মেডিসিন এবং ফিজিওলজিতে নোবেল কেন তাৎপর্যপূর্ণ?

অনুসন্ধিৎসু মানুষের কাছে এবারের নোবেল পুরস্কার এক নতুন যুগের উন্মোচন ঘটিয়েছে।

সেজান মাহমুদসেজান মাহমুদ
Published : 4 Oct 2022, 12:41 PM
Updated : 4 Oct 2022, 12:41 PM

মেডিসিন ও ফিজিওলজিতে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেলেন সুইডিশ জেনেটিক বিশেষজ্ঞ ও বিবর্তনবাদী নৃতাত্ত্বিক সানটে প্যাবো (Svante Paabo)। সুইডিশরা ‘স’টাকে টেনে এনে ‘ত’ আর ‘ট-এর মাঝামাঝি উচ্চারণ করেন তার নাম। প্রথমেই দেখি নিই সংক্ষেপে তার আবিষ্কার নিয়ে কী বলা হয়েছে।

“The geneticist and evolutionary anthropologist Svante Pääbo has won this year’s Nobel Prize in Physiology or Medicine for his pioneering work on the DNA of extinct humans and human ancestors. His remarkable discoveries, which include the identification of a previously unknown variety of human who lived alongside modern humans and Neanderthals tens of thousands of years ago, have had a revolutionary impact on our understanding of human evolution.”

বিলুপ্ত মানব ও মানুষের পূর্ব-পুরুষদের ডিএনএ নিয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্যে এ পুরস্কার পেলেন সানটে প্যাবো। তার আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে জানা যায় অজানা এক মানব প্রজাতির কথা যারা আজকের আধুনিক মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং নিয়ানডারথালের পাশাপাশি বসবাস করত হাজার হাজার বছর আগে, যা মানুষের বিবর্তনকে বুঝতে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখবে।

প্রথমেই বলে নিচ্ছি, বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হলো একটি হাইপোথিসিসকে নিয়ে তথ্য, উপাত্ত, প্রমাণ দিয়ে ওই হাইপোথিসিসকে হয় ভুল প্রমাণ করা অথবা মেনে নেওয়া। তারমানে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য নতুন তথ্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করাও বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য– যাকে বলা হয়, ফলসিফিকেশনিজম। তাই শুধু বিশ্বাস থেকে বা বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল বলে যারা একে গ্রহণ করতে চান না, সেই মনোভঙ্গি নিয়ে এই লেখা না পড়াই ভালো হবে। জেনেটিক্স একটি অতি জটিল বিষয়। তার ওপরে এই বিষয়ে এত বেশি নতুন নতুন উন্নতি হয়েছে যে সাধারণ মানুষের জন্যে সহজ করে ব্যাখ্যা করাটাও অনেক কঠিন হয়ে যায়। তবু সব দিক থেকে সহজ করে বলার চেষ্টা করছি।

এই যে জিনোম সিকোয়েন্সিং বা ডিএনএ সিকোয়েন্সিং বলা হচ্ছে এর মানে কী? মানুষের শরীরে (অন্যান্য প্রাণীতেও) ক্রোমোজম থাকে, ওই ক্রোমোজমে থাকে ডিএনএ। ডিএনএ আবার নিউক্লিওটাইডস দিয়ে গঠিত। এই নিউক্লিক এসিড যার চারটা বেইজ থাকে এডিনাইন, গুয়ানাইন, সিস্টোসাইন এবং থাইমাইন যা A G C T দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এই চারটি নিউক্লিক এসিড কীভাবে কার পরে কোনটা থাকবে তা প্রতিটা প্রাণীর জন্যে একদম আলাদা। এই কারণে, ডিএনএ সিকোয়েন্সিং-এর মাধ্যমে শিশুর পিতৃপরিচয় চিহ্নিত থেকে শুরু করে, খুন বা ধর্ষণ কে করেছে তা নির্ণয় করা যায় রক্ত, চুল, থুতু বা শরীরের কোনো অংশ থেকে। অতি উন্নত ধরনের সিকোয়েন্সিং দিয়ে ঠিক সেভাবেই প্রাচীন কোনো জীবাশ্মের জিনেটিক জানা সম্ভব।

বলা বাহুল্য, এই যুগান্তকারী উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী ফ্রেদ্রিখ স্যাঙ্গার। কিন্তু প্যাবো আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন। জীবাশ্ম থেকে এই সিকোয়েন্সিং করা একটি দুরূহ কাজ– কারণ, কালের আবর্তে ডিএনএ নষ্ট হয়ে যায়, ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, নানান কেমিক্যাল দিয়ে দূষিত হয়। সানটে প্যাবো তার ল্যাবেরেটরিতে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে ওইরকম প্রাচীন জীবাশ্মে পূর্ণ সিকোয়েন্সিং করতে সক্ষম হয়েছেন।

২০০৮ সালে সাইবেরিয়ার ডেনিসোভায় পাওয়া যায় একটি ৪০,০০০ বছর পুরনো হাতের আঙ্গুল। যা ছিল মানুষের (হোমো স্যাপিয়েন্স) পূর্ব পুরুষ হিসেবে ভাগিদার নিয়ানডারথাল দলের। প্যাবো এক অসাধ্য সাধন করেন ওই আঙ্গুল থেকে পূর্ণ ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করে। তখনই প্রথম মানুষ জানতে পারে, নিয়ানডারথালদের সঙ্গে হোমো স্যাপিয়েন্সের জেনেটিক মিল সম্পর্কে। প্রায় ৪ লক্ষ বছর আগে ইউরোপ ও এশিয়ায় নিয়ানডারথাল রা বেড়ে ওঠে, আর আফ্রিকায় তিন লক্ষ বছর আগে মানুষ বা হোমো স্যাপিয়েন্সদের দেখা যায়। ৭০ হাজার বছর আগে একদল হোমো স্যাপিয়েন্স আফ্রিকা থেকে ইউরোপ চলে আসে। এই আবিস্কার নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে মানুষের বিবর্তনে নানান দলের সহাবস্থান। প্রায় এক লক্ষ বছর নিয়ানডারথাল আর হোমো স্যাপিয়েন্স একসঙ্গে পৃথিবীতে বিচরণ করেছে। যদিও নিয়ানডারথাল আর মানুষের ডিএনএ ডাইভারজেন্স আট লক্ষ বছরের মতো। তারপর নিয়ানডার্থালেরা বিলুপ্ত হয়ে যায়!

বিষয়টি বোঝার জন্যে আরেকটু বিশদভাবে বিবর্তনের বিষয়টি খোলাসা করি। এখানে বিবর্তন মানে শুধু ডারউইনিজম বা ‘বানর থেকে মানুষ’ জাতীয় সরলীকরণও নয়। একটি অনুসন্ধিৎসু প্রজাতি হিসাবে মানুষ তার অরিজিন বা আদি-জন্ম কোথা থেকে হয়েছে তা নিয়ে সবসময় প্রবল আগ্রহ দেখিয়েছে, গবেষণা করেছে, আলোচনা-পর্যালোচনা করেছে। ধর্মীয় ব্যাখ্যার দিকে যাচ্ছি না, কারণ সেটা তো বিশ্বাস করতেই পারেন কেউ– যা প্রমাণ করার কিছু নেই। লক্ষ লক্ষ ফসিল বা জীবাশ্ম, জেনেটিক্স, নৃতত্ত্ব, মলিকিউলার বায়োলজি, রসায়ন এরকম নানান বিষয়ের সম্মীলনে মানুষ যা জানতে পেরেছে তা হলো কোটি কোটি বছর (বিলিয়নস) আগে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে এবং ৫৫-৬৫ মিলিয়ন বছর আগে প্রাইমেট বা আদিম মানবের উদ্ভব হয়েছে। তিন মিলিয়ন বছর আগে ‘হোমো’ জেনাস বা বংশের জন্ম। এদেরকে বলা হয় হোমিনিন এবং এরাই মানুষের মানুষের নিকটতম পূর্বপুরুষ।

এদের মধ্যে হোমো জেনাস ১১টি স্তর পার হয়ে আধুনিক মানুষ বা হোমো স্যাপিয়েন্স হয়েছে। যে পূর্বপুরুষ থেকে ডেনিসোভান আর নিয়ানডারথাল এসেছ, ওই একই পূর্ব-পুরুষ থেকে আজকের আধুনিক মানুষের জন্ম। সানটে প্যাবো দু’রকমের সিকোয়্যানন্সিং করেন– নিউক্লিয়ার ডিএনএ এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ। মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ দিয়ে প্রাচীন জীবাশ্ম পরীক্ষা করা সুবিধাজনক, কারণ এটা পরিমাণে এত বেশি থাকে যে সহজে নষ্ট হয় না। অন্যদিকে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ আসে শুধু মায়ের কাছে থেকে। যা দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের আদি-মাতা কে পাওয়া গিয়েছে আফ্রিকায়। তার আবিষ্কারের তিনটি উল্লেখযোগ্য দিক– প্রথমত তিনি প্রমাণ করলেন যে ডেনিসোভান আর নিয়ানডারথাল এই দুই হোমিনিন আধুনিক মানুষের পাশাপাশি বসবাস করেছে প্রায় ৫৫০,০০০ থেকে ৬৯০,০০০ বছর (যা আগের ধারণার চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি) এবং এই তিন ধরনের হোমিনিনদের ভেতরে জিনের আদান-প্রদান ঘটেছে মিলনের মাধ্যমে। আগেই যেটা বলেছি, এক থেকে চার লক্ষ বছরেরও আগে ইউরোপ এবং এশিয়াতে বসবাস করে নিয়ানডারথাল এবং ডেনিসোভান নামক মানুষ-সদৃশ্য দুটো হোমিনিন। প্রায় একই সময় আফ্রিকা মহাদেশে বসবাস করত হোমো স্যাপিয়েন্স বা মানুষ প্রজাতি। প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে কিছু মানুষ ইউরোপ এবং এশিয়ায় দিকে মাইগ্রেট করে। যার ফলে নিয়ানডারথাল এবং ডেনিসোভানের কিছু জিন আধুনিক মানুষের শরীরে প্রবাহিত হয়। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে নিয়ানডারথাল এবং ডেনিসোভান প্রজাতি দুটো বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর হোমো স্যাপিয়েন্স (আধুনিক মানুষ) গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।

মানুষের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের জন্যে দশ-পনেরো রকমের জিনোম সিক্যুয়েন্সিং করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। জেনোম সিক্যুয়েন্সিং করলে সবার শরীরেই প্রায় ১-৬ শতাংশ জিন পাওয়া যায় যা এসেছে নিয়ানডারথাল অথবা ডেনিসোভান থেকে। আর এই জিনগুলোকে একত্রিত করলে দেখা যায় নিয়ানডারথাল অথবা ডেনিসোভানের ৪০ শতাংশ জিন এখনও বয়ে চলছে আধুনিক মানুষের মধ্যে। কিন্তু আফ্রিকার অধিবাসীদের শরীরে এই নিয়ানডারথাল বা ডেনিসোভানের কোন জিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কারণ, নিয়ানডারথাল বা ডেনিসোভান প্রজাতি দুটো আফ্রিকাতে মাইগ্রেট করেনি। তার আগেই তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আধুনিক মানুষের মধ্যে কালো আর সাদা ত্বকের মানুষের মধ্যে জেনেটিক পার্থক্য মাত্র এক শতাংশেরও কম। অর্থাৎ এ নিয়ে বর্ণবাদের কোনো সুযোগ নেই। সাদা আর কালো ত্বকের জীনগত তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

এই আবিষ্কার যুগান্তকারী। কারণ, শুধু মানুষের আদিরূপ জানাটাই বিষয় নয়, কীভাবে কেন মানুষ রোগ প্রতিরোধ করে বা কোন রোগে দ্রুত মৃত্যুবরণ করে তা সহজেই জানা যাচ্ছে বা জানার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কোভিডের সময়ে কারও কারও বেশি প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং কারও কারও দ্রুত মৃত্যু এই কারণকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। এই জিনগুলো মূলত আমাদেরকে হাই অ্যালটিচিউড বা উচ্চ ভূমিতে বসবাসের উপোযোগী করে তুলেছে যেমন, তিব্বতের মানুষের মধ্যে সদৃশ জিন খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও সংক্রমণ প্রতিরোধক কিছু জিনও নিয়ানডারথালদের কাছ থেকে আমাদের শরীরে চলে আসে। এতে করে আফ্রিকা থেকে ইউরোপ এবং এশিয়ায় মাইগ্রেট করা মানুষগুলো নতুনভাবে অভিযোজিত হয়েছে যা নতুন পরিবেশে বাঁচতে পেরেছে।

মানুষের জ্ঞান বিবর্তিত হবে। মানুষের বিবর্তন যারা অস্বীকার করেন তারা কোনো স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরে গিয়ে এইসব জীবাশ্ম ও প্রমাণ দেখতে পারেন। বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল হলেও কিছু কিছু আবিষ্কার হয়ে ওঠে স্বতঃসিদ্ধের মতো। মাধ্যাকর্ষণ বল যেমন। তেমনি কীভাবে বিবর্তন হয়েছিল তা নিয়ে নতুন নতুন আবিষ্কার আসবে সামনে কিন্তু বিবর্তনই যে হয়েছে তা এখন প্রায় স্বতঃসিদ্ধের পর্যায়ে চলে গিয়েছে প্রমাণ ও পরীক্ষায়। এর বিপরীতে ন্যূনতম প্রমাণও কোথাও পাওয়া যায় না। তাই অনুসন্ধিৎসু মানুষের কাছে এবারের নোবেল পুরস্কার এক নতুন যুগের উন্মোচন ঘটিয়েছে। তাই সানটে প্যাবোকে অভিনন্দন জানিয়ে আমরা নিজেরাই অভিনন্দিত হই।