা কি কঠিন? বড় বড় নেতারাই যেখানে এমন সেখানে পাতি নেতারা যে দল বদলাবেন আর খবরে শিরোনাম হবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
এ যাবত সবচেয়ে কম অবাক হয়েছি একসময়ের তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদের ধানের শীষে নির্বাচন করার ঘোষণায়। মুজিব কোট পরিহিত লোকটি তখন তথ্য প্রতিমন্ত্রী। নিরানব্বই সালে সিডনি এসেছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নাগরিক সংবর্ধনার জমাট সন্ধ্যায় তার পাশে বসে বলেছিলেন, তিনি যদি শেখ হাসিনার গুণাবলীর ছিটেফোঁটাও বলেন- তাহলে নাকি রাত ভোর হয়ে যাবে। মোসাহেবির চরমতম নির্লজ্জ ভাষণে বঙ্গবন্ধু কন্যাও লজ্জা পেয়ে গেয়েছিলেন বলে তাকে থামতে হয়েছিল। এবারও নৌকার মাঝি হতে চেয়েছিলেন। পারেননি বলে সবুর করেননি। সোজা ধানের শীষ মার্কা নিয়ে নেমে গেছেন পাবনা ১ আসনে। পাবনাই উপযুক্ত জায়গা বটে। নেতারা যে কতোকিছু পারেন! কতোকিছু করে দেখান। সার্কাসের লোকজন আজকাল তাই ভাতে মরে। ভাবছি আবু সাইয়িদের সাফারি পরিহিত ছবি দেখবো কবে??
প্রায় অচেনা রনিকে নৌকা এনেছিল লাইম লাইটে। তারপর যা হয় তা। সমাজে রাজনীতি যেমন নেতাও তেমন বটে। মনে আছে মাওলা বনাম সালমানের লড়াইয়ের কথা। সালমান সাহেব মাওলার চাইতে অনেক পাওয়ারফুল। সে সময় রনিকে কারাগারেও যেতে হয়েছিল। কারাগারবাস নেতাদের জন্য দরকারি। এক সময় নেহেরু, সীমান্ত গান্ধী. গাফফার খান কিংবা বঙ্গবন্ধু কারাগারেই পার করেছেন বেশিরভাগ সময়। বাঙালি মণিষী শ্রী অরবিন্দ কারাগার মুক্তির পর দার্শনিক ও ঋষিতে রূপান্তরিত করেছিলেন নিজেকে। বঙ্গবন্ধু কারাগারে বাট্রান্ড রাসেল পাঠের পর কণিষ্ঠ পুত্রের নাম রেখেছিলেন রাসেল।
যারা মতলববাজ তাদের কারাগারবাস ভিন্ন। রনি তখন কাদের মোল্লার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। কারাগার থেকে ফিরে উচ্ছা ভাজিকে 'উষ্ট্রা ভাজি' লিখে আম জনতার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য লিখেছিলেন- 'কাদের মোল্লা নাকি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন'। এমনতরও হাজার কেচ্ছা-বানোয়াট গল্প আর কথা বলে নিজেকে আলাদা করতে থাকা রনি তখনও যাননি। বরং যেভাবেই হোক নৌকার টিকেট পেতে মরিয়া ছিলেন বলে এবার ও নমিনেশন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। ইন্টারভিউ ও দিয়েছিলেন।
মা বলতেন, এক বেড়ালের ওপর ইঁদুরদের ছিলো ভয়ানক রাগ। কিন্তু কিছুই করতে পারেনা তারা। একদিন দেখে কী দুধ চুরির অপরাধে সে বিড়ালকে গলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে । আনন্দিত ইঁদুররা মজা করে জানতে চেয়েছিল- কী হলো বেড়াল ভায়া? কই যাও? পরাজয়ে মানতে নারাজ বিড়াল নাকি উত্তর দিয়েছিল:
মাছ খাইনা মাংস খাইনা ধর্মে দিছি মন
তুলসিমালা গলায় দিয়ে চলছি বৃন্দাবন।
গোলাম মাওলা রনি 'মাওলা' নামের দিকে খেয়াল রাখেননি। গোলাম-ই হলেন শেষতক। কথা দিয়েছেন আমৃত্যু জাতীয়তাবাদের 'গোলাম' থাকবেন। আর ধানের শীষে ভোট করবেন। খবরে দেখলাম আহ্লাদিত মির্জা ফখরুল জানিয়েছেন, রনিকে পেয়ে নাকি তারেক জিয়াও খুব খুশি। রতনে রতন চিনবে এটাই স্বাভাবিক। মীরজাফর কত আগে ইন্তেকাল ফরমাইয়েছে, তারপর মোশতাকও গেছে- আছে শুধু গোলামের দল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এরা তো এখনও নবীশ। বড় বড় নেতাদের কি ঠিক আছে? খবরে দেখলাম ড. কামাল হোসেন বলছেন পিঠা ভাগ করতে গেলে যেখানে টানাটানি হয় সেখানে এমপি পদ নিয়ে টানাটানিতো থাকবেই। নেতার মতো কথা বটে। টানাটানি কিভাবে বন্ধ হবে বা কিভাবে সমঝোতা হবে, কিভাবে ঐক্যবদ্ধ থেকে রাজনীতি করা যাবে- সেটা বলুন । আর কতকাল এই পিঠাভাগ দেখবো আমরা?
তিনি দেখলাম বেশ রেগে আছেন। বললেন, এদেশ ষোল কোটি মানুষের। কোনও ব্যক্তি বা পরিবারের না। ইনডিকেশান ক্লিয়ার। কী বলতে চাচ্ছেন সেটা আমরা সবাই বুঝি। মানিও বটে। দেশ কেন কোনও পরিবারের হবে? যদি সে পরিবার হয় উটকো তবে তো আরো কথা নাই। পোস্টারগুলো ভালো করে দেখুন ড. কামাল হোসেন। একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি তার সুযোগ্য কন্যা আর জয়, অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের পাশে খালেদা জিয়া ফের তারেক রহমান। পারবেন বন্ধ করতে?
যদি না পারেন তো একদিকে আঙুল উঁচিয়ে কি লাভ? যে দলের হয়ে আপনার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু, যাদের খেয়ে পরে ভোটে-অভোটে মন্ত্রী হলেন- তাদের সাথে না থাকেন, এমন সব কথা বলার জন্য তাদের টার্গেট করলে বাকিরা কি ধোঁওয়া তুলসিপাতা? আপনারা যদি দেশ ও জাতিকে পরিবার বা দলমুক্ত করতে আসতেন তাহলে আরেক পরিবারের তালুবন্দি হতেন? ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতেন? খামোখা কথা বলে কী ফায়দা? এই যে বললেন- এ দেশ কোনও দলের না, এ কথাটা তিনবার বলতে হবে। আমার খুব ভালো লেগেছে এটা। আসুন আপনিই শুরু করুন, বলুন এদেশ আওয়ামী লীগ বা বিএনপির না। পারবেন বলতে?
সব মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি রাজনীতির আভাস । শুরু হয়ে গেছে দলবদল আর টিকেট পাবার ইঁদুর-লড়াই। আদর্শ বা নীতির রাজনীতি কোনওদিন মাথা তুলতে পারবে, এমনটা এখন আর মনে হয়না। ইয়াবা না থাকলে বৌ আছে। মাওলা না থাকলে গোলাম আছে। নেতা না থাকলে গড ফাদার আছে। এমনটাই চলছে চলবে। গুড লাক বেঈমানির রাজনীতি।