নূর হোসেনের বুকে-পিঠে স্লোগান লেখা না থাকলে হয়তো তার লাশ হয়তো পাওয়া সম্ভব হতো না। ১০ নভেম্বরের আরেক শহীদ আমিনুল হুদা টিটো কিন্তু অজ্ঞাত লাশ হয়েই আছেন।
Published : 10 Nov 2022, 07:37 PM
বাংলাদেশকে বলা হয় প্রতিবাদের দেশ, মিছিল-মিটিংয়ের দেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ওই প্রতিবাদ, মিছিল-মিটিংয়ের ধারাতেই। পাকিস্তান যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতো, যদি বাঙালি জাতির প্রতি বিদ্বিষ্ট না হতো, এমন কি যদি সত্তরের নির্বাচনের রায় মেনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর কর হতো স্বাভাবিক নিয়মে, যদি ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া না হতো, তাহলে পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা হয়তো একাত্তরেই ওভাবে বেজে উঠতো না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য কিন্তু এক নদী রক্ত সাঁতরে আসতে হয়েছে। বাংলাদেশ ৩০ লাখ শহীদের দেশ। আশা করা হয়েছিল, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে আর নিরীহ নাগরিকের রক্ত ঝরবে না। কাউকে আর শহীদ হতে হবে না। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। তাই বার বার এই স্লোগান উচ্চারিত হয় বিভিন্ন মিছিলে ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না'। শহীদের রক্ত বৃথা যায় – বিজয় অর্জন করে সে বিজয় আমরা ধরে রাখতে পারি না, হাতছাড়া হয়ে যায়। শহীদ নূর হোসেনের আত্মদানের ঘটনাটিও কি আজ আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে না?
নূর হোসেনের কথা কি আমরা ভুলে গেছি? না, নূর হোসেন শহীদ হওয়ার দিনটি এখনো হয়তো কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে থাকে। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিকতা এক ধরনের তামাশার মতো মনে হয়। কেন নূর হোসেনকে জীবন দিতে হয়েছিল? ক্ষমতা জবরদখলকারী সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছিল। ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল হাইজ্যাক না করলে এরশাদকে হটানোর জন্য বিরোধী দলগুলোকে রাজপথে নামতে হতো না। কিন্তু এরশাদ ছিলেন ‘বিশ্ব বেহায়া’। তাই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য গণআন্দোলনের বিকল্প ছিল না। বিরোধী দলগুলো যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলে সরকার সাত দিনের জন্য সভা-সমাবেশ, মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকরা যাতে ঢাকা আসতে না পারে তার জন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ করা হয়েছিল। এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ৮-দল, ৭- দল এবং ৫-দলীয় জোটের সমর্থকরা সারাদেশে থেকে ঢাকায় এসে জড়ো হয়েছিল অবরোধ কর্মসূচি সফল করতে। 'এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি?'- স্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। সেদিনের কর্মসূচি ছিল মূলত সচিবালয়কে ঘিরে। সচিবালয়কে মনে করা হয় সরকারের হৃদপিণ্ড। সচিবালয়কে অবরুদ্ধ করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলাই ছিল আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য।
ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী সরকার মানুষের প্রতিবাদের বিষয়টিকে বিবেচনায় না নিয়ে জনতাকে দমন করার জন্য রাস্তায় নামিয়েছিল পুলিশ এবং বিডিআরের সশস্ত্র সদস্যদের। কিন্তু মৃত্যুভয়ের পরোয়া না করে হাজারো প্রতিবাদী মানুষ স্লোগান মুখরিত হয়ে সচিবালয় ঘিরে ফেলেছিল। মানুষের জমায়েত ক্রমাগত বাড়তে থাকায় এবং বিক্ষুব্ধ মানুষ অশান্ত হয়ে ওঠায় আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা বিনা উস্কানিতে নিরীহ মানুষদের ওপর হামলা চালায়। শুধু লাঠিচার্চ ও টিয়ারগ্যাস ছুড়ে সমাবেশ বা মিছিল ছত্রভঙ্গ করা নয়, টার্গেট করে গুলি ছোড়া হয়েছিল। এতে ঘটনাস্থলেই নিহিত হন অন্তত দুই জন। এদের একজনের নাম নূর হোসেন এবং অন্যজনের নাম সৈয়দ আমিনুল হুদা টিটো। নূর হোসেনের মৃত্যু সবার মনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল এবং এরশাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও ঘৃণা তৈরি করেছিল।
নূর হোসেন ছিলেন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এক যুবক। দরিদ্র্ অটোচালক পিতার ৬ সন্তানের একজন নূর হোসেন অষ্টম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। তবে তারমধ্যে জাগরুক ছিল তীব্র দেশপ্রেম। দেশকে ভালোবাসার কারণেই নূর হোসেন জড়িয়েছিলেন রাজনীতিতে। হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছিল তার সহজাত স্বভাব। যুবলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মিছিল-মিটিংয়ে ছিল তার সরব উপস্থিতি। ১০ নভেম্বরের অবরোধ কর্মসূচিতেও তিনি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক অভিনব পথ বেছে নিয়েছিলেন। গায়ের জামা খুলে উদোম বুকে ও পিঠে সাদা রঙে লিখিয়ে নিয়েছিলেন অসাধারণ সেই স্লোগান- 'স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক'। এটা ছিল তখন গোটা দেশের মানুষের প্রাণের দাবি।
বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে মিছিলে অংশ নেওয়ার জন্য হাজারো জনতার ভিড়ে নূর হোসেন দ্রুত সবার দৃষ্টি কেড়েছিলেন। খালি গা আর জিন্সের প্যান্ট পরিহিতি কোমড়ে শার্ট জড়িয়ে নূর হোসেন ছুটছিলেন মিছিলের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। সবার চোখ আটকে যাচ্ছিল তার বুকে ও পিঠে। শরীরে জড়ানো এক প্রতিবাদী পোস্টার, যে পোস্টার অন্য যেকোনো প্রতিবাদী পোস্টারের থেকে আলাদা। মুখের প্রতিবাদী স্লোগানের চেয়েও নূর হোসেনের শরীরে লেখা ওই ছয় শব্দের ১৭ অক্ষরের লেখাটুকু স্বৈরাচারী সরকারের বুকে শেল হয়ে বিঁধেছিল শতগুণ বেগে। এমন জীবন্ত প্রতিবাদী পোস্টারকে সহ্য করা সহজ ছিল না স্বৈরাচারের পাহারাদারদের।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গাড়িতে চড়ে জনতার মধ্য দিয়ে চলার সময় তারও চোখ গিয়েছিল নূর হোসেনের গায়ে ওই লেখা স্লোগানের দিকে। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল তার অন্তরাত্মা। নূর হোসেনকে কাছে ডেকে তাকে সতর্ক করেছিলেন। 'ওরা টোকাই কেন' বইতে শেখ হাসিনা লিখেছেন, 'মনে পড়ে আমি তাকে বলেছিলাম, জামাটা গায়ে দাও, একি সর্বনাশ করছ, ওরা যে তোমাকে গুলি করে মারবে।' নূর হোসেন মাথাটা এগিয়ে দিল আমার কাছে। বলল, 'জান দিয়া দিমু আপা, আপনে শুধু মাথায় হাত বুলাইয়্যা দেন।' শেখ হাসিনা লিখেছেন, 'আমার হাত ধরে বেশ কিছুক্ষণ নূর হোসেন গাড়ির পাশে হাঁটল। তারপর কখন যেন জনতার স্রোতে হারিয়ে গেল।’ কিছুক্ষণ পরেই গুলির শব্দ।
মিছিলটি জিরো পয়েন্টে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। গুলি এসে লেগেছিল নূর হোসেনের বুকে। গুলির আঘাতে তার দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত রাজপথ রঞ্জিত করে। মরণযন্ত্রণায় কাতর নূর হোসেনকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশ টেনে-হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। তারপর তার আত্মীয়-স্বজনকে না জানিয়ে অতি গোপনে তাকে কবর দেওয়া হয় জুরাইন কবরস্থানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নূর হোসেনের পরিবার তার কবরের সন্ধান পেয়েছিলেন গোরখোদকের সহায়তায়। তার বুকে-পিঠে স্লোগান লেখা না থাকলে হয়তো তা সম্ভব হতো না। ১০ নভেম্বরের আরেক শহীদ আমিনুল হুদা টিটো কিন্তু অজ্ঞাত লাশ হয়েই আছেন।
নূর হোসেনের আত্মদান বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এবং শহীদের তালিকায় উজ্জ্বল হয়েই আছে। দেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানসহ অনেকেই তাকে নিয়ে কবিতা ছাড়াও উদ্দীপনামূলক লেখা লিখেছেন। শামসুর রাহমান তার 'বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়' শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন, 'ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা, নূর হোসেনের বুক নয়, বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে।'
নূর হোসেন, টিটো, তাজুল, সেলিম-দেলোয়ারসহ অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটেছে। কিন্তু গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে? না। এরশাদ পতনের পর দেশে ৬টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্ত ভিত্তি পায়নি। রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত বা সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া ছাড়া গণতন্ত্রের আর কোনো চিহ্ন দেশ শাসনে কিংবা রাজনৈতিক দল পরিচালনায় দেখা যায় না। বিএনপি-জাময়াতকে গণতন্ত্রের মিত্র মনে করেন না অনেকেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন দাবিদার হলেও দেশ এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলছে বললে গণতন্ত্রকেই লজ্জায় ফেলা হয়। প্রতি বছর এখনও নূর হোসেন দিবস পালন করা হয়, তার সাহসিকতার প্রশংসা করা হয়। কিন্তু পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে, সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে, মানুষ নির্ভয়ে অবাধে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারলে নূর হোসেনকে স্মরণ করা প্রকৃতপক্ষে একটি তামাশা ছাড়া আর কিছু হয় না।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত থাকে বলে এক সময় যারা স্বস্তি বোধ করতেন, এখন তারাও বর্তমান সরকারের অনেক কাজকর্মে অস্বস্তি বোধ করছেন। শেখ হাসিনার সরকার দেশের অনেক উন্নতি করেছেন, অনেক কিছুতেই উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ আর শূন্য ঝুলির দেশ নয়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার সক্ষমতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এক দিনে প্রধানমন্ত্রী ১০০ সেতু জন্য খুলে দিয়ে নতুন এক বাংলাদেশের চিত্রই তুলে ধরেছেন। কিন্তু এত সাফল্যের পরও মানুষের মনে কিন্তু সুখ ও স্বস্তির অভাব রেয়েছে। ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য মানুষের যে আকুতি তা যদি অপূর্ণই থাকে তাহলে নূর হোসেনের আত্মদানও কি মূল্যহীন হয় না?