কমিউনিস্ট পার্টি যে একটি বিশেষ কালপর্বে দেশের রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাববলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল তার পেছনে অজয় দার মতো মানুষদের ব্যক্তিগত ভূমিকা একেবারে গৌণ নয় বলেই আমি মনে করি।
Published : 17 Oct 2023, 04:22 PM
অজয় রায়, আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় অজয় দার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৩ সালের দিকে। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়ে তার নিজের জেলা ময়মনসিংহ থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ঢাকা আসার পর। তবে তার সম্পর্কে জানি আরও আগে থেকে। যেহেতু স্কুল জীবন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম এবং রাজনৈতিক বইপুস্তিকা পড়ার অভ্যাস ছিল, সেহেতু অজয় বায়ের ‘বাংলা ও বাঙালী' পড়া হয়েছিল। তাছাড়া কারাগারে ও আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতাদের বিষয়ে জানার আগ্রহ থেকেও আমি অজয় রায় সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিলাম তার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের আগেই।
মেধাবী ছাত্র ছিলেন, জেলে বসে পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে অর্থনীতিতে এম এ পাস করেছেন। তার বাবাও ছিলেন বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চার ভাষায় পণ্ডিত – এসব তথ্য জেনে একদিকে যেমন তাকে নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে, অন্যদিকে তেমনি কমিউনিস্ট হওয়ার ঝোঁকও প্রবল হয়েছে।
কমিউনিস্টরা সব অসাধারণ মানুষ, তারা একদিকে ধীমান, অন্যদিকে আত্মত্যাগী – এগুলোই আমাকে আকৃষ্ট করেছিল সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ তত্ত্বকথা তার পরের বিষয়।
অজয় দাকে বাইরে থেকে দেখে একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হলেও বাস্তবে তিনি তা ছিলেন না। তার মতো অমায়িক মানুষ খুব বেশি দেখিনি। তার সাথে সহজেই মেশা যেত, কথা বলা যেত, তর্কাতর্কিও করা যেত।
তার সঙ্গে বয়সের অনেক ব্যবধান সত্ত্বেও তিনি আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণই করতেন। আমার ধারণা অন্যদের সঙ্গেও তাই করতেন। কারণ এটাই ছিল অজয় দার বৈশিষ্ট্য। অজয় দার মধ্যে পাণ্ডিত্য জাহিরের কোনো ভাব ছিল না। অন্যের মত মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, নিজের মত চাপিয়ে দিতেন না।
পার্টির কোনো সিদ্ধান্ত আমার মনঃপূত না হলে অজয় দার কাছে গিয়ে তর্ক জুড়ে দিতাম। তার সঙ্গে অনায়াসে তর্ক করা যেত। যুক্তি পাল্টাযুক্তির লড়াই শেষ করতেন অজয় দা এইভাবে: কমরেড, আপনার কথায়ও যুক্তি আছে। কিন্তু এখন পার্টির সিদ্ধান্ত তো মানতেই হইবো। আমাকেও রণে ভঙ্গ দিতে হতো। পার্টির সিদ্ধান্ত বলে কথা! তার কোনো নড়চড় হওয়ার সুযোগ নেই।
অজয় দা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। অর্থনীতি ও শিল্প- সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। কমিউনিস্ট কিংবা কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন নন এমন কারও কারও সাথেও অজয় দার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তার সরলতা, জ্ঞান-বুদ্ধি অন্যদের সহজেই আকর্ষণ করত।
কমিউনিস্ট পার্টি যে একটি বিশেষ কালপর্বে দেশের রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাববলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল তার পেছনে অজয় দার মতো মানুষদের ব্যক্তিগত ভূমিকা একেবারে গৌণ নয় বলেই আমি মনে করি।
অজয় দা পার্টির সাপ্তাহিক মুখপাত্র ‘একতা’র সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। আমি একতায় কাজ করতাম। সেই সুবাদেও তার সঙ্গে আমার কাজের সম্পর্ক ছিল। তিনি একতায় লিখতেন। তার লেখা সংগ্রহের জন্য ওয়ারীর বাসায় যেতে হতো। কখনো কখনো আমাকে বসিয়ে রেখেই লেখা শেষ করতেন। তাতে আমি একটুও বিরক্ত হতাম না। বরং দেরি হোক মনে মনে সেটাই চাইতাম জয়ন্তী বৌদির সুস্বাদু চা-নাস্তা পাওয়ার লোভে।
একতা সম্পাদক মতিউর রহমানের বাসাও ছিল ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিটে। মতি ভাইয়ের বাসায় প্রায় প্রতি সকালেই যেতে হতো। সুযোগ পেলে কখনো কখনো অজয় দার বাসায় ঢুঁ মেরে আসতাম। তার সঙ্গে কতদিন কত বিষয়ে কত কথা হয়েছে তার সব কিছু এখন মনেও নেই। যদি দিনপঞ্জি লেখার অভ্যাস থাকত তাহলে অজয় দাকে নিয়ে আমার লেখা আরও তথ্যপূর্ণ হতে পারত।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত বিপর্যয়ের পর সিপিবির মধ্যেও আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। অজয় দাকে যেহেতু পার্টির তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে দেখা হতো সেহেতু আদর্শিক দ্বন্দ্বে তার অবস্থান কোন দিকে সেটা জানার আগ্রহ নিয়ে অজয় দার সঙ্গে আলোচনায় বসে বিস্মিত হলাম সংস্কারের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান দেখে!
আমার ধারণা ছিল তার মতো একজন পুরানা কমিউনিস্ট এতদিনের লালিত বিশ্বাস থেকে নড়বেন না। কারও কারও কাছে মার্কসবাদ যতটা না দর্শন, তারচেয়ে বেশি বিশ্বাস। আরও নির্দিষ্ট করে বললে অন্ধ বিশ্বাস!আমার মনে হয়েছিল, অজয় দা তার এতদিনের বিশ্বাস আঁকড়ে থাকবেন।মার্কসবাদী দর্শনকে অভ্রান্ত মনে করে কমিউনিস্ট পার্টি রক্ষায় জানপ্রাণ দিয়ে নামবেন। বাস্তবে তিনি বিপরীতটাই করলেন।
আমাকে বললেন, শুধু তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশে আর বাম আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃষ্টান্ত দিয়ে, অসংখ্য কমিউনিস্টের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের উদাহরণ দিয়েও যেখানে আমরা মানুষের ব্যাপক সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছি, সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর মার্কসবাদী তত্ত্বের প্রায়োগিক যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় এখন নতুন ভাবনার বিকল্প নেই।
এই নতুন ভাবনার অংশ হিসেবেই দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙ্গে গেল। এই ভাঙনে অজয় দা পক্ষ নিলেন সংস্কারবাদীদের। এরপর আমৃত্যু অজয় রায়ের কেটেছে এক ধরনের অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। কাজের ক্ষেত্র খুঁজেছেন, সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কতটুকু সফল হয়েছেন সে বিচার এখনই নয়।
তিনি ছিলেন চিন্তাশীল প্রগতিকামী সদাসক্রিয় মানুষ। মানবকল্যাণ, মানবমুক্তির যে স্বপ্ন নিয়ে কৈশোরকালেই নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন রাজনীতিতে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা থেকে কখনোই বিরত থাকেননি। নানা ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন অজয় দা। শেষপর্যন্ত স্থিতু হয়েছিলেন সামাজিক আন্দোলন নামের একটি সংগঠনে। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ বিরোধী একটি জাতীয় মঞ্চ গড়ে তুলতেও তিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন।
অজয়দা যখন যে উদ্যোগই নিয়েছেন তাতে শামিল হওয়ার জন্য আমাকে ডাকতেন। তার ডাকে সাড়া না দিতে পেরে খারাপ লেগেছে। কিন্তু আমার মনে হতো, এভাবে হবে না। আবার কীভাবে হবে সে সম্পর্কে আমার নিজেরও কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। তাছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগে জড়িত না হওয়ার ব্যাপারে আমি দৃঢ়মত। অজয় দার বয়স হয়েছিল। যখন তার অবসর কাটানোর কথা তখন তিনি নানা ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য সভা ডেকেছেন, মানববন্ধন করেছেন।
রক্তে তার মিশেছিল অন্যায়, অনাচার, অসাম্যের বিরোধিতা করা। চোখের সামনে এসব ঘটতে দেখলে তিনি কি নিশ্চুপ থাকতে পারেন?
পুরানো বন্ধুদের তিনি তার পাশে চাইতেন। খুব সাড়া পেতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তিনি হতোদ্যম হতেন না। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে – অজয়দা যেন শেষ জীবনে এই নীতি নিয়েই অগ্রসর হয়েছেন।
অজয় দা পার্টি ত্যাগের পর যদি আর কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগে না জড়িয়ে লেখালেখিতে অধিক মনোযোগী হতেন, তাহলে সেটাই বেশি ভালো হতো বলে আমি অন্তত মনে করি। অজয় দা বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। এরমধ্যে কয়েকটি বই অনেকের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।
সময় দিয়ে তিনি যদি লেখালেখি চালিয়ে যেতেন তাহলে আমরা আরও কিছু মননশীল গ্রন্থ পেতে পারতাম। শেষ দিকে রোগশয্যায় শুয়েও তিনি একটি বই লিখে গেছেন। রাজনীতি নয় – বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাই ছিল অজয় রায়ের উপযুক্ত ক্ষেত্র।
এই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্যই ছিল তারজীবন উৎসর্গীকৃত। অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক একটি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি বিরামহীন শ্রম দিয়েছেন। কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা নয়, নিজে দেশ ও সমাজকে কি দিতে পারছেন সেটাই ছিল তার জীবনসাধনা।
অজয় রায় আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। রেখে গেছেন কর্মনিষ্ঠার এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। যারা সমাজ প্রগতিতে বিশ্বাস করেন, যারা অসাম্প্রদায়িক দেশের জন্য সংগ্রাম করছেন তাদের কাছে যদি অজয় রায় প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হন তাহলে তার জীবনসাধনা বিফল বলে মনে হবে না। অজয় দাকে অনেক ব্যাপারেই আমার মনে পড়বে। ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার নিপীড়নের ঘটনা দেশে অব্যাহতভাবে ঘটতে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। তিনি এসবের বিরুদ্ধে আমৃত্যু প্রতিবাদী সোচ্চার কন্ঠ ছিলেন।
আজ ১৭ অক্টোবর অজয় রায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। পরিণত বয়সেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর – এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অজয় রায় এ দেশের রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি এবং মানব কল্যাণে বড় অবদান রেখেছেন। প্রগতির পথ রচনায় তার অবদানের কথা আমাদের মনে করতেই হবে।
অজয় দার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।