Published : 15 Apr 2017, 08:45 PM
ভূখণ্ডগত অবস্থান বিবেচনায় ১,২০০ মাইল দূরত্বের পূর্ব বাংলা সঙ্গে নিয়ে ১৯৪৭ সালে গঠিত হয়েছিল পাকিস্তান নামের ধর্মভিত্তিক একটি 'বিকলাঙ্গ' রাষ্ট্র। বিকলাঙ্গ বলছি এ জন্য যে, সেই সময়ে সবদিক থেকে পাশ্চাত্য আধুনিকতায় ঋদ্ধ যে রাজনীতিকের চাওয়ায় এই রাষ্ট্রটির শুরু হয়েছিল তার প্রতি পরতে ছিল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার।
যাপিত জীবনে ধর্মকর্মে প্রায় অবিশ্বাসী সেই রাজনীতিক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতবর্ষের মুসলমানদের হিন্দুবিদ্বেষ আর ধর্মানুভূতি কাজে লাগিয়ে নিজেই হয়ে গিয়েছিলেন ধর্মভিত্তিক এই রাষ্ট্র পাকিস্তানের 'কায়েদে আযম' তথা জাতির পিতা। ধর্মের মোড়কে মুসলিম জাতীয়তাবাদ নামে একটি অনৈতিক এবং যার-পর-নাই অপরিচিত একটি জীবন-ধারণা চাপিয়ে দেওয়ার উদ্যোগও শুরু হয় সেই সময়ে। ভৌগলিক ও পার্শ্বিক কারণে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের সবকটি প্রদেশের জনজীবনে মুসলিম জাতীয়তাবাদের অবস্থান প্রোথিত থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানে তা ছিল একেবারেই অনুপস্থিত।
কেননা নৃতাত্ত্বিক দিক বিবেচনায় এই বঙ্গে হিন্দু জাতির বাস ছিল গৌতম বুদ্ধের জন্মেরও আগে থেকে। ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যকে তিনটি জাতির নাম পাওয়া যায়। এখানে জাতি শব্দের অর্থ ইংরেজিতে যাকে caste বলে, তা নয় মোটেও। তবে তাকে ইংরেজিতে বলা যায় Ethnic race বা জাতিগোষ্ঠী। আর এসব জাতিগোষ্ঠীর নাম ছিল 'বঙ্গ', 'বগধ' ও 'চের'। হিন্দু ধর্মের সক্রিয়তায় এসব জাতিগোষ্ঠীর জীবনাচরণে পূজাপার্বণ, উৎসব-অনুষঙ্গ ছিল নিত্য। হিন্দু ধর্মের এই প্রভাব ছিল প্রাচীন পুন্ড্র-গৌড়-সুহ্ম-রাড়-তাম্রলিপি-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি ভৌগলিক ও রাষ্ট্রিয় অবস্থানে।
তবে কালের পরিক্রমায় এসব ভূখণ্ড এক হয়ে নিজ নিজ নাম বাদ দিয়ে এক বঙ্গ বা বাঙলা নামে অভিহিত হতে শুরু করে। আর প্রাচীনকাল থেকেই বহু মিশ্রণে-সংঘাতে-সংশ্লেষে-সমন্বয়ে এগিয়ে গেছে এই বাঙলার ইতিহাস। এরই মধ্যে বাঙলা ও বাঙালির জনজীবনে পড়েছে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মিশ্রিত প্রভাবের সঙ্গে যোগ হয়েছে ইসলামের সুফি ধারার সমন্বিত প্রয়াস। যা বাঙালির জনজীবনে দিয়েছে ধর্ম-বর্ণ আর সংস্কৃতির পারস্পরিক সহাবস্থানের উদারনৈতিক এক দ্যোতনা। যা একেবারেই বদ্বীপ এই ভূখণ্ডের পাললিক নিগঢ় থেকে উৎসারিত; কারও চাপিয়ে দেওয়া নয়।
তাই তো আমরা দেখি ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে তোলা বিকলাঙ্গ রাষ্ট্র পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করতে এতটুকু বেশি সময় লাগেনি এ দেশের সাধারণ মানুষের। পাকিস্তান জন্মের বছর না ঘুরতেই বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে শুরু করে ধর্মের নামে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে নানাবিধ শোষণ-শাসন আর নিপীড়ন। ভাষার অধিকার হরণের প্রয়াস প্রত্যাখ্যানেই শুরু হয় বাঙালির সংগ্রামের আরেক ইতিহাস। ভাষা থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা– ধারাবাহিক এই সংগ্রামে বাঙালি স্পষ্টতই বুঝে ফেলে শাসকের ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার। বাঙালির আত্মপরিচয় নির্মাণের ধারাবাহিক সেই সংগ্রামের পাথেয় হয়ে ওঠে শ্রী চৈতন্যদেব থেকে রামমোহন রায়-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নজরুলের সমাজ-সাহিত্য চেতনা। যার চূড়ান্ত পরিণতি দিতে নেতৃত্বের ভূমিকায় সফল নায়ক হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শাসন-শোষণের রাষ্ট্রিক প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে এল স্বাধীনতা। এল লাল-সবুজের বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু বললেন:
"বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।"
[১৯৭২ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া ভাষণ]
আর ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বললেন:
"সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো বিশেষ ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।"
[১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর রেসকোর্সে দেওয়া ভাষণ]
দুঃখজনক সত্য যে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চাপে নিজ অবস্থান অনেকটাই ধরে রাখতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রিকভাবেই যোগ দেন লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে। প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামি ফাউন্ডেশন। গড়ে তোলেন ধর্ম মন্ত্রণালয়। তাতে অত্যন্ত নিঃশব্দে হলেও ভিত্তি পায় বাঙালির কাছে যারপরনাই ঘৃণিত-প্রত্যাখ্যাত ধর্মের রাষ্ট্রিক ব্যবহার। যদিও বাঙালির হাজার বছরের বহু ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী-সংস্কৃতিভিত্তিক জীবনাচরণের প্রতি অগাধ বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর মনে ছিল। আর বিশ্বাসবোধ থেকে তিনি নিজেই বলেছিলেন:
"রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে তাহলে বাংলার মানুষ তাকে প্রত্যাঘাত করবে। এ বিশ্বাস আমি করি।"
[১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদে দেওয়া ভাষণ]
এই বিশ্বাসবোধ আর অসাম্প্রদায়িক এক বাংলাদেশ গড়ার প্রয়াসে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ করেন একাত্তরে ধর্মের নামে ব্যাভিচারী, ধর্ষক, নিপীড়ক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ এ দেশে ক্রিয়াশীল ধর্মভিত্তিক সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। তারপরও, বলাবাহুল্য যে, ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক আর ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর নিজের বিশ্বাসবোধ আর রাষ্ট্রিক অবস্থানের কিছুটা বিচ্যুতিতে ফণা তোলার সুযোগ পেয়ে যায় ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকারী প্রগতিবিরুদ্ধ অপশক্তি।
বাংলাদেশবিরোধী বিদেশি রাষ্ট্রিক শক্তির পরোক্ষ সহায়তায় সেই অপশক্তিই খুন করে বঙ্গবন্ধুকে। আবারও বাঙালির প্রিয় বাংলাদেশ হয়ে ওঠে প্রগতিবিরুদ্ধ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক অপশক্তির অবাধ চারণভূমি।
পঁচাত্তর থেকেই 'বাঙালি' হয়ে যায় 'বাংলাদেশি'। বহু ধর্মের এই দেশের রাষ্ট্রিক সংগঠনে ভিত্তি করে নেয় বিশেষ একটি ধর্ম। ইসলাম হয় 'রাষ্ট্রধর্ম'। রাষ্ট্রীয় জীবনে আসে একটি ধর্মাশ্রিত আচার-অনুষ্ঠানের চর্চা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাধারণের বিশেষ করে মুসলমানদের জীবনাচরণেও প্রোথিত করা হয় ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার। শুরু হয় হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি মুসলমানকে সাম্প্রাদায়িক ও ধর্মান্ধ করার প্রয়াস।
পাশাপাশি, অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতেও যাবতীয় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা অঘোষিতভাবেই বাতিল করে রাষ্ট্র। পরিকল্পিতভাবে বাঙালি মুসলমানের জনজীবনে প্রবিষ্ট করানো হয় ধর্মের নামে অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প। সামরিক বেসামরিক লেবাসে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে প্রগতিবিরুদ্ধ এই অপশক্তি জন্ম দেয় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির। রাজনীতি-অর্থনীতিসহ জনজীবনের প্রতি পরতে প্রোথিত করে দুবৃর্ত্তায়ন।
শুধু সমাজ, রাষ্ট্র ও জনজীবন পেছন দিকে ঠেলে দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি দুর্বৃত্ত এই অপরাজনৈতিক গোষ্ঠী। প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ফের সংগঠিত হওয়ার, রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে একাত্তরে বাংলাদেশবিরোধী জামায়াতের মতো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে। সুযোগের এই ধারাবাহিকতায় যারা রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদও পেয়ে যায় নব্বই-পরবর্তী কথিত গণতান্ত্রিক ধারাতে।
এমন রাজনেতিক বাস্তবতায় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দেশশাসনে আসে আওয়ামী লীগ। অন্যসব কিছু ছাপিয়ে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকারই দ্বিতীয় মেয়াদে দেশশাসনের সুযোগ করে দেয় দীর্ঘ ২১ বছর রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা দলটিকে। আর যথার্থ অর্থেই আওয়ামী লীগের এই অঙ্গীকারের প্রতি দেশের মানুষের বিশেষ করে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ জনগোষ্ঠীর সমর্থন প্রমাণ করে বাংলা ও বাঙালি এখনও চেতনাগতভাবে সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে।
রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠানের স্বার্থে সাধারণের এই চাওয়া কাজে লাগাতে এতটুকু ভুল করেনি আওয়ামী লীগ। অঙ্গীকার পূরণের প্রয়াসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে সরকার, আইন সংশোধন হয়েছে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হিসেবে জামায়াতের মতো দলগুলোর বিচার করতে।
ইতিহাস বিবেচনায় এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাঙালির ভাষার সংগ্রাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে স্বপ্নসারথী হয়েছে আওয়ামী লীগই। যদিও সব আন্দোলনেই তারা এই ভূমিকা নিয়েছে একান্তই শ্রেণিচেতনা থেকে। তারপরও অন্য কার্যকর কোনো নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাঙালি বারবার ফিরে গেছে এই দলটির কাছেই। একই কারণে জাতির কাছে দায় ও দায়িত্বটা অন্য দলগুলোর চেয়ে আওয়ামী লীগের অনেক বেশি।
কিন্তু বাঙালির মনোজগতে ধাক্কা তখনই লাগে যখন আওয়ামী লীগের এই দায় ও দায়িত্বে বিচ্যুতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যখন দেখা যায় বিপুলসংখ্যক অসাম্প্রদায়িক সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়ে সরকারে আসার পরও সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রবর্তনের পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বহাল থাকে। যদিও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের এই মাত্রাটুকুতে আওয়ামী লীগের অসামঞ্জস্যতা তার শ্রেণিগত চরিত্রেরই বাধ্যবাধকতা। তারপর এটা ইতিহাসগতভাবেই প্রমাণিত যে, এ দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অধিকার প্রতিষ্ঠার যাবতীয় সংগ্রামের পুরোভাগে থেকেছে বা থাকার সুযোগ হয়েছে এই আওয়ামী লীগেরই।
আবার এ কথা তো ঠিক যে, বাংলা ও বাঙালির চেতনাবিরুদ্ধ আওয়ামী লীগের যে কোনো অবস্থানই দেশকে ঠেলে দিয়েছে পেছনের দিকে। যার খেসারত শুধু এ দেশের মানুষকেই নয়, দিতে হয়েছে খোদ আওয়ামী লীগকেও।
দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময়ের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে বাঙালির স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ স্পষ্টতই এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে বহু ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির পারস্পরিক সহাবস্থানে বিশ্বাসবোধে ঋদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত জনমানুষ। আরেকটি হচ্ছে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত প্রগতিবিরুদ্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী। যে গোষ্ঠীর উন্মত্ত রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আজ জ্বলছে গোটা বাংলাদেশ।
প্রগতিবিরুদ্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে নিবিষ্ট প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক এই অপশক্তি রুখতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে একক একটি ধারায় দেশ ও দেশের মানুষকে চলার সুযোগ করে দেওয়া। যে ধারা প্রতিনিধিত্ব করবে বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের উদার গণতান্ত্রিক, নানা ধর্মমতের পারস্পরিক সহাবস্থানের চেতনার।
এ জন্য প্রথমেই যা দরকার তা হচ্ছে, রাষ্ট্রিকভাবে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। কোনো না কোনো কারণে যেসব শক্তি আজ ধর্মব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে হয়ে উঠেছে দেশ ও মানবতাবিরোধী তাদের নিজেদের সুধরে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। সর্বোপরি, দেশের সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্রিত করার প্রয়াস নেওয়ার পাশাপাশি তাদের একত্রিত হওয়ার নিমিত্তে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া।
প্রশ্ন হচ্ছে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? স্পষ্টতই বলা যায়, এই ঘণ্টা বাঁধতে হবে আওয়ামী লীগকেই। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বাংলা ও বাঙালির মুক্তির সনদ অর্জনের বাহন হয়ে ওঠার সুবাদেই এই দায়িত্ব বারবারই বর্তেছে আওয়ামী লীগের উপর। তাছাড়া বাংলা ও বাঙালির স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের বিভিন্ন বাঁকে এই দায়িত্ববোধের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগই দিয়ে এসেছে। যে নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব বোধ, চেতনাজাত অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আর আওয়ামী লীগের নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম একসূত্রে গ্রন্থিত হয়ে গেছে। এ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করার সুযোগ আওয়ামী লীগের নেই।
অবশ্য বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ তার এই ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধ থেকে সরে যে আসেনি, তা নয়। দলের শ্রেণিচরিত্রগত বিরোধাত্মক অবস্থান, ক্ষমতাকাঠামো পরিচালনার স্বার্থে আপোসকামিতা, বিদেশি চাপ ও তাপে অনেক সময়েই এমনতর দায় ও দায়িত্ববোধে বিচ্যুতি ঘটেছে এই দলটির। যা আবার শুধরেও নিয়েছে তারা। কিন্তু এ কথা তো সত্যি যে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী হবে– এসবের একটা সংহত নির্দেশনা দিয়েছেন দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
তাই এ কথা বলা সংগত যে, জাতির জনকের সেই দায় আর রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় আজকের আওয়ামী লীগ কতটুকু এগোবে আর কতটুকু এগোবে না তা নির্দিষ্ট করার সময় বোধকরি এখনই।