অর্ধ-শতাব্দী-উত্তর বিজয় দিবস: প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও বাসনা

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রত্যাশা ছিল বৈষম্য এবং শোষণহীন একটি স্বাধীন দেশ যেখানে সকলের গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার থাকবে।

মোস্তফা সারওয়ারমোস্তফা সারওয়ার
Published : 15 Dec 2022, 01:06 PM
Updated : 15 Dec 2022, 01:06 PM

অর্ধ-শতাব্দী-উত্তর বিজয় দিবসে সকল মুক্তিযোদ্ধা, নির্যাতনের শিকার মা-বোন এবং ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল শহীদের প্রতি রইল আমার অন্তরতম কৃতজ্ঞতা। জন্ম জন্মান্তরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি বঙ্গবন্ধুর প্রতি রইল হৃদয়ের কনকাঞ্জলি। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীসহ সকল দেশপ্রেমিককে জানাই বিপ্লবী সালাম। বন্ধুপ্রতীম ভারতের জনগণ, মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সেনাবাহিনী ও তৎকালীন সরকারের প্রতি রইল কৃতজ্ঞতা।

বিজয় অর্জনের একান্ন বছর পর আমাদের নিরীক্ষা হবে চারটি বিষয়ে: ১) মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা, ২) কী পেয়েছি, ৩) কী পাইনি, ৪) যা পাইনি তার বাসনা।

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রত্যাশা ছিল বৈষম্য এবং শোষণহীন একটি স্বাধীন দেশ যেখানে সকলের গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার থাকবে। মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। মৌলিক অধিকারে থাকবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থান। হবে মুক্তচিন্তার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ– বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির আলোকে এক নন্দিত সমাজ।

একান্ন বছরে এই সব নীতির সুষ্ঠু ও পূর্ণ প্রয়োগ একটি দরিদ্র দেশের জন্য কতটুকু সম্ভব? এর জন্য প্রয়োজন বিপুল অর্থের। পৃথিবীর ধনী দেশগুলো শত শত বছরের প্রচেষ্টায়ও এর সম্পূর্ণ সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাদেশের শুরু ছিল এক তলাহীন ঝুড়ি হিসেবে। দীর্ঘসময় ধরে দুই পর্যায়ে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শোষণের সমাপ্তিতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ছিল কৃষিনির্ভর এক দরিদ্র দেশ, যেখানে মাথাপিছু উৎপাদন ক্ষমতা ছিল নগণ্য। শিল্প ও সেবাভিত্তিক খাতগুলো ছিল দুর্বল। অবকাঠামোর অবস্থা ছিল নিদারুণ করুণ। পুঁজি ছিল না বললে ভুল হবে না। সর্বোপরি ছিল ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ।

এতক্ষণ আলোচনা করেছি আমাদের প্রত্যাশা এবং ১৯৭১ সালের মাঠের পরিস্থিতি। এখন দেখব আমরা কী পেয়েছি? অর্থনৈতিক, মানবিক ও পরিবেশবিষয়ক উন্নয়নে বাংলাদেশ গোটা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছে।

১৯৭১ সালে মাথাপিছু আয় ছিল একশ চৌত্রিশ ডলার। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স-এর ২০২১-২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আজ মাথাপিছু আয় দু-হাজার আটশ চব্বিশ ডলার। একুশ গুণের চেয়েও বেশি। ২০২২ সালের মোটামুটি হিসাব মতে মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশের অবস্থান একশ সাঁইত্রিশ, ভারত একশ উনচল্লিশ, পাকিস্তান একশ সাতাত্তর। অতএব, মাথাপিছু জিডিপির হিসেবে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশে।

২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করেছে। কার্যকরী হবে ২০২৬ সালে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বাস্তব বলে মনে হচ্ছে।

সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দুটি বিশ্ব বিখ্যাত সংবাদপত্র যখন বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়, তখন গর্বে-অহঙ্কারে আমার বিচরণ নক্ষত্রের রাজ্যে। নিউ ইয়র্ক টাইমস ২০২১ সালের ১০ মার্চ শিরোনাম দিয়েছে, "What Can Biden's Plan Do for Poverty? Look to Bangladesh." কী বিস্ময়? দারিদ্র মোচনের জন্য বাসকেট ভরা যুক্তরাষ্ট্রকে অনুকরণ করতে হবে এক কালের বাসকেটহীন বাংলাদেশকে। ২০২১ সালের ২৫ মার্চ বিশ্বের সেরা ডানপন্থী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে, “...Bangladesh will surpass India in output per capita in 2021. Not quite an Asian Tiger, Bangladesh is a tiger cub." আরও বলেছে, "With the erosion of secularism in neighboring India, it's possible to argue that Bangladesh is the most secular country in South Asia."

২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর খ্যাতনামা পাকিস্তানি সাংবাদিক জায়ঘাম খান সুইডেনের পরিবর্তে বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেল অনুকরণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে।

এই অর্জনগুলো কীভাবে সম্ভব হলো? উত্তর হলো, শাসন প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত প্রতিকূলতা সত্যেও সাবেক সরকারগুলোর মুক্ত অর্থনীতির বিকাশ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কতগুলো সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ, অভিবাসী খেটে-খাওয়া বাংলাদেশিদের উপার্জনের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠানো, পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পে নিয়োজিত বাংলাদেশি শ্রমিকদের ঘর্মাক্ত শ্রম, কৃষকদের উদ্ভাবনী উৎপাদন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম, ও কতিপয় প্রতিভাবান সৃষ্টিধর্মী উদ্যোক্তার দুঃসাহসী ভূমিকা।

এতক্ষণ শুধু চমকপ্রদ অর্জনের কথা জানিয়েছি। তা সত্ত্বেও প্রত্যাশার সবকিছু পাওয়া যায়নি। সুষ্ঠ নির্বাচন, আয়ের সমতা, সর্বস্তরে আইনের শাসন, দুর্নীতি দমন এবং সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি।

বর্তমানে দুর্নীতির করাল গ্রাসে সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে।

কিছু না কিছু দুর্নীতি সব দেশেই রয়েছে। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পর দুর্নীতির ঊর্ধ্বগতিতে বঙ্গবন্ধুর ব্যথিত চিত্তের পরিচয় পাই তার ভাষণে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে তিনি বলেছিলেন, “করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ, যারা আজ ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন- আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান করাপশন, খাদ্য কিনতে যান করাপশন, জিনিস কিনতে যান করাপশন, বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে পাঁচ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি। আজ আত্মসমালোচনার দিন এসেছে। এসব চলতে পারে না।”

বঙ্গবন্ধু জানতেন দুর্নীতির ধারক-বাহক হলো শিক্ষিত সমাজ। সাধারণ মানুষকে দুর্নীতির জিম্মি করে রেখেছে দুর্নীতিবাজ শিক্ষিত সমাজ। ১৯৭৫ সালের স্বাধীনতা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “শিক্ষিতদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন- আমি এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, তা কারা করে? আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্ল্যাক মার্কেটিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয়। হোর্ড করে কারা? এই আমরা যারা শতকরা পাঁচজন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই রয়েছে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে, আত্মশুদ্ধি করতে হবে।”

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চামচাগিরির বিরুদ্ধে এক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে। ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাইয়ের ভাষণে তিনি নব নিযুক্ত জেলা গভর্নরদের বললেন, “আজ আমার কাছে আপনারা তওবা করে যান, স্বজনপ্রীতি করবেন না। ঘুষখোরদের সাহায্য করবেন না।”

জাতির পিতার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। জঘন্য কুলাঙ্গারদের হাতে শহীদ হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি। পাঁচ দশক পার হয়েছে। লাগামহীন দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে। অফিসে-আদালতে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। ঋণ খেলাপিদের দৌরাত্মে সাধারণ নাগরিকদের জীবন দুর্বিষহ। দেশ ছেড়ে আট হাজার মাইল দূরে নিউ অরলিয়েন্সে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কবিতা লিখে প্রবাসী জীবনের অসহায়ত্ব প্রকাশ করা ছাড়া আমি নিরুপায়। মনে হয় চিৎকার করে বঙ্গবন্ধুর শেষ বছরের কথাগুলো প্রতিধ্বনিত করি আরও কঠিন ও কর্কশ ভাষায়।

"... প্রার্থিত নির্বাসনের চোখ দিয়ে

বাংলাকে মনে হয় যেন নষ্ট পোকার অবিন্যস্ত ঢিবি ...

রাজনীতির বেশ্যারা কিলবিল করছে স্বচ্ছন্দে

চারিদিকে সর্বনাশা মশা ... এনজিও মশা, আমলা মশা,

সুবিধাবাদী সাংবাদিক মশা, লোভি বেনিয়া মশা,

বুদ্ধিহীন বুদ্ধিজীবী মশা,

ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসী মশা ...

দিগন্ত হতে দিগন্তে শুধু পোকা আর মশাদের হরতাল।"

(লেখক: মোস্তফা সারওয়ার; কবিতার নাম ও বইয়ের নাম: প্রার্থিত নির্বাসনের উন্মাদ পদাবলী, পৃষ্ঠা ৫২)

হাজারও প্রতিবন্ধকতার মাঝেও আমি আশাবাদী হতে চাই। একান্ন বছর একটি জাতির জন্য খুবই কম সময়। চমকপ্রদ অর্জনের কথা জানিয়েছি এই প্রবন্ধের প্রথমে। দুর্নীতির কথা বলেছি দ্বিতীয় ভাগে। দুর্নীতির দৈত্যকে পুরোপুরি নিধন করা যাবে বলে হয় না। তবে এই দৈত্যের হাত পা ভেঙ্গে এক ন্যায়ভিত্তিক সমাজ হবে এবং এই অর্জনগুলো বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, মেহনতি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে– এটাই হলো আশা। এ জন্য অহিংসামূলক বিপুল গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এটাই হলো বিজয় দিবসের বাসনা।