একটি শক্তিশালী, ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বদলি নীতি এবং তার ধারাবাহিক বাস্তবায়ন ছাড়া শিক্ষাখাতের বিশৃঙ্খলা দূর হবে না।
Published : 12 Apr 2025, 12:34 AM
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ গত ৮ এপ্রিল জারি করা এক আদেশে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৩৫ জন অধ্যাপককে নতুন জাতীয়কৃত কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন করেছে। উপজেলা পর্যায়ে অবস্থিত এই কলেজগুলোকে ২০১৮ সালে জাতীয়করণ করা হয়েছিল। তখন একসঙ্গে ৩০০ কলেজ জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়। এরপর থেকে এসব কলেজের অধ্যক্ষরা একে একে অবসরে চলে গেছেন। অন্যান্য শিক্ষকের পদও প্রতিনিয়ত শূন্য হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে, এই আদেশের ভুল-ত্রুটি নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ আলোচনা চলছে। যেমন, মৃত ব্যক্তিদের পদায়ন বা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে ঢালাও পদায়নের বিষয়গুলো সামনে এসেছে।
আমাদের দেশে শিক্ষাখাত এমনিতেই রাষ্ট্রীয়ভাবে কম গুরুত্ব পায়। সংবাদমাধ্যমেও এটি অনেকটা উপেক্ষিত। শিক্ষা নিয়ে অনেক সংবাদ প্রকাশিত হলেও সেগুলোতে সবসময় সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে না। খবরে ওঠে আসা এই বিষয়গুলোকে নেতিবাচকভাবে না দেখে বরং এটিকে গঠনমূলক আলোচনার সুযোগ হিসেবে নিতে পারি আমরা।
শিক্ষা বিষয়ক সংবাদে জনস্বার্থের প্রতিফলন না হওয়ার একটি বড় কারণ হলো বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা। ১৩৫ জন অধ্যক্ষের পদায়নের এই আদেশকে আমরা একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হিসেবে দেখতে পারি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এই খাত পরিচালনা করে। এই অধিদপ্তরে কাজ করেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। নতুন জাতীয়কৃত কলেজগুলো রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত হলেও এগুলো ক্যাডার শিডিউলের আওতায় নেই। এদের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি আমলের কিছু নিয়ম এখনও চালু আছে। এ কারণে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও কিছু ভূমিকা রয়েছে।
পুরোনো সরকারি কলেজের পাশাপাশি নতুন জাতীয়কৃত কলেজগুলোর তথ্য সংরক্ষণ করে অধিদপ্তরের ইএমআইএস শাখা। তথ্য হালনাগাদে প্রতিষ্ঠান ও সেখানে কর্মরতদের দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু এতগুলো সংস্থা একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সমন্বয়ে ঘাটতি থেকে যায়। প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে বিষয়টি দেখে, আর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মন্ত্রণালয়ে। আদেশ জারির পর দুর্বলতাগুলো সামনে আসতে শুরু করে।
সংবাদমাধ্যমে তাৎক্ষণিক বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পায়। মৃত ব্যক্তিদের পদায়ন এমনই একটি উদাহরণ। এটি একটি সাধারণ ত্রুটি, যা দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই পদগুলো কেন এতদিন শূন্য ছিল, এই পদায়নে নতুন কোনো সমস্যা তৈরি হলো কিনা— এসব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেছনে পড়ে যাচ্ছে। আমাদের উচিত বিষয়টির গভীরে যাওয়া এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে সব দিক বিবেচনা করা।
বদলি একটি সাধারণ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। কিন্তু পেশাজীবীদের কাছে এটি জীবন-মরণের বিষয়। রাজনৈতিক সরকারগুলো প্রায়ই বদলি-পদায়নের মাধ্যমে ক্ষমতাচর্চা করে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কাজের পরিধি অনেক বড়। তারা শিডিউলভুক্ত সরকারি কলেজ, অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ড, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা সংক্রান্ত কার্যালয় ও প্রকল্পে কাজ করেন। অধিদপ্তরের অধীনে সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি কলেজ ও নতুন জাতীয়কৃত কলেজও পরিচালিত হয়। এত বড় ক্ষেত্রে পদায়নের সময় শিক্ষার সামগ্রিক চিত্র বিবেচনা করা দরকার। কিন্তু বাস্তবে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সমাধানে অধিদপ্তরকে ভাগ করা হলেও সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীভূত থেকে যায়। ফলে সবাই মন্ত্রণালয়ে ভিড় করেন, আর নিয়মিত কাজে ব্যাঘাত ঘটে।
এই পেশার সদস্যরা চান একটি সুষ্ঠু বদলি নীতি, যেখানে পেশার স্বার্থ, শিক্ষার্থীদের কল্যাণ, ব্যক্তির পেশাগত উন্নতি ও আকাঙ্ক্ষার সমন্বয় হবে। সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি জানিয়ে আসছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে নীতি করেছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত হয়নি। নীতিগুলো প্রায়ই আবেদনকারীদের সামলানোর জন্য করা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে পড়ানো এবং অফিসে পদায়নকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়। অফিস বা বড় শহরে পদায়ন নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। কাগজে-কলমে থাকা নীতিও কার্যকর হয়নি।
নীতি প্রণয়নে পেশার প্রতিনিধিদের না নেওয়াই এর একটি বড় কারণ। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল। অধিদপ্তর ও ক্যাডার সংগঠনকে নীতি প্রণয়নে অংশীদার করা হয়েছিল, ফলে একটি ভালো নীতি তৈরি হয়। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাবে স্বার্থগোষ্ঠীর সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। অনেক প্রতিভাবান কর্মকর্তা প্রত্যন্ত এলাকায় চাকরি করে অবসরে গেছেন, আর কিছু ব্যক্তি বারবার আকর্ষণীয় পদে নিয়োজিত হয়েছেন। কথিত লাভজনক পদায়নের জন্য অনৈতিক বিনিময়ের অভিযোগও ছিল বিস্তর। বদলিতে শৃঙ্খলা আনার ক্ষেত্রে পেশার সংগঠন থেকে যে দাবি আসার কথা তা আসেনি।
গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন সরকার গঠিত হলে আশা জাগে। বঞ্চিত কর্মকর্তারা সচিবালয়ে ধর্না দেন। কর্তৃপক্ষ তাদের কথা শুনেছেন, অনেকে কাঙ্ক্ষিত পদ পেয়েছেন। কিন্তু ১৬ হাজার সদস্যের এই পেশার জন্য এটি যথেষ্ট নয়। শুরুতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল, তবে এতদিনে একটি সুন্দর ব্যবস্থা গড়ে ওঠা উচিত ছিল। মন্ত্রণালয় একটি সফটওয়্যার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে আবেদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষ্পত্তি হবে। এর মধ্যেই ইএমআইএস তথ্যের ভিত্তিতে ১৩৫ জনের পদায়ন হয়েছে, যাকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার উদাহরণ বলা যায়।
উদ্যোগটি মহৎ নিঃসন্দেহে। তবে, পদায়নপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, এটি অধিকাংশকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। মহানগর ও জেলায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি আছে, সেখানে কনিষ্ঠদের পদায়ন হয়েছে। অথচ প্রত্যন্ত উপজেলায় জ্যেষ্ঠদের পাঠানো মনোকষ্টের কারণ হয়েছে। অতীতে কলেজগুলোকে এ, বি ও সি গ্রেড করা হতো, তবে সেই তালিকা হালনাগাদ নেই। ধারণা করা হয়, উপজেলার কলেজগুলো সি গ্রেডভুক্ত। কিছুদিন আগে সেখানে সহযোগী অধ্যাপকদের পদায়ন দেওয়া হতো। আবেদনের ভিত্তিতে অধ্যাপকদের পদায়ন হলে যারা কাজ করবেন তাদের কর্মসন্তুষ্টি থাকবে এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণের বিষয়টিও বিবেচনা করা দরকার। যে সকল কর্মকর্তার চাকরির তিন-চার মাস অবশিষ্ট আছে, তারা প্রতিষ্ঠানে পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাবেন না।
সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করছে, তবে শিক্ষায় সংস্কার বিষয়ে আলোচনা এখনও জোরেশোরে শুরু হয়নি। প্রশাসনিক সংস্কারে যে কমিশন দায়িত্ব পালন করছে, তাদের সাথে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রতিনিধিদের আলোচনা হয়নি। শিক্ষাকে ক্যাডার বহির্ভূত করে কমিশনের আওতায় আনা হবে– এমন ঘোষণা আসায় শিক্ষা ক্যাডারে অস্থিরতা দেখা দেয়। অন্যান্য ক্যাডারগুলোতেও নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অসংযত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তা শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন। আপাতত উত্তেজনা কমলেও সমস্যাগুলো নিয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা শুরু হয়নি।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে প্রজাতন্ত্রের নাগরিক এবং সরকারি কর্মচারী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো সরকারের সৎ পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা। সেই সহযোগিতার একটি সুযোগ তৈরি করা দরকার, যেখানে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ তাদের মতামত দিতে পারে। প্রত্যন্ত উপজেলার নতুন জাতীয়কৃত কলেজগুলোর শিক্ষা পরিবেশ গতিশীল রাখা একটি কঠিন কাজ। মহানগরীর শিক্ষার্থীদের দাবি রাষ্ট্র গুরুত্বের সাথে দেখে, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা ওই গুরুত্ব পায় না। অথচ সেখানেও দক্ষ, মেধাবী ও অনুপ্রাণিত শিক্ষক-প্রশাসকের পদায়ন হওয়া দরকার। সেটি করতে হলে সামগ্রিক ক্যারিয়ার পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেখানে যারা ভালো কাজ করবেন, তাদেরকে পর্যায়ক্রমে মহানগরীতে পদায়নের সুযোগ তৈরি করতে হবে। অফিস পদায়নকে যেভাবে আলাদা করে দেখা হয়, সেটি ভুল।
২০২০ সালে সর্বশেষ যে বদলি নীতি প্রণয়ন হয়, তার শিরোনাম ছিল ‘সরকারি কলেজের শিক্ষক বদলি/পদায়ন নীতিমালা’। শিরোনামটির মধ্যেই নীতিটির সীমাবদ্ধতা ফুটে উঠেছে। রাষ্ট্রীয় শিডিউলভুক্ত একটি ক্যাডার সার্ভিসকে যথাযথ নামে অভিহিত না করে কেবলমাত্র ‘সরকারি কলেজ শিক্ষক’ নামে অনানুষ্ঠানিক সম্বোধনে পরিচিত করার মাধ্যমে বদলি নীতিটিকে খণ্ডিত ও সংকীর্ণ লক্ষ্যে ধাবিত করা হয়েছে। এই নীতির পাশাপাশি অফিস পদায়নের জন্য পৃথক একটি নীতি করা হয়েছিল। মহানগরীতে পদায়নের জন্য মন্ত্রণালয় এবং ছোট জেলা ও উপজেলায় পদায়নের জন্য অধিদপ্তর– এই নীতির মধ্যেও খণ্ডিত ও নিয়ন্ত্রণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায়। সবগুলো নীতিকে একত্রিত করে পেশার সামগ্রিক অবস্থান থেকে বিন্যস্ত করে নতুন একটি নীতি গ্রহণ করলে এই জটিল সমস্যার একটি সুষ্ঠু সমাধান আসা সম্ভব।
উপজেলা ও ছোট জেলার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনগুলোর দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। নতুন জাতীয়কৃত কলেজের জন্য অধিদপ্তরে একটি পৃথক শাখা খোলা দরকার। শূন্য পদ পূরণ ও আর্থিক বরাদ্দ ইত্যাদি বিষয়গুলো যাতে কোনো প্রকার তদবির ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘদিনের অবহেলিত ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সমস্যার সমাধান করা দরকার। অনেকেই নিজের সমস্যাকে অতিরঞ্জিত করে বলেন, আবার যৌক্তিক কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত অনেকেই নিজেকে বঞ্চিত হিসেবে উপস্থাপন করছেন।
সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা আবারও শুরু হয়েছে। অতি ভক্তি দেখাতে কেউ কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী পদায়নপ্রার্থীর বিরুদ্ধে তথ্য সরবরাহ করছেন, যা সার্বিক কর্মপরিবেশ নষ্ট করছে। বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী বা জনতা কর্তৃক গোলযোগ সৃষ্টির পেছনে কিছু শিক্ষকের ইন্ধন রয়েছে। একটি শক্তিশালী, ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বদলি নীতি এবং তার ধারাবাহিক বাস্তবায়ন ছাড়া শিক্ষাখাতের বিশৃঙ্খলা দূর হবে না। মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়ন না হলে শিক্ষকদের কর্মস্পৃহা নষ্ট হবে। শিক্ষকতার মতো একটি পেশায় প্রেরণা খুবই জরুরি একটি বিষয়। সরকারের সামনে অনেক কাজ, সেই কাজে সবাইকে সাথে নিতে হলে নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের যুক্ত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।