Published : 09 Aug 2017, 09:57 AM
আজ 'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস' যাকে জাতিসংঘ (রাষ্ট্রসংঘ!) অফিসিয়াল নামকরণ করে International Day of the World's Indigenous Peoples বা 'বিশ্ব আদিবাসী মানুষের আন্তর্জাতিক দিবস'। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের মিলিয়ন মিলিয়ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার ঘোষণা করা হয় যা United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples নামে গৃহীত হয়।
প্রতি বছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘ কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে একটা ঘোষণা দেয় যাতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো দিবসটি পালন করে এবং নিজ দেশের চাহিদা অনুযায়ী নীতিমালা নির্ধারণ করে। যেমন ২০১৬ সালের ঘোষণা ছিল, 'আদিবাসীদের শিক্ষার অধিকার' (Indigenous Peoples' Right to Education), ২০১৫ সালের ঘোষণা ছিল '২০১৫ উত্তর এজেন্ডা: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও কল্যাণচিন্তা' (Post 2015 Agenda: Ensuring indigenous peoples' health and well-being), ২০১৪ সালের ঘোষণা ছিল 'ঘাটতি দূরীকরণ: আদিবাসীদের অধিকার বাস্তবায়ন'(Bridging the gap: implementing the rights of indigenous peoples) এবং ২০১৩ সালের ঘোষণা ছিল 'আদিবাসী মিডিয়া' (Indigenous Media)।
কিন্তু ২০১৭ সালের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের ঘোষণা হচ্ছে, 'জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী অধিকারের দশ বছর পূর্তি' (10th Anniversary of the UN Declaration on the Rights of Indigenous Peoples)। এটা কেবল একটা শিরোনাম বা বাৎসরিক ঘোষণা নয়। জাতিসংঘ কর্তৃক 'আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রের' দশ বছর পূর্তি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার একটা চেহারা উপলব্ধির বাসনা থেকেই এ ঘোষণা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের 'মতামত' পাতায় গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিতভাবে বিশ্ব আদিবাসী দিবসে বাংলাদেশের আদিবাসীদের নানান দিক, তাদের আত্মপরিচয়ের সংকট, পরিচয়ের রাজনীতি, তাদের আদিবাসী আন্দোলন, রাষ্ট্রের সঙ্গে নানান টানাপোড়েন এবং আন্তর্জাতিক আদিবাসী অ্যাকটিভিজমের সঙ্গে স্থানীয় অ্যাকটিভিজমের যোগাযোগ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছি। কিন্তু আজকে জাতিসংঘ কর্তৃক উপস্থাপিত ২০১৭ সালের আদিবাসী দিবসের 'ডাক' বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস্তবিক এবং প্রায়োগিক হাল-হতিকতের একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার চেষ্টা করব। দীর্ঘদিনের মাঠকর্মের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং অতিসাম্প্রতিক কিছু নগদ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আদিবাসীদের বর্তমান অবস্থা, নানান সমস্যা এবং সংকটের একটা 'আদিবাসী ভূগোল' সে সঙ্গে উপস্থাপন সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে প্রধানত চারটি ভৌগোলিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এক, উত্তরবঙ্গের (দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা প্রভৃতি) আদিবাসী যার অন্যতম হচ্ছে সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওরাং, মাহাতো, কোড়া, কাদর প্রভৃতি। দুই, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা অঞ্চলের গারো, কোচ, খাড়িয়া, বর্মণ এবং ডালু প্রভৃতি আদিবাসী। তিন, সিলেট-মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জের আদিবাসী জৈয়ন্তা, মণিপুরি, খাসিয়া, হাজং, লালেং, পাত্র প্রভৃতি। চার, পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তনচংঙ্গ্যা, বম, খুমি, খেয়াং, ম্রো, পাংখোয়া প্রভৃতি।
উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের প্রধান সমস্যা ভূমি। শত শত বছর ধরে তারা যেসব ভূমির মালিকানা বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকারসূত্রে সংরক্ষণ করছে, সেসব বাঙালি ভূমিদস্যুরা নানান বাহানায় দখল করে নিচ্ছে। দুর্নীতিগ্রস্ত স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা, কেন্দ্রীয় রাজনীতির যোগসাজস এবং পেশিশক্তির বলে আদিবাসীদের বংশপররম্পরায় স্থানান্তরিত ভূমি চলে যাচ্ছে বাঙালি ভূমিদস্যুদের হাতে। সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওরাংদের জীবনের প্রধান সমস্যা তারা ক্রমান্বয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি দিনাজপুরের বিরলে বসবাসরত কোড়াদের চরম দুরবস্থা। ভূমি বেদখল হতে হতে এখন মাত্র আঠারটি কোড়া পরিবার (যাদের সর্বমোট সংখ্যা ৮২ জন) কোনোরকমে টিকে আছে। অথচ দশ বছর আগেও এদের পরিবার ছিল ২০০ আর জনসংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজারের মতো। এভাবেই ভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে হতে এখন তাদের অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার উপক্রম।
অতিসম্প্রতি সাহেবগঞ্জ এবং বাগদাফার্মের ঘটনা আমরা জানি। ভূমিদখল কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় পুলিশের গুলিতে মারা যায় শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু যে হত্যাকাণ্ডের এখনও বিচার হয়নি। ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে প্রায় ২৫০০ সাঁওতাল পরিবারকে উদ্বাস্তু করে ফেলা হয়েছে। এভাবে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা নিজের পৈত্রিক ভিটেমাটিতে বসবাস করার অধিকার পর্যন্ত হারাতে বসেছে।
একই সমস্যা বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা অঞ্চলের আদিবাসী কোচ, খাড়িয়া, বর্মণ, ডালু ও গারোদের। এসব অঞ্চলের গারো আদিবাসীদের একটা বড় অংশ এখন আদি পৈত্রিক ভিটামাটি ছেড়ে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলোর স্থানীয় অভিবাসী হিসেবে দিনযাপন করছে। সরকারি আর বেসরকারি ভূমিদখলের অব্যাহত প্রতিযোগিতায় হাজার হাজার গারোর জীবন ও জীবিকা সংকটাপন্ন।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬৫ সালে ন্যাশনাল পার্কের নামে গারোদের ৪২,০০০ একর জমি সরকারিভাবে দখল করে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ আমলে ১৯৮৬ সালে সেই ন্যাশনাল পার্কই 'মধুপুর ইকোপার্কের' নামে প্রায় ৩০,৮৩৭ একর জায়গা সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করা হয়। যার কারণে হাজার হাজার গারো বাস্তুচ্যুত হয়। ২০০২ সালে থেকে ইকোপার্কের কার্যক্রম শুরু হয়। অতিসম্প্রতি, ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৯১৪৫ একর জমি রিজার্ভ ফরেস্টের নামে সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করা হয়। এভাবে বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো আদিবাসী মানুষ ভূমি ও বন দুটোই ক্রমান্বয়ে হারিয়ে জীবন-জীবিকার চরম সংকটে আপন্ন।
সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটা স্বতন্ত্র ভূমি কমিশনের দাবি দীর্ঘদিন ধরে তোলা হচ্ছে আদিবাসীদের পক্ষ থেকে। অথচ রাষ্ট্র এ বিষয়ে কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। ওদিকে আদিবাসী জনগণ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক হওয়ার কারণে বাঙালি ভূমিদস্যুদের কাছে ক্রমান্বয়ে ভূমি হারিয়ে উদ্বাস্তু ও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
সিলেট-মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জের আদিবাসীদেরও অন্যতম প্রধান সমস্যা ভূমি এবং জীবিকার প্রশ্ন। মণিপুরি, জৈন্তা, খাসিয়া এবং হাজংরা দিন দিন তাদের সনাতন পেশা ছেড়ে এখন সিলেটসহ বড় বড় শহরগুলোতে দিনমজুরের কাজ করে। ভূমি বেদখলের অভিজ্ঞতা এদেরও একটা বড় সমস্যা।
এর বাইরে রয়েছে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত আন্তঃসীমান্ত চুক্তির নানান নেতিবাচক প্রভাব যার অন্যতম হচ্ছে ভূমি বেদখল। তাছাড়া, ভারতের মেঘালয়ে প্রতিষ্ঠিত ও বেসরকারিভাবে পরিচালিত উন্মুক্ত কয়লা খনির কারণে খাসিয়া, জৈন্তা এবং হাজংদের অন্যতম পেশা 'পানের বরজ' প্রায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের কাছে প্রতিকার চাওয়া হয়েছে। কার্যত কিছুই হয়নি। ফলে, ভূমি হারানোর পাশাপাশি নিজের পেশাতেও আদিবাসী মানুষ অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
এরকম ভূমিহীনতা ও পেশাহীনতার সংকট পুঁজি করে চলছে ব্যাপক হারে ধর্মান্তরকরণের প্রক্রিয়া যা আদিবাসী সমাজের নিজস্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ক্রমান্বয়ে সংকটের মুখে ফেলে দিচ্ছে। ধর্মান্তরকরণ সবসময় ছিল। তবে বর্তমানে সেটা প্রকট এবং আশংকাজনক আকার ধারণ করেছে বলে অনেক আদিবাসী নেতা মনে করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের সমস্যার তো অন্ত নেই। ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য পাহাড়ি আদিবাসীদের একটি রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি দীর্ঘদিন আন্দোলন করছে। কিন্তু পাহাড়ে কাঙ্ক্ষিত শান্তি আসছে বলে মনে হয় না। কিছুদিন পরপর বাঙালি বনাম পাহাড়ি সংঘাত এবং পাহাড়ি বনাব পাহাড়ি সংঘাত আমরা দেখতে পাই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও অদ্যাবধি তা হয়নি। ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান ভূমি-সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধানও দূরের পথ। ত্রিপুরা থেকে প্রত্যাগত শরণার্থীদের যথাযথভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেবার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। স্থানীয়ভাবে উদ্বাস্তুদের দীর্ঘস্থায়ী পুনর্বাসনের উদ্যোগও দেখতে পাইনি আমরা। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নের্তৃবৃন্দের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন লেগেই থাকে। পাবর্ত্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের হাতে অর্পণ করার কথা ছিল।
এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একটি বড় সমস্যা আকারে সর্বদা উপস্থাপিত হয়। এ বছর চুক্তি স্বাক্ষরের বিশ বছর পূর্তি হবে। এত দিন পরও চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য পাহাড়ি আদিবাসীদের আন্দোলন করতে হয়, এটা দুঃখজনক।
এভাবেই বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় তিরিশ লক্ষ আদিবাসী জনগোষ্ঠী আত্মপরিচয়ের সংকটের পাশাপাশি নিজস্ব আঞ্চলিক রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক সীমানায় নানান ধরনের সমস্যার সম্মুখীন। এরকম একটি পরিস্থিতিতে 'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস' পালনের গুরুত্ব এবং কার্যকারিতা নিয়ে নানান মাত্রার আলোচনা করা যায়।
সংক্ষেপে শুধু এতটুকু বলব, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন আদিবাসীদের প্রতিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, ভূমি ও ফরেস্টের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আত্মমর্যাদা এবং অংশিদারিত্বের পথ সুগম হওয়ার পথে, সেখানে বাংলাদেশের আদিবাসীরা বহুমাত্রিক সমস্যায় জর্জরিত। এমনকি বাংলাদেশ আদিবাসীদের সাংবিধানিক এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকারই করে না। তাই আজকে বিশ্ব আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত 'আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রের দশ বছর' পূর্তিতে প্রধান দাবি হোক তিনটি–
(১) আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে; (২) সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে; (৩) অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশের সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বিশ্ব আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা।