ফুটবলের বরপুত্রকে খোলা চিঠি

রাজনীতি আমাদের সুখ দেয়নি, সংসার আমাদের স্বস্তি দেয়নি, খোদ প্রেয়সীও মনি-কাঞ্চনের অভাবে ছেড়ে গিয়েছে আমাদের! তুমিই শেষ পর্যন্ত আমাদের মুখে হাসি ফোটালে। ৩৬ বছরে ট্রফি না জেতা নীরব অশ্রু মুছে দিলে।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 19 Dec 2022, 06:35 PM
Updated : 19 Dec 2022, 06:35 PM

প্রিয় নায়ক, ফুটবলের বরপুত্র, ফুটবল জাদুকর মেসি, যে বয়সে প্রেমিক ভালোবাসে প্রেমিকাকে, সেই বয়সে আমরা অনেকে ভালোবেসেছি তোমাকে। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ উজাড় করা সেই ভালোবাসা! আমাদের পেটে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই, দেখার মতো ভালো স্বপ্ন নেই, তবু আমরা ফুটবল প্রেমে মজেছি অকাতরে। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে অবস্থিত আর্জেন্টিনাকে ভালোবেসেছি। সমর্থন করেছি। আসলে ঠিক আর্জেন্টিনা নয়, ভালোবেসেছি তোমাকে, আর তাই ভালোবেসেছি তোমার দেশ আর্জেন্টিনাকে! তোমাকে ভালোবাসার পর অনেক সময়ই মনে হয়েছে, আমরা কি তোমাকে ভালোবাসার যোগ্য? আমাদের যে কিছুই নেই ভালোবাসাটুকু ছাড়া!

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মানসী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘গুপ্ত প্রেম’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘তবে পরানে ভালোবাসা কেন গো দিলে রূপ না দিলে যদি বিধি হে!/পূজার তরে হিয়া উঠে যে ব্যাকুলিয়া,/ পূজিব তারে গিয়া কী দিয়ে!’ হ্যাঁ, রবি ঠাকুরের এই কবিতার মতোই মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, আমরা তোমাকে কী দিয়ে, কেমন করে পূজা করব? তেমন যোগ্যতা, সামর্থ্য কোথায় আমাদের?

সেই ‘পরমপূজ্য’ তুমিই ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে জীবনে এক বড় দীর্ঘশ্বাস হয়ে দেখা দিয়েছিলে। আমাদের লক্ষ-কোটি ভক্তের হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে বিদায় নিয়েছিল তোমার আর্জেন্টিনা। আকস্মিক কোনো অন্ধকার গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিল তোমার সেই জৌলুস, সেই ঝলকানি, সেই জাদু!

তোমার কোটি কোটি ভক্তের হৃদয় সেদিন খান খান হয়ে গিয়েছিল। তুমি কি ভক্তদের সেই রক্তক্ষরণ, বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেয়েছিলে? তুমি শেষ হয়ে গিয়েছ, তুমি আসলে ক্লাব ফুটবলের জন্য– এমন অনেক কথা তখন নিন্দুকরা বলেছি। এখন প্রশ্ন জাগে, তোমার সমস্ত ঝলক ও জাদু কি আগামীর জন্য তুলে রেখেছিলে? হে ফুটবলের বরপুত্র! আমরা জানি তুমি নরম মনের, যে তুমি কামিনী ফুলের সুবাস, সেই তুমি, সেই মেসি, দশ নম্বর জার্সি গায়ে এতখানি অপমান নীরবে হজম করতে পারো না। তুমি জানো বাগানের সব ফুল উজাড় করে তুলে এনে শুধু তোমার জন্যই কোটি কোটি ভক্ত রাত জেগে আর্জেন্টিনা বার্সেলোনা কিংবা পিএজজির খেলা দেখে। ‘ফুটবলের ঈশ্বর’ হয়ে নিশ্চয়ই তুমি সেদিন ভক্তদের সাধ পূরণের অঙ্গীকার করেছিলে!

না, তোমার ভক্তরা তো কোনোদিন চায়নি ইস্পাতকঠিন পেশির বিস্তার। চায়নি বিতর্কের বর্ণমালা। চায়নি ঔদ্ধত্যের আগুন! তারা শুধু ম্যাজিক চেয়েছিল। সেই ইন্দ্রজাল, যা জালে জড়িয়ে দেয় স্বপ্ন। যে পোড়া দেশ ফিফার নজরেও পড়ে না, সেখানেও ভক্তরা চেয়েছিল, বেজে উঠুক তোমার সেতার। সবুজ গালিচায় তুমি কি ফুল ফোটাওনি? লোকে যাকে ম্যাজিক বলে, তুমিই কি মগ্ন বিশ্বাসে তাকে সত্যি বলে তুলে ধরোনি? তুমিই কি গড়ে দাওনি সেই মায়াপৃথিবী যেখানে অসম্ভব বলে কিছু নেই?

লিও মেসি, তুমি তো শুধু ফুটবল খেলো না। তোমার অসুখ অতিক্রম করে ফিনিক্স হয়ে জীবনে ফিরে আসা, প্রতি মুহূর্তে নিজেকে শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর হিসেবে উন্নীত করা আসলে কোটি মানুষকে দিয়েছে রূপকথা। বুঝিয়েছে, যে পৃথিবীতে লিও মেসি আছে, সেখানে হেরে যাওয়া বলে কিছু নেই। ঔদ্ধত্যের বিপরীতে এ পৃথিবীতে আছে এক সমাহিত তটভূমি যেখানে কনে দেখা আলোয় আজও কেউ প্রেমে পড়ে। চাঁদের নরম হাসি আজও যেখানে সমস্ত পরাজিতদের চুলে বিলি কেটে যায়। সেই মায়াময় পৃথিবীতে তুমি আবার ফিরে এসেছ অনন্য, অসাধারণ হয়ে!

নজির তৈরি করতে, নজির ছুঁতে, নজির ছাপিয়ে যেতে অভ্যস্ত তুমি। এই যেমন রোববার রাতে কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে এক অনন্য নজির তৈরি করলে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে কোনো ফুটবলার আজ পর্যন্ত যা করতে পারেনি, সেটাই তুমি করে দেখালে। ‘ক্যাপ্টেন আর্জেন্টিনা’ হয়ে লিখলে ফুটবল ইতিহাস। কাতার সাক্ষী থাকল অনন্য রেকর্ডের।

১৮ ডিসেম্বরের রাত আসলে তোমার স্বপ্নপূরণের রাত। শুধু ২০১৮ নয়, এর আগে ২০১৪ সালে যা হয়নি, একেবারে শেষ মুহূর্তে হিগুইনের গোল মিস আর মারিও গোৎজের অসামান্য গোলে স্বপ্নভঙ্গের পর তোমার শূন্যদৃষ্টি রোববার রাত থেকে অতীত। সমস্ত তাচ্ছিল্য, অপমান, শোকের এবার থেকে ছুটি। ৭ বারের ব্যালন ডি’অর জিতেও যেন সবটা জিতে ওঠা যাচ্ছিল না। কিন্তু রবিবাসরীয় মহারণে তোমার নেতৃত্বে ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বজয়ের পর আর কোনো অপ্রাপ্তি রইল না। হ্যাঁ, দিয়াগো ম্যারাডোনার অলৌকিক দ্যুতিকেও বুঝি স্পর্শ করে ফেললে। হয়ে উঠলে রাজার রাজা। ফুটবলের মহারাজা!

তুমি তো শুরু করেছিলে মাত্র ১৩ বছর বয়সে। আর্জেন্টিনা ছেড়েছ। ততদিনে সকলেই বুঝতে পেরেছেন ঠিকমতো প্রশিক্ষণ পেলে তুমি অনেক দূর যাবে। কিন্তু এত প্রতিভা সত্ত্বেও তোমার দৈহিক বৃদ্ধি ততটা হচ্ছিল না। আর তাই নিয়মিত বৃদ্ধির হরমোন ইনজেক্ট করাতে হচ্ছিল শরীরে। কি দুঃসহ সেই স্মৃতি। এফসি বার্সেলোনা সেই খরচ বহন করেছিল। এরপর ২০০৫ সালের মধ্যে বার্সার প্রথম দলে যখন তুমি ঢুকে পড়েছিলে, তারপর থেকেই তো চলছে গৌরবের পথযাত্রা। অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপে দেশকে চ্যাম্পিয়ন করে হয়ে উঠেছিলে জাতীয় তারকা। সেই শুরু। সেই থেকেই প্রত্যাশার পারদ তোমাকে ঘিরে আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু সেই প্রত্যাশাকে চাপ হয়ে উঠতে দাওনি তুমি। বরং সেটাকেই উদ্দীপনার অস্ত্র করে দ্রুত পেরুতে থাকো একের পর এক মাইলফলক। মাত্র কয়েক বছর– বলা যায় ২০১১ সালের মধ্যেই তুমি বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের অভিজাতনগরের বাসিন্দা। ম্যারাডোনা-পেলের সঙ্গে তুলনীয়। খোদ ম্যারাডোনাও তোমাকে স্বীকৃতি দিতে ভুল করেননি।

যত এগিয়েছে এবারের বিশ্বকাপ ততই যেন স্পষ্ট হয়েছে তোমার অনন্যতা। অতীতের সব ব্যর্থতার স্মৃতি, সব বিতর্ককে উড়িয়ে ‘মুকাদ্দর কা সিকান্দর’ হয়ে উঠলে তুমি। দলগত জয়ের পাশাপাশি এই ব্যক্তিগত শৃঙ্গ আরোহণ করে তুমি পৌঁছে গেলে এমন এক স্তরে যেখানে পৌঁছনো বহু জিনিয়াসেরও স্বপ্ন হয়ে রয়ে গিয়েছে। হয়তো থাকবেও।

১৮ ডিসেম্বরের কাতার জন্ম দিয়ে গেল এমনই সব মুহূর্তের, যা না জন্মেও ঝলমলিয়ে উঠল ফুটবলভক্তদের স্বপ্নে। বুঝিয়ে দিয়ে গেলে আজ থেকে বিজয়ীর সমার্থক শব্দ লিওনেল মেসি। এবারের বিশ্বকাপ হয়ে উঠল তোমার রেকর্ডময় বিশ্বকাপ।

ফাইনাল ম্যাচের ২৩ মিনিটেই তুমি পেনাল্টিতে গোল করে আর্জেন্টিনাকে ১-০ এগিয়ে দিয়েই লিখে ফেললে নয়া ইতিহাস। ২০২২ বিশ্বকাপের নক-আউট পর্যায়ের প্রতি ম্যাচে গোল করার অনন্য রেকর্ড গড়ে ফেললে। এর আগে বিশ্বের কোনো ফুটবলার কখনো যা করতে পারেনি।

অথচ কি হতাশাজনকভাবেই না এবার তোমার দল আর্জেন্টিনা কাতারের অভিযান শুরু করে করেছিল। সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে হারার পর ২০১৮ সালের স্মৃতি আবার ফিরে এসেছিল। কিন্তু যে দলে তুমি আছো, সে দল তো হেরে যাওয়ার দল নয়। এরপর আমরা দেখলাম তোমার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা দলের ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে ছন্দময় ফুটবল খেলা। সব হিসেব তুমি বদলে দিয়েছ। ব্রাজিলকে হারিয়ে গতবছর কোপা আমেরিকা জিতেছিলে। ২৮ বছর পর কোপার জয় পাও তুমি। নীল-সাদা জার্সিতে ট্রফির খরা কাটিয়েছিলে লিও। তখন থেকেই তোমার হাতে বিশ্বকাপ দেখার জন্য আশায় বুক বেঁধেছে গোটা বিশ্বের কোটি কোটি সমর্থক।

ফাইনাল শেষে যখন সাড়ম্বরে ডাকা হলো তোমার নাম, টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার গোল্ডেন বল গ্রহণের জন্য তখন আমরা দেখলাম তোমার মধ্যে সেই পুরস্কার গ্রহণের কোনো তাড়াই নেই। যেমন ছিল না ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে মারাকানায়। ব্রাজিলে সেবার জার্মানির কাছে শেষ মুহূর্তের গোলে হেরে বিশ্বকাপ জয়ের আক্ষেপে পুড়েছিলে তুমি। সেদিন গোল্ডেন বল জয়ে তাই আনন্দের কোনো ছিটেফোঁটা ছিল না তোমার মধ্যে। এবার বিশ্বকাপ জয়ের পরও গোল্ডেন বল নেওয়ায় যেন বড্ড অনীহা ছিল তোমার। কেননা তোমার দৃষ্টি তো ছিল ওই সোনালি ট্রফিটায়।

কাতার বিশ্বকাপে ৭ গোল আর ৩ অ্যাসিস্টে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার গোল্ডেন বল হাতে নিয়েই তুমি ছুটলে বিশ্বকাপ শিরোপার দিকে। চুমু এঁকে দিলে ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণে তৈরি সোনালি ট্রফিটায়। এই চুমু বহু আক্ষেপের পর স্বপ্ন ছোঁয়ার আনন্দের।

গোল্ডেন বল নিয়ে মাতামাতি না থাকলেও, ইতিহাস গড়ে ফেলেছ তুমি। প্রথম ফুটবলার হিসেবে দুটি বিশ্বকাপের টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার হাতে উঠেছে তোমার। ফুটবল বিশ্ব তো আর কম কিংবদন্তীকে দেখেনি। তবে তুমি হয়ে গেলে এক ও অনন্য। অমরত্বের জন্য বিশ্বকাপ জয়ের জন্য হয়তো এটাও দরকার ছিল তোমার।

জিততে শেখানোর মতো, মহাকাব্যের নায়ক তুমি, তুমিই শিখিয়েছিলে হারকে মেনে নেওয়ার সহন-শিক্ষা। জীবনে এর চেয়ে বড় শিক্ষা আর কি আছে? তুমিই পারো এভাবে দুদিক মেলে ধরতে। উপন্যাসের চরিত্র না হয়ে, তুমিই পারো উপন্যাস হয়ে উঠতে। ফুটবল বিশ্বে তুমি নিজেই তো একটা গোলার্ধ।

লিও মেসি, কামিনী ফুলের সুবাস তুমি, এবার যে রূপকথার গল্পখানা শোনালে তা আমরা চিরদিন মনে রাখব। রাজনীতি আমাদের সুখ দেয়নি, সংসার আমাদের স্বস্তি দেয়নি, খোদ প্রেয়সীও মনি-কাঞ্চনের অভাবে ছেড়ে গিয়েছে আমাদের! তুমিই শেষ পর্যন্ত আমাদের মুখে হাসি ফোটালে। ৩৬ বছরে ট্রফি না জেতা নীরব অশ্রু মুছে দিলে।

তোমাকে অভিবাদন প্রিয় মেসি!