Published : 29 Sep 2017, 09:12 AM
Rome Statue ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইসিসি প্রসিকিউশন স্বপ্রণোদিতভাবে তাদের তদন্ত-সাপেক্ষে আইসিসিতে মিয়ানমার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করতে পারে। অনেকে অজুহাত দেখান যে, আন্তর্জাতিক আদালতে কোনো রাষ্ট্রের বিচার করতে গেলে তাদের সম্মতি নেওয়া জরুরি। কথাটি International Court of Justice (আইসিজে)এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আইসিজে হল জাতিসংঘের কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত একটি আন্তর্জাতিক আদালত– আইসিসি জাতিসংঘের কাঠামো অন্তর্ভুক্ত আন্তর্জাতিক আদালত নয়। আইসিসির কার্যক্রম পরিচালিত হয় ১৯৯৮ সালের Rome Statue অনুযায়ী। সুতরাং আইসিসিতে মিয়ানমারের বিচার করার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সম্মতি গ্রহণ জরুরি নয়।
এছাড়া এটি কিন্তু আইসিসিতে প্রসিকিউশনের পক্ষে স্বপ্রণোদিতভাবে তদন্ত কার্যক্রমের সূত্রপাতের প্রথম ঘটনা নয়। এর আগে ২০১০ সালে কেনিয়াতে, ২০১১ সালে আইভরি কোস্টে অথবা ২০১৬ সালে জর্জিয়াতে আইসিসি প্রসিকিউশন গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের বিষয়ে স্বপ্রণোদিতভাবে তদন্ত ও মামলার কাজ শুরু করেছে। তাই বিশ্ববাসীর উচিত হবে যথা দ্রুত সম্ভব আইসিসি প্রসিকিউশনের কাছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সংঘটিত গণহত্যা ইত্যাদি অপরাধ সম্পর্কে তথ্য, উপাত্ত ও প্রমাণের যোগান দিয়ে তাদেরকে মিয়ানমারের গণহত্যার তদন্তের সূত্রপাত ঘটানোর জন্য আবেদন জানানো।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে: এক, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর গণহত্যা ইত্যাদি অপরাধের বিষয়ে তথ্য, উপাত্ত এবং আইনি প্রমাণ আমরা কোথায় পাব? দুই, এই গণহত্যা ইত্যাদি অপরাধের বিষয়ে আমরা কার ওপর দায়ভার অর্পণ করব?
রোহিঙ্গা মুসলিম সমস্যার কারণ ও বর্তমান পরিস্থিতি অনুসন্ধানে জাতিসংঘের বিশেষ দূত মিস ইয়াংঘি লী এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২০-২৩ তারিখে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শন শেষে UN Office Of the High Commissioner for Human Rights (UNOHCHR) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে মিয়ানমারে যে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে চলেছে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
UNOHCHR রিপোর্ট অনুযায়ী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর সেখানকার সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং তাদের মদদপ্রাপ্ত উন্মত্ত জনতা নির্দ্বিধায় ব্যাপকভাবে গণধর্ষণ, শিশুহত্যা, নিষ্ঠুর শারীরিক নির্যাতন, গুম এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। ইয়াংঘি লী যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তাদের বেশিরভাগই স্বচক্ষে নিজ পরিবারের সদস্যদের নিহত হতে দেখেছে। অনেকের পরিবারের সদস্যরা এখনও উধাও রয়েছে। শিশুদের এমনকি যাদের বয়স ৮ বছর, ৫ বছর অথবা মাত্র ৮ মাস তাদেরকেও জবাই করে মেরে ফেলা হচ্ছে।
UNOHCHR এর রিপোর্টে আরও জানা যায় যে, ইয়াংঘি লী তাঁর পরিদর্শনের সময় মোট ১০১ জন নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তাদের অর্ধেকেরও বেশি দাবি করেন তারা মিয়ানমারে ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং বিভিন্ন প্রকারের যৌনহয়রানির শিকার হয়েছেন। একজন নির্যাতিতা নারী জানান যে, তাকে যখন মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা ধর্ষণ করছিল তখন তার ৫ বছরের কন্যা তাকে বাঁচাতে গেলে সেনাসদস্যরা শিশুটিকে হত্যা করে। ঠিক একইভাবে UNOHCHR রিপোর্টের মাধ্যমে জানা যায় যে, একজন নির্যাতিতা নারীকে ৫ সেনাসদস্য গণধর্ষণ করার সময়ই তার চোখের সামনে তার ৮ মাসের সন্তানকে হত্যা করে।
UNOHCHR রিপোর্টে প্রকাশ পায় যে, হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়িঘর, স্কুল, হাট-বাজার, দোকান, মাদ্রাসা এবং মসজিদ পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। তাদের খাদ্যশস্য, ক্ষেতখামার এবং গবাদি পশুসমূহ লুট করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাদের বাসস্থান এবং দেশ থেকে জবরদস্তি বিতাড়ন করা হচ্ছে। অতিসম্প্রতি মালায়শিয়ার আন্তর্জাতিক গণআদালতের রায় অনুযায়ী, মিয়ানমারের সেনাসদস্য, পুলিশ এবং তাদের মদদপ্রাপ্ত জনগণ রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধসহ নানা প্রকার ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটন করছে।
এই গণআদালতে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার বিষয়ক অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নানা রকম তথ্য-উপাত্ত, এমনকি ভুক্তভোগী রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষে জবানবন্দিও লিপিবদ্ধ করা হয়। এই সকল কিছুর ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক গণআদালত মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করে তার রায় ঘোষণা করে।
এদিকে আমাদের দেশি এবং বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীরা নিয়মিতভাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের উপর রিপোর্ট প্রকাশ করে চলছেন। বর্তমানে ৮ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তাদের লিখিত বক্তব্য, অডিও ভিজ্যুয়াল ফুটেজ সংগ্রহ করে আইসিসি প্রসিকিউশনের কাছে দাখিল করা যেতে পারে। সুতরাং রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার রাষ্ট্রের গণহত্যা, নির্যাতনসহ অন্যান্য অপরাধের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত বা প্রমাণাদির অভাব হবে না।
এখন প্রশ্ন হল, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর সংঘটিত অপরাধের দায়ভার কার উপর বর্তাবে? মূলত, আমরা জানি, অপরাধগুলো সংঘটনের পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং তাদের মদদপ্রাপ্ত মিয়ানমারের উন্মত্ত জনতা। Rome Statue অনুযায়ী অপরাধীদের উপর দুই ধরনের দায়ভার অর্পণ করা যায়: ১. ব্যক্তিগত অপরাধের দায়ভার (Individual Criminal Responsibility) এবং ২. ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়ভার (Superior Responsibility).
আমরা দেখেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে প্রথম দফাতেই নেতৃস্থানীয় অপরাধীদের বিচার শুরু করা হয়। এরপর আমরা দেখি, সরাসরি Superior Responsibility এর জন্য ম্যানিলা ট্রাইব্যুনালে জেনারেল ইয়ামাশিতার মৃত্যুদণ্ড হয়। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে আমি মনে করি, রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছে তার দায়ভার সেদেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের উপরে বর্তায়। সে ক্ষেত্রে যে ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করা উচিৎ তারা হল: মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হিলেইং (Senior General Min Aung Hlaing), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল কায়া সুই (Lt. General Kyaw Swe), প্রতিরক্ষামন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেইন উইন (Lt. General Sein Win) এবং সীমানা-সংক্রান্ত মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়ে অং (Lt. General Ye Aung)।
অনেকে প্রশ্ন করেন যে, আন্তর্জাতিক বিশ্ব কি মিয়ানমারের উপরে শুধুমাত্র কূটনৈতিক চাপই সৃষ্টি করবে না কি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করলে তা কূটনৈতিক তৎপরতা ব্যাহত করবে? আমি মনে করি, মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক বিশ্বের সব ধরনের চাপ প্রয়োগ জরুরি এবং তা একইসঙ্গে করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে আমি বলতে চাই যে, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের সমস্যার আইনি সমাধান হয়েছে কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি। আর তাই আশা করি, একইসঙ্গে মিয়ানমারের উপর সর্বাত্নক চাপ প্রয়োগ করার মাধ্যমে আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা মুসলমান সমস্যার স্থায়ী সমাধান পাব।