প্রয়াত শামসুজ্জামান খান নির্বাহী প্রধান থাকার সময়ে বাংলা একাডেমি আইনে কতগুলো সংস্কার আনা হয়। সংস্কারের ফলে প্রতিষ্ঠানটি নামকাওয়াস্তে স্বায়ত্তশাসিত হলেও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন আমলারা নানা সময়েই দৃষ্টিকটুরকম হস্তক্ষেপ করেন।
Published : 26 Jul 2024, 03:04 PM
বাংলা একাডেমির নতুন মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. হারুন-উর-রশীদ আসকারী। ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক ও অনুবাদক হারুন আসকারী উপাচার্য হিসেবে পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে মেয়াদ পূর্ণ করেছেন।
তবে বাংলা একাডেমির নির্বাহী প্রধান হিসেবে তার সামনে রয়েছে বিস্তর প্রতিকূল বাস্তবতা। হাল আমলে একাডেমিটি স্বায়ত্তশাসন খুইয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন আমলা-নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে অনেকটাই। এই প্রতিকূলতা একদিনে তৈরি হয়নি। প্রয়াত শামসুজ্জামান খান নির্বাহী প্রধান থাকার সময়ে বাংলা একাডেমি আইনে কতগুলো সংস্কার আনা হয়। সংস্কারের ফলে প্রতিষ্ঠানটি নামকাওয়াস্তে স্বায়ত্তশাসিত হলেও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন আমলারা নানা সময়ে দৃষ্টিকটুরকম হস্তক্ষেপ করেন, যা খবরের শিরোনাম পর্যন্ত হয়েছে।
প্রয়াত সভাপতি আনিসুজ্জামান দু-একবার আইন পরিবর্তনের তাগিদের কথা বলেছেন। তার প্রয়াণের পর ওই তাগিদ দেওয়ার মতো কাউকে আর দেখা যায়নি। পরিবর্তিত আইনে গলদ থাকলেও একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনায় স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছিলেন শামসুজ্জামান খান, একাডেমির মহাপরিচালক আর সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে। ওই সময়ে দৃশ্যমান কোনো ব্যত্যয় আমাদের গোচরে আসেনি। এর অন্যতম কারণ ছিল তার ব্যক্তিত্ব, একাডেমির কার্যক্রম নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার সুযোগ। শামসুজ্জামান খানের প্রয়াণের পর যে দুজন মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের ওই সুযোগ না থাকায়, একাডেমির কাঠামোগত দুর্বলতা এবং আমলাতন্ত্রের খবরদারির চিত্র দৃশ্যমান হতে থাকে।
একাডেমির নবনিযুক্ত নির্বাহী প্রধানকে এইসব বাস্তবতা মাথায় রেখে করণীয় ঠিক করতে হবে। এর জন্য শুরুতেই তিনি একটি সুদরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলা একাডেমি আইন সংস্কার ও স্বায়ত্তশাসন পুনরুদ্ধারে উদ্যোগী হতে পারেন। প্রয়োজনে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন।
বিগত একযুগ ধরে বাংলা একাডেমি পরিচালিত হচ্ছে কার্যনির্বাহী কমিটিতে সাধারণ সদস্যদের মাঝ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই। নবনিযুক্ত মহাপরিচালক প্রতিনিধি নির্বাচনের রেওয়াজটাও পুনরুদ্ধারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।
শামসুজ্জামান খান কতগুলো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েছিলেন; দু-একটি বাস্তবায়নও শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে মোটাদাগে উল্লেখ করা যায়, ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত স্বাধীন দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের পুনরায় প্রবর্তন, লেখক ক্লাব, লেখকদের জন্যে অতিথিশালা, আন্তর্জাতিক অনুবাদ প্রতিষ্ঠান স্থাপন। তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে সবগুলো উদ্যোগ থেমে যায়। সাবেক দুই মহাপরিচালক একাডেমির অবস্থান ব্যবহার করে ব্যক্তিগত প্রকাশনা, একাডেমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন কার্যক্রমের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত ব্যতিব্যস্ত থেকেছেন কিনা ওই প্রশ্নও তোলা যায়। এসবের কিছু কিছু সংবাদমাধ্যমেও এসেছে। একাডেমির সামনে করণীয় ঠিক করতে এহেন বাস্তবতাও খতিয়ে দেখার সুযোগ রয়েছে।
এই পর্যায়ে আমি বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পেছনের ইতিহাসে একটু নজর বুলাতে চাই। ধারণা করা যায় বাংলা একাডেমির স্বপ্নদ্রষ্টা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আমাদের একাডেমির কাঠামোগত বিষয়ে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ফরাসি একাডেমি থেকে। এখানে উল্লেখ্য যে, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ফ্রান্সে গবেষণার জন্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন ১৯২৬ সালে। ১৯২৮ সালে বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ নিয়ে গবেষণা করে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এর আগে ১৯২৫ সালে কলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে অনুষ্ঠিত এক সভায় শহীদুল্লাহ্ বাংলা ভাষায় জ্ঞানসাধনা ও সাহিত্যচর্চার প্রস্তাব করেন। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষ এবং বাংলা থেকে ব্রিটিশদের খেদানোর পরে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে মূল অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি একটি একাডেমি গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন।
ফরাসি একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে ১৬৩৫ সালে। ফরাসি একাডেমির মূল উদ্দেশ্য ভাষা ও সাহিত্যের মানদণ্ড রক্ষা করা। তার মূল উদ্দেশ্য থেকে একাডেমি যেমন বিচ্যুত হয়নি, তেমনি ফরাসি বিপ্লবের সময় ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৩ পর্যন্ত কয়েক বছর ব্যতীত এর কার্যক্রমে কোনো রকম ধারাবাহিকতাও বিঘ্নিত হয়নি। আমলাতন্ত্রের খবরদারির বিষয়টিও কল্পনাতীত। একাডেমির যাবতীয় রক্ষাকবচ বিদ্যমান আইনে রক্ষা করা হয়েছে অর্ধসহস্র বছর ধরে। অথচ, মাত্র সাত দশকে আমলাতন্ত্রের খপ্পর থেকে স্বকীয়তা বজায় রেখে, মুখ্য উদ্দেশ্য সাধনে কতটুকু দৃঢ় অবস্থানে আছে আমাদের বাংলা একাডেমি? এই প্রশ্নটি সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্দেশে রাখতে চাই।
সাবেক মহাপরিচালকদের কারও কারও মাঝে দেশে এবং দেশের বাইরে নানা তাৎপর্যহীন আয়োজনে অযাচিত অতিথি হবার প্রবণতা খেয়াল করা গেছে। এখানে সুইডিশ একাডেমির একটি রীতি সামনে নিয়ে আসতে চাই। এই একাডেমির স্থায়ী পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের মাঝ থেকে একজনকে স্থায়ী সচিব বা পার্মানেন্ট সেক্রেটারি হিসেবে নির্বাচন করা হয়। ধরে নেয়া যায়, এই স্থায়ী সচিব অনেকটা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের সমতুল্য। নির্বাচিত স্থায়ী সচিব দায়িত্বপালনকালে ব্যক্তিগত লেখালেখির প্রয়োজনে এবং একাডেমির কার্যক্রম বহির্ভূত কোনো কর্মযজ্ঞ বা আমন্ত্রণ, সভা, সেমিনার এড়িয়ে চলেন। অথচ আমাদের এখানে দেখা যায় ঠিক উল্টোটা, বিশেষ করে বিদায়ী দু-একজনের ক্ষেত্রে তো বিষয়টি রীতিমতো প্রশ্নবোধক!
নবনিযুক্ত মহাপরিচালক দায়িত্ব গ্রহণ করে যথার্থ বলেছেন, জাতির সাংস্কৃতিক বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির জন্য সবাই এই প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি এমন এক সময় এই পর্যবেক্ষণ দিলেন যখন আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ইংরেজির মিশলে এক 'খিচুড়ি' ভাষার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। স্থায়ী অভিধান সভা না থাকার কারণে অনেক বিদেশি শব্দের নিজস্ব পরিভাষা অনুপস্থিত, নতুন আবির্ভূত অনেক শব্দ যথাসময়ে অভিধানে ভুক্তি হিসেবে স্থান পাচ্ছে না। আদিবাসী ভাষাগুলো বিলুপ্ত হবার হুমকির মুখে। আমলাতন্ত্র এবং সংবাদ মাধ্যমে ভাষা ব্যবহারে বিশৃঙ্খলা। সর্বোপরি বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়টিও উপেক্ষিত। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে বাংলা একাডেমির কতটুকু আইনগত এখতিয়ার এবং প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য রয়েছে ওই প্রশ্নটি নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের মানুষদের সঙ্গে নবনিযুক্ত মহাপরিচালকের মতবিনিময় করার সংগত কারণ রয়েছে।
বাংলা একাডেমিকেই ভাষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতি আর বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের সকল দায় নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। দুনিয়ার কোনো একাডেমি ওই দায় নেয়ার সক্ষমতা রাখে না। তবে অনেক ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে, প্রস্তাবনা দিতে পারে, এমনকি অংশীদারিত্ব স্থাপন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সুইডিশ একাডেমি তাদের স্থায়ী অভিধান প্রণয়নের প্রয়োজনে লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একযোগে দীর্ঘ বছর কাজ করেছে।
বহুব্যবহার উপযোগী ব্যাকরণসিদ্ধ কোনো ডিজিটাল অভিধান আমাদের নেই। সেক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি লাগসই কর্মযজ্ঞের কথা বিবেচনা করে দেখতে পারে। জাতীয় ভাষা পরিষদ প্রতিষ্ঠা এবং বাংলা উন্নয়ন বোর্ড পুনর্প্রতিষ্ঠার আলোচনাটিও খতিয়ে দেখা দরকার। এই আলোচনার সূত্রপাত বাংলা একাডেমি শুরু করতে পারে।
নবনিযুক্ত মহাপরিচালক বাংলা একাডেমি ঘিরে আরও কিছু তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্গীকারের কথা বলেছেন। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ধারক ও বাহক বাংলা একাডেমিকে আন্তর্জাতিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান, বিশেষ করে অনুবাদ চর্চার মধ্য দিয়ে। তিনি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকর্মগুলো অনুবাদ এবং আন্তর্জাতিক প্রকাশনার মধ্য দিয়ে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চান। এক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই, আমাদের দেশের গোটা অনুবাদ জগৎ অনেকটা ইংরেজিনির্ভর এবং ইংরেজিআশ্রিত।
আমাদের আন্তর্জাতিক সাহিত্য বিনিময়ের উপায় হচ্ছে ইংরেজি থেকে বাংলা এবং বাংলা থেকে ইংরেজি। এই 'বন্ধকী' অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে আমাদের দেশের সাহিত্যের অন্য দেশে বাজার বা আগ্রহের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। অনুবাদ নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনায় আমরা যেন চিরাচরিত ইংরেজিনির্ভর পশ্চিমের দিকেই কেবল তাকিয়ে না থাকি।
ভারতবর্ষসহ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা কাছাকাছি হবার কারণে আমাদের বইয়ের বাজার সৃষ্টিতে এই রাষ্ট্রগুলো অগ্রাধিকার পেতে পারে। এশীয় অঞ্চলের প্রধান প্রধান ভাষা বিশেষ করে আরবি, ফার্সি, উর্দু, তামিল, নেপালি, সিংহলি, বার্মিজ, থাই, চীনা, কোরীয়, জাপানিজ ভাষা সাহিত্যের সঙ্গে অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের কার্যকর বিনিময় সম্ভব। প্রথমে আমাদের দেশে ক্রিয়াশীল দক্ষ অনুবাদকদের একটা সমীক্ষা হতে পারে। ওই সমীক্ষার পর আন্তর্জাতিক একাডেমি এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি, মতবিনিময় এবং প্রয়োজনে ঢাকায় একটি অনুবাদ সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা যেতে পারে।
এসবের সঙ্গে দরকার দেশে-বিদেশের অনুবাদকদের সঙ্গে একটি ক্রিয়াশীল যোগাযোগবলয় সৃষ্টি করা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রকাশক, দেশ-বিদেশের অনুবাদকদের জন্যে ফেলোশিপ চালু করা যেতে পারে। তবে অন্যান্য দেশে এ ধরনের কর্মসূচি গ্রন্থকেন্দ্র বা আর্টস কাউন্সিল বা জাতীয় সংস্কৃতি বিভাগ করে থাকে। তবে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা আর বিতর্ক অবারিত করে সকলের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে একসঙ্গে কাজ করে অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। একই সঙ্গে স্বাধীন একটি অনুবাদ এবং লেখক তহবিল প্রবর্তন করা যায়। এই কাজটি বাংলা একাডেমির এখতিয়ারের মধ্যে না থাকলেও, আলোচনা শুরু করলে লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব নয়।
স্বাধীনতার পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 'বঙ্গবন্ধু লেখক ট্রাস্ট' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ট্রাজেডির পর ওই ট্রাস্ট বিলুপ্ত হয়ে যায়। নবনিযুক্ত মহাপরিচালক ‘বঙ্গবন্ধু লেখক ট্রাস্ট’ পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার নিয়েও রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের সুরাহা করার জন্যে পুরস্কার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা এবং নিয়ম-নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। পছন্দের কাউকে কাউকে পুরস্কার দেওয়ার জন্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুরস্কার কাঠামোয় গোঁজামিলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এরকম একটি গোঁজামিলের উদাহরণ হচ্ছে পুরস্কারের জন্যে নির্ধারিত নাটক বিভাগকে 'নাট্যসাহিত্য' করে নাট্যকারের পরিবর্তে একজন চলচ্চিত্র পরিচালককে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। এরকম গোঁজামিল থেকেও বাংলা একাডেমিকে বের করে আনতে হবে।
প্রতিবছর পুরস্কার ঘোষণার সময় প্রতিটি পুরস্কার কাকে এবং কেমনতর সাহিত্যকর্মের জন্যে দেওয়া হলো, পুরস্কার কমিটির তরফে তার একটা লিখিত বিবৃতি প্রকাশ করা জরুরি। একইসঙ্গে দীর্ঘ সময়ে আর্কাইভে সংরক্ষিত পূর্বে ঘোষিত পুরস্কারগুলোর পেছনের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার দলিল-দস্তাবেজ অবমুক্ত করার বিষয়টি খতিয়ে দেখা যায়। আলোচনা, বিতর্কের সূত্রপাত হলেও এতে লেখালেখি পরিমণ্ডল প্রাণ ফিরে পেতে পারে।
পুরস্কার কমিটিতে যারা থাকবেন তাদের নামও গোপন রাখার কিছু নেই। গোপন থাকলেই বরং প্রশ্ন ওঠার সুযোগ বেশি থাকে এবং দায় এড়িয়ে যাওয়া সহজ। শেষতক সব দায় এসে পড়ে মহাপরিচালকের ওপর। আরেকটি দৃষ্টিকটু ব্যাপার, একাডেমিতে যারা কর্মরত আছেন, তারাও লাইন ধরে পুরস্কার নিচ্ছেন। ফরাসি একাডেমি, সুইডিশ একাডেমি, দিনেমার একাডেমি কিংবা দিল্লির সাহিত্য একাডেমিতে খোঁজ নিয়ে দেখুন এরকম দৃষ্টিকটু রেওয়াজ কোথাও আছে কিনা।
পুরস্কার ঘিরে বিগত বছরগুলোতে আরও একটা ক্ষতিকর ব্যাপার ঘটে গেছে। বয়স এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা আর সাংগঠনিক খবরদারি বিবেচনা করে পদধারী অনেক আমলা, রাজনীতি ও সংগঠন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তা-উপকর্তাদের বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এই প্রবণতা থেকেও বেরিয়ে আসা জরুরি।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো নিয়েও নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। বাজারি সাময়িকী বা দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা, ঈদ বা পূজাসংখ্যার আদলে যদি বাংলা একাডেমির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়, তাতে দেশের লেখালেখি জগতের কতটা উৎকর্ষ সাধিত হয় তা ভেবে দেখার দরকার আছে। একাডেমির পত্রিকায় দিনের পর দিন একচেটিয়া কবিতা, গল্প, উপন্যাস ছাপানোর চেয়ে সমালোচনা সাহিত্যে বিশেষ করে, বিতর্ক, দেশ-বিদেশের লেখালেখি নিয়ে তুলনামূলক আলোচনাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার আছে। পাশাপাশি পত্রিকাগুলোকে অনলাইনে পড়ার জন্যে অবারিত করে দেওয়া যায় কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
এই সময়ে বাংলা একাডেমির কর্মক্ষমতা নিয়েও পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। এখানে একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, স্বাধীনতার পর মযহারুল ইসলাম মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমির দায়িত্ব নেয়ার পর সারাদেশ থেকে বেশকিছু মেধাবী তরুণ প্রতিভাকে বাংলা একাডেমিতে যুক্ত করার সুযোগ অবারিত করে একাডেমির কর্মক্ষমতার আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রশীদ হায়দার, শামসুজ্জামান খান, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, সুব্রত বড়ুয়া প্রমুখ।
বইমেলার আয়োজনের কাজটি বাংলা একাডেমি প্রকাশনা সমিতির কাছে ছেড়ে দিতে পারে অথবা একাডেমির অধীনে স্বতন্ত্র একটি কোম্পানি করে দিতে পারে। বইমেলা চলাকালীন অনুষ্ঠানাদি, সেমিনার, সংলাপের মতো বিষয়গুলো বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধান থাকতে পারে। দুনিয়ার কোনো দেশের একাডেমিই মেলা আয়োজন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে না। একাডেমির আরও জরুরি অনেক কর্মযজ্ঞ রয়েছে। একই সঙ্গে প্রকাশনা এবং মুদ্রণ বিভাগকেও আলাদা কোম্পানি করা যেতে পারে। তবে সবকিছুর আগে জরুরি একাডেমির আইনগত সংস্কার এবং এর স্বায়ত্তশাসন পুনরুদ্ধার করা।
স্বায়ত্তশাসিত কি অধীনস্থ? সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের 'দাদাগিরিতে' ক্ষোভ