Published : 18 Mar 2016, 05:51 PM
জনগণের অাগ্রহ অাছে কি না সেটা বড় বিষয় নয়, দলাদলির কারণে জাসদ অাবার ভাঙ্গনের মুখোমুখি হল। দলটি অামাদের যৌবনে বাম রাজনীতির খোয়াব দেখিয়ে পপুলার হলেও মূলত এর নেতাদের জীবনে তার কোনো প্রভাব ছিল না। অামরা নিজেরা এখন ষাটের দোরগোড়ায়। পেছনে তাকালে দেখি বঙ্গবন্ধুর ভাগনের সঙ্গে রেষারেষি অার জনক যেহেতু উভয় দিকে গিয়ে সমতা রাখতে পারেননি, জাসদ একলাফে মগডালে উঠে গিয়েছিল।
বললে তারা খুব মাইন্ড করেন, কিন্তু এটাই সত্য যে, জাসদ ছিল মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের গোপন অাস্তানা। মুখে বাম প্রচারে সমাজতন্ত্র থাকলেও এর অাড়ালে-অাবডালে সংঘটিত নিষিদ্ধ জামাত ও মুসলিম লীগাররাই একে চালিয়েছিল। যে কারণে শেখ মুজিবর রহমান ও চার নেতা নিহত হবার পর জাসদের জনপ্রিয়তা দূরে থাক, অস্তিত্বও রইল না। অবশ্য এর ভেতরে গদি দখলের নানা খেলায় তারা প্রচণ্ড মার খায়।
জাসদের ইতিহাসই হচ্ছে বড় বড় কথা, মাস্টার প্ল্যান, পরিশেষে সবকিছু ভণ্ডুল করে দেওয়া। অাজ তাদের যেসব নেতা গণবাহিনী ও বিপ্লবের গালগল্প করেন তারা নিহত-অাহত নিরীহ জাসদ কর্মীদের কথা বলেন না। এ-ও বলেন না যে, তাদের চোরাপথে গদিতে যাবার মিশনগুলো কীভাবে মাঠে মারা গিয়েছিল।
জিয়াউর রহমানের মতো খাস লোক খুঁজে পাওয়া ও তার মাধ্যমে পাকিকরণের পথ করে নেওয়া চক্র আর কোনোদিন জাসদকে কাছে টেনে নেয়নি। তাহেরের বাণী প্রচারকারীরা তাঁকে নির্ভীক নিঃশঙ্ক যাই বলুক না কেন, জিয়ার সঙ্গে শাসনভার ভাগাভাগি করার কাজটি ঠিকমতো হলে ইতিহাস অন্য কথা বলত। মূলত সে সময় জাসদের বিদায়ঘণ্টা বেজে যায়।
অামরা ভেবেছিলাম সময়ের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা দল সময়েই নিঃশেষিত হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের নেতাদের অারও একটা অতীত অাছে। বেশিরভাগই ছিলেন শেখ মুজিবের হাতে গড়া। এরা মুক্তিযোদ্ধা। এদের ইমেজও ছিল অাকাশসমান। ফলে তাঁরা টিকে থাকলেন। তবে যে যার মতো একেকটা জাসদ বাসদ জেএসডি বানিয়ে।
এই টিকে থাকার ফলে রাজনীতির লাভ-লোকসান যাই হোক জাসদ নামটি মরল না। বদলে যাওয়া দেশ ও রাজনীতিতে জাসদের দরকার পড়ল ১৯৯৬ সালে। এককভাবে সরকার গঠন করতে না পারায় এরশাদের সহযোগী এমনকি গণতন্ত্র নিধনে ভূমিকা রাখার পরও অা স ম রবকে সঙ্গে নিল অাওয়ামী লীগ। তখন ইনুরাও এসে যোগ দিলেন। কিন্তু সেসব পিরিতি বালির বাঁধ। এক সময় বিএনপি গদিতে এলে শাহজাহান সিরাজ ভিড়লেন সে দিকে। ভরাডুবির জাসদ অাসলে কোথাও থিতু হতে পারেনি।
এমন করতে করতে প্রায় ভুলে যাওয়া দলটি জোটের শরিক হয়ে শেখ হাসিনা ও নৌকার বদৌলতে কয়েকটি সিট লাভ করে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতে চাইল। বিশেষত হাসানুল হক ইনু মন্ত্রিত্ব পাবার পর খালেদা জিয়া-বিরোধী স্পোকম্যানে পরিণত হলে তাঁর কদর বাড়তে থাকে।
এদিকে সংসদে মঈনুদ্দীন খান বাদলের জ্বালাময়ী ভাষণে আওয়ামী-সমর্থকদের ভেতর ধন্য ধন্য পড়ে গেল। যদি কখনও ফ্রি ও ফেয়ার নির্বাচন হয় এবং তিনি মশাল মার্কাায় দাঁড়ান তাঁকে সেদিন যে আকারে যে চেহারায় দেখা যাবে সেটাই তাঁর আসল। তাছাড়া পারিবারিকভাবে বিএনপি ও জামাতের সঙ্গে কড়া মিত্রতা আছে তাঁর।তার বড় বড় কথা, মুক্তিযুদ্ধ-প্রেম আর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধাচারণের পরও মন্ত্রিত্ব জোটেনি। তিনি ধরে নিয়েছেন, এর জন্য দায়ী ইনু। ফলে যখনই সুযোগ পেয়েছেন জাসদ ভাঙ্গার নামে নিজের আসল চেহারায় বেরিয়ে এসেছেন। এ যাবত প্রকাশিত খবরাখবরে তিনিই একমাত্র লোক যিনি বলেছেন জাসদ ভাঙ্গার মূল কারণ নাকি ইনুর সম্পদের পাহাড়।
এদের কথায় দেশ ও জাতির কিছু যায় আসে না। বহু আগেই বাতিলের খাতায় চলে গিয়েছেন এরা। বেঁচে আছেন মিডিয়া আর রাজনীতির দুষ্ট চালে। প্রথম কথা, স্বয়ং জাসদেরই এখন আর কোনো জোশ অবশিষ্ট নেই। না আছে ছাত্র না মজুর শ্রমিক না তারুণ্য। আপনি বাংলাদেশের উঠতি তারুণ্যকে প্রশ্ন করুন, তারা জাসদ কী জানেই না। তাছাড়া যে জাসদ এখন আওয়ামী লীগের 'বি' টিম তার লেজুড় ধরে কী লাভ? তার চেয়ে ঢের ভালো ছাত্রলীগ করা।
এবার খুব শান-শওকতের সঙ্গে তাদের সম্মেলন করার চেষ্টা হয়েছিল। দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি বা রাজনীতিতে আদর্শের টিমটিমে বাতির বাম দলগুলো বা কমিউনিস্ট পার্টি যেখানে হলরুমে বা ছোটখাটো কোথাও সম্মেলন করতে বাধ্য হচ্ছে সেখানে মশালের বিশাল ছবি, চোখ-ধাঁধানো স্টেজ আর নেতাদের ভীড় চোখে লাগার মতো।
আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম সাহেব সরলভাবে বলেই দিয়েছেন তিনি জানতেন না জাসদ এত শক্তিশালী একটি দল। ধন্যবাদ নাসিম ভাই, আমরাও জানতাম না। দলে দুএকজন মন্ত্রী থাকলেই যে এমন জেল্লা আর শান দেওয়া যায় এটা জানা ছিল না। কিন্তু তাতেও শেষ ভালো হয়নি। ইনুর পাশে বসা শরীফ নুরুল আলম আম্বিয়াও চটে গিয়েছেন। আগেই বলেছি, জাসদ ভাঙল না বুড়ি মরল তাতে এ জাতির লাভ-লোকসান নেই।
আমরা জানতে পারলাম না কেন এই ভাঙ্গন বা জাসদ আসলে এখন কী ধরনের রাজনীতি করে। দুনিয়ার কোথাও বামরা সুখে নেই। পৃথিবীর বদলে যাওয়া সময়ে বাম রাজনীতির ভেতর অনেক ধরনের বিষক্রিয়া ঢুকে গেছে। স্বয়ং লেনিন কতটা মহৎ ছিলেন তা নিয়ে রাশিয়ায় বিতর্ক চলছে। কার্ল মার্ক্সকে একপাশে সরিয়ে রাজনীতি করার মাশুল দিয়েছে বামরা।
আমাদের পাশের বঙ্গে একদা জমজমাট সাম্রাজ্যের লাল লাল নেতারা এখন অস্তাচলে। তাঁরা গেছেন বড় কথা নয়, পশ্চিমবঙ্গকে দিয়ে গেছেন উৎকেন্দ্রিক এক মহিলার হাতে। যিনি মাদ্রাসা-প্রেমী জঙ্গি পুষে ভোট বাড়ানোর রাজনীতি করতে ভালোবাসেন। কিছুদিন আগে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। প্রত্যেকের এক কথা, বাম রাজনীতির দিন দুনিয়ায় আর নেই। তারা এ-ও মনে করেন, ভালো লোক আর বৃদ্ধ লোকেরা সমাজের অভিভাবক বটে, তাদের হাতে সমাজ বা দেশ নির্মাণ হয় না। তাছাড়া এখন কি আগের সে দুনিয়া আছে যে, শোষণ শোষণ বলে গান গেয়ে পলিটিক্স করা যাবে?
জাসদের নেতারা নিজেরাও জানেন না কী তাদের রাজনীতি, কী তাদের উদ্দেশ্য। জানেন না বলেই ইনু কালবিলম্ব না করে দুটো কমিটি হবার জন্য জঙ্গিবাদকে দায়ী করে দিয়েছেন। তার কথামতো, যারা পাল্টা কমিটি করেছে তারা জঙ্গিবাদের উস্কানিদাতা। এদ্দিন এদের সঙ্গে রাজনীতি করলেন কীভাবে তবে? কী চায় আজকের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল? এদেশের উন্নয়ন তারুণ্য ডিজিটাল ভাবনায় তারা কোথায়?
এগুলোর কোনো উত্তর নেই। সেই স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবে এ দেশ ও জাতিকে অস্থির রেখেছিল জাসদ। নেতারা বঙ্গবন্ধুর মুণ্ডু চিবিয়ে খেতে পারলে বাঁচত। এরা তারুণ্যকে বিপ্লবের নামে বেপথে ঢেলে দিলেও কখনও দায় স্বীকার করেনি। কালক্রমে 'শত্রুর শত্রূ আমার মিত্র' এই হিসেবে আওয়ামী-ঘনিষ্ঠ হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সুফল কুড়ালেও দল হিসেবে জাসদের আমার্জনীয় ব্যর্থতা কখনও ঢাকা পড়বে না।
এবারের যে ভাঙ্গন তার পেছনে না আছে কোনো আদর্শ না কোনো ব্যাখ্যা। এ স্রেফ পাওয়ার গেইম। সঙ্গে যোগ হয়েছে নেতা নামধারী কিছু মানুষের খায়েশ। দেশ জনগণ গণতন্ত্র ও উন্নয়নের হাজার ইস্যু মাঠে। তাতে জাসদের মন দেবার সময় কোথায়? বাহাত্তর থেকে আজ অবধি একবার বন্দুকের নল একবার হঠকারিতা আর এবার আপোসের নামে কুড়াল মারার কাজ চলছে।
একটি গল্প চালু আছে জাসদের নেতাদের নামে। খুব টক লেবুকে নাকি মিঠা লেবু বলে বিক্রির চল আছে গাঁয়ে। এক বোকা লোক সরল বিশ্বাসে সেই তিতা লেবু কিনেছিল মিঠা মনে করে। খেয়ে যখন মেজাজ চরমে, ফিরিয়ে দিতে এসেছিল বাজারে। বচসা আর ঝগড়ার পর জানল, তিতা লেবু মিঠা মনে করে খেয়ে ফেললে আর ফেরত নেওয়া হয় না। বাম আর্দশের নামে একবার গিলে ফেলা কুইনাইন আর ভুল ডোজের জাসদকে কেউ নেয় না। আর নিলেও সে নিজেই ঠিক থাকতে পারে না।
তবু দেশের মিডিয়ার তারা শিরোনাম, সেটাও কম কী! ঝড়ে ভাঙ্গে বা গড়ে বটে, দুচারজন ফকিরের কেরামতি তো বাড়ে।