তার চিন্তা ও দূরদর্শিতার নাগাল পাওয়ার সক্ষমতা আমাদের ছিল না। এই কথাটি মেনে নিলেও আমাদের অপরাধ মুক্তি হবে না। অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হবার একমাত্র উপায় তার দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে চলা।
Published : 13 Apr 2023, 08:08 PM
আহমদ শরীফের গুড়ির আড্ডায় দ্বিমত ছিল। কেউ কেউ বলছিলেন জেনারেল এরশাদের সঙ্গে কাজ করলে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নামে ও গায়ে কলঙ্কের দাগ লেগে যাবে। জাফরুল্লাহ দৃঢ়কণ্ঠে জানালেন, ‘আমি মসিলিপ্ত হই তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু কাজটি করতে পারলে দেশের মানুষ শতবর্ষ ধরে উপকৃত হবে।’ কাজ মানে জাতীয় ঔষধ-নীতি।
এমন নয় যে ওষুধ নীতি নিয়ে তিনি শুধু প্রেসিডেন্ট এরশাদের কাছেই ধর্না দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এই কাজে নীতিগত সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সময় হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের কাছে গেছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া তাকে বলেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসাবে যোগ দিয়ে যা করতে চান করুন।
জিয়ার পর এরশাদ। জাফরুল্লাহ তখনও লেগে আছেন ওষুধ নীতি নিয়ে। দেশের মানুষকে ওষুধ-মাফিয়ার হাত থেকে মুক্ত করা তখন তার জীবনের ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
'ওষুধ-মাফিয়া'। আমরা তো বটেই, পৃথিবীর খুব কম মানুষই জানে অস্ত্র ও মাদক মাফিয়াদের চাইতেও বড় এবং ভয়াবহ সিন্ডিকেট এই ওষুধ-মাফিয়া। মানুষ চিনতে পারে না তার মূল কারণ এটি 'হোয়াইট কলার মাফিয়া'। এরা নিজেদের সুবিধামতো আইন তৈরি করিয়ে নিয়ে পৃথিবীজুড়ে জাল বিছিয়ে রেখেছে। এদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে দেশে আইন তৈরি করেই লড়তে হবে। তার জন্য ওষুধ-নীতি চাই-ই চাই। লড়াইটি আরো বেশি কঠিন, কারণ বিরোধিতা শুধু দেশে নয়, বিদেশের শক্তিকেন্দ্রগুলো থেকেও আসছে।
জর্জ বুশের পরিবার অনেকগুলো মাল্টিন্যাশনাল ওষুধ কোম্পানির বড় শেয়ারহোল্ডার। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের ওপর তাদের ব্যাপক প্রভাব। অন্য মালিকরাও ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের নীতি নির্ধারক। তাদের সাম্রাজ্যে হানা তারা সহ্য করবে কেন? বহুজাতিক কোম্পানির ঝানু প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব, এমনকি প্রেসিডেন্টকেও কনভিন্স করার চেষ্টা করেছে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ দোদুল্যমান হয়ে পড়েছিলেন।
কাজেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানারকম বিতর্ক উঠতে শুরু করল প্রস্তাবিত ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক আজিজুর রহমানের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানবতাবাদী চিকিৎসক, স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী, সমাজকর্মীরা সম্মিলিতভাবে বিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় একটি ওষুধের তালিকা তৈরি করেছিলেন। তাদের প্রণীত বইটির নাম 'এসেনশিয়াল মেডিসিনস'। বইটি প্রকাশে বাধা দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু নানান কৌশলে এটির প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছিল। জাফরুল্লাহ বইটি দেখেছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে। কিন্তু বইটি ওখানে বসেই পড়তে হয়েছিল। কারণ সেটি কারো নামে ইস্যু করা হতো না। পরবর্তীতে দেশে ফিরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তিনি বইটির কপি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। এই বইটি ছিল তাদের ঔষধ-তালিকা প্রণয়নের অন্যতম ভিত্তি। বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত ওষুধগুলোর মধ্যে প্রায় দুই হাজার ওষুধ অপ্রয়োজনীয় বলে বাদ দেওয়া হয়েছিল। শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়। ক্ষতিকরও বটে। প্রথমত ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। দ্বিতীয়ত রোগীর আর্থিক ক্ষতি।
এই তালিকা নিয়ে চূড়ান্ত বিতর্কটি হয়েছিল বঙ্গভবনে। একদিকে বহুজাতিক কোম্পানির এক্সপার্ট প্রতিনিধি ও তাদের দেশীয় সহযোগীরা, অন্যদিকে জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ও তাদের আট সহযোগী। বিচারক স্বয়ং প্রেসিডেন্ট এরশাদ। সেই চূড়ান্ত শুনানিতে অন্যদের আক্রমণের উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট এরশাদের চোখের অসুখের কারণ যে একটি ওষুধ খাওয়া, সেটিও উল্লেখ করেছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বই খুলে দেখিয়ে দিয়েছিলেন সেই ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, যাতে বলা হয়েছে দীর্ঘদিন সেবনে চোখের বিশেষ ধরনের অসুখ হবার কথা।
পাশ হলো ওষুধ নীতি।
২.
শুধু তালিকা নির্ধারণ করাই নয়, ওষুধের দাম কোনোভাবেই অত বেশি হতে পারে না, তা প্রমাণ করে দেওয়া এবং দাম কমানোর প্রস্তাবও ছিল ওষুধ নীতিতে। মনে আছে, সেই সময় প্যারাসিটামল ট্যাবলেট প্রতিটি এক টাকা থেকে দেড় টাকায় বিক্রি হতো। সেই ট্যাবলেট প্রতিটি ১৪ পয়সায় বিক্রি করলেও কোম্পানির ২০% লাভ থাকে তা অংক কষে দেখিয়ে দিয়েছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীরা। দুই টাকার সেমিটিডিন ৬০ পয়সায় নামিয়ে এনেছিলেন তারা। জীবন রক্ষাকারী হার্টের অসুখ লেনোক্সিনকে পাঁচ টাকা থেকে নামিয়ে এনেছিলেন ৫০ পয়সায়। এভাবে সব ওষুধের দাম কমে গিয়েছিল বাংলাদেশে।
নব্বই পরবর্তী সরকারগুলোর সময় ওষুধের দাম দফায় দফায় বেড়ে চলেছে, তার দায় সরকারসমূহের।
৩.
এন্টিবায়োটিক তৈরির মেটেরিয়ালের কপিরাইট দেশে আনতে পারা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিশাল এক অবদান। সেই অবদানের ফলে দেশে ওষুধশিল্পের ব্যাপক বিকাশ হয়েছে। আশির দশকে দেশের মোট প্রয়োজনীয় ওষুধের শতকরা ৮০ ভাগ আমদানি করতে হতো বিদেশ থেকে। এখন চাহিদার শতকরা ৯৫ ভাগ ওষুধ তৈরি হয় আমাদের দেশেই।
৪.
আমরা এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তার গৃহীত সব পদক্ষেপেরই বিরোধিতা করেছিলাম। এরশাদ যেহেতু অবৈধ শাসক, অতএব তার গৃহীত কোনো সিদ্ধান্ত আমরা মানব না– এটাই ছিল আমাদের মনোভাব। এই মনোভাব থেকে আমরা তখন ওষুধ নীতিরও বিরোধিতা করেছিলাম। আমাদের বিভ্রান্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন বিএমএ নেতৃবৃন্দ এবং জাঁকিয়ে বসা মেডিকেলের অধ্যাপকবৃন্দ এবং ব্যবসাসফল ডাক্তাররা। তবু জনগণের জন্য সান্ত্বনা এটুকু যে ওষুধ নীতি বাতিল হয়নি। জনগণ তার সুফল ভোগ করছে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী সময়ের চাইতে অনেক এগিয়ে থাকা মানুষ। তার চিন্তা ও দূরদর্শিতার নাগাল পাওয়ার সক্ষমতা আমাদের ছিল না। এই কথাটি মেনে নিলেও আমাদের অপরাধবোধ দূর হবে না। অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হবার একমাত্র উপায় তার দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে চলা। প্রায়শ্চিত্ত পূর্ণ হবে তখনই, যখন আমরা রোগীর জন্য সারাদেশে রেফারেল সিস্টেম চালু করতে পারব।