Published : 31 Aug 2016, 11:30 AM
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফর একটি উজ্জ্বল ঘটনা। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে জন কেরির সফরটি যদিও স্বল্পকালীন সময়ের জন্যে ছিল তথাপি বর্তমান সরকারের কর্মপদ্ধতিকে আকর্ষণ করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে স্থাপিত যাদুঘরে পরিদর্শনের পাশাপাশি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এটি এ দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। এ জন্যে তাঁকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি জন কেরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বক্তব্য রেখেছেন।
এ ঘটনাও আমাদের দুদেশের বন্ধুত্বকে আরও নিবিড় করে তুলবে। কেননা, মার্কিন সরকার ১৯৭১ সালে যদিও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপক্ষে ছিল, কিন্তু মার্কিন জনগণের একটি বড় অংশই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্বাগত জানিয়েছিল। জন কেরি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপ করেন।
জন কেরির এবারের বাংলাদেশ সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা আদানপ্রদান। আসলে জননেত্রী শেখ হাসিনা একান্তভাবেই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতিতে বিশ্বাসী। এই জঙ্গিবাদ কিন্তু এককভাবে আজ আর আমাদের সমস্যা নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাবাদ একটি বড় মাপের সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।
ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, জার্মানি থেকে আরম্ভ করে সৌদি আরব, ভারত, তিউনিসিয়া, তুরস্কসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ জঙ্গি হামলা হচ্ছে। আর পাকিস্তান হচ্ছে জঙ্গিবাদের অন্যতম আস্তানা।
জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে জন কেরি বিশেষজ্ঞ দিতে চেয়েছেন। এ দেশে জঙ্গিবাদ দমনে আমাদের গোয়েন্দারা বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে সরকার যে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে– কারিগরী ও উন্নততর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এবং তথ্য আদানপ্রদান। এ দুটি ইস্যু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ইতিবাচকভাবে ভাবতে চাচ্ছি।
যদি জঙ্গিবাদ দমনের জন্যে উন্নততর কারিগরী ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা পাওয়া যায়, তবে দেশীয় গোয়েন্দারা আরেকটু ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশে কাজ করতে পারবেন। পাশাপাশি যদিও বাংলাদেশে 'নিউ জেএমবি'-এর উত্থান ঘটেছে এবং তা দমনে গোয়েন্দারা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। তবে তথ্য আদানপ্রদান করা গেলে সেটি কেবল দেশের অভ্যন্তরের নয় বিদেশে থেকেও কোনো ঝুঁকি থাকলে তা মোকাবিলা করা সহজ হবে।
তামীম চৌধুরী সম্পর্ক যতটুকু ইতিহাস পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে তাতে বোঝা যায়, বিদেশে থাকতে গিয়ে কিংবা ক্যারিয়ার গড়তে গিয়েও কেউ জঙ্গির খপ্পরে পড়তে পারে। আবার সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা সাধারণ কলেজসমূহে পড়তে গিয়েও কেউ জঙ্গিতে পরিণত হতে পারে।
জঙ্গিবাদের জন্যে যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয় তা দেশে বৈধ বা অবৈধভাবে আসতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে এসে থাকে বলা যায়। এ অর্থ কীভাবে স্থানান্তরিত হচ্ছে সেটি নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা দরকার।
জঙ্গিবাদ মানুষকে অন্যায়ের দিকে ধাবিত করছে এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে সুন্দর ও ভালো গুণগুলো মলিন করে হিংস্র করে তুলছে। যদিও তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য তারপরেও এদের হিংস্রতা, ভয়াবহতা, অনৈতিকতা মানুষকে পশুতে রূপান্তর করছে।
দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদ একটি বড় বাধা। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনার অনমনীয় ও বিজ্ঞোচিত নেতৃত্বগুণে জঙ্গিবাদ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সচেষ্ট রয়েছে। এ দেশের ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষ জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করে। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি হয়।
যারা বিদেশে পড়ে এসেছেন, তাদের কেউ কেউ হয়ত বিভ্রান্তি ছড়ান। আগে মনে করা হত বিদেশ থেকে যারা তাবলিগ জামাতে আসছেন তারা কেবল ধর্মের পথে আহ্বান জানান। একমাত্র গোয়েন্দারাই বলতে পারবেন তাবলিগ জামাতের সঙ্গে জঙ্গিদের কোনো সংস্পর্শ আছে কি না।
যারা বিদেশে প্রবাসজীবন বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি সূত্রে যান, সেখানে ওয়াহাবী বা সালাফী মতবাদে দীক্ষিত হোন কি না– সেটি পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। আবার অনেকেই ব্যবসাসূত্রে তুরস্ক-পাকিস্তানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন, তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া দরকার।
আর্থিক খাতে Financial Intelligence সম্পর্কে জানা দরকার। সীমাহীন হিংস্রতা এবং জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তামীম চৌধুরীর মতো গুটিকয়েক নরপশুর কারণে দেশ পিছিয়ে যেতে পারে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, তামীম চৌধুরী আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এই আর্থিক লেনদেনের চ্যানেলটি খুঁজে বের করা দরকার।
জন কেরি ঠিকেই বলেছেন যে, হলি আর্টিজানের ঘটনা এ দেশকে বিশ্ব থেকে বিছিন্ন করার ষড়যন্ত্র।
জন কেরি ঢাকায় সফরকালে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি সম্পর্কে জননেত্রীকে বলেছেন যে, উনি উনার দুঃখ বোঝেন। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনা। আমরা বিশ্বাস করি, যতদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর একজন খুনিও পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবে, ততদিন জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে না। দুজন খুনিকে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হয় তবে এ দেশের জনগণও স্বস্তি পাবে।
জন কেরি বাংলাদেশে তাঁর দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা বলেছেন। এটি একটি ইতিবাচক দিক। আমাদের নির্দিষ্ট উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় মার্কিন বিনিয়োগ যদি কার্যকরভাবে আসে তবে তাকে স্বাগত জানাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তা নির্দিষ্ট খাতে আসা বাঞ্ছনীয়। বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের কারিগরী কলাকৌশল ও উন্নততর প্রযুক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। বস্তুত, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে শিল্পোয়নের জন্যে অবকাঠামোরও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন দরকার।
জন কেরি বাংলাদেশের সফরকালে পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, কর্মপরিবেশ ও ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগসুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেন।
জননেত্রী শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ১৩৬% পোশাক খাতে বেতন বাড়িয়েছেন।
তবে কর্মপরিবেশটি আরও উন্নত করার দায়িত্ব পোশাক খাতের বিভিন্ন কারখানার উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের। ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রমিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ন্যায্য দাবি আদায়েন শ্রমিক নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
জিএসপি ফ্যাসিলিটিজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গার্মেন্টেসের ক্ষেত্রে বন্ধ করে দিলেও তার ক্ষতি কিন্তু গার্মেন্টেসে নয়, বরং পাট-প্লাস্টিক ও অন্যান্য অপ্রচলিত দ্রব্যের উপর কর বেশি দিতে হচ্ছে– এ ব্যাপারটি অন্তত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিবেচনায় আনা দরকার।
অ্যাডওয়ার্ড এম কেনেডি সেন্টারে বক্তৃতাকালে জন কেরি বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদানের কথা বলেছেন। এ মুহূর্তে বঙ্গোপসাগর নিয়ে নিরাপত্তা বৃদ্ধির প্রস্তাবটি মূলত চীনের ক্রমবর্ধমান অাধিপত্য ঠেকানোর প্রয়াসও হতে পারে। এ অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক কারণে বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জন কেরি বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময়ে তাঁরা দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে আলোচনা করেন।
জন কেরি গণতন্ত্র ও সুশাসন সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি তাঁর আলোচনায় মন্ত্রীদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্ঠার সঙ্গে বিষয়টি আলোকপাত করেন। তাঁর বক্তব্য থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, হিলারি ক্লিনটনের সময়ে যে বৈরীভাব তৈরি হয়েছিল তা বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতায় কেটে গেছে।
বর্তমান সরকার দেশের উন্নয়ন ও প্রগতির জন্যে সার্থকভাবে ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়ার সঙ্গে যে সমস্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ গ্রহণ করেছে তা বাস্তবসম্মত।
মার্কিন বিনিয়োগ আমাদের দেশে যেমন দরকার তেমনি আমাদের পণ্য তাদের দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশের অধিকার দিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ পরিবেশের উন্নয়নে এবং ক্ষতিকারক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছে।
অবশ্য জন কেরির সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় খালেদা জিয়ার সহযোগিতা চাওয়া কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে তা একমাত্র তিনি-ই জানেন।
জন কেরির এ সফরের ফলে আগামীদিনের মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্র নীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। কেননা, নভেম্বর মাসেই পালাবদল শুরু হবে। হিলারি বা ট্রাম্প যিনিই পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হোন না কেন, নতুনভাবে আবর্তিত হবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি।
তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য পরিবর্তনের সুযোগ খুব কম। কেননা, তারা এখন তাদের চিন্তাভাবনায় ভারতকেও অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার মার্কিন ভূমিকা পারস্পরিক সমঝোতাভিত্তিক বন্ধুত্বসুলভ হলে এ দেশের অগ্রযাত্রা আরও বেগবান হবে।
তবে সেই দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা অবশ্যই ন্যায়ভিত্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
যে কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি তাদের স্বীয় সংশ্লিষ্ট স্বার্থে বদলায়। তারপরও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা এবং এ দেশের মানুষের মধ্যে মার্কিন সম্পর্কের বন্ধুত্বরূপ একটি সমৃদ্ধতর সম্পর্কের বাঁধনে উপনীত হতে পারে– সেখানে মানবিকতাই মুখ্য।