Published : 27 Oct 2022, 01:20 PM
সাংবাদিকতা সম্পর্কে আমার প্রথম ধারণা জন্মে নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেমসাহেব’ উপন্যাসটি পড়ে। হাই স্কুলে পড়ি তখন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে যাই। সেখানেই এক বন্ধু ‘মেমসাহেব’ পড়তে দিয়েছিল আমাকে। উপন্যাসের নায়ক খবরের কাগজের রিপোর্টার, তার জবানি পড়তে গিয়ে ওই সময়ে আমার অপরিণত কল্পনায় ধরা দিয়েছিল একটা খবরের কাগজের অফিস হয়তো আমাদের স্কুলভবনের মতোই হবে!
স্রেফ ইউটোপিয় এ ধারণা টিকে ছিল বহুদিন। তারও বহুবছর পর পড়াশোনা শেষে দুই-একটা চাকরি করে যখন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ এলাম, আমার ওই কল্পনার আরেকটা সংস্করণ যেন পেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু-অগ্রজ অনেকের কাছেই জেনেছিলাম ‘বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম হচ্ছে আঁতুড়ঘর/ শেখার জায়গা’ এমন কিছু ইতিবাচক কথা। আবার কবিতা লিখি বলে অনেকে নিরুৎসাহিত করেছে এই বলে যে, ‘সাংবাদিকতা করলে সৃজনশীলতা নষ্ট হয়, সাংবাদিক হলে জীবনে আর কিছু হওয়া যায় না’ ইত্যাদি। কেবল জীবিকার প্রয়োজনেই প্রায় সাত বছর আগে আমি এখানে এসেছিলাম। কিন্তু পেশার সঙ্গে সাহিত্যচর্চার সংযোগ ঘটিয়ে দিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, কাজের সঙ্গে যোগ হলো শেখার ও জানার আনন্দ।
অফিসে আমার বসার জায়গা যেহেতু বার্তাকক্ষ, একটা পত্রিকা অফিসের পুরো উত্তাপ পাওয়া শুরু করলাম। নিজে মিতবাক হলেও চারপাশ থেকে সহকর্মীদের কি-বোর্ডে আঙুল চালানোর শব্দ, কাজের মাঝে নিজেদের মধ্যে সংবাদের পরিভাষায় কথোপকথন, কাজের তাড়া আবার কিছুক্ষণ পর নীরবতার শ্বাস আমার কানে ভেসে আসতে লাগল। সংবাদ সম্পাদনা শেখার মাধ্যমে জানতে লাগলাম শব্দ কীভাবে মানুষের লক্ষ্যের অনুবর্তী হয়। যে শব্দে কবিতা হয়, উপন্যাস হয়, ওইসব শব্দে সংবাদও হতে পারে, কেবল ব্যাকরণ পাল্টায়, আঙ্গিক বদলায়। সংবাদও হতে পারে ক্রিয়েটিভ নন-ফিকশন, বিশেষ করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো। বার্তাকক্ষের জ্যেষ্ঠদের কাছে শিখতে লাগলাম সাহিত্য ও সংবাদ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক এবং ঘটনা ও কল্পকাহিনির (ফ্যাক্ট অ্যান্ড ফিকশন) মধ্যে সম্পর্ক ও দ্বন্দ্ব। সাংবাদিকতার ছাত্র না হয়েও আমি তাকে কেবল শব্দ-বুনন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। এই অফিস আমার কাছে যেন কল্পনার সেই স্কুল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ হলেও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর আমাকে চিন্তা করতে শিখিয়েছে ছাত্রত্ব ব্যাপারটি নিত্য, কখনও শেষ হয় না। এখানে সহকর্মীই শিক্ষক, প্রত্যেকে নিজেকে প্রকাশ করার আগে সমৃদ্ধ হন। উপলব্ধি যখন এখনও পূর্ণ নয়, তখন বারবার সত্য অনুসন্ধানই সৃষ্টির শেষ কথা। গত ২৩ অক্টোবর ১৬ বছরের পথচলা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে চলা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তাই ‘সাংবাদিকতার স্কুল’, আমাদের বলিষ্ঠ আশাবাদের চিহ্ন। তার ষোড়শ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন সন্ধ্যায় অফিসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাংবাদিকতা ও সাহিত্য জীবন নিয়ে অল্প কিছু কথা বলেছিলাম, আরও যা বলতে পারিনি সেগুলো স্পর্শ করার চেষ্টায় আজকের এ লেখা।
আইরিশ লেখক অস্কার ওয়াইল্ডের একটা কথা আছে এমন- ‘সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার মধ্যে পার্থক্য হলো সাংবাদিকতা অপাঠ্য এবং সাহিত্য অপঠিত।’ অস্কার নিজেকে কেবল শিল্পী হিসেবে দেখতেন এবং সাহিত্য সমালোচক-সাংবাদিকদের থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। তিনি লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি চার বছর রাজত্ব করেন, কিন্তু সাংবাদিকতা চিরকালের জন্য শাসন করে।... যা জানার যোগ্য তা ছাড়া সবকিছু জানার জন্য জনসাধারণের অতৃপ্ত কৌতূহল রয়েছে। সাংবাদিকতা এই বিষয়ে সচেতন, তার ব্যবসায়ী মনোভাব তাদের চাহিদার যোগান দেয়।...ব্যর্থতা সত্ত্বেও, সাংবাদিকতার পক্ষে অনেককিছু বলার আছে- অশিক্ষিতদের মতামত ছাপিয়ে সাংবাদিকতা সমাজের অজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ তৈরি করে দেয়।...সেইদিন ছিল সর্বনাশা দিন, যখন মানুষ আবিষ্কার করল যে কলম পাথরের চেয়ে শক্তিশালী এবং ইট-পাটকেলের মতো আপত্তিকর হয়ে উঠতে পারে। তারা তৎক্ষণাৎ সাংবাদিকের খোঁজ করল, তাকে খুঁজে পেল, গড়ে তুলল এবং পরিশ্রমী ও ভালো বেতনের চাকর বানিয়ে ফেলল। উভয়ের জন্যই খুব আফসোস করতে হয়।’
অস্কার ওয়াইল্ড নিজেও একসময় নারী বিষয়ক একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। হতে পারে তার সময়ে আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ শাসন নিয়ে, কলোনিয়াল রুল ও তার তাবেদার সাংবাদিকতায় বিরক্তি থেকে তিনি এসব বলেছেন। তবে এ বাস্তবতা এখন এই বাংলাদেশেও আছে। একটি সংবাদপত্র সংবাদ পরিবেশক না হয়ে কীভাবে কোনো নির্দিষ্ট পুঁজি সম্প্রসারণ ও তার খারাপ কাজের পক্ষে মজুরের ভূমিকা পালন করে তা আমরা দেখি। কিন্তু এর বিরুদ্ধে লড়াই করে কেউ কেউ। সংবাদ পরিবেশনের কারণে একবার বন্ধ করে দেওয়া হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর, আরেকবার বিনিয়োগ আটকে দেওয়া হয়, তবু নানা শঠতা মোকাবিলা করে টিকে থাকতে তার একমাত্র শক্তি হলো ওই সংবাদই। সময়ে অনেক কিছু বদলায়, কিন্তু সংবাদ রোপন করে সামাজিক শক্তি।
বাংলা সাহিত্যে সেরা অনেক গদ্য সাংবাদিকরাই বেশি লিখছেন। কারণ হতে পারে, সাহিত্যিকদের সাংবাদিক হওয়ার নজির। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক– উভয়ের উপজীব্য হলো পৃথিবীর ঘটনাস্রোত। একজন সাহিত্যিক হলেন শব্দ বা কলমশিল্পী, সাংবাদিকেরও শব্দশিল্প জরুরি। কবিতা-উপন্যাস লেখেন না, কেবল সাংবাদিকতা করেন– এমন অনেক সাংবাদিকের প্রতিবেদন যেন উজ্জ্বল সাহিত্য হয়ে ওঠে। আমি তো মনে করি সাহিত্যিকদের সাংবাদিকই হতে চাওয়া উচিত। প্রথমত দুটোই লেখালেখির বিষয়, দ্বিতীয়ত দুজনের পক্ষে জীবনের ঘটনাবলীর বিবরণ দেওয়ার একটা সুযোগ পাওয়া যায় এতে। সাহিত্যিক যদি প্রতিবেদক হন, তাহলে আরও ভালো। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধের (১৯৩৬-১৯৩৯) সময় রিপোর্টার ছিলেন, গোলাগুলির মধ্যেও সেনাদের মাঝে চকোলেট বিলিয়ে বেড়াতেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি লিখলেন উপন্যাস ‘ফর হুম দ্য বেল টোলস’ (১৯৪০)। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘নিউজ অফ আ কিডন্যাপিং’ (১৯৯৬) কিংবা খুনি গ্যারি গিলমোরের জীবন অবলম্বনে নরম্যান মেইলারের লেখা ‘দ্য এক্সিকিউশনারস সং’ (১৯৭৯) সাহিত্য-নির্ভর প্রতিবেদন বলা চলে। মার্কিন সাহিত্যে ‘নিও জার্নালিজম’ ধারার প্রবর্তন করেছিলেন মেইলার, এ ধারার লেখকরা সত্য কাহিনিকে উপন্যাস বানিয়ে ফেলতে পারেন।
একজন সাহিত্যিকের লেখালেখির জন্য কেবল নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট নয়। তাকে আরও অনেকের জীবন ধার করতে হয়, সেই জীবন যাপন করে দেখতে হয়। তাই দরকার সাহচর্য বা ভ্রমণ বা পাঠের অভিজ্ঞতা। সাংবাদিকতা একসঙ্গে ওইসব সুযোগ তৈরি করে দেয়। কোনো একটি ঘটনাকে তিনি বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারেন না, ব্যক্তিমানুষের পরিধিতে নির্দিষ্ট করে আর দেখেন না। তার চোখ সমগ্রকে দেখে, ঐতিহাসিক সত্যে দ্বিমত করেন না। আবার আমরা যারা সাব-এডিটর, তাদের কাজ সাহিত্যিক মনমেজাজ চাপা রেখে কেবল সম্পাদনা, সম্পাদনার মধ্যে দিয়ে খবরকে পলিশ করে পরিবেশনা। কবিতায় যেটা হয়– হৃদয় দিয়ে লেখা কবিতা আসলে দুর্বল কবিতা হয়ে পড়ে। উৎকৃষ্ট কবিতা হলো ঊন অনুভূতির শিক্ষিত সংস্করণ। তাই উৎকৃষ্ট কবিতা মানে সুসম্পাদিত কবিতাই। তেমনই সংবাদ কেবল ভাষা বা গদ্যের ব্যাপার মনে হলেও এর মধ্যে রয়েছে নৈব্যক্তিক অভিব্যাক্তি। একটা ঘটনার সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। পানির মতো বোঝা যায়, কিন্তু মাথায় বোঝার মতো চেপে বসে না। এটাও সাহিত্যের একটা বড় উপাদানের চর্চা। ম্যাথু আর্নল্ড যেমন লিখেছেন, ‘সাংবাদিকতা হলো হুট করে লেখা সাহিত্য’।
আবার কেবল তথ্যের সন্নিবেশ জ্ঞান তৈরি করে না, তাই প্রয়োজন নতুন আঙ্গিক। সাহিত্যিক আর সংবাদিকের গদ্যের আঙ্গিক আলাদা। একটা সাবজেকটিভিটি, আরেকটা অবজেকটিভিটি। অনেক সময় সংবাদ সম্পাদনা করতে গিয়ে আমার আঙুলে গল্প চলে আসে, অনেকের উল্টোটাও হতে পারে। কিন্তু কিছু খবরের বেলায় বলতে হয় সেগুলো সাহিত্য হয়ে উঠতে না পারলে পাঠক নিরাশ হন, কেবল তথ্য চায় না পাঠক, তারা চায় গল্পটা। সংবাদকে বিশ্বাসযোগ্য করতে সাংবাদিক যেমন বর্ণনা ব্যবহার করেন, কথাসাহিত্যেও তাই। আবার এও সত্য সব খবরকে সাহিত্য করাও অনুচিত। পুরো বিষয়টা নির্ভর করছে সাহিত্যিকের মন ও আঙুলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং গাণিতিক পরিশীলিততা অর্জন। উৎকৃষ্ট সাহিত্য বারবার পড়া যায়, সংবাদও যাতে একবার পড়ে ছুড়ে ফেলতে না হয়, তেমন ‘ক্রিয়েটিভ জার্নালিজম’-এর ভাষাগত কৌশলও প্রয়োজন।
‘মেমসাহেব’ উপন্যাসের শুরুর মতোই একজন সাংবাদিকের জীবন কঠোর পরিশ্রমের, খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের কাছে পাওয়া অনুপ্রেরণা আর আত্মত্যাগের। সব মিলে গোটা জীবন। আমি একবার এক সাহিত্য পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম পুরস্কার আনতে। বেশ আড়ম্বর ছিল। পুরস্কার হাতে নিয়ে নিজের অনুভূতি জানাতে যখন মঞ্চে দাঁড়ালাম তখন বক্তব্যের মাঝে খেয়াল করলাম আমার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে উপস্থিত। শুধু তাই নয়, উনি সেদিন আমার পুরস্কার নেওয়ার ও বক্তব্য দেওয়ার ছবি তুলেছিলেন এবং নিজেই অনেকটা রিপোর্টারের ভূমিকায় ছিলেন।
অনুজ কর্মীর সামান্য সাফল্যে প্রধান সম্পাদকের এমন ভূমিকা অনুপ্রেরণা জাগায়। আমাদের সাবেক-বর্তমান সহকর্মীদের কাছে এমন আরও সত্য গল্প পাওয়া যাবে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আমাদের কাছে এমনই ‘সাংবাদিকতার স্কুল’। সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পাঠককেও সত্যনিষ্ঠ করে তোলে। এ সামাজিক দায় অর্থের-কারবারি বুদ্ধির নয়, চিরায়ত মননশীলতার।