মানুষ কিংবা দেশকে ভালোবাসার পেছনেও ‘পবিত্র পাগলামি’ থাকে। প্রাণ দিতেও পিছপা হয় না মানুষ। কথায় আছে পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না।
Published : 02 Mar 2025, 05:31 PM
মাঝরাতে পাড়ার পরিচিত এক ডাক্তারের বাসার দরজা ধাক্কাচ্ছে আইজউদ্দী। ঘুম ভাঙ্গার পর ডাক্তার জানতে চাইল, কে? এত রাতে কী চাই? আইজউদ্দী বলল, আমি আইজউদ্দী। আমার বউয়ের পেইন উঠেছে। সহ্য করতে পারতেছে না। সম্ভবত অ্যাপেন্ডিসাইটিসের পেইন। ডাক্তার দরজা খুলে উত্তর দিলেন, অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা তো হবার কথা না। গত বছর না অপারেশান করে ফেলে দিলাম? আইজউদ্দী খানিক লজ্জা নিয়ে বলল, ডাক্তার সাহেব এটা আমার নতুন বউ!
নতুন কখনো-সখনো দেখারও ব্যাপার। যেমন বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকার নাম নূতন হলেও মানুষ তাকে নতুন নামেই ডাকে। এর একটা কারণ এমন হতে পারে যে, তার অভিনীত প্রথম ছবির নাম ‘নতুন প্রভাত’ যার পরিচালক ছিলেন মোস্তফা মেহমুদ। নূতন অভিনীত বাংলা চলচ্চিত্রে তার নাচ দেখার একটা ট্রেইন্ড ছিল একসময়। বাংলা চলচ্চিত্রের ওই দিন আর নাই। তবে হিন্দি ছবির এক নায়িকারও নাম ছিল নূতন। তাকে বলা হতো চিরনতুন নূতন। নতুন নায়িকা, নতুন বউ যেমন দেখার ব্যাপার, নতুন দলও নাকি তেমনই দেখার ব্যাপার।
আসলে নতুন নিয়ে বাঙালির আদিখ্যেতার শেষ নেই। ধরুন আপনি একটা পত্রিকার নাম রাখলেন ‘নতুন দিগন্ত’। কিছুদিন পর দেখা গেল নতুন আরেকটা পত্রিকা এসেছে যার নাম ‘নয়া দিগন্ত’। আমার কাছে একজন জানতে চাইল ‘নতুন’ আর ‘নয়া’-এর মধ্যে পার্থক্য কী? আমি বললাম, জানি না। ওই একজন বলল, এটা ঠিক জল আর পানির মতো না। নতুন মানে হতে পারে আপনি বামের অনুসারী বিধায় নাম ‘নতুন দিগন্ত’। আর ডান হলে নাম ‘নয়া দিগন্ত’ হওয়া অস্বাভাবিক না। সুতরাং সব শব্দই অবিতর্কিত না! ইংরেজিতে পত্রিকার নাম আছে ‘নিউ এইজ’। প্রিয় পাঠক আপনাদের কারোরই ইংরেজি শব্দ ‘নিউ’ অর্থ অজানা থাকার কথা নয়। ধরুন আপনারা দুই বন্ধু মিলে ব্যবসা করেন এবং প্রতিষ্ঠানের নাম সীমা টেড্রার্স। বাঙালির পার্টনারশিপ ব্যবসা বেশিদিন টেকে না বিধায় দুজন আলাদা হলেন এবং নতুন যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলো তার নাম হতে পারে, ‘নিউ সীমা ট্রেডার্স’! যেমন ছিল ভাটিয়াপাড়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। তিনভাগে ভাগ হবার পর একটার নাম হলো ‘আদি ভাটিয়াপাড়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। একটা থেকে গেল মূল নামে, আরেকটার নামকরণ করা হলো, ‘দ্য নিউ ভাটিয়াপাড়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’! এই তিনটা আবার এক হলে অনেকটুকু ডান, কিছুটা বাম এবং খানিকটা মধ্যপন্থি গোটা দেয়ার মতো হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির সমর্থকরা যেমন ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ/ জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’ গানটা ভালোবাসে তেমনি এরশাদের জাতীয় পার্টির লোকজন ভালোবাসে ‘নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা/ নতুন করে আজ শপথ নিলাম’। নতুন শপথ, নতুন গান, নতুন দল, নতুন স্বাধীনতা কিংবা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে ২০২৪-এর অগাস্টের পর থেকে আলোচনা শুরু হয়েছে, এখনও অনেক আলোচনা হচ্ছে। ওইসব নিয়ে না হয় পরে আলোচনা করা যাবে! সব নতুন আলোচনা সব সময় ‘সময় উপযোগী’ নাও হতে পারে!
কথা উঠেছিল আদিখ্যেতা নিয়ে। কবিতায় আছে, ‘ওরে নবীন (নবীন এখানে নতুন) ওরে আমার কাচা/ আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’! কবিতা কাম গানে আরও আছে, ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখীর ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’ জয়ধ্বনি করার আগেও কিছু ঘটনা ঘটে। যেমন বছরের নতুন বা প্রথম ঝড়ে আমের মুকুল বা ছোটখাটো আম কিংবা ধান নষ্ট হয়। সব নতুন কিন্তু ভালো ফল বয়ে আনে না। যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ছেলে লিখেছে, মাকে হারানোর পর একরকম ভালোই ছিলাম। কিছুদিন পর বাবা এক মহিলাকে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ইনি তোমার নতুন মা। শুরু হলো শাসনের নামে নতুন মায়ের নতুন অত্যাচারের দিন। সবাই বলে সৎ মা। এরেই বলে সততা?
যাই হোক বাংলা ছবির স্বর্ণযুগে নতুন ছবি মুক্তি পেলে সিনেমা হলের সামনে ব্ল্যাকে টিকেট বিক্রি ও হলে ঢোকা বা বের হবার সময় ভাঙচুর করাটাও যেন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাড়ায় কোনো নতুন ভাড়াটে বা বাড়ি কিনে কেউ থাকতে এলে ওই বাড়িতে যদি সুন্দরী মেয়ে থাকত তাহলে ভিড় লেগে যেত বাড়িটার সামনে। এখন নতুনের জায়গায় ভিন্ন রকম জিনিস এসেছে। যেমন মোবাইল। নতুন কেনার পর সেটা দেখানোরও ব্যাপার থাকে।
নতুন বউ এবং বাসর নিয়েও অনেক কৌতুক প্রচলিত আছে। এই ক্যাটাগরির বেশিরভাগ কৌতুকই আঠারো প্লাস হওয়ায় পরিবেশন না করাই ভালো।
নতুন দল বা পার্টি কখন করে মানুষ? কৌতুক করে বলা হয় যখন প্রান্তিক একা একা মানুষেরা অনেকের সঙ্গে পারবে না জেনেও নিজেকে শক্তিশালী ভাবা শুরু করে। প্রান্তিক মানুষদের উজ্জীবিত করতে বলা হয়, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। বলা হয় সাধারণ মানুষের শক্তিকে কখনো অবহেলা করো না। কিন্তু বিপরীত বাস্তবতার কথা হচ্ছে, বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস! আপনি কৌতুক করে যতই বলুন, বন্দুক কি একনলা নাকি দুই নলা, মনে রাখবেন ক্ষমতা নাকি কখনো পুরোনো হয় না। যারা ক্ষমতা থেকে ছিটকে যায় তারা হয়তো অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে কিন্তু ক্ষমতা সবসময় নতুন থাকে! অভিজ্ঞতার কারণে পুরোনো দলকে তুলনা করা হয় ভাতের সঙ্গে। পুরোনো চাল নাকি ভাতে বাড়ে। বাস্তবতা কখনো-সখনো ভিন্ন হতে পারে। ১৯৪৭ সালের আগে-পরে ভারত উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল মুসলিম লীগ বাংলাদেশ থেকে একরকম উধাও হয়ে গেছে! ২০২৪-এর জুলাই বাস্তবতা কি কোনো একটা দলকে মুসলিম লীগ পর্যায়ে নামিয়ে আনবে? নামালে সেটা কোন দল?
লেখাটা সিরিয়াস পর্যায়ে চলে যাক জাতি তা একেবারেই চায় না। আমরা অন্যদিকে মন দেই। কথায় আছে পুরান পাগল ভাত পায় না, নতুন পাগলের আমদানি। নতুন পাগলদেরও পুরান পাগলরা জায়গা ছেড়ে দিতে চায় না। মানুষ কিংবা দেশকে ভালোবাসার পেছনেও ‘পবিত্র পাগলামি’ থাকে। প্রাণ দিতেও পিছপা হয় না মানুষ। কথায় আছে পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না। পৃথিবীটা নাকি বিচিত্র সব পাগলের মেলা। যারা দেশপ্রেম নামের পাগলামির পর আত্মত্যাগী হয় তাদের মহিমাও চিরনতুন।
যাই হোক নতুন রাজনৈতিক দল এনেছে ছাত্ররা, হয়েছে নতুন ছাত্র সংগঠনও। অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে এসব নিয়ে। কেউ বলছে এটা কিংস পার্টি। সরকারের কেউ কেউ বলছেন, এদেশের প্রথম কিংস পার্টি বাকশাল, যেখানে কিং ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিএনপিও একটি কিংস পার্টি, যেখানে কিং ছিলেন জিয়াউর রহমান। জাতীয় পার্টিও তাই, যেখানে কিং ছিলেন এরশাদ। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পার্টি কিংস পার্টি না, কারণ এখানে ড. ইউনূস কিং হননি বা হতে চাননি। আবার কেউ কেউ বলছেন, নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করলেও তার সহযোদ্ধারা এখনও সরকারেই আছেন। সরকারের সুযোগ-সুবিধা নিয়েই এ দল গঠন করা হয়েছে। যে ছাত্রদের দৃশ্যত কোনো আয় নেই, দল গঠন করার বিশাল খরচ তারা কোথা থেকে পেলেন?
তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? নতুন দলকে সাধুবাদ জানাবেন নাকি সমালোচনা করবেন? দুটো পথই খোলা রাখা হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার, আপনি কোন পক্ষে যাবেন। তাই প্রথমটা কৌতুক–
দুই বন্ধু গল্প করছে। এক বন্ধুর মন খুব খারাপ। সে কান্নাকাতর। প্রথম বন্ধু বলল, তোর ছেলে নাকি নষ্ট হয়ে গেছে? কী করে রে? ছিনতাই-মিনতাই না তো? অন্য বন্ধুর উত্তর, না রে, তারচেয়েও খারাপ। প্রথম বন্ধু আবার জানতে চাইল, তাহলে কি নেশা করে? ড্রাগ-ট্রাগ নেয়? অন্য বন্ধুর উত্তর, না বন্ধু, এরচেয়েও খারাপ। প্রথম বন্ধু অবাক হয়ে বলল, এরচেয়ে বেশি খারাপ আর কী আছে? অন্য বন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার ছেলেটা রাজনীতিতে নেমেছে!
হয়তো রাজনীতি নিয়ে নেতিবাচক ধারণাটা এবার বদলাতে পারে। তাই পরেরটা বিখ্যাত কবিতা। এরচেয়ে বড় সাধুবাদ আর কী হতে পারে? সুকান্ত ভট্টাচার্য যেমন লিখেছিলেন–
“এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
ক’রে যাবো আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস॥”